(এক)
তখন শেষ রাত;সূর্যের সাদাটে আভাগুলো যেন সারা রাত চেষ্টা করে খানিকটা আঁধার ভেদ করেছে।আলো এবং অন্ধকারের মায়াবী সংযোগকাল সবাইকে অপার্থিব হবার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। পুরো শহর ঘুমে অচেতন। তবে একটা গলির ভেতর কারো পদশব্দ শোনা যাচ্ছে;একটা লোক খুব দ্রুত হেটে চলেছে। অন্ধকার গলি;তবু শেষ রাতের আবছায়ায় লোকটাকে অস্পষ্টভাবে দেখা গেল;মাঝবয়সী পুরুষ,হাতে একটা ব্যাগ,হাবভাব এবং হাঁটার দ্রুততা দেখে বোঝা যায় যে লোকটা গলির নির্জনতাকে ভয় পাচ্ছে। তবে বেশি ভয় পাচ্ছে বোধহয় হাতের ব্যাগটা নিয়ে;বার কয়েক ওটা শার্টের ভিতরে লুকিয়ে ফেলতে চাইল কিন্তু শার্টটা একটা মানুষ এবং ব্যাগ, দুটোকে একসাথে ধারন করতে পারল না।
সামনে গলিটা বামে মোড় নিয়েছে। লোকটা মোড় নিতে গিয়েই একটা ধাক্কা খেল যেন।খুব দ্রুত হাঁটার সময় হঠাৎ থামা যায় না কিন্তু সে থেমে গেল আর জড়তার কারনে পড়ে গেল রাস্তায়। তাঁর কয়েক মিটার সামনেই একটা প্রাইভেটকার,এগিয়ে আসছে;হেডলাইটের তীব্র আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে কিন্তু গাড়িটা থামছে না!সে চিৎকার করে ওঠে;তীক্ষ্ণ আর্তনাদ শেষ হয় না তার আগেই দানবীয় চাকা গলার উপর দিয়ে চলে যায়।
এদিকে কোনো এক বড়লোক বাবার নেশাখোর ছেলেটা সারা রাত ফুর্তি করে মাতাল অবস্থায় বাড়ি ফিরছে। ড্রাইভিং সিটে বসে এখনও টুলছে সে। সামনে পিছনে কোনো দিকেই কিছু দেখতে পাচ্ছে না,এখনও জানে না যে কাউকে চাপা দিয়ে এসেছে। সদ্য চাপা দেওয়া মানুষটির রক্তের দাগ রাস্তায় ফেলে চাকাগুলো এগিয়ে যায়….।
(দুই)
অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙে। উঠে দেখি সাড়ে চারটা বাজে। একরাশ বিরক্তি এসে ভিড় করে মনে। তবু উঠে পড়ি;সকাল ছয়টার ট্রেন ধরতে হবে। একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছি দূরে। ফ্রেশ হই,ফুটপাথ থেকে কেনা কোট-প্যান্ট পড়ে সাহেব সাজি;ঘরের জীর্ণ আসবাবপত্র গুলো আমার সাজ-পোশাক দেখে অবজ্ঞার হাসি হাসে। ফাইল ভর্তি সার্টিফিকেট,বায়োডাটা গুছিয়ে নিই;সেগুলোর প্রতিটি অক্ষরেও আমার জন্য জমা হয়ে আছে অপমান। বেকারত্ব,অভাবের উষ্ণ নিঃশ্বাস গায়ে মেখে নিজের প্রতি নিজেরই ঘৃণা হয় মাঝেমাঝে।
