বেলা-কালবেলা

ভয় (সেপ্টেম্বর ২০২১)

ashrafuddinahmed
  • 0
  • ৪০
সারাদিন কাদার মতো ঘুমিয়ে কাটায় আছিমুদ্দি চৌকিদার। রাত্রি হলেই নিশাচরের মতো শুরু হয় জাগরণের পালা। এ’ চাকুরী তার বাপের সূত্রে পাওয়া। তোরাব আলীর মৃত্যুর পর চাকুরীটা পায় সে, তাও বেশ কয়েক বছর হলো। সন্ধ্যা হলেই আছিমুদ্দি লাঠি-টর্চ ঠিক করতে থাকে, আর সরকারী ব্যাল্টখানা কোমরে এঁটে তৈরী হয় দায়িত্ব পালনে। সন্ধ্যা একটু গাঢ় হলে লম্পটা জ্বেলে নছিরন রাতের খাবার বেড়ে দেয়। আছিমুদ্দি খেয়ে উঠে ঢেশুর তুলতে-তুলতে বাইরে চলে যায়, প্রথম-প্রথম নছিরন চাইতো তার স্বামী রাত্রিটা ঘরে থাকুক, তখন অবশ্যই নছিরন নতুন বউ। জোয়ান স্বামীর বুকের ওম পাওয়ার কামনায় সারা শরীর তার আকুপাকু করতো,শরীরের তামাম উত্তাপ নিঃড়ে নিতে চায়, আর তা টুইটম্বুর যৌবন নিয়ে ভরিয়ে তুলতে চায় রাত্রের গভীর ভালোবাসা। ষোড়শী নছিমন কতোভাবে বোঝাতো স্বামী বেচারীকে, ইশারা-ইঙ্গিতে বুকের মধ্যে পোষা ময়নার মতো লুকিয়ে রাখতে চাইতো, রাত্রের কালো অন্ধকারে কাছাকাছি পাওয়া ছিলো যেন এক স্বপ্ন। সারাদিনের ক্লান্তি আর আকাঙ্খাকে পল¬বিত করার কামরা নিয়ে একেবারে রক্তের ভেতর ঝড় তুলে দাঁড়াতো কদাচিৎ। কিন্তু আছিমুদ্দি কেমন জানি! নিজের কর্তব্য আর দায়িত্ব পালনে ঘরের পোষা ময়নাটার প্রতি একটু সদয়দৃষ্টি দেওয়ার মতো সময় যেন নেই।
রাত্রের কালো অন্ধকার আসে যেন দায়িত্ব পালনের জন্য, জীবন কি শুধু দায়িত্ব পালনের একটা মালবাহি গাধা! আছিমুদ্দির কাছে চাকুরিটাই বড় কথা, মাস কাবারে একগাদা টাকা যখন হাতে আসে তখন সে দায়িত্ব এড়িয়ে কোথায় যাবে।
রাত্রি হলেই চৌকিদার আছিমুদ্দির শরীরে কিসের এক টান পরে, গ্রামটাকে পাহারা দিতে, আজকাল চোর-ডাকাতের উপদ্রপ শহরের মতোই গ্রামেও চেয়ে গেছে, তাই ঘুমন্ত জনপদকে সজাগ করে দেওয়াই তার কাজ। তার বাপও এ’কাজ করেছে জীবনভর। মানুষকে পাহারা দেওয়া ছাড়া আর যেন কোনো ভাবনা ছিলো না। একদিন ফট করে তোরাব আলী মরে গেলো আর দশটা মানুষের মতোই। প্রথানুযায়ী গ্রামের লোকেরা হা-হুতাশ করলো ক’দিন, কেউ-কেউ আবার চোখের পানি ভাসিয়ে দিলো, মানুষ মরলে মানুষের সহানুভূতি আরো বেড়ে যায়। গ্রামের গন্য-মান্য আর দশজন মানুষ তোরাব আলীর মরার পর একমাত্র ছেলে আছিমুদ্দিকে কাজটা দিলো, তোরাব আলীর সংসারে একমাত্র ছেলে ছাড়া আর কেউই ছিলো না। বউটা তো সেই বারো বছরের আছিমুদ্দিকে ঘরে রেখে পালিয়ে গেলো মহেষতলীর কসাই হাতেম গুন্ডার হাত ধরে। হাতেম গুন্ডার চার নম্বর বউ হওয়ার সাধ কেনো যে ওর হয়েছিলো, তোরাব আলী কোনোদিন বুঝেনি। শুধু অনুমান করেছিলো, রাত্রের ক্ষুধা ওর বড় বেশি তীব্র হয়ে ওঠে, অথচ তোরাব আলি তেমনভাবে সামাল দিতে পারতো না। হাতেম গুন্ডা কি ভাবে যে ওর মনটা হয় করলো তোরাব আলী আজো জানে না।
