বাঁশঝাঁড়ের নীচের নাবাল জমিটুকু অবশেষে সেটেলম্যান রেকর্ডে এবার আরমান প্রমাণিকের নামে নথিভূক্ত হবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জবেদা, কতো সাধ্যি-সাধনায় আজকের দিনটা ধরা দিয়েছে তার সামনে। বুকের মধ্যে আনন্দ কলবল করে তার এখন কাতলা মাছের মতো। নাবাল ধানী জমি, বছরে দু’দুটো সোনা-সোনা ধান, ধানের সুঘ্রাণে মনটা কেমন নেচে ওঠে অকস্মাৎ। নতুন ধান, নতুন দিন, নতুন জমি, নতুন স্বপ্ন আর নতুন সূর্য যেন প্রতিনিয়ত ধরা দেয় নিকোনো উঠোনে। বাঁশঝাঁড়ের পাতারা ঝিরিঝিরি বাতাসে খেলে যায় যেমন ভাবে, নদীর মতো নিরবধি সুর ধরে মনের আনন্দ বাতাসের সঙ্গে মিশে যায়।
আরমান প্রামাণিকের চোখেও স্বপ্ন দোলে, বয়সটা এখনো স্বপ্ন দেখার মতো হয়নি কিন্তু মায়ের স্বপ্নবীজ তাকেও বেশ আবিষ্ঠ করে। নাবাল জমিটুকু অনেককাল আগে আরমানের বাপ সোলায়মান প্রামাণিকের বাপ সোহরাবের দলিল পত্রেই সংযুক্ত ছিলো, শরীকে-শরীকে ভাগ বাটোয়ারা হওয়ায় অন্যের হাতে চলে যায়, অন্যের হাতে মানে আরেক ভাগ্যে আটকে যাওয়া। এতোকাল পরে হাত বদল হয়ে ক্রয় সূত্রে মালিক বনে যায় আরমান।
জবেদা স্থির নয়নে তাকিয়ে দেখে দূরের রঙ করা আকাশ। একমাত্র ছেলেকে নিয়েই তার তাবৎ স্বপ্ন-সাধ-আহলাদ, স্বামী বেচারি এখনো জেল-হাজতে পঁচে মরছে, বারো বছরের সাজা শেষ হতে এখনো সারে চার বছর অপেক্ষা করতে হবে, জমি-জিরাত বা মাটি হলো কৃষকের প্রাণ, জমি বা মাটি না থাকলে কৃষকের থাকেটা কি আর ! সোলায়মান হেলে চাষা না হলেও জমি নির্ভর তার জীবন। তারপর জমি মানুষকে অন্ধ করে দেয়, আল ঠেলতে-ঠেলতে মানুষ যেমন পরের জমি জবর দখল বহাল করতে চায়, তেমনি ওপর মহলে টাকা খাইয়ে অন্যের জমি দখল করবার আগেই সেটেলম্যান রেকর্ডে নথিভুক্ত করে নেয়। কিন্তু জমি যার হকের সে কেনো মানবে, লংকাকান্ড বাঁধবেই !
সোলায়মান প্রামাণিকের বাঁশের আঘাতেই শেষ পর্যন্ত মেনহাজ তালুকদারের মরণ, শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়েই প্রাণ খুলে মেরেছিলো মাথার ওপর, জমি দখলের সাধ্যি মিটিয়ে দেয়, সাতগাঁয়ের লোকের সামনেই ধড়ফড়িয়ে মরলো মেনহাজ তালুকদার। বিচারে রায় হলো বারো বছর জেলবাস, মৃত্যুদন্ড থেকে কি ভাবে ছাড়া পেলো এটাও একটা প্রশ্ন গাঁয়ের লোকের মুখে-মুখে, মেনহাজ তালুকদারের আজন্ম স্বভাব ছিলো লোকের জমি দখল, নামমাত্র মূল্যে টিপসই দিয়ে ছিনিয়ে নেওয়া, এমন কি আল ঠেলে-ঠেলে নিজের জমির পরিধি বাড়ানোও তার অভ্যাস। মানুষজন অতিষ্ট ছিলো তার অত্যাচোরে, আর তাই তেমন স্বাক্ষী না পাওয়ায় মেনহাজ তালুকদারের খুনী আসামী সোলায়মান প্রামাণিকের মৃত্যুদন্ডের পরিবর্তে বারো বছরের জেল বাস হয়।