বাইরে বেরিয়ে পড়ি এবার। রেলস্টেশন পর্যন্ত হেটেই যেতে হবে,ঘন্টাখানেক লাগবে হয়ত।ফজরের আজান দিতে এখনও কিছু সময় বাকি তাই বাইরেটা আধো অন্ধকারে ছেয়ে আছে। গলির ভেতর আনমনে হাটছি,মোড়ের মাথায় হঠাৎ পায়ে কি একটা ঠেকল,পা হড়কে পড়ে গেলাম। বস্তার মতো কিছু অনুভব করলাম নিচে তবে একটু খেয়াল করতেই ভুল ভাঙলো আর ভয়ানক আতংকে উঠে দাঁড়ালাম। মোবাইলের আলো জ্বেলে দেখলাম,একটা পুরুষের শরীর পড়ে আছে, মাথাটা শরীর থেকে প্রায় আলাদা হয়ে গেছে, চারপাশে জমে থাকা রক্তে চাকার দাগ অস্পষ্টভাবে উঁকি মারছে। আমার জামা,হাত সবজায়গায় রক্ত লেগে গেছে, ছিন্নভিন্ন একটা লাশের পাশে দাঁড়িয়ে নিজেকে একটা পিশাচ বলে মনে হলো। কি যেন দেখতে পেলাম আর তখনই বোধহয় একটা শয়তান সত্যি সত্যিই আমার উপর ভর করল।খুব অভাব এবং খুব বেশি ক্ষমতা দুটোই মানুষকে অনেক নিচে নামিয়ে আনতে পারে। আমার যে অভাবে স্বভাব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সেটা আজ বুঝতে পারলাম।নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছি ক্রমশ। একটা হাত আপনা প্রবেশ করল লাশের বুক পকেটে,বের করে আনল একটা মানিব্যাগ,না!বেশি কিছু পেলাম না,কয়েকটা একশো টাকার নোট পড়ে আছে সেখানে,রেগে উঠলাম। আবার আলো ফেললাম,এবার হাতে ধরা ব্যাগটা দেখতে পেলাম;নিতে গেলাম কিন্তু ওটা শক্তভাবে ধরা অবস্থায়ই আস্তে আস্তে জমে গেছে লাশের হাত। আমার ভিতরের কু-সত্তাটাও আরও উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। হাতটা পায়ের তলায় চেপে জোরে টান দিয়ে ছাড়িয়ে আনলাম ব্যাগটা। ব্যাগের হাতল ছিঁড়ে চলে এল;একটানে চেইন খুলে ফেললাম;হ্যাঁ! এবার ভিতরের জিনিসগুলো দেখে খুশি হয়ে উঠলাম,এতটাই যে আমার চিন্তা শক্তি জট পাকিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় ফজরের আজান কানে এলো;দৌড়ে আবার বাসায় ফিরে দরজা বন্ধ করে হাঁপাতে লাগালাম। ব্যাগটা থেকে সব কিছু বের করে খাটের উপর রাখলাম;নগদ অনেকগুলো টাকা এবং পুরোনো কিছু সোনার গহনা মিলিয়ে এত পরিমাণ সম্পদ একসাথে কখনো দেখিনি। সমাজ-পাহাড়ের পাদদেশে ধুলায় গড়াগড়ি খাওয়া আমি এবার চুড়ায় উঠে যাব;এতদিনের কল্পনা হঠাৎ সত্যি হয়ে উঠছে তাই সত্যিটাকেই আবার কল্পনা মনে হচ্ছে। রক্ত মাখা হাতটা মুছে তখনই গুনতে শুরু করলাম টাকাগুলো। জামা থেকে তখনও ফোটা ফোটা রক্ত ঝড়ে পড়ছে মেঝেতে..।
গোনা শেষ করে সবকিছু লুকিয়ে রাখলাম। এবার গোসল করতে হবে। বালতি ভর্তি পানি সারা শরীরে ঢেলে ঢেলে এতক্ষণের সব ক্লান্তি ধুয়ে ফেলতে লাগলাম। গোসল শেষে খাটে এসে বসলাম। ব্যাগের হাতল ছিঁড়ে লাশের হাতেই রয়ে গেছে তাই পরে আবার ঝামেলা হতে পারে এজন্য ওটা টুকরো টুকরো করে কেটে ময়লা আবর্জনার সাথে মিশিয়ে দরজার সামনে রেখে এলাম। ব্যাগটা থেকে আরও একটা জিনিস পেয়েছি;একটা ছোট্ট রুমাল,অদ্ভুত কারুকাজ করা,খুব সুন্দরও নয় আবার অসুন্দরও বলা যায় না,এক জায়গায় ছোট্ট করে একটা নাম লেখা "এম,ইউ,এন,টি,এ,এইচ,এ",বোধহয় কারিগরের নাম। কি মনে হতে রেখে দিলাম ওটা ভাগ্য পরিবর্তনের সাক্ষী হিসেবে।
