বজ্রপাত

বৈশাখ (এপ্রিল ২০১৫)

রবিউল ই রুবেন
  • 0
  • ৭৫
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ভাবনায় পড়ে গেল হাসেম ।
একটা লোক প্রতিদিন তাকে নামায পড়ার জন্য বলছে আর সে তার কথার কোন গুরুত্ব দিচ্ছে না। সে ভাবছে, আমি নামায না পড়লে তার কি? আজ কেন যেন ভাবতে হচ্ছে কথাটা। না ভেবেও পারছি না। নামায পড়া ভাল কাজ, ধর্মের কাজ, আল্লাহর হুকুম, ফরজ কাজ । সবার মত আমিও জানি কথাটা তারপরেও নামায পড়ি না। কেন পড়ি না? সেটা বলতে পরব না।
আমাদের মসজিদের নতুন ইমাম সাহেব দেখা হলে সালাম দেন এবং নামায পড়ার কথা বলেন। কোরআন হাদীসের কথা বলেন।নামায পড়লে কি হয়, না পড়লে কি হয় সেটাও বলেন। মাঝে মাঝে তার কথায় অতিষ্ট হই কিন্তু ভাষায় প্রকাশ করতে পারি না।চেপে যায় । তার মধুর কণ্ঠের কথায় রাগ করতে পারি না।
আজ কেন জানি ইমাম সাহেবের সাথে দেখা করতে খুব ইচ্ছে করছে হাসেমের।দাঁত ব্রাশ করে হাত-মুখ ধুয়ে বেরিয়ে পড়ল ইমাম সাহেবের খোঁজে।
ইমাম সাহেবকে বাসায় পাওয়া গেল না। তবে জানা গেল তিনি বাইরে কোথাও গেছেন।
নিরাশ মনে পথ চলছে হাসেম আর মনে মনে নানা রকম মন্দ-ভাল কথা ভাবছে।
রাস্তার বাঁক পেরোতেই লোকজনের চিৎকার চেচামেচি শুনতে পেল সে। পাড়ার দোকানের সামনে অনেক লোকের ভিড় । ঘটনাস্থলে এসে ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করছে সে।
করিম চাচা বলছেন, শয়তানের বাক্সের মধ্যি তোরা পাইছিস কি? সারাদিন নাচা গানা দেখে সময় পার করিস। তোগের কি পড়া-লেখা নেই? সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মানুষ আল্লা রাসূলের নাম নেয়। নামায কালাম পড়ে, কুরআন পাঠ করে। আর তোরা লেখাপড়া বাদ দিয়ে সারাদিন শয়তানের বাক্সের সামনে চোখ ফুটোয় বসে থাকিস। এই তোগের কি বাপ-বা নেই? তারা তোগের খোঁজ-খবর নেয় না?
দোকানের সামনের বেঞ্চিতে পাড়ার কয়েকটা ছেলে মাথা নিচু করে বসে আছে। মাঝে মাঝে চোরের মত এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখছে আর পালাবার পথ খুঁজছে। হাসেম ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গেল।
করিম চাচার কাছে জানতে চাইল, কি হইছে চাচা?
কি হয়নি সেইটা বল? দেখ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই চলে আইছে সব শয়তানের বাক্সের সামনে। শয়তানগুলো শয়তানের বাক্সের দিকে হা করে তাকিয়ে গিলছে।ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি। আল্লা তুমি আমাদের এই পাপ-পঙ্কিলতা থেকে বাঁচাও।শয়তানের অসঅসা থেকে আমাদের রক্ষা করো। ঐ দেখ আরেকজন সকালবেলা দোকান খুলেই টিভি ছাড়ে বসে আসে।
চাচা আপনি শান্ত হোন আমি দেখছি।
বাবা শান্ত হওয়ার কথা না। অসহ্য।
ছেলেগুলোকে ধমকের সুরে তাড়া দিয়ে হাসেম বলল, এই যা তোরা যে যার বাড়ি গিয়ে পড়তে বোস। যা আর যেন পড়ার সময় তোদেরকে টিভির সামনে না দেখি।
ছেলেগুলো পড়ি মরি করে যে যার পথ ধরল।
চাচা এবার আপনিও বাড়ি যান।
বাড়ি গিয়ে আর কি হবে? মনের ভেতরের খচখচানি কি যাবে? যাবে না।মুসলমান ঘরে জন্ম নিয়ে যদি মুসলমানের কাজটা সঠিকভাবে না করি তাহলে কি আমরা মুসলমান থাকতি পারবো?