জবেদা বাড়ির উঠোনে শুকোতে দেওয়া নতুন জমি থেকে ওঠা আলু বস্তায় ভরতে-ভরতে আগামী দিনের স্বপ্নে উচ্ছল হয়ে ওঠে। আরমান দিনে দিন নওজোয়ান হয়ে উঠছে, ঠিক যেন নতুন ওঠা ধানের লকলকে শীষগুচ্ছ।
মাঘের সকালের মিষ্টি রোদে আলু বস্তাবন্দি করতে-করতে জবেদা ফেলে আসা পেছনের দিনগুলোর কথা স্মরণ করে আপন খেয়ালে। নতুন বউ হয়ে যখন আসে এ’ বাড়ির চৌকাঠে, ভাঙাচোরা বাস্তুভিটা বৈ তো কিছুই ছিলো না তেমন, আর ছিলো সারাদিনের অভাব নামের রাক্ষসটা বাড়ির চারপাশে, একে তো জবেদা বাপের বাড়িতে দেখেছে অভাব, স্বামীর বাড়িতেও সেই অভাব, অভাব যেন পিছু নিয়েছে জীবনভর,আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে তাকে। বাপ-ভায়েরা ধীবর, মাছ ধরাই জীবনের একমাত্র পেশা, বাপের দেশের মানুষগুলো কোনোদিনও আর হয়তো ধীবরের আচ্ছাদন বা খোলস ছাড়তে পারবে না। কাঞ্চনপুরের মানুষেরা ইচ্ছে করেই যেন বা অভাবকে নিমন্ত্রণ করে ঘরে রেখেছে, তাছাড়া কি ভাবে অভাবকে তাড়াতে হয় তাও জানে না। জবেদা জন্ম থেকেই কষ্ট আর দুঃখ এবং অভাব বৈ তো সুখ-স্বাচ্ছন্দ দেখেনি।
আজ তার উঠোনে সুখের ছড়াছড়ি, স্বামী জেলে গেলেও সংসারে এতোটুকু কষ্ট-ক্লেদ নেই, শুধু একটু দুঃখ মানুষটার জন্য, কিন্তু কি আর করা জীবন-যাপন তো করতে হবে। একমাত্র ছেলেটাই জবেদার স্বপ্ন-আকাঙক্ষা।
মাঝরাত্রে জবেদা আলো ঝলমলে উঠোনে এসে দাঁড়ায়,তামাম দুনিয়া পূর্ণিমার আলোয় ভরে আছে, সমবায় থেকে লোন নিয়ে আজ একটু-একটু সাবলম্বী হয়ে উঠেছে, পাশের বাড়ি চাচাত দেবর রবিউলের, কখনো-সখনো খুচরো-খাচরা আলাপ করতে আসে। জবেদা তেমন একটা পাত্তা দেয় না কখনো, সোলায়মান প্রামাণিকের জেল হওয়ার সময় রবিউল একবার কানপড়া গিয়েছিলো, ভাবী তুমি কি বারো বছর অপেক্ষা করবে ?
হ্যাঁ করবো সে তো আমার স্বামী-
না মানে আরমান তো এখনো অনেক ছোট আছে, তোমাকে সঠিক চিন্তা করতে হবে, কি বলো উচিৎ নয় কি !
কি চিন্তা মানে খোলসা করে বলো তো ?
কি আর বলবো, তুমি চাইলে আমি তোমাকে ঘরে তুলতে সম্মত আছি...
