নিজের জীবনটাও যে একেবারে স্টার জলসার সিরিয়াল বা ফেসবুকের ন্যাকামো মার্কা প্রেমের গল্পের মত হয়ে যাবে ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি নাহিদ। সদ্য পড়ালেখার পাট চুকিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করা আটাশ বছরের সদা হাস্যোজ্জ্বল যুবক নাহিদের সামনে এখন ঝা চকচকে কর্পোরেট লাইফ, তরতর করে বেয়ে যাবে প্রমোশন নামক সিড়িগুলো। লেখাপড়ার ঝামেলা শেষ, বেকারত্বের খোটা শুনতে হবে না, মা বাবার শাসন নেই - কেমন নির্ঝঞ্ঝাট জীবন! সারা সপ্তাহ দশটা - পাঁচটা ডিউটি, ছুটির দিনে নিজের ইচ্ছেমতো কাটানো আর অফিস ছুটি হলেই নিজের ছোট্ট ট্রাভেল ব্যাগটা গুছিয়েই ছুটে বেড়ানো ঘুরতে। হ্যাঁ,নাহিদের প্রিয় শখ ট্রাভেলিং। ছুটি মিললেই সে বেড়িয়ে পরে পুরো দেশের আনাচে কানাচে প্রকৃতির সৌন্দর্য চষে ফেলতে। এমন এক উপভোগ্য জীবনেই হুট করে বাবা - মা জুটিয়ে দিলেন বাবার এক পুরোনো বন্ধুর সদ্য মাতৃহারা মেয়ে। সে যেনতেন মেয়ে না, কথা না বলা মেয়ে। অর্থাৎ বাবা তার বাল্যবন্ধুর ঋণ শোধ করতেই যেন মূক মেয়েটিকে এনে দিয়েছেন।
.
বাবার জরুরি তলবে অফিস থেকে দুদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি আসে নাহিদ। তারপর কিভাবে বাবার অনুরোধে মূক মেয়েটিকে সে বিয়ে করতে গেল আর কিভাবে তার এত বছরের নানা প্ল্যানে সাজানো বিয়ে ব্যাপারটা এমন হুট করে শেষ হয়ে গেল নিজেও বুঝতে পারলো না। মেয়েটিকে সে দেখেওনি ভাল করে। আর তার জানামতে যারা কথা বলতে পারে না তারা নাকি কানেও শুনতে পায় না! এই কালা- বোবা মেয়ের সাথে সে কী- ই বা কথা বলবে? বাবা - মার উপর প্রচণ্ড রাগ আর চাপা অভিমান নিয়ে বিয়ে নামক সার্কাসের (!) পুরো সময়টা সে চুপ করেই ছিল। না মেয়ের ব্যাপারে কিছু জানতে চেয়েছে আর না মেয়ের দিকে ভাল করে তাকিয়েছে। কথা হয়নি বাসর রাতেও। দুদিনের ছুটি নিয়ে আসা তাই বিয়ের পরদিন সকালেই কর্মস্থল চট্টগ্রামে যাওয়ার জন্য রেডি হয় সে। বাবা অনিদ্রার রোগী; ঘুমের ওষুধ খেয়ে তখনও ঘুমাচ্ছেন। নাহিদকে বের হতে দেখে মা হাত টেনে সোফায় বসান; মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে বলেন, 'আমাদেরকে ভুল বুঝিস না, বাবা। একটা রত্নই এসেছে আমাদের ঘরে। সময়ে সব বুঝতে পারবি। আর এমন প্রতিমার মতো মেয়েটাকে কখনও কষ্ট দিস না।' নাহিদ কোনো মন্তব্য না করেই চুপচাপ শুনে উঠে পরে। সদর দরজার দিকে পা বাড়াতেই পাশে কারও উপস্থিতি টের পায়, না চাইতেও ঘুরে তাকায় আর তখনই চোখ পরে মায়ের বলা প্রতিমার মুখে। এই প্রথম তাকালো সে মেয়েটার দিকে, কেমন ভাবলেশহীন চাহনি। এমন চাহনিতে বিরক্তি ফুটে ওঠে নাহিদের মনে।হাতে বাড়ানো একটা ছাতা।উপেক্ষা করতে গিয়েও মায়ের কঠোর দৃষ্টির সামনে না পেরে হাত বাড়িয়ে নিয়ে নেয়। আকাশে যে মেঘ জমছে!
.
বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে রিকশা থেকে নামতে গিয়েই মনে পরলো মেয়েটার কথা! এতক্ষণ আকাশে মেঘ থাকলেও ঝুম বৃষ্টি নামলো মাত্র। রিকশা থেকে নেমে বাসে উঠতে উঠতেই পুরো ভিজে যাবে সে। একটা ছাতা হলে আর ভিজতে হত না। আর তখনই মনে পরলো মেয়েটার কথা। মেয়েটা? নিজের প্রতি একটু অনুশোচনা হল নাহিদের। নিজের বিয়ে করা স্ত্রী - আর সে নামটাই এখনও জানেনি! অথচ মেয়েটা বিয়ের পর প্রথম দিনেই আদর্শ স্ত্রীর মত পতিসেবা করে দেখিয়েছে বৃষ্টির দিনে হাতে ছাতা ধরিয়ে দিয়ে। আদর্শ স্ত্রী! আরে ন্যাকামো। বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে ছাতা বের করতে গিয়ে দেখে রিকশায় ওঠার আগেই সে ছাতা খুইয়ে বসে আছে। অগত্যা ভেজা ছাড়া উপায় নেই।
.