(তিন)
জীবনের ভীত গড়ার মতো সরঞ্জাম যখন আমার হাতে এসেছে,ভাবলাম কিভাবে সবকিছু শুরু করব। প্রায় সবগুলো টাকা ঘুষ হিসেবে বিনিয়োগ করে ভালো মানের একটা সরকারি চাকরি জোগাড় করলাম। আমলাদের এইসব চাকরি অনেকটা আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো। এর মাধ্যমে অল্প দিনের মধ্যেই গাড়ি বাড়ি সব করে ফেলা যায়। আমারও এখন সব হয়েছে। আলিশান ফ্ল্যাট,দামি গাড়ি, বিলাসী পরিবারের বেষ্টনীতে আবদ্ধ হয়ে কবেই ভুলে গিয়েছি আগেকার দিনের কথা। যখন অভাবের দিন ছিল তখন বড়লোকদের ঘৃনা করতাম। রবিন হুডের মতো চাইতাম সব বড়লোক গুলোকে ছিড়ে ফেলতে আর এখন রবিন হুডকে একটা বর্বর ডাকাত ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারি না। জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে সবটুকু মানবীয় গুনাবলীকে অবনত করে। তবুও আমার কোনো ভাবাবেগ হয়না, বিবেকের পিছুটান কখনও কাটা বিদ্ধ করে না আমার মনকে।
(চার)
আজ অফিসে একটা মিটিং আছে,তাড়াতাড়ি যেতে হবে। বুয়াকে চা দেওয়ার জন্য ডাকলাম। অনেক্ষণ হয়ে গেল এখনও চা নিয়ে আসছে না,আবার ডাকলাম;কোনো সাড়াশব্দ নেই। বিরক্ত হয়ে রান্নাঘরে গেলাম। দেখি বুয়া দেয়ালে হেলান দিয়ে দিব্যি ঘুমাচ্ছে। জোরেশোরে একটা ধমক দিতে যাব তখনই চোখ পড়ল বুয়ার হাতে আলতোভাবে ধরে থাকা একখণ্ড কাপড়ের উপর। খুব চেনাচেনা লাগছে ওটা। আস্তে গিয়ে হাতে তুলে নিলাম। বুকটা কেঁপে উঠল। এই রুমালটা এখানে কিভাবে এল? এটার কথা তো আমি ছাড়া অন্য কেউ জানে না!আর আমার অভ্যস্ত হাতে লুকোনো জিনিসটা কারো পাবারও কথা নয়। হিসাব মিলাতে পারলাম না। রুমালটা নিয়ে তড়িঘড়ি করে একটা রুমে প্রবেশ করলাম। দরজা বন্ধ করে দিয়ে ডিজিটাল লকের মাধ্যমে আটকানো গোপন ড্রয়ারটা এক নিঃশ্বাসে খুলে ফেললাম। বিস্ময়ের ধাক্কাটা এবার আর সামলাতে পারলাম না। থপ করে বসে পড়লাম মেঝের উপর;দুই হাতে দুটো রুমাল চোখের সামনে মেলে ধরে দেখলাম, দুটোই প্রায় হুবহু এক,দুটোতেই ছোটো ছোটো করে লেখা "এম,ইউ,এন,টি,এ,এইচ,এ"! মুহূর্তেই মনে একটা সন্দেহ দানা বাধল। ড্রয়ারের জিনিসটা ড্রয়ারেই রেখে দিয়ে কোনো মতে রান্না ঘরে ফিরে দেখি বুয়া জেগে উঠেছে। কি যেন খুজছে চারপাশে। আমি হাতের রুমালটা দেখিয়ে বললাম," এটা খুঁজছো?"
