নিজের শয়নকক্ষে চিন্তিত মুখে পায়চারি করছিলেন মহারাজ নৃপেন্দ্রনারায়ণ। তাঁর কপালে গভীর ভ্রুকুটি, মনে হাজারটা ভাবনা এবং দু'চোখের মণিতে অস্থিরতার ছাপ স্পষ্ট। পঁচিশ বছর ধরে তিনি রাজ্য শাসন করছেন, বহিঃশত্রুর আক্রমণে বা খরার কারণে চাষীদের ফসল নষ্ট হলেও তিনি কোনোদিন এতটা বিচলিত বোধ করেননি। ঈশ্বরের আশীর্বাদে তিনি সব রকম কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছেন। কিন্তু আজকের ব্যাপার সম্পূর্ণ আলাদা। আজ তাঁর কি করা উচিত তিনি জানেন না। যদিও রাজ-জ্যোতিষী আশ্বাস দিয়েছেন যে যা ঘটতে চলেছে তাতে রাজ্যের কোনো ক্ষতি হবে না, তবুও নৃপেন্দ্রনারায়ণের মন থেকে দুশ্চিন্তার মেঘ সরছে না।
"ভিতরে আসতে পারি, মহারাজ?”, ঘরের দরজার কাছ থেকে শোনা গেল একটা অত্যন্ত পরিচিত কণ্ঠস্বর।
"আসুন মহামন্ত্রী। কোনো সংবাদ পেয়েছেন?", জিজ্ঞেস করলেন মহারাজ নৃপেন্দ্রনারায়ণ।
মহামন্ত্রী কেশব সেন মৃদু অথচ স্থির, অকম্পিত গলায় উত্তর দিলেন, "রাতের আকাশ চিরে রাজবাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে একটি সাদাটে আলোর বিন্দু, এবং তার আকার ক্রমাগত বাড়ছে। আমার মনে হয়, আপনার এবার যাওয়া উচিত মহারাজ, ওনারা তো আপনার সঙ্গেই দেখা করতে আসছেন।"
নৃপেন্দ্রনারায়ণ এক পলকের জন্য কি ভাবলেন, তারপর বললেন, "বেশ, চলুন তাহলে।"
দুজনে এসে দাঁড়ালেন রাজবাড়ির প্রাঙ্গণে। আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকালেন নৃপেন্দ্রনারায়ণ। হ্যাঁ, একটা জ্যোতির্ময় বৃহদাকার কোনো বস্তু এগিয়ে আসছে এইদিকেই, এবং অগ্রসর হতে হতে জিনিসটার গতিও কমছে। একসময় সেটা একেবারে সামনে এসে হাজির হলো, তারপর ধীরে ধীরে মাটিতে অবতরণ করলো। জিনিসটার গা থেকে তীব্র সাদা রঙের আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে বটে কিন্তু সেই আলো চোখকে কোনোরকম কষ্ট দিচ্ছে না। নৃপেন্দ্রনারায়ণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন জিনিসটার দিকে। জিনিসটা গোলাকৃতি এবং তার আকার একটা থালার উপরে উল্টোনো বাটির মতো যেটা আয়তনে রাজপ্রাসাদের সিংহদুয়ারের সমান। অনেকগুলো গোলাকার আয়নার মতো জানালা দেখা যাচ্ছে জিনিসটার গায়ে। জিনিসটার রঙ বড়ই অদ্ভুত, যেন কালো, বেগুনি, লাল, খয়েরি, কমলা;সব রঙ কেউ একসঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। তার থেকেও বড় কথা জিনিসটা থেকে কোনো শব্দ নির্গত হচ্ছে না, একেবারে নিশ্চুপ সেটা, যদিও গা থেকে সমানে একইরকমভাবে সাদা আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে।
নৃপেন্দ্রনারায়ণ ভাবছিলেন এবার তাঁর কি করা উচিত কিন্তু আর বেশি ভাবার প্রয়োজন হলো না। গোলাকৃতি জিনিসটার সামনের অংশ থেকে একটা লম্বা দরজা পাটাতনের মতো এগিয়ে এসে মাটি স্পর্শ করলো এবং তার উপরে এসে দাঁড়ালো এক কিম্ভুতকিমাকার জীব। এমন প্রাণী শুধু যে তিনি আগে দেখেননি তাই নয়, তাঁর পূর্বপুরুষদের কেউ দেখেছেন বলেও মনে হলো না নৃপেন্দ্রনারায়ণের। প্রাণীটির আয়তন সাধারণ মানুষের মতো ঠিকই, কিন্তু তার হাত রয়েছে চারটি। পায়ের পাতা ঠিক যেন হাঁসের পায়ের মতো এবং শরীরের রং সম্পূর্ণ সবুজ। সবচেয়ে আশ্চর্য এবং অস্বস্তিকর বিষয় হলো প্রাণীটির মাথা মানুষের মতো হলেও তাতে চুল নেই এবং দু'পাশে শুধু দুটি লম্বাটে কান ছাড়া মুখের বৈশিষ্ট্য বলতে কিছুই নেই; চোখ, নাক, ঠোঁট, কিচ্ছু না। প্রাণীটি যে কিছু একটা বলছে সেটা মহারাজ এবং মহামন্ত্রী দুজনেই বুঝতে পারছেন কিন্তু সে ঠিক কি বলছে তা কারও পক্ষেই বোঝা সম্ভব হচ্ছে না।
নৃপেন্দ্রনারায়ণ জীবটির উদ্দেশ্যে হাতজোড় করে বললেন, "আপনি কি বলতে চাইছেন তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। যদি অন্য কোনোভাবে আপনার কথা বুঝতে পারতাম তবে কৃতার্থ বোধ করতাম।"
প্রাণীটির হাতে যে একটা বাক্স জাতীয় কোনো জিনিস আছে সেটা নৃপেন্দ্রনারায়ণ আগেই দেখেছিলেন। এবার সেটা সে তাঁর দিকে এগিয়ে দিলো। নৃপেন্দ্রনারায়ণ বুঝলেন যে সব প্রশ্নের উত্তর এতেই আছে। তিনি ধন্যবাদ জানিয়ে বাক্সটা গ্রহণ করলেন। প্রাণীটি আবার কিছু একটা বলে উঠলো এবং তার পরেই তাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসা পাটাতনটা আবার ঢুকে গেল গোলাকৃতি অদ্ভুত জিনিসটার মধ্যে। দুই রাজপুরুষ দেখলেন, সেটা যেমনভাবে মাটিতে নেমেছিলো আবার তেমনভাবেই ধীরগতিতে উপরের দিকে উঠতে উঠতে একসময় একটা ছোট্ট বিন্দুর মতো মিলিয়ে গেল আকাশের কোনও এক অজানা প্রান্তে। মহারাজ নৃপেন্দ্রনারায়ণ ফিরে চললেন তাঁর প্রাসাদের দিকে আর মহামন্ত্রী কেশব সেন বিনা বাক্যব্যায়ে তাঁকে অনুসরণ করলেন। বাক্সটায় কি আছে জানার জন্য তাঁর অদম্য কৌতূহল হলেও তিনি কিছু জিজ্ঞেস করলেন না, তিনি জানেন যে মহারাজ সময় হলে নিজেই সব বলবেন।
নিজের শয়নকক্ষে ফিরে এসে প্রদীপের আলোয় বাক্সটা ভালো করে দেখতে লাগলেন নৃপেন্দ্রনারায়ণ। সাধারণ একটা ছোট কাঠের বাক্সের মতোই দেখতে সেটা, তবে গায়ের সর্বত্র কি এক অজানা ভাষায় কিছু শব্দ বা সংখ্যা লেখা আছে। বাক্সটার মুখে কোনও চাবির গর্ত নেই, উপরের অংশটাকে ধরে তুলতেই সেটা খুলে গেল। ভিতরে রয়েছে একটা মোটা বই, খুব সম্ভবত চামড়া দিয়ে বাঁধানো, তবে কোন জন্তুর চামড়া সেটা তিনি জানেন না। বইটাও বাক্সের গায়ে যে ভাষার প্রয়োগ করা হয়েছে সেই ভাষাতে লেখা। বইয়ের পাশে রয়েছে একটা কৌটো, যেটা স্বচ্ছ কিন্তু কাঁচের তৈরি বলে তাঁর মনে হলো না। কৌটোর ভিতরে একটা ছোট্ট, কালো রঙের কিছু রয়েছে। মোমবাতি জ্বালিয়েও জিনিসটাকে চিনতে পারলেন না তিনি। অনেকক্ষণ ধরে বাক্স, বই, এবং কৌটোটাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পর্যবেক্ষণ করার পর তিনি আবার বাক্সটা বন্ধ করে তাঁর পালঙ্কের পাশে রাখা জলের গেলাসটার দিকে হাত বাড়ালেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পিঠে আমূল বিঁধে গেল একটা ধারালো ছোরা! প্রচন্ড যন্ত্রণায় তিনি চিৎকার করে উঠতে গিয়েও পারলেন না কারণ ছুরিটা পিঠে ঢোকার মুহূর্তেই একটা বলিষ্ঠ হাত তাঁর মুখ চেপে ধরেছিলো। শেষবারের মতো চোখের পাতা বন্ধ করার আগে মহারাজ নৃপেন্দ্রনারায়ণ দেখলেন, তাঁর আপন ভাই ধীরেন্দ্রনারায়ণ সেই বাক্সটা নিজের হাতে তুলে নিচ্ছেন।
(২)
কাপে ঠোঁট লাগিয়ে একটা চুমুক দিতেই মেজাজটা বিগড়ে গেল। আজ আবার চিনি কম। ওফ! এভাবে আর পারা যায়? বারবার বলে দেওয়া সত্ত্বেও একই গোলমাল রোজ হয় কি করে? এবার তো দেখছি সকালের চা'টা নিজেকেই করে নিতে হবে।
বেশ ঝাঁঝালো গলাতেই হাঁক পাড়লাম, "বলরাম!"
গলার সুরেই বোধহয় বলরাম বুঝে গিয়েছিলো যে আজ তার কপালে দুঃখ আছে। তাই এক ডাকেই দৌড়ে এসে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে খুব মৃদু গলায় সে বললো, "আমাকে ডাকছেন?"
