অতি বাস্তব কিংবা মায়া

ভয় (সেপ্টেম্বর ২০২১)

Zahid
মোট ভোট প্রাপ্ত পয়েন্ট ৫.১
  • 0
  • ৪৯
রাত প্রায় দুইটা বাজে। অনেক দিন পর আজকে একটা বই পড়তে বসলাম। শুরু করেছি বারটার দিকে। পড়তে পড়তে এখন দুইটা বাজছে। তাও শেষ হচ্ছে না। বই পড়ার আমার কোন নেশা নেই। তবে ভালো বই হাতে পেলে শেষ না করে কিছুতেই উঠতে পারি না। আজও একটা ভালো বই হাতে এসেছে। তাই শেষ না করে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না।
এমন সময় হল লোড শেডিং। আমার পড়ায় পড়লো ছেদ। কিছু করার নেই। আবার উঠে গিয়ে বাতি জ্বালিয়ে আনবো সে ইচ্ছা হচ্ছে না। তাই অন্ধকারেই বসে থাকলাম।
আমাদের দেশের বিদ্যুৎ অফিসের লোকজন আসলে খুবই ভালো করে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিতে পারেন। বৃষ্টি শুরু হওয়ার ঠিক আগেই তারা লোড শেডিং করেন। আকাশে মেঘ দেখলেই লোড শেডিং হয়।
বাইরে মেঘলা আকাশ, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বাতাসও বইছে। পর্দটা একটু ফাঁক করে দিলাম। পাশ থেকে টুল এনে জানালার সামনে বসলাম। বেশ ভালোই লাগছে। আকাশটা মেঘলা হলেও এর আড়ালে চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় মোটামুটি সবই দেখা যাচ্ছে। মেঘ আসার ঠিক আগ মুহূর্তের সময়টা সত্যিই অসাধারণ। কয়দিন ধরে একটা বদ অভ্যাস করে ফেলেছি। জানি অভ্যাসটা খারাপ। তবুও সেটা করে ফেলেছি। শখের বসেই শুরু করেছিলাম। এখন আর ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। কী করবো আর? শাসন করার কেউ নেই, কিছু বলার কেউ নেই। একা মানুষ, কে কী বলবে?
তাই অভ্যাসবশত পাশের টেবিলের ড্রয়ার থেকে সিগারেট বের করলাম। লাইটার পকেটেই ছিল। সেটা বের করে খুব সাবধানে সিগারেটটা ধরালাম। কিছু ধোঁয়া ছাড়লাম। এশট্রে কোথায় জানি না। এই অন্ধকারে উঠে খুঁজেও পাব না। তাই মেঝেতেই সিগারেটের ছাই ফেললাম। দামি সিগারেট। নিকোটিন, টার নেই বললেই চলে। শুধু ধোঁয়া উড়াবার জন্যই খাই। এ অন্ধকারে চাঁদের আলোয় ধোঁয়ার ছায়া দেখা যাচ্ছে। বুঝা যাচ্ছে ধোঁয়া যে ছাড়ছি। ভালোই লাগছে।