:"হু,আপনি এইটা কোথায় পাইলেন?ভাইজান"
:"এইতো এখানে…রুমালটা কি তুমি তৈরি করেছ?"
বুয়া হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়ে।
:"এখানে লেখা নামটা তারমানে তোমার?"
বুয়া সলজ্জ হাসে। অবশ্য কাজের বুয়া হিসেবে এমন একটা নাম সত্যিই বেমানান। এই নামে হয়ত কেউ তাকে ডাকেও না। এবার আমার মনে উদয় হওয়া সন্দেহটা মেটানোর জন্য বেমানান একটা প্রশ্ন করলাম:"তোমার স্বামী কি করে?"
বুয়া মনে হলো কেমন যেন আনমনা হয়ে গেল, নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে উঠলো,"সে বাইচা নাই, আট-নয় বছর আগে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে।"
প্রবল মানসিক উত্তেজনা মুখমন্ডলে ছায়া ফেলার আগেই ওখান থেকে চলে আসলাম। আজ আর চা খাওয়া হলো না।
পরদিন,আরও কিছু জিজ্ঞেস করে জানলাম যে তার স্বামী সেদিন গ্রামের জমিজমা বিক্রি করে, মায়ের রেখে যাওয়া গয়নাগাটি ভাগ বাটোয়ারা করে সবকিছু নিয়ে ফিরছিল। কিন্তু গ্রামের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে তার আর ফেরা হয়নি। অবশ্য এই ঘটনার শেষ অংশটা আমি সবচেয়ে ভাল জানি। তবুও জানা কথাটা আবার জানতে চাইলাম,"তুমি সেই টাকা-গহনা গুলো পেয়েছিলে?
বুয়ার চোখে ঘৃনা এবং ক্রোধের ছাপ ফুটে উঠল,"না,খালি ব্যাগের হাতলটা পাইছিলাম, পোশম্যাডামে(পোশমর্টেমে) জানাইছে একটা জানোয়ার নাকি মরা মানুষটার হাত থিকা সবকিছু ছিনাই নিছিল।"
আমি মনে মনে বিকুন্ঠ হসি নিয়ে চিন্তা করি,আজ সেই জানোয়ারটা তোমার সামনেই দাঁড়িয়ে তোমার সাথে সহমর্মিতাপুর্ণ আলাপ জুড়ে দিয়েছে।
(পাঁচ)
এই সব জানার পর আমার হালকা অনুশোচনা ভাব এলো।
এরপরে,বুয়ার জন্য আমি বেশ ভালো অংকের দু'তিনটা সরকারি মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করে দিলাম, বেতন বাড়িয়ে দিলাম, বুয়ার একটা দশ-বারো বছরের মেয়ে আছে;পুরি-সিঙারার দোকানে কাজ করে তাকে স্কুলে পড়ার সুযোগ করে দিলাম। হঠাৎ এত দরদ উথলে উঠল কেন সেইরকম একটা সন্দেহ হতে পারে ভেবে বুয়ার সাথে সাথে আরও কয়েকটি দরিদ্র পরিবারকে কিছু সাহায্য করলাম। এতকিছু করার পর বুয়া কৃতজ্ঞতার অশ্রু ফেলে বলেছিল,"আপনার মতো মহানুভব কিছু মানুষ বেঁচে আছে বলেই পৃথিবীটা টিকে আছে।"
আমার পরিবার,অধস্তন,পরিচিত জনেরা সবাই আমার এই মানবসেবা মূলক কাজে শ্রদ্ধা জানিয়েছে তবে এত শ্রদ্ধার ভারে পিষ্ট হয়ে বিবেক আমায় অস্ফুটে বলেছে,"তুমি সুখে নেই….।"
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
অর্জন দুই ধরনের: ভালো, খারাপ। সমাজে খারাপ অর্জন নেহাত কম নয়। এই বিষয়টি মিল রাখে।
২২ এপ্রিল - ২০২২
গল্প/কবিতা:
৯ টি
সমন্বিত স্কোর
৫.৩৫
বিচারক স্কোরঃ ২.৭৫ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ২.৬ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