মেজাজ সপ্তমে চড়লে কেমন হয় জানিনা, তবে বলরামের এই মিনমিনে স্বরে কথা বলায় আমার মেজাজটা নির্ঘাত পঞ্চম বা ষষ্ঠ স্তরে পৌঁছে গেল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, "চায়ে ক চামচ চিনি দিয়েছো?" বলরাম তৎক্ষণাৎ জবাব দিলো, "আজ্ঞে এক চামচ।" আমি এবার খাপ্পা হয়ে উঠলাম, "কেন এক চামচ? তোমাকে কতবার বলেছি না যে চায়ে দু'চামচ চিনি দেবে? তাও তুমি প্রায় রোজই কম দিচ্ছো। এর কারণটা কি?"
"কেন সাহেব, আপনিই তো সেদিন বলছিলেন যে বয়স বাড়ার সাথে সাথে চিনি, মিষ্টি জাতীয় খাবার, এগুলো কমিয়ে দেওয়া উচিত। বেশি চিনি খাওয়া শরীরের পক্ষে ভালো নয়।"
একে ব্যাটা ভুলভাল কাজ করেছে, তার ওপরে এখন আবার বিজ্ঞের মতো জ্ঞান দিচ্ছে! রাগের চোটে চিৎকার করার আগে শেষবারের মতো প্রশ্ন করলাম, "তোমাকে আবার কখন এসব বললাম আমি?"
"না, না, আমাকে বলবেন কেন", প্রতিবাদ করলো বলরাম। "তিনদিন আগে সন্ধ্যাবেলায় এক ডায়েবিটিসের রুগী এসেছিলো না আপনার কাছে, তাকেই তো আপনি বলেছিলেন এই কথাগুলো। আমিও তাই ভাবলাম যে আপনাকে এবার থেকে চিনি কম খাওয়াবো, শরীরটাকে তো দেখতে হবে। আর তাছাড়া, আপনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তো চলবে না সাহেব।"
খুব চোটপাট করবো ভেবেছিলাম কিন্তু বলরামের সরল উত্তর শুনে আর কিছু বলতে পারলাম না। ছেলেটা আমার প্রতি খুবই যত্নশীল। একা মানুষ আমি, বাবা-মা তো কবেই ছেড়ে গিয়েছেন, বিয়ে-থাও করিনি। ডাক্তারিটা পাশ করার পরে পৈতৃক বাড়িতেই গুছিয়ে বসেছি। কিন্তু একেবারে একা কি আর মানুষের পক্ষে থাকা সম্ভব? যতই হোক, আমরা সামাজিক প্রাণী। এই বলরামই আমার সব। যাকে বলে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ, সবরকম কাজই ও জানে। ইদানিং তো রোগী দেখার সময়ে এটা-সেটা এগিয়ে দেওয়া, সঠিক ওষুধটা আলমারি থেকে বার করে আনা, সবই করে দেয়। ওকে ছাড়া আমার চলবে না। তাই রাগ আর বিরক্তি ঝেড়ে ফেলে বললাম, "আচ্ছা বুঝেছি। ঠিক আছে তুমি যাও।" বলরাম রান্নাঘরের দিকে চলে যেতে আমি আজকের কাগজটা টেনে নিলাম। প্রথম পাতাতেই চোখ আটকালো।
"আন্দুলে মৃগীরোগে আক্রান্ত ৮"
ব্যাপারটা সত্যিই বড় অদ্ভুত। বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে কাগজে, টিভিতে, সব জায়গাতেই এই ঘটনা দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ করে বলা নেই কওয়া নেই, মৃগীরোগ বা খিঁচুনিতে অসুস্থ হয়ে পড়ছে এক-একটি এলাকার মানুষ। এদের মধ্যে কারও পরিবারে যে আগে কখনো এই রোগ দেখা দেয়নি তা নয়, কিন্তু কেউ কখনও শুনেছে যে মৃগীরোগ কলেরার মতো ছোঁয়াচে? নাকি এমন কখনো দেখা গেছে যে মশা কামড়ালে ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গুর বদলে মৃগী হচ্ছে? হওয়ার কথাও নয়, কারণ এরকম হওয়াটা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক। কিন্তু এই অস্বাভাবিক ব্যাপারই হচ্ছে। এটা প্রথম আরম্ভ হয়েছিলো রাজস্থানে দু মাস আগে, তারপর এখন পশ্চিমবঙ্গে দলে দলে লোক আচমকা মৃগী বাঁধাচ্ছে। দেশের নামজাদা বিজ্ঞানীরা এবং তাবড় তাবড় ডাক্তাররাও এই ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারছেন না। কি করে যে এমন হচ্ছে, কেউ জানে না।
"সাহেব, রোগী এসেছে। আপনার চেম্বারে বসিয়ে এলাম", বলরামের কথায় আমার চিন্তায় ছেদ পড়লো। একটু অসন্তুষ্টভাবেই মুখ তুলে বললাম, "এই সাতসকালে আবার রুগী? তা কিরকম রুগী, মানে কি জন্য দেখাতে এসেছে কিছু বুঝলে?"
বলরাম একটু ভেবে বললো, "আজ্ঞে হাত-পা কাঁপছে অল্প অল্প। কথাও কেমন যেন আটকে আটকে বলছে। দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে দেখলাম। মৃগী বলে মনে হচ্ছে সাহেব।"
"অ্যাঁ!", বলে আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম সোফা ছেড়ে।
(৩)
অন্ধকারের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে লোকটি। যদিও আশেপাশে কেউ নেই, থাকার কথাও নয়, দিনের বেলাতেই লোকে এদিকে তেমন ঘেঁষে না, এই ঘোর অমাবস্যার রাত তো কোন ছাড়। তবুও, সাবধানের মার নেই। লোকটি নিজের সঙ্গে একটা লন্ঠন বা টর্চ, নিদেনপক্ষে একটা লাইটার, কিছুই নেয়নি। এতে যে তার অসুবিধা হচ্ছে পথ চলতে তা নয় কিন্তু, বরং দিনের আলোর থেকে অন্ধকারে চলাফেরা করতেই সে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
ওইতো, ওইটাই তো সেই মন্দিরের চূড়া বলে মনে হচ্ছে। লোকটি আরো কয়েক পা এগিয়ে গেল। নাহ, কোনো সন্দেহ নেই, এই সেই জায়গা। কিন্তু তাও, ভেতরে ঢুকে খোঁজাখুঁজি করার আগে আরেকবার নিশ্চিত হওয়া দরকার। পন্ডশ্রম করার মতো সময় বা ইচ্ছে, কোনোটাই তার নেই।
কানে লাগিয়ে রাখা ব্লুটুথ হেডফোনটা বোতাম টিপে চালু করল লোকটি। কিছুক্ষণ সব চুপচাপ, তারপর আস্তে আস্তে কানে বাজতে লাগলো একটা কান্নায় বোজা, আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর,
"পুঁতে দিয়েছি। ওই বিষাক্ত পাপকে আমি মাটিতে পুঁতে দিয়েছি। ও জিনিসে সাক্ষাৎ শয়তানের বাস, যে ওতে হাত দেবে তার জীবন থেকে সমস্ত আলো শুষে নেবে অন্ধকার। আমি সেই ভয়াল ভয়ঙ্করের কথা কাউকে জানতে দিতে চাই না কিন্তু এও বুঝতে পারছি, সব কথা না বললে আমার নিস্তার নেই। নিজের কবর আমি নিজেই খুঁড়েছি।
আমার নাম রমেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। পেশায় আর্কিওলজিস্ট। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অধীনে একটা প্রজেক্টের জন্য বছরখানেক আগে আমাকে যেতে হয়েছিলো নদিয়ায়। বল্লাল ঢিপির কাছে কিছুটা জায়গা পরিদর্শন করার দায়িত্ব পড়েছিলো আমার উপরে। কাজটা সম্বন্ধে আমার ব্যক্তিগত আগ্রহ ছিলো প্রবল কারণ ছোটবেলায় মায়ের মুখে শুনেছিলাম, আমার পূর্বপুরুষরা নাকি নদিয়ার কোনো একটা জায়গায় রাজত্ব করতেন এককালে। সে জায়গাটা খুঁজে পেলে একটা খুবই গর্বের ব্যাপার হতো সন্দেহ নেই, কিন্তু তার বদলে ভাগ্য আমাকে এমন একটা জিনিসের সন্ধান দিলো যার জন্য আমার জীবনটাই শেষ হয়ে গেল।
তারিখটা ঠিক মনে নেই তবে সেদিন সকাল থেকে প্রচন্ড বৃষ্টি হওয়ার দরুন কাজ বন্ধ ছিলো। বৃষ্টি ধরে এলে আমি একাই একটু এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছিলাম। হয়তো একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম বলে খেয়াল করিনি, একটা প্রকাণ্ড গাছের গুঁড়ির সঙ্গে ধাক্কা খেতে খেতে সামলে নি নিজেকে। তারপর চোখে পড়ে যে গুঁড়িটার নিচের দিকে একটা অদ্ভুত চিহ্ন রয়েছে। দেখে মনে হলো গরম লোহার শিক দিয়ে চিহ্নটা আঁকা হয়েছে। গোলাকার বৃত্তের মধ্যে তিনটৈ লম্বা দাগ তিনদিকে চলে গেছে সোজাসুজি এবং এবং সেগুলো যেখান থেকে বেরিয়েছে অর্থাৎ চিহ্নটার কেন্দ্রে একটা কোনো জন্তুর মুখ। হঠাৎ কি মনে হওয়ায় গাছের গোড়ার মাটিটা খুঁড়ে দেখার ইচ্ছে হলো। হা ঈশ্বর! কি ভুল যে করেছিলাম! পকেটের ছুরিটা দিয়ে খানিকক্ষণ মাটি নাড়াচাড়া করতেই একটা অদ্ভুত ধরনের বাক্স মাটির তলা থেকে উঁকি দেয়। সাইজে সেটা খুব বড় নয়, কিন্তু তার সারা গায়ে কোনো এক অজানা ভাষায় কিসব লেখা রয়েছে। কোনো তালা ছিলো না বাক্সটার ডালায়। উপরের অংশটা ধরে টানতেই সেটা খুলে যায়। বাক্সের ভিতর একটা বই, যেটার মলাটে এবং প্রত্যেক পৃষ্ঠায় ওই বাক্সের গায়ের ভাষা। বইয়ের পাশে স্বচ্ছ কাঁচের মতো দেখতে কোনো পদার্থ দিয়ে তৈরি একটা কৌটো এবং সেই কৌটোর মধ্যে কালো রঙের, সরু কাঠির মতো একটা ছোট্ট জিনিস।