হঠাৎ পেছনে কিসের আওয়াজ এল। কারো পায়ের শব্দ পাচ্ছি মনে হল। ঘরে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। তাই পায়ের শব্দ পাওয়া মানে 'ভূত'!
মনে মনে ভয় পেলাম না। কারণ একা থাকি, কত কিছুই শুনি। কখনো পায়ের শব্দ, কখনো কারো কান্না। ছাদে প্রায়ই অনেক রকম শব্দ শোনা যায়। তাই ওসব নিয়ে তেমন মাথা ব্যথা হয় না। এজন্য সমানে সিগারেট ফুকে গেলাম।
কিছুক্ষণ পর পায়ের শব্দ আরও কাছে শোনা গেল। শব্দটা বেশ পরিচিত লাগছে। যেন এ শব্দটা অনেক দিন ধরেই শুনছি, অনেক আগে থেকেই চিনি।
এক সময় ওঘর থেকে কে যেন একটা মোমবাতি হাতে এদিকে এল। এসে এঘরে প্রবেশ করলো। পেছন থেকে বলল, এখন এসবও শুরু করে দিয়েছো?
কণ্ঠটা আমার খুবই চেনা। কথাগুলোও অনেক শুনেছি। এবং কথাটায় বেশ বিব্রতই হলাম। আস্তে করে সিগারেটটা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেললাম। মুখে যা ধোঁয়া ছিল তাও ওপাশে ফু দিয়ে ছেড়ে দিলাম। জানি এ চেষ্টাটা বৃথা। যা জানার জেনে ফেলেছে। তবুও মনকে একটু শান্তি দেওয়া আরকি। বললাম, ভালো আছো, কেয়া?
কেয়া আমার পাশের টুলে এসে বসতে বসতে বলল, আমার আর ভালো থাকা! তুমি এসব করলে কি আমি ভালো থাকি?
আমি আরও বিব্রত হলাম। বদ অভ্যাসটা ছেড়ে দিলেই পারতাম। শুধু শুধু কথা শুনতে হচ্ছে। আমি নীরব থাকলাম। ধোঁয়া কিছু রয়ে গিয়েছিল। সে আঁচল দিয়ে মুখ চেপে বলল, ইশ, এসব কীভাবে খাও, বল তো? আমার তো দম বন্ধ হয়ে আসছে।
একটু থেমে বলল, তুমি ভালো তো?
আমি কেবল হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। কিছু বলতে গেলাম না। বললে হয়তো আবারও কিছু বলে লজ্জা দিবে। কেয়া কিছু বলার অপেক্ষা করলো না। বলল, এত রাত ধরে জেগে আছো যে, কাল অফিসে যাবে না?
অফিস আমার আছে, যাবও। তবে বইটা পেয়ে আর ঘুমাতে যেতে পারলাম না। আজকে শেষ করতেই হবে। তাই বললাম, রাতে না ঘুমালে বুঝি অফিস করা যায় না?
কেয়া একটু রাগ করে বলল, তা যায়। কিন্তু পরে যে শরীর খারাপ করবে, তখন কে টানবে তোমাকে?
আমি হেসে বললাম, কেন? এত এত হাসপাতাল, এত এত ডাক্তার কেন আছে? তারা আমাকে পেলে আরও খুশি হয়ে সেবা যত্ন করবে।
কেয়া রাগ করলো। অভিমান করে বলল, ঠাট্টা করবে না। আমি সিরিয়াসলি বলছি। এসব করলে কীভাবে হবে? নিজের প্রতি খেয়াল তো রাখবে।
আমি বললাম, রাখি তো।
কেয়া টেবিলে রাখা সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিয়ে বলল, এই তোমার খেয়াল রাখা?
তার কপালের রেখায় ভাঁজ পড়লো। প্যাকেটটা মাটিতে ফেলে বলল, আর কত? এখন একটু নিজের খেয়াল নাও। একটু ভালো হয়ে চল।
কথাটার কোন উত্তর দিলাম না। নীরবে বসে থাকলাম। পাশে কেয়া উত্তর না পেয়ে মুখ ফিরিয়ে বসে থাকলো। আমাকে নিয়ে কেয়ার এত চিন্তা নতুন না। সব সময়ই আমাকে নিয়ে সে চিন্তা করে। আর উল্টাপাল্টা কিছু করলে সমানে বকে, রাগ করে। তাই আজ তার কথায় মোটেও অবাক হলাম না।

বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। জানালা দিয়ে একটু একটু বৃষ্টির পানিও আসছে। আমি গিয়ে তাড়াতাড়ি করে জানালা লাগালাম। এসে যখন বসবো তখন কেয়া বলল, তুমি এত খারাপ কেন?
কণ্ঠে একটা অভিমান স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। উত্তরে আমি কিছু বলতে পারলাম না। সে উত্তরের অপেক্ষাও করলো না। বলল, আমার কোন কথা শুনো না। আমি কি তোমার কেউই না?
এবারও কোন উত্তর দিতে পারলাম না। এসে আস্তে করে তার পাশে বসলাম। তার হাতটা আমার হাতে নিলাম। সে আমার দিকে ফিরল। তার চোখ ছলছল করছে। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলল, আমার একটা কথা রাখবে?
আমি বললাম, বল।
বলল, তুমি আরেকটা বিয়ে করে ফেল।
জানি কথাটা সে সিরিয়াস হয়েই বলেছে। তবুও তার কথাটা আমি হেসেই উড়িয়ে দিলাম। বললাম, সতীন দেখার এতই শখ?
কথাটা শুনে তার খুব রাগ করার কথা। আমি ভেবেছিলাম আমাকে বকবে। সে শান্ত গলায় বলল, তোমাকে নিয়ে আমার খুব চিন্তা হয়, জানো? একা থাকো, কী করো, খাওয়াদাওয়া ঠিকঠাক মতো করো না। তোমার কিছু হলে কে দেখবে? খেয়াল রাখার জন্য তো একটা মানুষ দরকার হয়।
আমি স্বাভাবিক ভাবেই বললাম, ভালোই তো আছি। ওসবের দরকার কী? এতদিন তো একাই ছিলাম। কিছু হয় নি। তুমি এত চিন্তা করো না তো, আমার কিছু হবে না।
কেয়া একবার আঁচলে চোখ মুছলো। আমি সেটা দেখেও না দেখার ভান করলাম। বললাম, আর আমার এখন বয়স হয়েছে না? আমাকে কে মেয়ে দিবে? বলবে বুড়া। এ বয়সে আবার কেউ বিয়ে করে?
উত্তরে কেয়া কিছুই বলল না। একটু সময় নীরব থাকলো। তবে টের পেলাম আমার হাতে তার যে হাতটা ছিল তা দিয়ে আমার হাতটা সে একটু শক্ত করে ধরলো।
এভাবে কিছু সময়ের নীরবতা কেয়া নিজেই ভাঙলো। বলল, আচ্ছা, তুমি যে একা থাকো, তোমার ভয় করে না?
আমি না সূচক মাথা নাড়লাম।
ভয় আমার করে না সেটা ঠিক। এর কারণও আছে। সাবাই জীবনে কিছু না কিছুকে ভয় পায়। কেউ ভূতকে ভয় পায়, কেউ বা অন্য কিছুকে। কিন্তু যখন তার ভয়ের জিনিসটা তার সামনে এসে যায় তখন ভয়টা সেভাবে আর কাজ করে না। মানুষ অজানাকে ভয় পায়, যা দেখেনি তাকে ভয় পায়। ভূতকে কেউ দেখে না বলেই ভূতের ভয় থাকে। ভূতকে যদি সবাই দেখতে পারতো তবে তাকে নিয়ে এত ভয় কারো হত না। আমিও আমার ভয়কে দেখে ফেলেছি। যা নিয়ে আমার ভয় ছিল তা আমার সামনে এসেছে।
কেয়া বলল, আচ্ছা সত্যি করে বলো তো, তুমি জীবনে কখনো খুব বেশি ভয় পেয়েছো?
এবারও আমি না করলাম। জানি সেটা মিথ্যা। ভয় আমি পেয়েছি। কেয়ার ডেলিভারির দিন আমি সম্ভবত জীবনের সব চেয়ে বেশি ভয় পাই। ডাক্তার বলেছিল, মা-সন্তান দুজনের অবস্থাই খুব খারাপ।
তখন এত ভয় পেয়েছিলাম যেটা আমি বলে বুঝাতে পারবো না। কারণ কেয়াকে হারাতে চাই না। আর হারানোটা যে কী সেটা ভেবেই এত ভয় পাই।

