মহীয়সী রেজিয়া

স্বাধীনতা (মার্চ ২০২২)

Arafat Zahan Titly
মোট ভোট প্রাপ্ত পয়েন্ট ৪.২৭
  • 0
  • ৫৬
আজ আমি এক সাধারণের মাঝে অসাধারণ, এক মহীয়সী নারীর গল্প শোনাবো।

সাদা  জবা ফুলের মতো পবিত্র আর শুদ্ধতায় ঘেরা কিশোরী এক মেয়ে,নাম রেজিয়া।নিষ্পাপ তার চোখ দুটি, সহজ সরল,মুগ্ধতায় মাখা মুখের হাসি।গায়ের রং কালো,তাতে কি হয়েছে তার মুখখানি মায়ায় ঘেরা, যেন আলোর প্রদীপ।বয়স তার তখন পনেরো কি ষোলো বধোয়।

নেত্রকোনার কেন্দুয়া থানার এক অজপাড়াগাঁয়ে এই ফুলের জন্ম। যে গ্রাম আজও আধুনিকতার ছোঁয়ার বাইরে। পরিবারের আট ভাইবোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। বাবা কৃষক, মা গৃহিণী।
রেজিয়া অত্যন্ত বুদ্ধিমতী কিশোরী,তার গায়ের রং কখনোই তাকে দমিয়ে রাখতে পারে নি,যে যুগে মেয়েদের পড়াশোনা ছিল অভাবনীয় তখন রেজিয়া মাইল পেরিয়ে গুটি গুটি পায়ে বিদ্যাবলব স্কুলে যেত।
সকল  শিক্ষক এর  আদরের ছিলো সে আপন গুনে, কখনোই ২য় হয় নি,ছেলেদের থেকেও সে ছিল এগিয়ে।
কুতুব আলী  স্যার বলতেন - রেজি তুই কালা হইলে কি হইবো,তুই অনেক মেধাবী, আমাদের গর্ব।
রেজিয়ার বাবা ভাইবোনদের মাঝে সবচেয়ে বেশি তাকেই ভালোবাসে।
মেয়ে কে চোখে হারায়।রোজ দুপুরে স্কুল থেকে আনতে যায়।
রেজিয়া বলে-
বাপজান তুমি এই কাঠফাটা রোইদের মধ্যে আমারে নিবার আইছো কেন,তোমার তো গরম লাগবো।

বাবা বলতেন-তাই কি হইছে ছাতা ছাড়া আমার মায়ের কষ্ট হইবো না, তাই আসি।
যাইবার বেলা  হাট থাইক্কা তোরে একখান  কমলা রঙের শাড়ি কিন্না দিমু।

রেজিয়া বাবার সাথে খুশিমনে বাড়ি ফেরে।
রেজিয়া ছিল দুরন্ত মেয়ে,বই পড়া আর মাছ ধরা ছিল তার নেশা।
তার মাছ ধরার নেশা ছিল মারাত্মক, শাড়ির আঁচলখানা কোমরে গুঁজে বঁড়শি নিয়ে বেড়িয়ে পড়তো, জীন-ভূত কোনো কিছু তোয়াক্কা না করে সন্ধা সাঁজে বঁড়শি ফেলতো ঝোপঝাড়ের ডোবায়।
বলা বাহুল্য সে ছিল এক দস্যি মেয়ে।

দস্যি মেয়ের দস্যিপনা আর বধোয় বেশিদিন রইলো না,বিয়ের ফুল ফুটলো বলে।গায়ের রঙ চাঁপা বলে সে মনে মনে ধরেই নিয়েছিল -বিয়াডা আমার এইবারো হইতো না,মাছ ধরায় কেউ বাঁধা দিতে পারবো না।
কিন্তু তা আর হলো না তার মায়বী চোখের প্রেমে পড়েছে একজন।
অবশেষে বিয়েটা হয়েই গেলো।।
যে জনাবের সাথে রেজিয়া বিবাহবন্ধন আবদ্ধ হয়েছে তিনি হানিফ সাহেব।দেখতে সুদর্শন,ধবধব দুধ সাদা তার গায়ের রং। বিনয়ী,নম্র,সহজ সরল প্রকৃতির লোক তিনি।
রেজিয়া ধীরে ধীরে পাকা গিন্নি হয়ে উঠেছে।তবে মাঝরাতে হানিফ সাহেব নৌকো করে তাকে নিয়ে বকশী বিলে মাছ ধরতে যায়,চাঁদের জোছনা মাখে দুজনে।দুজনে মিলে শাপলা ফুল তুলে,নিজ হাতে মালা বানায় রেজিয়া।
এভাবেই কাটছিলো দিন,হঠাৎ হানিফ সাহেবের তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনী তে সরকারি চাকরি হয়।
সেই থেকে হানিফ সাহেব নাম হয়ে যায় হানিফ মিলিটারি।
তাদের কোল আলো করে আসে প্রথম পুত্র সন্তান। হানিফ সাহেব শেখ সাহেবের পরম ভক্ত ছিলেন,তাই শেখ সাহেবের ( শেখ মুজিবুর রহমান) ছেলের নামানুসারে ছেলের নাম রাখেন কামাল।