জবেদা তারপর আর কথা বলতে চায়নি ওর সঙ্গে, রবিউল বয়সে হয়তো একটু ছোটই হবে জবেদার চেয়ে, কিভাবে যে ওমন একটা কথা মুখে আনলো ভেবে পায় না। আজো কথাটা স্মরণ করলে হাসি পায় জবেদার। রবিউল একটা নছিমন চালায়, তুকিপুরের তোরাব দেওয়ানের রি-কন্ডিশন নছিমন, কেনার পরই রবিউলকে ভাড়া দেয় আয়-রোজগার ভালোই হয়। বছর দুয়েক আগে বিয়েও করেছে, আমঘাটার আতিক মৌলবির ছোট মেয়েকে, ভালোবাসার বিয়ে না বলে আতিক মৌলবি সামাজিক বিয়েই বলতে বেশি পছন্দ করে, যৌতুক- ফৌতুকও দেয় যৎসামান্য, তাতে অবশ্য রবিউলের এতোটুকু কষ্ট নেই। ভালোবাসা না থাকুক ওর মধ্যে, দৈহিক মিলনের একজন সঙ্গি তো জুটেছে, যাকে নিয়ে শারীরিক আনন্দ উপভোগ করবে দিনরাত্রি।
জবেদার ওপর বরাবরই ক্ষোভ আছে রবিউলের, বড় চাপা স্বভাবের বলেই আন্দাজ করা কঠিন। বউটাও বেশ মিশুক, কদাচিৎ ছুটে চলে আসে, জবেদার সঙ্গে গলায়-গলায় সম্পর্ক, সমিতি-টমিতি করেছে আবার। ওপাড়ার হায়াত আলীর ভাগ-বাটোয়ারায় পড়া ধানী জমিটুকু কিনবে বলে শলা-পরামর্শ চলছে অনেকদিন থেকেই, রবিউল কিনবে কথাটা কাকলি জানায় সেদিন খুউব গোপনে।
আরমান বাপের মুদি দোকানটাই বসে, বেচা-বিক্রি নেহাৎ মন্দ নয়, গায়ে গায়ে বাড়ি-ঘর মানুষজনের, শুধু ওই হাটবাজারের দিকে তাকিয়ে তো আর জীবন চলে না, অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে হয় কদাচিৎ, আর সে কারণে সওদাপাতি করতে হয় অনেকটা মুদি দোকান থেকেই, আরমানের দোকানে নিত্য প্রয়োজনীয় সকল কিছুই আছে, আর আছে বলেই লোকজনের ভিড়ভাট্টা বেশি। জবেদাও সময়ে-অসময়ে তদারকি করে, রবিউলের চোখে লাগে অনুমান করা যায়, কোনো ভাবে জব্দ হলো না তাহলে মনে-মনে ভাবে।
আরেকদিন মাঝরাত্রে রবিউল পরিকল্পনা আঁটে যেভাবেই হোক জবেদাকে বিপদে ফেলতে হবে, দীর্ঘদিনের ক্ষোভের আগুন দাউ-দাউ করে জ্বলে ওর চোখে-মুখে। যেভাবে এখনো স্থির আছে জবেদা, না জানি আর কতো জমি-জিরাত কিনে ফেলবে একে-একে এ’ গাঁয়ের, বাপ-দাদার জমি-জিরাত ভাগ-বাটোয়ারা হবে আর সে সুযোগে জবেদা কিনবে ছলচাতুরি করে সবার নাকের সামনে।
বুকের মধ্যে অনেক আগুন জ্বলে ওঠে একসাথে রবিউলের, মেনহাজ তালুকদারের খুনের আসামী সোলায়মান প্রামাণিকের বউ দেশগ্রামের মাথা হতে চায় কিসের ভরসায়, মন মেজাজ বিগড়ে যায় রবিউলের, নিজের ভেতর নিজেই যুদ্ধ করে দিবানিশি, তারপর কি হবে আর, কোথায় যাবে সে, শূন্য লাগে চারদিক, এমন ভাবে বাঁচা মানে তো পরাজয়কে মেনে নেওয়া, সে তো কোনোভাবে সেই সুদূর পরাজয়কে মেনে নিতে পাবে না, কেনো নিচে পড়ে থাকবে, এমন অপমান নিয়ে বেঁচে থাকতে তার আর ইচ্ছে হয় না !
পরের জমির আল ঠেলে-ঠেলে মেনহাজ নিজের জমির পরিধি বাড়াতো বলে খুন হতে হয়েছে, কেউ তো এভাবে প্রতিবাদ করেনি কোনোদিন, কেনো সোলায়মান খুনটা করলো নিজের হাতে, এর মধ্যে কি অন্য কোনো কারণ আছে । সুন্দরী বউ জবেদার সাথে কোনো লটরফটর সম্পর্ক ছিলো কি না কে জানে ! হয়তো তা শুধু ওদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো ব্যাপারটা, এমনও তো হতে পারে, কেনো তবে আল ঠেলার অপরাধে মেনহাজকে খুন করলো ওই জবেদার স্বামী !