চাচা বাদ দেন, বাচ্চা মানুষ বুঝতে পারেনি।
এসব কথা বলিস না হাসেম। বোঝে সবাই বোঝে। ধর্মের বেলায় সবাই অবুঝ। এই তুই ফজরের নামায পড়েছিস? না তোরে তো মসজিদে দেখলাম না। মনি বাঁচবা কদ্দিন। হিসাব দিয়া লাগবে।যত ফাঁকি দিবা তত ফাঁকে পড়বা। সময় থাকতে সাবধান হও। নামায কালাম পড়, ধর্ম কর্ম কর।
মিনমিনিয়ে হাসেম বলল, চাচা ধর্ম কর্ম তো করি।
ইসলামের পাঁচটি খুঁটি, বলতো কি কি?
চাচা জানি।
জানা থাকলে বল।
কালিমা, নামায রোজা, হ্জ্ব, যাকাত।
কালিমা পারিস?
পারি।
বলতো একটা।
চাচা আমার গরু ছুটে গেছে আমি গেলাম পরে কালিমা পড়ে শুনাবো।
হাসেম দৌঁড়ে স্থান ত্যাগ করল।
আজ হাসেম বড় বাঁচা বেচে গেছে। সে কালিমা জানে না। করিম চাচার হাত থেকে সে কোনরকমে বেঁচে এসেছে। বাড়ি ফিরে সে বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম করতে লাগল।
সে মনে মনে ভাবছে, নামায না পড়ে একরকম ভুল করি আর কালিমা না জনে আরো বড় ভুল করেছি। সে আজই একটা নামায শিক্ষা কিনবে এবং কালিমা দোয়া-দরুদ সব মুখস্ত করবে। আর সে ভুল করতে চায় না। সবকিছু জেনে রাখা ভাল, নামায পড়ি আর না পড়ি।
বাজার থেকে নামায শিক্ষা বই কিনে এনে সারাদিন সেটা পড়ে পড়ে মুখস্ত করেছে হাসেম।
বিকালবেলা হাঁটতে বেরিয়েছে পথিমধ্যে ইমাম সাহেবের সাথে দেখা।
ইমাম সাহেব সালাম দিলেন, আসসালামু আলাইকুম।
ওআলাইকুমুস্ সালাম।
কেমন আছ হাসেম?
আছি, ভাল আছি।আপনি?
আলহামদুলিল্লাহ। আছরের নামায পড়েছ?
না।
কেন?
এমনিই।
মুসলমানের ছেলে নামায পড় না, এটা লোকের কাছে বলা যায়?
কাপড় পাক থাকে না।
শোন ওসব অজুহাত দেখিওনা। ইচ্ছা থাকলে উপায় একটা না একটা হয়।যাও এখন ওজু করে পড়ে এসো।
পড়বো।
কখন? কবে?
বললাম তো পড়বো।
তাহলে মাগরিব থেকেই শুরু কর।
দেখি।
নামায দেখাদেখির বিষয় নয়। এটা ফরজ কাজ। না পড়লে তুমি গুনাহগার হবা। তুমি জান না নামায বেহেস্তের চাবি। নামায না পড়লে বেহেস্তে যেতে পারবা না। অতএব ভাবাভাবির সময় নেই।যত দেরি করবা তত পেছনে পড়ে যাবা। কথা দাও কখন থেকে শুরু করছ।
হাসেম ভাবনায় পড়ে গেল। ইমাম সাহেব তাকে চিনে জোঁকের মত ধরেছে। আজ তার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার কোন উপায় নেই। কি বলবে, আর কি বলে ইমাম সাহেবের হাত থেকে মুক্তি পাবে সে পথ খুঁজছে সে।
সে জানতে চাইল, আমি নামায পড়লে আপনার লাভ কি?
এখানে লাভের প্রশ্ন আসছে কেন?
আপনি প্রতিদিন আমাকে নামায পড়ার কথা বলেন তাই।
এটা আমার ঈমানী দায়িত্ব। তোমাকে নামায পড়ার কথা না বললে আমি গুনাহগার হয়ে যাব। আর তুমি নামায পড়লে আমিও কিছুটা সওয়াব পাব। তোমাকে নামাযের পথে আনতে পারলে লাভ আমার এটুকু আমিও ছওয়াবের ভাগিদার হব। আর নামায পড়তে তো বেশি সময় ব্যয় হয় না। সময় মত নামায পড়বা তোমার সময় নষ্ট হবে না। নামায পড়ে তুমি তোমার দৈনন্দিন সকল কাজ করতে পারবা। বল কখন থেকে শুরু করছ।
ইমাম সাহেবের কথায় তার মনটা কিছুটা নরম হতে শুরু করেছে। সে চুপ করে কিছু একটা ভাবছে। কি বলবে, কি বলবে।
চুপ করে না ভেবে বল কখন থেকে নামায শুরু করবে।
হুজুর আমি চাচ্ছি বিশেষ দিন থেকে শুরু করি।
বিশেষ দিনটা কবে?