বাক্সটা নিয়ে আমি ফিরে আসি। অনেক গবেষণা করে, তন্নতন্ন করে ইন্টারনেটে খু্ঁজে এবং বিস্তর বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে অবশেষে ওই অজানা ভাষায় লেখা কথাগুলোর একটা মোটামুটি অর্থ বের করি এবং বইয়ের লেখা অনুসরণ করে কৃষ্ণপক্ষের এক গভীর রাতে কৌটো থেকে সেই কালো বস্তুটিকে বার করে এনে তার সাহায্যে ডেকে আনি এক জলজ্যান্ত বিভীষিকাকে। আমার বুদ্ধিশুদ্ধি অনেক আগেই লোপ পেয়েছিলো, যতদিনে সেগুলো ফিরে পাই ততদিনে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে।
আমি জিনিসগুলোকে নষ্ট করে ফেলতে চেয়েছিলাম, পারিনি। এ বাক্স বা বই আগুনে পোড়ে না, বন্দুকের গুলিও এগুলিকে ভেদ করতে পারেনি। কুঠার দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলার চেষ্টা করেছিলাম, সম্ভব হয়নি। একটা কোপ মারার জন্য বইয়ে কুঠার ছোঁয়াতেই সেটা শত টুকরোয় ভেঙে মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে, বইটাকে অক্ষত রেখে।
নদিয়ায় আর যাওয়া হয়নি। যেতে চাইও না, মনটা আমার অনেক আগেই মরে গিয়েছিলো, শরীরের আয়ুও আর বেশিদিন নয়। এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার আগে, শেষবারের জন্য একটা জায়গায় গিয়েছিলাম, রাজস্থানের লোহাগড়ায়। লোহাগড়া দুর্গের কাছেই ঘন জঙ্গলের মধ্যে আছে একটি ভাঙা মন্দির। সেই ভাঙা মন্দিরের দেবীর পায়েই সঁপে দিয়ে এসেছি সমস্তকিছু। আমাকে তিনি দয়া করবেন না জানি, কিন্তু আশা করি, এই বিশ্ব-সংসারকে তিনি রক্ষা করবেন ওই দানবীয় বিপদের হাত থেকে।"
কথাগুলো একটানা শুনতে শুনতে লোকটি তার কাজ করে যাচ্ছিলো। মন্দিরের ভিতরে ঢুকে চারিদিক দেখা হয়ে গেছে তার। এবার ভগ্নপ্রায় পাথরের দেবীমূর্তিটির পায়ের কাছে চোখ পড়তেই তার ঠোঁটে ফুটে উঠলো একটা কুটিল হাসি। বহু বছরের ধুলো, নোংরা, আর মাকড়সার জাল জমে থাকলেও সেই বিশেষ চিহ্নটি ঠিকই দেখা যাচ্ছে। শাবল দিয়ে একবার চাড় দিতেই কাঙ্খিত বস্তুটির সন্ধান পেয়ে গেল সে। মত্ত উল্লাসে হেসে উঠলো লোকটি, আর সেই নিষ্ঠুর হাসি এক অশনি সংকেত পৌঁছে দিতে লাগলো চারিদিকে।
(৪)
হন্তদন্ত হয়ে চেম্বারে পৌঁছে দেখি, কান্ড যা ঘটার তা ইতিমধ্যেই ঘটে গেছে। আধময়লা হলদেটে পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরা রোগাগোছের একটা লোক, গায়ের রঙটা চাপা, মুখে কয়েকদিনের না-কামানো দাড়ি, মাথার চুল উস্কোখুস্কো; আমার কাঁচের টেবিলটার সামনে পেশেন্টদের বসার জন্য যে প্লাস্টিকের টুলগুলো রাখা থাকে, তারই একটায় বসে কাঁপছে। কাঁপছে বললে ভুল বলা হবে, লোকটার সারা শরীরে যেন ভূমিকম্প দেখা দিয়েছে! চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে তার জ্ঞান নেই, কিন্তু আমি এখন কি করি? মৃগী রোগীর খিঁচুনি জোর করে বন্ধ করা যায় না, করতে গেলে মারাত্মক পরিণাম হতে পারে। লোকটা যেরকম ভয়ঙ্করভাবে কাঁপছে, এই মুহূর্তেই কিছু একটা ব্যবস্থা করা দরকার। কিন্তু মিডাজোলাম(midazolam) বা কেপ্রা(keppra) ইঞ্জেকশন তো নেই আমার কাছে।
"যেটা নেই সেটা নিয়ে অযথা ভেবে সময় নষ্ট করা উচিত নয়", বলে উঠলো একটা শান্ত, গম্ভীর কণ্ঠস্বর। পিছন ফিরে তাকালাম। কখন যেন আমার চেম্বারে ঢুকে এসেছেন এক ভদ্রলোক। পরনে একটা হালকা সবুজ রঙের ফুলহাতা জামা ও যত্ন করে কোঁচানো শান্তিপুরী ধুতি, পায়ে অফিস চপ্পল। ফর্সা, ধোপদুরস্ত চেহারা। হাইট প্রায় সাড়ে ছ'ফুটের কাছাকাছি। মাথার কোঁকড়ানো চুলে অল্প পাক ধরলেও বেশিরভাগই কুচকুচে কালো। গলায় একটা স্ফটিকের মালা এবং একটি সোনার চেইন। ডান হাতের মধ্যমায় একটা পান্না বসানো আংটি, কব্জিতে একটা লাল তাবিজ এবং একটা সোনার বালা। বাঁ হাতের কব্জিতে শুধু একটা কালো ঘড়ি। বয়সটা পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চান্নর মধ্যে, সঠিক বোঝা যায় না। সব মিলিয়ে খুব অসাধারণ কিছু হয়তো নয় কিন্তু গোঁফ-দাড়ি নিখুঁতভাবে কামানো পরিষ্কার মুখটায় ওই মোটা ডাকাতে ভুরুগুলোর নিচে যে জ্বলজ্বলে চোখজোড়া রয়েছে, সেগুলোকে কিছুতেই সাধারণ বলা চলে না। চোখের মণির রং আকাশী নীল এবং আকাশের সীমাহীনতার মতোই অপরিমেয় জ্ঞান, বুদ্ধি ও সাহসের ভান্ডার যেন লুকোনো আছে সেখানে।
"আপনি কে?", আমি জানতে চাইলাম, "পেশেন্টের সঙ্গে এসেছেন?"
ভদ্রলোক ব্যস্তভাবে বলে উঠলেন, "সে প্রশ্নের উত্তর পরে পেলেও চলবে আপনার। আপাতত আসুন, আগে ওকে ধরে মাটিতে শুইয়ে দিই। মৃগীর খিঁচুনি সাধারণত পাঁচ মিনিটের বেশি স্থায়ী হয় না।" এতক্ষণে যেন আমার সম্বিত ফিরলো। সত্যিই তো, এই সামান্য ব্যাপারটা আমার মাথা থেকে পুরো বেরিয়ে গেছিলো। সকালের খবরের কাগজটা পড়াই আমার কাল হয়েছে। আমি একজন ডাক্তার, মৃগী রোগী দেখে এভাবে বোধবুদ্ধি হারানো আমার পক্ষে মোটেই শোভা পায় না।
লোকটিকে চেম্বারের মেঝেতে শুইয়ে দেওয়ার খানিকক্ষণের মধ্যেই তার খিঁচুনি থেমে গেল। কিন্তু তার জ্ঞান ফেরার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। সেই ভদ্রলোক এবার আমাকে বললেন, "আমি ওর জ্ঞান ফেরাচ্ছি। আপনি বরং একটু গরম দুধের ব্যবস্থা করুন। বেচারার শরীরে একদম শক্তি নেই।"
কেন জানিনা, আমার মনে হলো, ভদ্রলোক যা বলছেন সেটা করাই উচিত। আমি বলরামকে দুধের কথা বলে ফিরে আসার পর দেখলাম, লোকটি উঠে বসে দুর্বলভাবে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তার চোখে-মুখে ক্লান্তি ও অসুস্থতার সঙ্গে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু কেন?
একটু পরেই বলরাম দুধের গ্লাস নিয়ে এলো। ভদ্রলোক সেটা নিয়ে তাঁর জামার বুকপকেট থেকে একটা ছোট্ট শিশি বের করে কি যেন একটা পদার্থ দুধের গ্লাসের মধ্যে মিশিয়ে দিলেন। আমি বাধা দেওয়ার আগে তিনি নিজেই বলে উঠলেন, "রজত ভস্ম, সঙ্গে খানিকটা স্বর্ণ মক্ষিকার গুঁড়ো। শরীরে বল জোগাতে এবং মৃগীরোগের চিকিৎসায় এটি অব্যর্থ। অন্যান্য অনেক গুণও এর আছে কিন্তু এখন সেগুলোর তালিকা করার সময় নয়।" তারপর খুব আস্তে আস্তে, পরম মমতায় অসুস্থ লোকটার গায়ে, মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে খানিকটা দুধ তাকে খাইয়ে দিলেন। এতক্ষণে লোকটা যেন একটু ধাতস্থ হয়েছে বলে মনে হলো। খুব অস্পষ্ট উচ্চারণে সে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলো, কিন্তু তার কথাগুলো বোঝা গেল না। যেন কোন ছোটো বাচ্চাকে বোঝানো হচ্ছে, কিচ্ছু হয়নি, সব ঠিক আছে, ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই, তেমনভাবে ভদ্রলোক তাকে বললেন, "এখন কিছু বলার প্রয়োজন নেই। বিশ্রাম নাও।" তারপর হঠাৎ লোকটির পাশ থেকে উঠে এসে নিচু গলায় আমাকে বললেন, "ওর ঘাড়ের কাছে একটা অদ্ভুত দাগ দেখতে পেলাম। আপনি একবার দেখুন তো, কিছু বুঝতে পারেন কিনা।" আমি এক পলক অবাক হয়ে তাকালাম ভদ্রলোকের দিকে, এটা কি এমন কথা যে এইভাবে গলা নামিয়ে বলতে হলো?