তবে সে যাই হোক না কেনো, এখন তো কেসটা অন্য দিকে মোড় নিচ্ছে, যেভাবে বেঁচাকেনা শুরু হয়েছে তাতে সারে সর্বনাশের আর বাকি কোথায়, একটা সময় আসবে জবেদা এবং ওর ছেলে আরমান পরের জমিকে নিজের জমি বলবে, এমন কি রাতারাতি সেটেলম্যান রেকর্ডে নথিপত্র করিয়ে নেবে। টাকা ঢাললে কি না হয় আজকাল, সবই তো দেখছে খোলা চোখে রাতদিন, দেখার আর বাকি আছে কি। তবে দিনেদিন যেভাবে গায়েগতরে বেড়ে উঠছে ওরা তাতে সহ্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে প্রতিদিন, যেভাবে হোক একটা দফারফা না করলেই নয়।
জবেদার সঙ্গে নয়াপাড়ার রহমান ঠিকাদারের আবার কেমন ধরণের আত্মীয়তা রয়েছে, রহমান যতোই ভালো মানুষ হোক না কেনো কডে বা দাদনে জমি নিয়ে নিজের আলমারিতে পরের দলিলে ভরেছে ভালোই। জবেদার যতো শত বুদ্ধি সবই রহমান ঠিকাদারের, হাঁস-মুরগী-গরু-ছাগল-সমিতি-কিস্তি-আলুচাষ লিজ-কড বা দাদন ব্যবসা সবই করেছে রহমানের কথায়। ওরই বা কি এমন স্বার্থ আল¬া মালুম, এতো বুদ্ধি দেওয়ার পেছনে নিশ্চয় কোনো লাভ তো আছেই। অনেক কথা মনে এলেও অংক মেলাতে পারে না কোনোভাবে। রাগটা তখন আরো বেড়ে যায়, মাথার ভেতর কেমন যেন চিনচিন করতে থাকে। সব কিছু আগুনে ছাড়খার করে দিলেই বুঝি নিস্তার।
আতিক মৌলবি ভালো মানুষ বলেই ওর মেয়েও খুব ভালো, একদিন কথায়-কথায় বলে, জানো ভাবি তোমার বড় রকমের সর্বনাশ করবে তোমার দেবর !
শুনে জবেদার আক্কেলগুম অবস্থা, মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। কি আর সর্বনাশ করবে নতুন করে, তারপরও ভেবে পায় না, কেনো সে সর্বনাশ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে বুঝে পায় না কিছুই।
আবার প্রশ্ন করে জবেদা, কিন্তু কেনো সে আমার সর্বনাশ করবে, বলো তো ?
জানি না তো ভাবি, কিন্তু আমার মনে হয় ও তোমাকে আজো ভালোবাসে।
তাই কি হয়েছে, এখন তো তুমি ওর বউ, তোমার মধ্যে মধু পায় না বুঝি !
নাক সিটকে কাকলি বললো, বউ না হাতি, শুধু শরীর আর শরীর ছাড়া কি চাই, মন তো তোমার আঁচলে বাধা...
জবেদা আর কিছু বলে না, স্তমিত হয়ে যায়, সর্বনাশ করবে যখন বলেছে নিশ্চয় বড় রকমের কোনো কিছু করবে, মনে-মনে ভাবে হয়তো পুরানো রাগের জের সে কড়ায়-গন্ডায় তুলবে। যদি মনের ভেতর অনেক জ্বালা থেকে থাকে তো জ্বালিয়ে দেবে তাকেও, একসময় নিজের মধ্যে সাহস সঞ্চয় করে বলে, যে যা করবে করুক গে, নিজেকে নিয়ে আর চিন্তা করে না সে...
চৈত্রমাসের একদিন অনেকরাত্রে জবেদার ঘুম ভেঙে যায়, দেখে তার ঘরটায় আগুনে দাউ-দাউ করে জ্বলছে, চিৎকার করে ওঠে তারপর, চারদিকে আগুন। দু’ চার’ দশ বাড়িতে শুধু আগুন,আশেপাশের সবারই বাড়ি জ্বলছে আগুনের শিখায়। সবাই চিৎকার করছে, কেউ কাউকে সাহায্য করতে আসছে না, সবাই কি স্বার্থপর হয়ে গেলো, জবেদা ভেবে পায় না, তামাম পৃথিবীটা যেন আগুনের স্তরে দাঁড়িয়ে বিদ্রুপ করছে। আলমারিতে গচ্ছিত রাখা সেটেলম্যান রেকর্ডে নথিভুক্ত হওয়া দলিলপত্র পুড়ছে, দাদন বা কডে বা লিজে নেওয়া জমির কাগজপত্র পুড়ে বাতাসের সঙ্গে ছাঁইগুলো মিশে উড়ে যাচ্ছে। শুধু জবেদা উড়তে পারছে না, ওর পাখা নেই বলে নয়,আসলে ও যে ডানা ভাঙা কবুতর, রবিউল আকাশের ওপরে বসে অন্যরকম হাসি ছড়িয়ে দিচ্ছে, মেঘের আকাশে সে হাসি কেউ দেখতে না পেলেও জবেদার চোখকে ফাকি দিতে পারে না।