কলিগ বা বন্ধু - কেও জানলো না বিয়ের কথা। যেমন বিয়ে আর যেমন পাত্রী - সবাইকে কিভাবে জানাবে নাহিদ বিয়ের কথা? তাই চেপে গেল সব। জীবন চলবে আগের মতই - স্বাধীন ব্যাচেলর লাইফ!
বাড়ি থেকে ফিরেছে আজ দুদিন। বাড়িতে কোনো যোগাযোগ করেনি। মা বাবাও তার এমন আচরণে কষ্ট পেয়ে আর ফোন দেননি। কেমন আছেন তারা? যদিও আগে নাহিদের রুটিন ছিল প্রতিদিন অফিস শেষে বাসায় ফিরেই মাকে ফোন দেওয়া। কিন্তু এই বিয়ে সব ওলট-পালট করে দিয়েছে। মাঝে মাঝে অবশ্য মেয়েটার কথাও মনে পরছে। বেচারির আর কি দোষ!
.
অফিসে বসে দিবে না দিবে না করেও শেষ পর্যন্ত মাকে কল দিয়েই ফেললো নাহিদ। অভিমান হার মানলো, তিনদিন মায়ের কণ্ঠ না শুনে থাকা যায় নাকি! ভেবেছিল মা'ও নিশ্চয়ই খুব মনমরা হয়ে আছে। কিন্তু কল রিসিভ হতেই ওপাশ থেকে মায়ের কিশোরী মেয়েদের মত খলখলে হাসিমাখা কন্ঠ শুনে থমকে গেল সে, " কীরে! এতদিন পর মনে পরলো আমাদের কথা? আর মনে পরবেই বা না কেন? রাজা - রানী আর রাজকন্যাকে ফেলে তুই ও যে ভাল নেই সে আমরা জানি। তা কবে আসছিস,বল তো? আমরা পিঠেপুলি বানিয়ে রাখব। নতুন জামাই বলে কথা!"
এত প্রফুল্ল হয়ে মা'কে কবে কথা বলতে দেখেছে ঠিক মনে পরে না তার। আর আমরা আবার কে? মনের কথা যেন ঠিক ধরতে পারলো মা, ' কী হল? চুপ করে আছিস কেন? পিঠার কথা শুনে অবাক হলি? শোন না, আমি ভাল না পারলে কী হবে! মোহনা কিন্তু খুব ভাল পিঠা বানায় জানিস! আর তাছাড়া ইউটিউব ঘেঁটে আরও কত কি যে রান্না করে। আমাদের দুজনের তো এখন প্রতিদিন নতুন নতুন রেসিপি ট্রাই করেই সময় কাটে। এবার আসলে দেখবি রাজপুত্রের রাজভোজ! "
.
নাহ! এমন একটা ঘটনায় কারও কিচ্ছু যায় আসেনি। মা তো খুব আনন্দে আছে দেখা যাচ্ছে। বাবাকে ফোন দেওয়া বৃথা যাবে নিশ্চিত। আর মেয়েটা? সে কেমন আছে? আশ্চর্য! এখনও সে মেয়েটা মেয়েটা করছে? মেয়েটার নাম মোহনা। আজকে মায়ের সাথে কথায় কথায় জানতে পেরেছে। মোহনা! সে কি পারবে এই ড্রামাটিক বিয়ের পরেও ভালোবাসার মোহে আচ্ছন্ন করতে?
ফেসবুক ঘেঁটে মোহনার আইডি বের করে ফেলে সে। বিয়ে করে মেয়েটার সম্পর্কে কিছু না জানলেও প্রোফাইল দেখে কিছুটা ধারণা পায়। মোহনা তার মতই হুমায়ূন ভক্ত। আজব তো!
.
কাল থেকে তিনদিন অফিস বন্ধ, পূজোর ছুটি। সবসময়ের মত নাহিদ রাতে ব্যাগ গোছায় ট্যুরে যাওয়ার জন্য। সে একটা ট্রাভেলিং ক্লাবের মেম্বার। তাই হুটহাট বেড়িয়ে পরতেও কোনো সমস্যা হয় না। এবার যাবে সিলেটে যদিও এর আগেও অনেকবার গিয়েছে। রাতে অনলাইনে সব কনফার্ম করে ঘুমাতে যায়। ভোর পাঁচটায় ট্রেন তার। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই স্টেশনে পৌঁছেও অদ্ভুতভাবে সে ট্রেন মিস করলো। ট্রেন ছেড়ে সে উঠে পরলো ঢাকাগামী বাসে। নিজের রাজ্যে ফিরবে সে যেখানে রাজা রানী অপেক্ষা করছে তাদের নতুন রাজকন্যাকে নিয়ে।
.