যাইহোক, আমি লোকটার কাছে এগিয়ে গিয়ে নিচু হয়ে বসার পর ওর ঘাড়ে সত্যিই একটা কালচে দাগ দেখতে পেলাম। কালশিটে নয় এটা, জড়ুল তো নয়ই, কালো কালি দিয়েও যে আঁকা নয় সেটা হলফ করে বলা যায়। দাগটা আকারে খুবই ছোট, বড়জোর তিন থেকে চার সেন্টিমিটার। দেখতে অনেকটা কোন আইসক্রিমের মতো, একটা দিক বেশ চওড়া এবং দুটো খাঁজ রয়েছে সেদিকে, অন্যদিকটায় চওড়া থেকে ক্রমশ সরু হয়ে আসা উপরের আর নিচের রেখা দুটো জুড়তে গিয়েও না জুড়ে মিলিয়ে গেছে। অদ্ভুত দাগ সন্দেহ নেই, এবং কোনো পোকা কামড়ালে এমন দাগ হয় বলে আমার অন্তত জানা নেই।
হঠাৎ একটা অপ্রত্যাশিত কান্ড ঘটলো। আমি লোকটাকে তার ঘাড়ের ওই দাগের কারণ জিজ্ঞেস করার আগেই সে প্রবল আতঙ্কিত চোখে আমার দিকে তাকালো এবং পরমুহুর্তেই আমাকে ধাক্কা মেরে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ি কি মরি করে ছুটে বেরিয়ে গেল চেম্বার থেকে! আচমকা ধাক্কায় আমি হয়তো পেছন থেকে উল্টে পড়ে যেতাম কিন্তু তার আগেই দুটো শক্তপোক্ত হাত আমাকে ধরে ফেললো। সেই ভদ্রলোক, তবে আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে লোকটির এহেন ব্যাখ্যাতীত আচরণে তিনি মোটেই অবাক হয়েছেন বলে মনে হলো না। বিস্ময়ের ছিটেফোঁটাও নেই তাঁর চোখে-মুখে, বরং ঠোঁটে এক চিলতে হাসির আভাস পাচ্ছি। শান্তকণ্ঠে তিনি বললেন, "লোকটা পাগল নয়, তবে ওর আচরণের কারণ আমি বোধহয় আন্দাজ করতে পারছি।" "তাই নাকি? কি কারণ?", উত্তেজিতভাবে বললাম আমি। "সেটা আজ রাতেই জানতে পেরে যাবো নিশ্চিতভাবে। আমার সঙ্গী হতে রাজি হলে আপনিও জানতে পারবেন", বললেন ভদ্রলোক।তিনি যে কি ইঙ্গিত করলেন তা তিনিই জানেন, তবে আমার মন বললো যে খুব তাড়াতাড়ি সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে।
ভদ্রলোককে অনুরোধ করেছিলাম দুপুরের খাওয়াটা আমার বাড়িতে সেরে নেওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি কিছুতেই রাজি হলেন না, বললেন তাঁর কাজ আছে। আমাকে বলে গেলেন, "আপনি খাওয়া-দাওয়া সেরে ভালো করে বিশ্রাম নিয়ে নিন ডাক্তারবাবু। আজ রাতে কিন্তু অনেকক্ষণ জেগে থাকতে হতে পারে।"
ঠিক রাত দশটায় আমার বাড়ির ডোরবেলটা বাজলো। দরজা খুলতেই ভদ্রলোক বললেন, "আপনি তৈরি তো? আপনার নাইন এমএম পিস্তলটা সঙ্গে নিয়ে নিন। কাজে লাগতে পারে।"
চোখের সামনে ভগবানকে দেখতে পেলেও বোধহয় আমি এতটা অবাক হতাম না। আমি যে আগ্নেয়াস্ত্র রাখি সেকথা ইনি জানলেন কি করে? আর শুধু তাই নয়, মডেলটা পর্যন্ত জেনে বসে আছেন! কিন্তু কিভাবে?
আমাকে ভ্যাবলার মতো তাকাতে দেখে ভদ্রলোক তাড়া দিলেন, "অবাক পরে হবেন। এখন চলুন। বেশি দেরি হলে আমাদের উদ্দেশ্য বিফল হয়ে যেতে পারে।" আমি আর কথা না বলে নিজের ঘর থেকে পিস্তলটা নিয়ে এলাম। রাস্তায় বেরিয়ে দু'পা এগোতেই মোড়ের মাথায় একটা ছায়ামূর্তিকে দেখতে পেলাম। আমাদের দেখতে পেয়ে সে এদিকে এগিয়ে এলো। স্ট্রীটলাইটের আলোয় দেখলাম, একটি ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়সী যুবক। পরনে গাঢ় বেগুনি রঙের হাফহাতা জামা আর জিন্সের প্যান্ট। হাইট প্রায় ছ' ফুট। ঋজু দেহের সঙ্গে যুতসই গোঁফ-দাড়ি কামানো পরিষ্কার মুখের গঠন। শান্ত চোখের দৃষ্টিতে আত্মপ্রত্যয়ী ভাব। ভদ্রলোক যুবকটিকে প্রশ্ন করলেন, "খবর কি হেমেন্দ্র? সব ঠিকঠাক তো?" যুবকটি চাপা গলায় বললো, "লোকটা সামনের বস্তির কাছেই একটা বাড়ির একতলায় ভাড়া থাকে। অন্য কোনো ভাড়াটে নেই কারণ বাড়ির অবস্থা ভালো নয়, আর খুব বেশিদিন হয়নি বাড়িটা ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এখন লোকটা বাড়িতে নেই, তাই আমাদের কাজের জন্য এটাই সঠিক সময়।"
"বেশ, যাওয়া যাক তাহলে", বললেন ভদ্রলোক, তারপর যুবকটি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছে বুঝতে পেরে তিনি আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন, "ও, তোমাকে বলা হয়নি, ইনি হচ্ছেন বিখ্যাত চিকিৎসক, ডাঃ জয়দ্রথ বন্দ্যোপাধ্যায়। আর ডাক্তারবাবু, এই আমার সহচর ও সহযোগী হেমেন্দ্রকুমার বর্ধন। আমার সমস্ত কাজেই ও আমাকে সাহায্য করে।"
অতঃপর আমরা রওনা দিলাম। হেমেন্দ্রই আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো। বেশি হাঁটাহাঁটি করতে হলো না, অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম বাড়িটার সামনে। সদর দরজায় তালা লাগানো, কিন্তু হেমেন্দ্র পকেট থেকে একটা চাবির গোছা বের করে নিমেষের মধ্যে খুলে ফেললো সেটা। ভদ্রলোক বললেন, "যদিও মনে হচ্ছে লোকটার ঘরেই যা চাইছি তা পেয়ে যাবো, তাও প্রয়োজনে গোটা বাড়িটাই আমাদের ঘুরে দেখতে হতে পারে। সুতরাং, আমরা তিনজনেই ভিতরে ঢুকবো।"
নির্দিষ্ট ঘরটা, অর্থাৎ যেটাতে থাকে সেই লোকটি, সেটাতেই আগে যাওয়া হলো। ঘরটা আকারে খুব বড় নয়, আসবাব-পত্রও বেশি নেই। একটা খাট, তাতে তেলচিটে বালিশ এবং ময়লা একটা চাদর। খাটের নীচে একটা টিনের তোরঙ্গ দেখা যাচ্ছে। এছাড়া রয়েছে দেওয়ালে লাগানো একটা আয়না, আর জানালার গরাদের সাথে বাঁধা দড়িতে টাঙানো দড়িতে খানকয়েক জামাকাপড়। একটা আলমারিও রয়েছে, তবে তার গায়ে জমে থাকা ধুলো আর মাকড়সার জাল দেখেই বোঝা যায় যে সেটা খোলা হয়না।
ভদ্রলোক ঘরে ঢুকেই হেমেন্দ্রকে নিয়ে একেবারে চিরুনি তল্লাশি শুরু করে দিলেন। আয়নাটাকে নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে তিনি বললেন, "ঠিক কি খুঁজছি তা আমি নিজেও খুব ভালোভাবে জানি না ডাক্তারবাবু, তবে আশা রাখছি যে সন্দেহজনক কিছু একটা এঘরে পাবো।" এবার আর অবাক হলাম না, ভদ্রলোকের কান্ড দেখে অন্য কারো মনেও এই একই প্রশ্ন আসতো ঠিকই, কিন্তু আমার মনের কথা যে তিনি কোনো এক আশ্চর্য উপায়ে জেনে ফেলছেন সেটা বেশ বুঝতে পারছি। এখন মনে পড়ছে, বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে আমি পিস্তলটা সঙ্গে নেবো কিনা, সে কথাই ভাবছিলাম।
আয়নাটা ছেড়ে দিয়ে ভদ্রলোক খাটের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমিও টিনের তোরঙ্গটার দিকে হাত বাড়াচ্ছিলাম কিন্তু তার আগেই ভদ্রলোক বালিশটা সরিয়ে কিছু একটা দেখতে পেয়ে হাতের মুঠোয় তুলে নিলেন। কি পেলেন জিজ্ঞেস করার আগেই একটা অস্ফুট চিৎকার আমার কানে প্রবেশ করলো। চমকে উঠে ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি, সকালে আমার চেম্বারে আসা সেই লোকটি! চিৎকারটা তার মুখ থেকেই বেরিয়েছে এবং আমাদের তিনজনকে তার ঘরের মধ্যে এইভাবে দেখে সে যে বিস্মিত হয়েছে তা আর বলে দিতে হয়না। সাধারণত এসব ক্ষেত্রে যার ঘর তিনি অনুপ্রবেশকারীদের দফারফা করে ছাড়েন কিন্তু এই লোকটি সকালবেলার মতনই উল্টো দিকে দৌড় দিলো।
আমরা তিনজনেই তৎক্ষণাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। ভদ্রলোক আমাকে বললেন, "ডাক্তারবাবু, আপনার পিস্তলটা, তাড়াতাড়ি!" আমি সেটা পকেট থেকে বের করে ভদ্রলোককে দিতেই তিনি লোকটির পিছু ধাওয়া করলেন। আমি তো বাধা দিতে পারলামই না, হেমেন্দ্রও দেখি মিটিমিটি হাসছে! আমি অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, "আপনি ওনাকে আটকালেন না কেন? ধুতি পরে দৌড়োনো যায় ওইভাবে? পা জড়িয়ে পড়ে গেলে যে কেলেঙ্কারি হবে। ওনার বয়সও তো কম নয়, এই বয়সে কি এসব করা উচিত?"