১৯৭১ সাল ২৫ শে মার্চ বাঙালির ইতিহাসে কালরাত্রি। এইরাতে রেজিয়ার জীবনেও নেমে এসেছিল কালোরাত।চট্টগ্রাম ক্যান্টোনমেন্ট এ হামলা করে পাকিস্তানিরা,আটক করা হয় বাঙালি সৈন্যদের,গ্রেফতার করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব কে।পাকিস্তান সরকার তাদেরকে পাকিস্তান এ পাঠিয়ে দেয় ।এদের মধ্যে হানিফ সাহেব ছিলেন একজন।

এদিকে দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, রেজিয়া কোলে শিশু সন্তান কামাল।স্বামী নিরুদ্দেশ। টেলিগ্রামের উত্তর আসে না,চিঠির জবাব পায় না।মাস যায় হানিফ সাহেবের খবর নাই।
রেজিয়ার বাপজান আসে নাতি আর মেয়েকে নিতে,কিন্তু রেজিয়া স্বামী ভিটে ছেড়ে যেতে নারাজ। অবশেষে নিরুপায় হয়ে বাড়ি ফেরে রেজিয়ার বাবা।
চারদিকে অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে, গ্রামে মুক্তি বাহিনী গড়ে উঠেছে। রেজিয়া একা ভুতুড়ে বাড়ি পাহারা দেয়,চারদিকে ঘন বাঁশের ঝোপ,মাঝখানে তার ঘর।সারাদিনও দেখা মিলে না কারও,এমনিতেই অনেকেই ভারত পাড়ি দিচ্ছে। মাঝেমধ্যে এক দুজন ভিখারিনীর দেখা মেলে কষ্টে, যেন ডুমুরেরফুল। নতুন শাড়ি কিংবা এক সের চালের বিনিময়ে রাজি হয় রাতখানা রেজিয়া সাথে থাকতে।
এ পড়া বাড়ি রেজিয়া একাই আগলে রেখেছে। মুক্তি বাহিনী দের মাঝরাতে আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেছেন।নিজ হাতে রান্না করে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের ক্ষুধা নিবারণ করেছেন।

এভাবেই কেটে যায় দীর্ঘ নয় মাস।দেশ স্বাধীন হয়।আবারো বাপজান আসে রেজিয়াকে নিতে,নতুন জায়গায় সংসারের কথা বলেন কিন্তু রেজিয়া রাজি হয় না,ফিরিয়ে দেয় বাবাকে।
কারণ রেজিয়ার সৃষ্টিকর্তা প্রতি অগাত বিশ্বাস। হানিফ সাহেব মারা গিয়েছেন সবাই ধরে নিলেও রেজিয়া তাঁরই অপেক্ষার প্রহর গুনে।

অবশেষে ১৯৭২ সালে রেজিয়ার নামে চিঠি আসে,যা থেকে সে বুঝতে পারে হানিফ সাহেব জীবিত।তার চোখে আনন্দ অশ্রু আসে।শেখ সাহেব দেশে প্রত্যাবতর্ন করেন,সেই সাথে বাঙালি সৈন্যরাও।
ফিরে আসেন হানিফ সাহেব,,সে দিনটি ছিল রেজিয়ার জন্য অত্যন্ত সুখের, যা ব্যাখ্যাহীন।

সাল ২০২১,হানিফ সাহেব মারা গিয়েছেন এক যুগ পার হয়ে গেছে। রেজিয়া হানিফ সাহেবের পুরোনো ছবিটি আঁচল দিয়ে মুছে।
আর ছবির সাথে কথা বলেন-