সেটা ঈদের দিন হতে পারে।
অনেক দেরি ঈদ আসতে তুমি শর্টকাট সময় নাও। তুমি পহেলা বৈশাখ থেকে শুরু কর। এটা বাঙ্গালীর একটা বিশেষ দিন।
আপনি যখন বলছেন আর আগামীকালই তো সেই পহেলা বৈশাখ।
আগামীকাল ফরজ থেকে শুরু কর।
দেখি।
দেখি নয়, বল ইনশাল্লাহ আগামীকাল ফরজ থেকে নামায পড়া শুরু করব। বল।
ইনশাল্লাহ আগামীকাল ফরজ থেকে নামায পড়া শুরু করব।
আমিন। আল্লাহ তোমার মনের নেক আশা পূর্ণ করুক। এখন কোথায় যাবে?
যাই বেড়িয়ে আসি।
আল্লাহর নাম নিয়ে যাও। আকাশে মেঘ করেছে সাবধানে যেও।
আল্লাহ ভরসা। আসসালামু আলাইকুম। আসি হুজুর।
ওয়ালাইকুমুস্ সালাম।
ইমাম সাহেব মসজিদের দিকে পা বাড়ালেন।
হাসেম বাজারের পথে পা বাড়াল। সে মনে মনে ভাবছে, হুজুরকে তো কথা দিলাম। কথা রাখতে পারব তো? এতদিন তো এই-সেই সাত-পাঁচ বলে হুজুরের হাত থেকে পরিত্রাণ পেয়েছি। এখন তো কথা রাখতে হবে। কথা না রাখতে পারলে হুজুরের কাছে আমি ছোট হয়ে যাব। হুজুরকে দেয়া কথা আমাকে যেভাবেই হোক রাখতে হবে।
ভাবতে ভাবতে হাসেম অনেকটা দূরে চলে এসেছে। দুইপাশে ফাঁকা মাঠ। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। আকাশভরা কালো মেঘ। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকের ফলে মেঘ গর্জন করছে। কামানের গোলার মত বিকট শব্দে আকাশ বাতাস কম্পিত হচ্ছে অহরহ। মাঝে মাঝে বজ্রপাত হচ্ছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ হাসেমের অনুকূলে নেই। তার মনে শুধু একটাই ভাবনা আগামীকাল ফরজ থেকে তাকে নামায শুরু করতে হবে।
প্রবল বাতাস বইতে শুরু করেছে। কালবৈশাখী ঝড় হতে পাবে। মেঘের গর্জন বেড়েই চলেছে। বিদ্যুৎ চমকে অন্ধকার পৃথিবী আলোকিত হয়ে উঠছে। আবার অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে। আলো আধারির খেলা চলছে। হুড়মুড়িয়ে আষাঢ় মাসের মত বৃষ্টি নামতে শুরু করল। মুঘলধারে বৃষ্টি যাকে বলে।
হাসেম মনে মনে ভাবল, ভালই হল আজ সে বুষ্টির জলে ধুয়ে পাক-পবিত্র হয়ে বাড়ি ফিরবে। সে মনের আনন্দে বৃষ্টিতে ভিজছে। বৃষ্টিতে ভিজতে আজ তার কেন জানি ভাল লাগছে। ভাললাগার আবেশে সে হারিয়ে যেতে চাইছে।
আচমকা বজ্রপাত হল।দপ করে চারপাশ আলোকিত হয়ে সবকিছু অন্ধকারে নিমজ্জিত হল।
ইমাম সাহেব মাগরিবের নামায পড়ে বাজারে চা খেতে যান। আজও তিনি যাবেন। প্রকৃতির তাণ্ডব থেকে গেছে। বাজারে যেতে কোন অসুবিধা নেই।
তিনি তজবী জপতে জপতে পা বাড়ালেন। পথিমধ্যে রাস্তার পাশে কাউকে দেখতে পেলেন। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে তার আলোতে তিনি যে মুখটা দেখলেন, তিনি চমকে উঠলেন। তিনি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। তিনি দেখতে পেলেন হাসেম মাটিতে লুটিয়ে আছে। সারাশরীর পুড়ে কালো হয়ে গেছে মুখটায় শুধু বাকি আছে। ইমাম সাহেব মুখের ভাষা হারিয়ে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইলেন।


আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Hasina অনেক ভাল লাগল।

১৯ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৪১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