আমার কথা শুনে চিন্তিত হওয়া তো দূর, যুবকটি হো হো করে হেসে উঠলো। তারপর হাসতে হাসতেই বললো, "আপনি ওনাকে চেনেন না ডাক্তারবাবু। জাদুকর শ্রীকান্ত বিজয় সান্যালকে কাবু করার সাধ্য বয়সের নেই। উনি মিলিটারি ট্রেনিং নিয়েছিলেন, সার্কাসে ট্রাপিজের খেলাও দেখিয়েছেন এককালে। ওনার শরীর সম্পূর্ণভাবে ওনার বশে। ওনার কাছে ধুতি যা, ট্র্যাকসুটের প্যান্টও তাই। আপনি চিন্তা করবেন না, উনি এই ফিরে এলেন বলে।"
সত্যিই দশ মিনিটের মধ্যে ফিরে এলেন শ্রীকান্তবাবু। কিন্তু তাঁর মুখ থমথমে, আমার পলাতক রোগীও সঙ্গে নেই। পিস্তলটা আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে তিনি ধীরে ধীরে দম নিয়ে বললেন, "বেচারা ভয় পেয়েছিলো প্রচন্ড। আরেকটু হলে গাড়ি চাপা পড়তো আমি চেপে না ধরলে। তবে যা ভেবেছিলাম সেটাই ঠিক। এরা সবাই এক একটা দম দেওয়া পুতুল, চাবি ঘুরিয়ে দেওয়ার পরে একটা নির্দিষ্ট সময় অবধি এরা কাজ করে, তারপরে থেমে যায়। কিন্তু চাবিটা কে কিভাবে ঘোরালো, সে সম্বন্ধে এদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। প্রশ্ন করতে গেলেই ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। যাকগে, আর কিছু না হোক, ছোটাছুটি করে খানিক কায়িক পরিশ্রম তো হলো।"
আমার আর হেমেন্দ্রর মনে এই মুহূর্তে সম্ভবত একটাই প্রশ্ন সবথেকে বড় আকারে উঁকি দিচ্ছিলো। সেটাকে আর কথায় প্রকাশ করতে হলো না। শ্রীকান্তবাবু নিজের থেকেই বললেন, "আপাতত আমাদের করণীয় দুটো। এক, চোখ-কান খোলা রেখে বিশ্রাম নেওয়া, এবং দুই, শেষ দৃশ্যের জন্য রিহার্সাল। স্থান, কাল, পাত্র আমি সঠিক সময়ে জানিয়ে দেবো।"
(৫)
"ইরক!"
"কি হলো ডাক্তার? অমন বিদঘুটে আওয়াজ করলে কেন?"
"হবে আর কি? দেখতাম কলকাতায় রোগী, আজ আপনার পাল্লায় পড়ে হলাম বনের যোগী! লতায় পা জড়িয়ে আরেকটু হলেই তো পপাত ধরণীতলে হচ্ছিলাম।"
আমার কথায় মুচকি হাসলেন শ্রীকান্ত বিজয় সান্যাল। তারপর একটু দুঃখ দুঃখ ভাব করে বললেন, "আহারে! খুব লেগেছে বুঝি ডাক্তারবাবু? কি আর করবেন বলুন, কপালের লিখন খন্ডায় কে!" "থাক, আর ঢঙ করে আপনি-আজ্ঞে করতে হবে না, 'তুমি' টাই ভালো", রেগে উঠে বললাম আমি, "কালীপুজোর রাতে কোথায় পাড়ার ক্লাবে গিয়ে ভোগ-প্রসাদ খাবো, রঙবাহারি বাজির আলোর খেলা দেখবো, তা নয় এখন জঙ্গলের মধ্যে টারজানগিরি করছি। তা আপনার সহচর হেমেন্দ্র কোথায় গেল? সে তো আমাদের সঙ্গে এলো না।"
শ্রীকান্তবাবু হাসিমুখেই উত্তর দিলেন, "অত রাগ করতে নেই ডাক্তারবাবু, রক্তচাপ বেড়ে যাবে। আর হেমেন্দ্রর কথা ভাবতে হবে না, ও আগে থেকেই স্পটে পৌঁছে পজিশন নিয়ে নিয়েছে।"
চাপা স্বরে কথা বলতে বলতে আমরা দুজনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কালীপুজোর রাত, আকাশে চাঁদ নেই। কনফারেন্সে যোগ দিতে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে অন্যান্য রাজ্যে গেলেও রাজস্থানে আমি আগে কখনো আসিনি। অবশ্য এলেও যে বিশেষ লাভ হতো তা নয়, লোহাগড়ার জঙ্গল বেশ ঘন, আগে থেকে রাস্তা চেনা থাকলেও পথ হারানোর সম্ভাবনা ষোলো আনা। সঙ্গে টর্চ থাকলেও শ্রীকান্তবাবু সেটা জ্বালতে দেননি। অন্ধকারের মধ্যে কোনদিকে যাচ্ছি বোঝার কোনও উপায় নেই। তবে শ্রীকান্তবাবু যেরকম শক্ত করে আমার হাতটা ধরে রেখে দৃঢ় ভাবে এগিয়ে চলেছেন তাতে তিনি ভুল রাস্তায় যাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে না।
শেষপর্যন্ত যেখানে এসে আমরা থামলাম, সেখানে একটা বড়সড় মন্দির, যদিও তার অবস্থা একেবারে জরাজীর্ণ। চূড়াটা বাদে মন্দিরের প্রায় সর্বত্রই দেয়ালে ফাটল এবং গর্ত, সেগুলোর মধ্যে থেকে সুযোগ বুঝে বট-অশ্বত্থের চারাও বেরিয়ে এসেছে বেশ কয়েকটা। অবাক লাগলো এটা দেখে যে ভাঙাচোরা, কালের গহ্বরে মিশে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মন্দিরটার ভিতরে দুটো মশাল জ্বলছে। তাহলে কি আজ রাতে কেউ এই মন্দিরে আসবে? "তোমার প্রশ্নের উত্তর এক্ষুণি পাবে", বললেন শ্রীকান্তবাবু, "কিন্তু তার আগে এসো আমরা ওই দিকের বড় গাছগুলোর আড়ালে গিয়ে দাঁড়াই। এই খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে আমাদের বিপদ হতে পারে।"
আত্মগোপন করে আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম, তবে বেশিক্ষণের জন্য নয়। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই মন্দিরের সামনে যেখানটায় আমরা দাঁড়িয়েছিলাম, ঠিক সেইখানে এসে উপস্থিত হলো একটা লোক। লোকটার হাঁটাচলা ঠিক স্বাভাবিক নয়, কষ্ট করে বাঁ পা'টাকে টেনে টেনে হাঁটছে সে। একবার চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে সে কিছু জিনিস মাটিতে নামিয়ে রাখলো। পরিষ্কারভাবে দেখতে না পেলেও অনুমান করলাম, সেগুলো চ্যালা করা কাঠ এবং শুকনো ডালপালা। ব্যাপার কি? এখানে কি কোনো যজ্ঞ-টজ্ঞ হবে নাকি?
যা ভাবছিলাম সেটাই হলো। কাঠগুলো সাজিয়ে লোকটা সেগুলোর চারিদিকে আগে একটা গোল করে গণ্ডি কাটলো। তারপর একটা গুঁড়ো মতন পদার্থ একটা বস্তা থেকে ঢালতে লাগলো কাঠগুলোর চারপাশে। শ্রীকান্তবাবু প্রায় শোনাই যায়না এমন চাপা গলায় বললেন, "বালি"।
কাজ শেষ হলে লোকটা মন্দিরের ভেতর থেকে একটা মশাল এনে কাঠের গায়ে আগুন লাগালো। আগুন ভালোভাবে জ্বলে উঠলে জ্বলন্ত অগ্নিশিখার মধ্যে সে কিছু একটা ঢেলে দিতে লাগলো এবং আগুনটাও সাথে সাথে অনেকখানি উঁচু হয়ে উঠলো। আমরা দুজনে যেখানে লুকিয়ে আছি সেখান থেকেও আগুনের তাপ ভালোই অনুভব করা যাচ্ছে। লোকটা কিন্তু আগুনের সামনে বসলো না। সে এবার মন্দিরের ভিতরে চলে গেলো। শ্রীকান্তবাবু আমার হাতে একটা মৃদু চাপ দিয়ে এগোনোর সংকেত দিলেন। এতক্ষণে হেমেন্দ্রকে দেখতে পেলাম, আমরা গাছের আড়ালে থেকে পা টিপে টিপে ক্রমশ মন্দিরের কাছে এগিয়ে যেতেই সে আমাদের জায়গায় এসে দাঁড়ালো। শ্রীকান্তবাবু শুধু একবার হেমেন্দ্রর দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ চোখে তাকালেন এবং হেমেন্দ্র মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো।
মন্দিরের মধ্যে নিঃশব্দে প্রবেশ করে আমরা দুজনে দুটো মোটা থামের আড়ালে দাঁড়ালাম। লোকটা আমাদের দিকে পিছন ফিরে বসে আছে, তার সামনে একটা গোলাকার পাথর যার গায়ে একটা প্যাটার্ন খোদাই করা। লোকটা হঠাৎ নিজের বাঁ হাতের একটা আঙুল ডান হাতের ধারালো নখ দিয়ে চিরে ফেললো! মাটিতে কয়েক ফোঁটা রক্ত পড়ার পর লোকটা একটা সরু, হলদেটে মতো কোনো জিনিসে রক্তটা লাগিয়ে পাথরে খোদাই করা প্যাটার্নে বোলাতে লাগলো। একবার, দুবার, তিনবার, পরপর এগারোবার বুলিয়ে তবে থামলো সে, এরই সঙ্গে একটানা সে একটা অজানা ভাষায়, অদ্ভুত সুরে, সম্ভবত কোনও মন্ত্র আউড়ে যাচ্ছিলো। এবার সেটা বন্ধ হয়ে গিয়ে খকখক করে কাশতে শুরু করলো লোকটা এবং প্রত্যেকবার কাশির সঙ্গে তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল খানিকটা করে নিকষ কালো ধোঁয়া! যেন মানুষ নয়, মোটরগাড়ির পিছনদিকে লাগানো একটা পাইপ ভলকে ভলকে ধোঁয়া ছাড়ছে। টানা এগারোবার ধরে লোকটার মুখ থেকে ধোঁয়া বেরোলো এবং জমাট বেঁধে তার মাথার উপরে প্রচন্ড গতিতে পাক খেতে লাগলো। যেন একটা ছোটখাটো সাইক্লোন ঢুকে পড়েছে মন্দিরের ভিতরে!