কামালের বাপ তুমি বড় পাষান, আমারে একলা ফালায় চইল্লা গেলা।আমগোর তিন সন্তান আইজ স্বাবলম্বী। কামাল তোমার মতোই সাহসী, বীর।বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসার। তোমার মাইয়াও উচ্চশিক্ষিত হইছে, বিয়ে দিছি যোগ্য পাত্রের লগে,মাইয়াও বেশ সুখী। ছোটো ছেলে জামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থাইক্কা ডিগ্রী আনছে।
সবাই অনেক সুখী।তুমি খালি আমারে ফাঁকি দিয়া চইল্লা গেলা।

চশমার আড়ালে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে রেজিয়ার বেগমের।
ছেলেমেয়েদের মধ্য দিয়ে রেজিয়া নিজের সপ্নগুলোকে পূরন করেছেন।
তিনি আমার চোখে একজন সার্থক অর্ধাঙ্গিনী, সার্থক মা,একজন মহীয়সী নারী।
হাজারো রেজিয়ার ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
বিষণ্ন সুমন সুন্দর লেখা। বিষয়বস্তুর সাথে দারুণভাবে এগিয়ে গেছেন। এখানেই আপনার মুন্সীয়ানা। কীপ ইট আপ সীস।
ফয়জুল মহী সুন্দর প্রকাশ বেশ ভালো লাগলো

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

গল্পটির মূল চরিত্র রেজিয়া।যার মধ্য দিয়েই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এক সাহসী নারীর কাহিনী ফুটে উঠেছে। রেজিয়া মধ্য দিয়েই তখনকার মা বোনের আত্মত্যাগ, মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা নানান বিষয় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্বামী নিখোঁজ এক নারীর বেঁচে থাকার লড়াই , স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আত্মত্যাগী মায়ের প্রতিচ্ছবি হলো রেজিয়া।১৯৭১ সাল ২৫ শে মার্চ বাঙালির ইতিহাসে কালরাত্রি। এইরাতে রেজিয়ার জীবনেও নেমে এসেছিল কালোরাত।চট্টগ্রাম ক্যান্টোনমেন্ট এ হামলা করে পাকিস্তানিরা,আটক করা হয় বাঙালি সৈন্যদের,গ্রেফতার করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব কে।পাকিস্তান সরকার তাদেরকে পাকিস্তান এ পাঠিয়ে দেয় ।এদের মধ্যে হানিফ সাহেব ছিলেন একজন। এদিকে দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, রেজিয়া কোলে শিশু সন্তান কামাল।স্বামী নিরুদ্দেশ। টেলিগ্রামের উত্তর আসে না,চিঠির জবাব পায় না।মাস যায় হানিফ সাহেবের খবর নাই। রেজিয়ার বাপজান আসে নাতি আর মেয়েকে নিতে,কিন্তু রেজিয়া স্বামী ভিটে ছেড়ে যেতে নারাজ। অবশেষে নিরুপায় হয়ে বাড়ি ফেরে রেজিয়ার বাবা। চারদিকে অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে, গ্রামে মুক্তি বাহিনী গড়ে উঠেছে। রেজিয়া একা ভুতুড়ে বাড়ি পাহারা দেয়,চারদিকে ঘন বাঁশের ঝোপ,মাঝখানে তার ঘর।সারাদিনও দেখা মিলে না কারও,এমনিতেই অনেকেই ভারত পাড়ি দিচ্ছে। মাঝেমধ্যে এক দুজন ভিখারিনীর দেখা মেলে কষ্টে, যেন ডুমুরেরফুল। নতুন শাড়ি কিংবা এক সের চালের বিনিময়ে রাজি হয় রাতখানা রেজিয়া সাথে থাকতে। এ পড়া বাড়ি রেজিয়া একাই আগলে রেখেছে। মুক্তি বাহিনী দের মাঝরাতে আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেছেন।নিজ হাতে রান্না করে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের ক্ষুধা নিবারণ করেছেন। গল্পটির এই চিত্রটি তেই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সম্পর্কিত বিষয় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তিনি আমার চোখে একজন সার্থক অর্ধাঙ্গিনী, সার্থক মা,একজন মহীয়সী নারী। হাজারো রেজিয়ার ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা।

১১ ফেব্রুয়ারী - ২০২২ গল্প/কবিতা: ১ টি

সমন্বিত স্কোর

৪.২৭

বিচারক স্কোরঃ ১.৮৭ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ২.৪ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