কিন্তু আমার সব ভয় কেটে যায়, যখন ডাক্তার এসে আমার কাধে হাত রেখে বলেছিল, আমরা যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করেছি। কিন্তু কাউকে বাচাতে পারিনি। আই এম সরি ফর ইয়োর লস।
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লেও ডাক্তারের এ কথাগুলো যেন আমার সব ভয় দূর করে দিল। কেয়া নেই। আমাকে ছেড়ে এভাবে চলে যাবে সেটা কোন দিনই ভাবিনি। কিন্তু এখন যখন চলেই গেল তখন আমি কী নিয়ে ভয়ে থাকবো? চোখ দিয়ে এক ফোটাও পানি বের হল না। সবাইকে খবর দিলাম, হসপিটালের যত ফরমালিটি ছিল শেষ করলাম, দাফন কাফনের ব্যবস্থা করলাম। এক দিক দিয়ে যেমন ব্যস্ত ছিলাম অন্য দিক দিয়ে শক্তও হয়ে গিয়েছিলাম। বুকের ভেতর কথ ব্যথা, কত কষ্ট ছিল। কিন্তু কিছুই বের হল না।
অবশেষে দাফন শেষে বাড়িতে এসে আর থাকতে পারলাম না। কান্নায় ভেঙে পড়লাম।

আজ পাঁচ পাঁচটা বছর এভাবেই চলে গেল। একা একা থাকাটাও ভালই শিখে ফেলেছি। এখন মানুষের মাঝে গেলে বিরক্ত হয়ে যাই। কেমন যেন লাগে। মনে হয় যেন ছুটে পালাই।
ঘরে থাকতে থাকতে মনে হয় পাগলই হয়ে গেছি। মৃত বউকে দেখা, কথা বলা, তার সাথে ঝগড়া করা নিশ্চয়ই কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের কাজ না। সেটা আমিও জানি। এজন্য একজন সাইকায়াট্রিসের এপয়েন্টমেন্টও নিয়েছিলাম। কিন্তু যাওয়া হয় নি। ভয় হয়, যদি উনি চিকিৎসা করে তবে তো কেয়াকেও আর দেখতে পাব না। একবার বাস্তবে তাকে হারিয়েছি, এবার কল্পনা থেকেও কি সে হারিয়ে যাবে?

কেয়াকে বললাম, চল বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখি।
উত্তরের অপেক্ষা না করে তাকে নিয়েই বারান্দায় গেলাম। ইজি চেয়ারটায় বসলাম। সে পাশের চেয়ারে বসলো। তার হাতটা আমার বুকের মধ্যে টেনে নিলাম। ঠান্ডা বাতাসে এত আরাম লাগছিল, কখন ঘুম চলে এল বলতেও পারলাম না। ঘুম ভাঙলো ভোরে। ভোরের রোদ এসে আমার চোখে পড়ছে।
কোন সময় ঘুমিয়ে পড়েছি বলতেও পারি না। আর কেয়া কোন এক ফাঁকে আমার গায়ে একটা চাদর দিয়ে সেটা বুক পর্যন্ত টেনে কোথায় যেন মিশে গেল, টেরও পেলাম না।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ নুরেআলম সিদ্দিকী প্রাণঢালা অভিনন্দন ভাই
মোকাদ্দেস-এ- রাব্বী দারুণ লিখেছেন। পড়ে খুব ভালো লাগল
ফয়জুল মহী অনেক সুন্দর লেখা
ভালো লাগেনি ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১
ধন্যবাদ, ইনশাআল্লাহ আরও ভালো লেখা উপহার দেব, দোয়া করবেন।
ভালো লাগেনি ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১

২৬ জুলাই - ২০২১ গল্প/কবিতা: ১ টি

সমন্বিত স্কোর

৫.১

বিচারক স্কোরঃ ২.১ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ৩ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