হঠাৎ খেয়াল করলাম পা টিপে টিপে সতর্ক শিকারির মতো এগোচ্ছেন শ্রীকান্তবাবু। তাঁর হাতে একটা মাঝারি আকারের কাঁচের পাত্র এবং তিনিও বিড়বিড় করে কোনো মন্ত্র বলছেন ওই লোকটার মতন। পলকের মধ্যে তিনি মেঝেতে বসা লোকটার ঠিক পিছনে গিয়ে দাঁড়ালেন এবং লোকটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ঠিক একজন জিমন্যাস্টের মতো লাফ দিয়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলীটাকে হাতের কাঁচের পাত্রের মধ্যে বন্দি করে ফেললেন। ব্যাপারটা এতটাই অবিশ্বাস্য এবং এমন দ্রুততার সঙ্গে ঘটলো যে আমার নিজেকে চিমটি কেটে দেখার ইচ্ছে হলো আমি আদৌ জেগে আছি কিনা। কিন্তু এখন সেসবের সময় নেই, কিছু একটা গোলমাল হয়েছে বুঝতে পেরে ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে লোকটা। তাকে দেখতে অনেকটা বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মতো। পরনে একটা লাল চেলির কাপড় আর একটা হলুদ উত্তরীয়। কিন্তু তার মুখটা কি বীভৎস! মুখের ডানপাশটা আগুনে ঝলসে গিয়েছিল কোনোকালে, সেদিকের চোখটাও নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু অবশিষ্ট বাঁ চোখের চাহনিতে যে অপরিসীম ঘৃণা আর রাগ মিশে আছে, তা দেখলে শিউরে উঠতে হয়! কর্কশ গলায় সে বলে উঠলো, "ওটা ফিরিয়ে দাও আমাকে! আমার কাজে বাধা দেওয়ার সাধ্য নেই তোমার।" "তাই নাকি?", ঠোঁটের কোণায় একটা বাঁকা হাসি ফুটিয়ে উত্তর দিলেন শ্রীকান্তবাবু, "আমার পিশাচ সংযমন মন্ত্র কেটে বেরোনোর ক্ষমতাও সকলের থাকে না।" "পিশাচ হলে তবে তো আটকাবে। আমি যার উপাসনা করছি সে কোনো পিশাচ নয় রে মূর্খ", বলে প্রচন্ড এক অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো লোকটা। ওহঃ! সে হাসি শুনলে মনে হয় যেন হাজারটা হায়না একসঙ্গে উল্লাসে মেতেছে। আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে দেখলাম, দাঁতে দাঁত চেপে কাঁচের পাত্রটাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন শ্রীকান্তবাবু। পাত্রটার মধ্যে যেন ধোঁয়া নয়, একটা ক্ষ্যাপা ষাঁড় বন্দী হয়ে আছে এবং মুক্তি পাওয়ার জন্য সে তার কয়েদখানার চতুর্দিকে ধাক্কা দিচ্ছে। আর পারলেন না শ্রীকান্তবাবু, কাঁচের পাত্রটা তার হাত থেকে ছিটকে গিয়ে মেঝেতে আছাড় খেয়ে চুরমার হয়ে গেল এবং সেকেন্ডের ভগ্নাংশেরও কম সময়ের মধ্যে বন্দী থাকা জমাট কালো ধোঁয়ার রাশি মুক্তিলাভ করে আকারে বাড়তে লাগলো। একটা বিরাট বড় দানবাকৃতির কোনো জীবের অবয়ব ধারণ করছে সেটা। দেখতে দেখতে যে চেহারাটা স্পষ্ট হয়ে উঠল আমাদের সামনে, তাকে দেখে আমার হৃদপিণ্ডটা একলাফে গলার কাছে উঠে আসতে চাইলো! মেডিকেল কলেজের রুমে মড়া কাটতে গিয়েও আমি অতটা ভয় পাইনি যতটা এখন পেলাম।
আমরা যে কুৎসিত দানোটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি তার উচ্চতা অন্তত দশ ফুট। মুখটা বিদেশি সিনেমার গবলিনের মতো। ছুঁচোলো কান, হলদেটে দুটো চোখ, আর ঝুলে পড়া চোয়ালের উপরে পাতলা ঠোঁটের ভেতর ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা দাঁতগুলো যেন সর্বক্ষণ তৈরি হয়ে আছে কামড় বসানোর জন্য। দেহটা রোগা প্যাঁকাটির মতো, দেখে মনে হয় যেন একটা কঙ্কালের গায়ে আঠা দিয়ে খানিক কালো চামড়া জুড়ে দেওয়া হয়েছে। কাঠির মতন দুটো হাতের শেষ প্রান্ত থেকে বেরিয়ে আসা ছ'খানা করে লিকলিকে আঙুলের ডগায় তীক্ষ্ণ ইস্পাতের ফলার মতো ইঞ্চিখানেক লম্বা নখ। পিঠ থেকে কনুইয়ের কাছ পর্যন্ত হাতের পিছনদিক থেকে বেরিয়েছে দুটি বিরাট ডানা, দেখতে অবিকল বাদুড়ের ডানার মতো। পা'দুটো দেখলে প্রাগৈতিহাসিক যুগের টিরানোসরাস রেক্স ডাইনোসরের কথা মনে পড়ে। দুই পায়েই চারটে করে আঙুল এবং সেগুলো হাতের মতনই তীক্ষ্ণ নখবিশিষ্ট। নিকষ কালো চেহারাটার পিছনদিক থেকে যে লম্বা, সরু খাঁজকাটা জিনিসটা বেরিয়ে এসে চাবুকের মতো মেঝেতে আছাড় মারছে সেটা একটা লেজ!
ঠিক তখনই বাইরে হঠাৎ একসঙ্গে অনেক পায়ের আওয়াজ পেয়ে আমি ঘুরে তাকালাম। অন্তত শ'তিনেক মানুষ এসে হাজির হয়েছে বাইরে, তবে তারা কেউ মন্দিরের দিকে আসছে না। সবাই চারিদিক থেকে সারিবদ্ধ ভাবে এগিয়ে চলেছে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা অগ্নিকুন্ডের দিকে! কি সর্বনাশ! এতগুলো মানুষ কি আগুনে পুড়ে মরবে নাকি?
"জৌহার! জৌহার!", চিৎকার করে হেসে উঠলো লোকটা। উন্মাদের মতো হাসতে হাসতে বলে চললো সে, "মধ্যযুগের রাজপুত নারীরা এইভাবে জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে ঢুকে পুড়ে মরতো নিজেদের সম্মান রক্ষার্থে। আজ, এত যুগ পর, আবার সেই একই প্রক্রিয়া হচ্ছে। তবে তফাৎটা শুধু এই, আজকের মৃত্যুযজ্ঞে যারা সামিল হচ্ছে তাদের মধ্যে নারী ও পুরুষ, দু'রকমই আছে।"
"কিন্তু এতগুলো মানুষের মৃত্যুর বিনিময়ে কি পাবে তুমি? কেন এমন নৃশংস কাজ করতে চাইছো?", আর চুপ করে থাকতে না পেরে জোর গলায় বলে উঠলাম আমি। জ্বলন্ত চোখে আমার দিকে তাকালো লোকটা, তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, "কি পাবো জানিনা, কোনোদিনই কিছু পাইনি আমি। দেবী কুব্জিকার সাধনা করতাম, তিনি খুশি হয়ে আমার মুখটা আগুনে পোড়ালেন আর একটা পা অকেজো করে দিলেন। এটাই যদি ঈশ্বরের বিধান হয় তাহলে আগুনেই পুড়ে মরুক সবাই! এদের পোড়া শরীরের ছাই আমি ছড়িয়ে দেবো সারা বিশ্বে, এই মৃত্যুবীজের স্পর্শ পাওয়ার সুযোগ কেউ হারাবে না। এমনিতেই এরা সবাই মৃগীরোগে ভুগছে এবং সে রোগ সারানোর ক্ষমতা পৃথিবীর কোনও ডাক্তারের নেই কারণ, এই রোগ ছড়িয়েছি আমি। তাই রোগমুক্তির কাজটাও তো আমাকেই করতে হবে নাকি?" আবার গলা ফাটিয়ে হেসে উঠলো লোকটা।
"তোমার সাধনার পথ সঠিক ছিলো না ত্রিগুণাচার্য", গম্ভীরভাবে বললেন শ্রীকান্তবাবু, "মায়ের আশীর্বাদধন্য সেবককে তুমি প্রাণে মারতে চেয়েছিলে। তোমার নিজের কৃতকর্মের ফলই তুমি ভোগ করছো। এর জন্য দেবীকে দোষ দিতে পারো না তুমি।"
অবিকল শকুনের মতো লাগছে লোকটার চাহনি। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে সে বললো, "এখন আর এসব বলে কোনো লাভ নেই। আমাকে তুমি আটকাতে পারবে না। একটু পরেই.. একি! আগুনের ছোঁয়া লেগেও হতচ্ছাড়ারা মরছে না কেন? আগুনের সামনে গিয়েও ওরকম ছিটকে যাচ্ছে কি করে?"