বাড়ি ফিরতেই মায়ের অবাক করা চাহনিতে কিছুটা লজ্জা পায় নাহিদ। মৃদু সম্ভাষণ শেষ করেই দ্রুত নিজের রুমে চলে যায় সে। বাবা অফিসে। রুমে ঢুকতেই মেয়েলি পারফিউমের গন্ধে থমকে যায় নাহিদ। রুমের চেহারাও আমুল বদলে গেছে। তার জিনিসগুলোর পাশে পরিপাটিভাবে মেয়েলি জিনিসপত্রে রুম ভরে উঠেছে৷ এমনকি বুকশেলফে বইগুলোর ঝকঝকে নতুন বিন্যাস দেখলেই বোঝা যায় মেয়েটার বিচরণ এ পর্যন্তও হয়েছে। রেগে উঠতে গিয়েও কেমন মিইয়ে যায় সে। মেয়েটার কি দোষ! সে তো আর জোর করে বিয়ে করেনি তাই নাহিদের সবকিছুতে জোর খাটানোর অধিকার তার আছে। নিজের প্রিয় লেখার ডেস্কের দিকে তাকিয়ে দেখে তার উপর দুই একটা বই আর একটা আধখোলা ডায়েরি। মেয়েটা নাহিদের চেয়ারে বসে কিছু একটা লিখতে লিখতেই হয়তো উঠে গিয়েছে। নাহিদ পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ায় ডায়েরির কাছে, গোটা গোটা অক্ষরে লেখা -' মনে করো আমি জলের রানী, তুমি বৃষ্টিরো পুত্র....'
মুচকি হাসে নাহিদ এটা দেখে।
.
মোহনার সাথে নাহিদের দেখা হল শেষ বিকেলের মেঘলা আকাশের নিচে। নাহিদ যখন বাড়ি আসে তখন মোহনা রান্নাঘরে ছিল। মায়ের কাছে তার আসার খবর পেয়ে আর এ ঘরমুখো হয়নি সে। এটা কি লজ্জা নাকি অভিমান - নাহিদ জানে না। খাবার টেবিলে সবাই একসাথে খেতে বসলেও চোখ তুলে তাকাতে পারেনি কেও। তবে সত্যি রাজভোজ হয়েছে নাহিদের। মা হাই প্রেশারের রোগী, গরম চুলোর ধারে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে রান্না করতে পারেন না অনেকদিন। আজ মেয়েটা রান্না করে টেবিলে ভরে ফেলেছে।
.
দুপুরে খাবার শেষে নাহিদ রুমে এসে ভাতঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ভেবেছে মোহনা নিশ্চয়ই এখন রুমে আসবে। কিন্তু না,আসেনি সে। অপেক্ষা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছে নাহিদ। ঘুম ভাংলো হঠাৎ মেঘের গুরুগুরু আওয়াজে। চারপাশে অন্ধকার। রুম থেকে বের হয়ে দেখে মা ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে আছেন। নাহিদকে দেখেই ডাক দেন, ' বাবা, দেখ তো মোহনা বৃষ্টি দেখে ছাদে গেল কাপড় তুলতে এখনও আসছে না। কিভাবে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে!" চমক লাগলো নাহিদের বুকেও। মোহনাকে ডাকতে এসে দেখে কাপড় তোলা বাদ দিয়ে সে বৃষ্টিতে ভিজছে। না, সিরিয়াল বা ফেসবুকের ন্যাকামো গল্পের মত না, সত্যিই কেমন সরলতা মেয়েটার মধ্যে। বিদ্যুতের এমন ঝলকানিতেও কি সে ভয় পায় না! নাহিদ এগিয়ে যায়, আলতো করে ধরে মোহনার হাত। মোহনা চমকে তাকায় নাহিদের দিকে, একরাশ অভিমানে ছলছল করে ওঠে চোখজোড়া। বৃষ্টির পানির মধ্যেও আলাদা করে বোঝা যায় সে পানির অস্তিত্ব। অপরাধবোধে ছেয়ে যায় নাহিদের মন আর অবাক হয়ে লক্ষ্য করে চোখের পানি আর বৃষ্টির পানিতে ঢাকা চোখদুটোতেও এত কথা লুকানো থাকতে পারে!
নাহিদের হাত দুটো আলতো করে ছুঁয়ে দেয় মোহনার ঠান্ডা গালদুটো; ফিসফিস করে আওড়ায় -
' মনে করো আমি জলের রানী,
তুমি বৃষ্টিরো পুত্র;
ছাদটা যেন পদ্মদিঘি
মনে রেখো এই সূত্র....'
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
এটি একটি রোমান্টিক ধরনের গল্প। গল্পটির থিমে প্রেম ও বৃষ্টি আছে। তাই আমি মনে করছি গল্পটি প্রতিযোগিতার বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
২৫ সেপ্টেম্বর - ২০২২
গল্প/কবিতা:
১ টি
সমন্বিত স্কোর
৫.৩৪
বিচারক স্কোরঃ ২.৯৪ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ২.৪ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