লোকটার গলায় বিস্ময়ের সুর স্পষ্ট। বাইরের দৃশ্যটা দেখে আমিও থ হয়ে গেলাম। মন্ত্রমুগ্ধের মতো অসহায় মানুষগুলো আগুনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে আগুনের সামনে পৌঁছানো মাত্র পিছনদিকে ছিটকে যাচ্ছে তারা। আগুন তাদের শরীর তো দূর, একটা লোমও পোড়াতে পারছে না! আর, এই ঘন জঙ্গলে রাতের অন্ধকারের মধ্যে কোথা থেকে যেন বাঁশি বাজানোর শব্দ ভেসে আসছে! সে বাঁশির সুরে স্বর্গের সুধা আছে, এমনই মিষ্টি তার আওয়াজ। এবার দেখতে পেলাম, গাছের আড়াল থেকে বাঁশি বাজাতে বাজাতে বেরিয়ে এলো হেমেন্দ্র! তার বাঁশির সুর কানে যেতেই সব মানুষগুলো শান্ত হয়ে বসে পড়ছে মাটিতে, তাদের আধবোজা চোখে ঝিমুনির ভাব। দৃশ্যটা দেখে মনে হচ্ছে, শ্রীকৃষ্ণ বুঝি আরো একবার রাখালের রূপে ফিরে এসেছেন মর্ত্যে।
এবার হো হো করে হেসে উঠলেন শ্রীকান্ত বিজয় সান্যাল। যেন বেশ মজা পেয়েছেন এমনভাবে বললেন, "কি ভেবেছিলে ত্রিগুণাচার্য? তুমি পৃথিবী ধ্বংস করবে আর সবাই সেটা মুখ বুজে মেনে নেবে? আজ পবিত্র দীপাবলীর রাত, স্বয়ং মা কালী আমাদের সহায়। ওই যে শুনছো বাঁশির শব্দ, ওটি সত্যিই মোহনবাঁশি। জাপানে ম্যাজিক দেখাতে গিয়ে উপহার পেয়েছিলাম। একসঙ্গে হাজারখানেক লোককে বশ করে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আছে ঐ বাঁশির সুরের। আর আগুন জ্বালাতে গিয়ে গণ্ডগোলটা তুমি নিজেই করেছো। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে তুমি খেয়ালই করোনি কি দিয়ে আগুনের চারপাশে গণ্ডি কেটেছো। পবনপুত্র হনুমানের চরণে ছোঁয়ানো মন্ত্রপূতঃ হলুদ গুঁড়ো আর জুঁই ফুলের পাপড়ি দিয়ে কোনো কিছুকে গণ্ডি দিলে সেই গণ্ডির মধ্যেকার বস্তুটিকে যিনি গণ্ডি কেটেছেন তিনি ছাড়া অন্য কেউ ছুঁতে পারে না। হেমেন্দ্র সঠিক সময়ে তোমার সরঞ্জামের মধ্যে এই জিনিসগুলো মিশিয়ে দিয়েছিলো। তুমি চাইলে ওই আগুনে খানিক ঘি কিংবা কেরোসিন তেল ঢালতে পারো, তবে সব কাঠ পুড়ে গেলেও ওতে মানুষ পোড়াতে পারবে না তুমি।"
"না, না, না এ হতে পারে না!", নিষ্ফল আক্রোশে চেঁচিয়ে উঠলো ত্রিগুণাচার্য। "আমার এতদিনের চেষ্টা, পরিশ্রম সব বিফল করে দিলি তুই? তোকে আমি ছাড়বো না, বারবার আমার কাজে নাক গলানোর শাস্তি তোকে পেতেই হবে।" উন্মত্ত চোখে সে তাকালো ধোঁয়া থেকে জন্ম নেওয়া সেই দানবটার দিকে এবং শ্রীকান্তবাবুর দিকে আঙুল তুলে তাকে সেই অজানা ভাষায় কিছু একটা বলতেই সেটা বীভৎস ডাক ছেড়ে তেড়ে এলো তাঁর দিকে। শ্রীকান্তবাবুর হাতের পাতায় জ্বলে উঠলো একটা নীলাভ শক্তির স্ফুলিঙ্গ। তিনি তাড়াতাড়ি আমাকে বললেন, "ডাক্তার, ওই পাথরটাকে ধ্বংস করতে হবে। ওটা নষ্ট না হলে.." তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই দানবটা তার বিশাল শরীর নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো তাঁর উপরে।
আমি আর বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট করলাম না। যা করার এক্ষুণি করতে হবে। পিস্তলটা বের করে এগোলাম সেই চিহ্ন খোদাই করা পাথরটার দিকে। ত্রিগুণাচার্য বাধা দিতে এগিয়ে আসছিলো, গায়ের সমস্ত শক্তি এক করে একটা প্রচন্ড লাথি কষালাম ওর তলপেটে। রোজ ব্যায়াম করি আমি, গায়ের জোর নেহাত কম নয়, তাও দেখলাম লোকটা নিজেকে সামলে নিয়েছে। ওকে আর কোনোরকম ঝামেলা করার সুযোগ না দিয়ে সোজা পাথরটাকে নিশানা করে পরপর তিনবার ফায়ার করলাম। তিনটে ছিদ্র তৈরি হলো সেটার গায়ে এবং পরমুহুর্তেই সেটা ভেঙে খানখান হয়ে গেল। পাথরটাকে বাঁচানোর একটা মরিয়া চেষ্টায় ক্রিকেটের ফিল্ডারদের মতো ঝাঁপ দিয়েছিলো ত্রিগুণাচার্য কিন্তু তার আগেই আমার পিস্তলের গুলি তার কাজ করে দিয়েছে। ফলে যা হওয়ার তাই হলো, নিজেকে থামাতে না পেরে ত্রিগুণাচার্যের মাথাটা সজোরে ধাক্কা মারলো দেবীমূর্তির পায়ের বেদীতে এবং আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে ঐ সংঘর্ষেই তার মাথার খুলি চৌচির হয়ে গিয়েছে। যদিও বা তার শরীরে প্রাণের কিছুমাত্র চিহ্ন অবশিষ্ট থাকতো, মন্দিরের ছাদের খানিকটা অংশ সেই মুহুর্তেই তার নির্জীব দেহের উপরে ভেঙ্গে পড়ায় সেটুকুও অবলুপ্ত হলো। চিরঘুমে ঢলে পড়লো সে।
পাথর ভেঙে যেতেই দানবটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলো। এইবার তার বিরাট দেহটা মাথা থেকে পা অবধি দুই ভাগে লম্বালম্বি ভাগ হয়ে মেঝের দুই পাশে পড়ে স্রেফ একরাশ কালচে ধুলোয় পরিবর্তিত হলো। অবাক হয়ে দেখলাম, দানবের বদলে সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন এক সৌম্যদর্শন পুরুষ! তাঁর রূপ ও বেশভূষা দেখলে মনে হয় বুঝি ইতিহাসের পাতা থেকে কোনো এক দোর্দন্ডপ্রতাপ রাজা এসে হাজির হয়েছেন। দুটি হাত জোড় করে তিনি কৃতজ্ঞ চোখে তাকালেন আমাদের দিকে। তারপর, বড়জোর হাফ সেকেন্ডের মধ্যে, তাঁর শরীরটা একটা সোনালী আলোর রেখায় পাল্টে গিয়ে আমাদের চোখের সামনে থেকে অন্তর্হিত হলো!
(৬)
"তোমার পলাতক রোগীর বাড়িতে যখন বাদুড়ের ডানাটা খুঁজে পেলাম তখনই বুঝে গিয়েছিলাম এটা কার কীর্তি। কিন্তু তাকে কে ডেকে আনলো সেটাই.. "
"না, না, ওভাবে খাপছাড়া করে বললে হবে না। গোড়া থেকে পুরো ব্যাপারটা সাজিয়ে-গুছিয়ে বলুন।"
কথা হচ্ছিলো আমার বাড়ির বৈঠকখানায় বসে। আসরের মধ্যমণি অবশ্যই শ্রীকান্ত বিজয় সান্যাল। তিনি বলছেন আর তাঁর দুইজন শ্রোতা, অর্থাৎ হেমেন্দ্র এবং আমি, মন দিয়ে শুনছি। তবে আমাদের যুগ্ম-প্রতিবাদে শ্রীকান্তবাবুকে থামতে হলো। খানিক আগেই বলরামকে দিয়ে আনানো গরম জিলিপির ঠোঙা থেকে একটা তুলে মুখে পুরে আয়েশ করে চিবোলেন তিনি। তারপর একটা তৃপ্তির শ্বাস ছেড়ে বলতে আরম্ভ করলেন,
"এই ঘটনার সূত্রপাত আজ থেকে অন্তত পাঁচশো বছর আগে, ষোড়শ শতাব্দীতে। সে যুগে আমাদের বর্তমান নদীয়া জেলার কিছুটা অংশ শাসন করতেন নারায়ণ রাজারা। এই বংশের অস্তিত্ব ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত নয় ঠিকই কিন্তু শোনা যায়, বংশের শেষ শাসক রাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ খুবই পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। এও বলা হয় যে তিনি ভিনগ্রহের প্রাণীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার পন্থা খুঁজে পেয়েছিলেন। তোমরা বলতেই পারো যে এটা হতে পারে না, কিন্তু জেনে রেখো, অনেক বিজ্ঞানীরাই মনে করেন যে সেই আদিকাল থেকেই পৃথিবীতে অন্য গ্রহের প্রাণীদের আনাগোনা চলছে। ইজিপ্টের পিরামিড এক্ষেত্রে একটা উল্লেখযোগ্য বিষয়। যাইহোক, রাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ ভিনগ্রহীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং আমার বিশ্বাস, তারা পৃথিবী থেকে ফিরে যাওয়ার সময়ে উপহারস্বরূপ এটা ওনাকে দিয়ে যায়।"
কথা থামিয়ে সামনের টেবিলের উপরে যে জিনিসটাকে শ্রীকান্তবাবু রাখলেন সেটা একটা অদ্ভুতদর্শন বাক্স। জিনিসটা দেখতে একটা সাধারণ কাঠের বাক্সের মতো হলেও সেটাকে সাধারণ বলার উপায় নেই কারণ তার প্রতিটা অংশে এক অজানা ভাষায় কিসব খোদাই করা রয়েছে। বাক্সটা আমরা সেরাতে ওই ভাঙা মন্দিরের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছিলাম। সেটা খুলে ভিতর থেকে একটা মোটা বই আর একটা কাঁচের মতো কোনো স্বচ্ছ পদার্থের তৈরি ফাঁকা শিশি বের করে টেবিলের উপরে রেখে আবার বলতে আরম্ভ করলেন তিনি,
"রাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ খুব সম্ভবত বাক্সটা খুলে দেখেননি, অথবা খুললেও ভিতরের জিনিসগুলোর উপযোগিতা সম্বন্ধে কিছুই বুঝতে পারেননি। তিনি সময়টাই পাননি কিছু করার কারণ যে রাতে তিনি বাক্সটা পান সেই রাতেই তাঁকে হত্যা করেন তাঁর ভাই ধীরেন্দ্রনারায়ণ। রাজা হওয়ার বাসনা তো তাঁর ছিলোই, আর বাক্সটা দেখে হয়তো তাঁর ধারণা হয়েছিলো যে এতে গোপন ধনভান্ডারের হদিশ আছে। ভাষার সমস্যাটা নিয়ে তিনি মাথা ঘামাননি কারণ এই কৌটোর মধ্যেকার জিনিসই তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো বেশি। এই বইয়ের মধ্যে কম করে হলেও অন্তত পাঁচশো রকম আজব ধরনের প্রাণীর ছবিসহ বিবরণ রয়েছে এবং আমার বিশ্বাস, তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার উপায়ও বাতলানো আছে। এছাড়া বেশ কয়েকটি অদ্ভুত গাছের ছবিও রয়েছে এখানে যেগুলো খুব সম্ভবত ঔষধি গাছ এবং যার বেশিরভাগই আমাদের এই ধরাধামে জন্মায় না। তবে ধীরেন্দ্রনারায়ণ যে সেসব দিকে ঘেঁষেননি তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো। এই কৌটোর মধ্যে থাকা জিনিসটা ছিলো একটা বীজ। যিনি বীজটাকে কৌটো থেকে বের করবেন তাঁর ইচ্ছানুযায়ী যেকোনো একটি প্রাণী বা গাছে রূপান্তরিত হওয়ার ক্ষমতা ছিলো সেটার। ধীরেন্দ্রনারায়ণ ভুলবশতঃ হোক বা জেনে বুঝে, জাগিয়ে তোলেন এক ভয়ঙ্কর দানবকে, যার নাম আহাজু(Ahazu)। এই আহাজু দেখতে যেমন ভয়াবহ, স্বভাবেও তেমনি হিংস্র। সে যাকে ছোঁয়, তার মারাত্মক রকমের এপিলেপসি বা মৃগী রোগ দেখা দেয়। কাজ শুরু করার জন্য আহাজুর প্রয়োজন হয় একটি দেহ, মানুষের হলে তো কথাই নেই, অন্য কোনো প্রাণীর হলেও চলে। ধীরেন্দ্রনারায়ণকে অবশ্য এ ব্যাপারটা নিয়েও বেশি ভাবতে হয়নি। হাতের কাছে থাকা সদ্যমৃত দাদার দেহটাই ব্যবহার করেন তিনি। কিন্তু তারপর যেটা হয় সেটা ছিলো তাঁর কল্পনারও অতীত। রাজা হয়ে সিংহাসনে বসার আগেই মহামারীর মতো চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে মৃগীরোগ। শেষপর্যন্ত প্রায় উন্মাদ অবস্থায় তিনি রাজ্য ছেড়ে পালান, আর এই বাক্সটাকে পুঁতে দিয়ে যান সেন রাজাদের নির্মিত বল্লাল ঢিপির কাছে।
এবার অতীত থেকে চলে এসো বর্তমানে। হেমেন্দ্র, তোমার হয়তো মনে আছে, বছরখানেক আগে আমি ভরতপুর গিয়েছিলাম। ফেরার সময়ে ট্রেনে আমার সহযাত্রী ছিলেন এক অদ্ভুত ভদ্রলোক। তিনি সারারাত ধরে তাঁর মোবাইল ফোনটাকে মুখের কাছে ধরে একনাগাড়ে কিছু বলে যাচ্ছিলেন, এবং থেকে থেকে কেঁদে উঠছিলেন। সেই কামরায় বেশি লোক ছিলো না আর তিনি যেরকম চাপা স্বরে কথাগুলো বলছিলেন, আমি ছাড়া অন্য কেউ শুনতে পেত না, অথবা শুনলেও বুঝতে পারতো না। আমার ঘুম উড়ে গিয়েছিলো কারণ তিনি বলছিলেন এমন এক প্রাচীন অভিশাপের কথা যাকে পাঁচশো বছর আগে জাগিয়েছিলো এক লোভী রাজপুরুষ। কথা বলতে বলতে একসময়ে চুপ করে গিয়েছিলেন ভদ্রলোক। আমি ভেবেছিলাম উনি হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছেন, কিন্তু পরের দিন বেলা গড়িয়ে যাওয়ার পরও যখন তিনি একইভাবে বসে রইলেন তখন তাঁর গায়ে হাত দিয়ে বুঝলাম যে তিনি মারা গিয়েছেন, সম্ভবত হার্ট অ্যাটাক। ভদ্রলোকের কানে একটা ব্লুটুথ হেডফোন লাগানো ছিলো দেখেছিলাম রাতের বেলায়, কিন্তু সকালে আর সেটাকে খুঁজে পাইনি। এখন বুঝতে পারছি, আমার সঙ্গে সেই একই ট্রেনে সফর করছিলো কুহক ত্রিগুণাচার্য, এবং ভোরের দিকে যখন আমি একটু ঝিমিয়ে পড়েছিলাম, তখনই সে ওটা সরিয়েছিলো। আর কি আশ্চর্য দেখো, ব্লুটুথ হেডফোনে সাধারণত ভয়েস রেকর্ড হয় না। কোনোক্রমে হলেও হেডফোনের মধ্যে সেটা কোনোভাবেই স্টোর হয়ে থাকতে পারেনা। অথচ এক্ষেত্রে সেটাই হলো, একেই বলে অলৌকিক। জীবিত অবস্থায় ভদ্রলোকের বলা শেষ কথাগুলো বন্দি হয়ে রইলো একটা কানে গোঁজার যন্ত্রের মধ্যে! ত্রিগুণাচার্য অতশত বুঝে হেডফোনটা নিয়েছিলো কিনা জানিনা, তবে জিনিসটাকে একবার কানে লাগিয়েই সে বুঝে গিয়েছিলো যে পৃথিবীকে পায়ের তলায় পিষে ফেলার উপায় সে পেয়ে গিয়েছে।"
এবার শ্রীকান্তবাবু তাঁর জামার পকেট থেকে একটা ব্লুটুথ হেডফোন বের করে আমাদের দিকে এগিয়ে দিলেন। "এটাও ওই মন্দিরের মধ্যে ছিলো। তোমরা বাটনটা অন করে শুনে দেখতে পারো রমেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর কাহিনি", বললেন তিনি।
"সে পরে হবে। আপনি যা বলছিলেন সেটা আগে শেষ হোক", অধৈর্য ভাবে বলে উঠলাম আমি।
ইতিমধ্যে বলরাম চা দিয়ে গেছিলো। ধূমায়িত কাপে একটা চুমুক দিয়ে শ্রীকান্তবাবু আবার বলতে লাগলেন,
"খবরের কাগজে নিশ্চয়ই দেখেছো, রাজস্থানে কিরকম মৃগীরোগের বাড়াবাড়ি দেখা দিয়েছিলো মাস দুয়েক আগে? ওই তখন থেকেই ত্রিগুণাচার্যের শয়তানি শুরু হয়। কিছু সময় পরে পশ্চিমবঙ্গেও অবধারিতভাবে এপিলেপসি ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। তোমার চেম্বারে যেদিন ওই লোকটি আসে, সেদিন আমি আর হেমেন্দ্র ঠিক তোমার বাড়ির সামনে দিয়েই যাচ্ছিলাম ডাক্তার। লোকটিকে দেখে আমার সন্দেহ হয়, তাই হেমেন্দ্রকে বলি লোকটি তোমার চেম্বার থেকে বেরোলে ওর পিছু নিতে। আগের দিন রাতে আহাজুর সাক্ষাৎ পেয়ে লোকটি স্বাভাবিকভাবেই ভয় পেয়েছিলো। আমরা ওর ঘাড়ের দাগটা নিয়ে উৎসুক হওয়ায় বেচারা আরও ঘাবড়ে যায়। আহাজু যাকে ছোঁয়, তার ঘাড়ে ওইরকম চিহ্নই দেখা দেয়। লোকটি পালায়, হেমেন্দ্র ওর ঠিকানাটা দেখে নেয়, এবং আমাদের নৈশ অভিযানে ওর ঘরের বিছানায় বালিশের তলা থেকে একটা ছোট্ট বাদুড়ের ডানা পাই আমি, যেটা দেখে আমার বদ্ধমূল ধারণা হয় এটা আহাজুর কীর্তি। আসলে আহাজু যে শুধু এপিলেপসি ছড়াতে পারে তা তো নয়, মানুষের মস্তিস্ককে বিকৃতও করে দিতে পারে সে। এইসব হতভাগ্য মানুষগুলোর সঙ্গে সেটাই হতো; জ্ঞান, বুদ্ধি, সবকিছুই একেবারে লোপ পেত এদের মগজ থেকে। তাই তো সেই রাতে অমন হতবুদ্ধি হয়ে মানুষগুলো এগিয়ে যাচ্ছিলো আগুনে পুড়ে মরতে। খুব সহজেই কুহক ত্রিগুণাচার্য তার কাজ হাসিল করে ফেলতো সন্দেহ নেই, কিন্তু বাধ সাধলাম আমরা এই তিনমূর্তি।"
একটা কথা জিজ্ঞেস করার জন্য মুখ খুলতেই শ্রীকান্তবাবু আবার আমার মনের কথাটা পড়ে নিয়ে বলে উঠলেন, "জানি তুমি কি বলবে। আমি কি করে বুঝলাম যে কালীপুজোর রাতটাই ত্রিগুণাচার্য বেছে নেবে? সত্যি কথা বলতে কি, আমি পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলাম না এই ব্যাপারে। তবে মনে হয়েছিলো যে এই সুযোগটা সে ছাড়বে না। আমরা সকলেই জানি অপশক্তি সবথেকে শক্তিশালী হয়ে ওঠে অমাবস্যায়। কালীপুজোর রাতের মতো ঘোর অমাবস্যা আর কটা পাবে তুমি? আর সবাই যেহেতু পুজোর কাজে নাহলে বাজি পোড়ানোয় ব্যস্ত থাকবে, নির্বিঘ্নে কর্ম সমাধা করতে কোনও অসুবিধেই হবে না কারণ এটাই একমাত্র রাত যখন জঙ্গলের মধ্যে হোক বা অন্য যেকোনো জায়গায় হোক, আগুন জ্বলতে দেখে কারও কোনো সন্দেহ হবে না।"
"সবই তো বুঝলাম, কিন্তু এখন এই অপার্থিব বস্তুর কি গতি হবে?", বাক্সটাকে হাতে তুলে নিয়ে বললো হেমেন্দ্র। একবার সেটার দিকে তাকিয়ে শ্রীকান্তবাবু বললেন, "ভিনগ্রহের প্রাণীদের সঙ্গে কিভাবে যোগাযোগ করতে হয় আমার জানা নেই। তারা যদি নিজে থেকে কোনোদিন ফিরে আসে পৃথিবীতে, তাদের জিনিস তাদের হাতেই ফিরিয়ে দেবো। ততদিন না হয় এটা আমার কাছেই থাকুক।"
"পারবেন সামলে রাখতে? কোনো বিপদ হবে না তো?", উদ্বিগ্নভাবে প্রশ্ন করলাম আমি। হেসে গড়িয়ে পড়ে হেমেন্দ্র বললো, "এস.বি.এস পারবেন না এমন কাজ আবার আছে নাকি?" থতমত খেয়ে জানতে চাইলাম, "এস.বি.এস মানে?"
উত্তরটা যাকে উদ্দেশ্য করে প্রথম প্রশ্নটা করেছিলাম এবং যিনি এখন জিলিপির ঠোঙার নিচের দিকটা হাতড়াচ্ছেন, তিনি, অর্থাৎ, শ্রীকান্ত বিজয় সান্যালই দিলেন, "এস.বি.এস মানে 'সবসে বড়া সিকান্দার'।"