আছিমুদ্দি ফাঁকি দিতে জানে না, ওর বাপও কোনোদিন ফাঁকি দেয়নি, মৃত্যুর আগে বাপ শুধু বলতো, কাজে ফাঁকি দিলে সারাজীবন ফাঁকিতেই কাটবে। তাছাড়া মজুরিটা হালাল করতে, ফাঁকি দিলে কি আর, নছিমন ওসব বোঝে না। ওর মায়ের মতো এ’স্বভাব সে পেয়েছে,তার কাছে জোয়ান স্বামীকে সারারাত্রি কাছে পাওয়ায় বড় কথা। রাত্রি হলেই কেমন এক ভয়ে যেন কুঁকড়ে যায়।
দুপুরের পরে মাথার ওপর সূর্যটা যতোই পশ্চিমমুখো হয়, ততই ভয় যেন নামে বুকের মধ্যে,চোখের ভেতর কালো অন্ধকার এসে কাঁটার মতো বিঁধে, শরীর হিম শীতল হয়ে আসে। এতোবড় রাত্রি নিঃসঙ্গতায় কাটে, বিছানায় শুয়েও চোখের দু’পাতা এক হয় না একটুও। স্বামী নামের লোকটা কেনো যে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে নছিমন বোঝে না। নিজের মধ্যে অহনিশি যুদ্ধ করতে থাকে। কি এক অদৃশ্য যন্ত্রণায় সারা শরীর জ্বলেপুড়ে যায়,নছিমন তামাম দিন লাঙল-জোয়ালের মতো পরিশ্রম করে। ভোরের প্রথম আজানের সুমিষ্টি কলগানে ঘুম ভেঙে যায়, তারপর শুরু হয় দিনযাপনের খেলা। তখন সারা শরীরে ক্লান্তি আর অবসাদ নিয়ে ঘরে ঢোকে আছিমুদ্দি। লাঠি-টর্চ এবং কোমরের ব্যাল্ট খুলে নাইতে যায় হাতিডোবা দীঘিতে, প্রায় ঘন্টা খানিক শরীরটাকে ঠান্ডা করে তবেই ঘরে ফেরে, তারপর খাওয়া-দাওয়া সেরে বিকেল অবধি টানা ঘুম।
ঘুম মানে সে কি ঘুম! যেন বা কুম্ভূকর্ণ, নাক ডেকে নিশ্চিন্তে ঘুমের সাগরে পাড়ি জমায়। তখন পৃথিবীর তামাম তার কাছে অসহ্য ঠেকে।সর্প যদি দংশন করে তবুও টের পাবে না, মাঝখান থেকে শুধু জীবনটা চলে যাবে পরপারে। বিয়ের পর-পর নছিমন দুপুরের দিকে স্বামীর কাছে ঘেঁষে একটু শুতে চাইতো। বুকের ওম নিতে সাধ হতো, কিন্তু ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীরনিয়ে আছিমুদ্দি শুধু ঘুমের মধ্যে কাটিয়ে দিতো,কোনোভাবেই নছিমনের কামনার আগুনে ঠান্ডা পানি দিতো না। তাই সমস্ত দিন-রাত্রি শুধু কেঁদে-কেঁদে বুকের জ্বালা জুড়োতো, পাথরের মতো বুকের উপর চেপে থাকতো বিভীষিকাময় কা্েরলা রাত্রি। মনে মনে কতোদিন গালাগালি করেছে বাপ মা ভাইদের, অবশেষে সমস্ত ভাগ্যের দোষ দিয়ে চোখের কোণে সাগর এনেছে, কিসের এক ক্ষুধা বুকের মধ্যে খেলতো। কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলতো না নছিরন, কদাচিৎ বড় খারাপ লাগতো, ওরই বয়সি মেয়ে কমিলার দিকে তাকাতে, ওর স্বামী ভ্যানরিকসা চালায়, সারাদিন হাড়ভাঙা কঠোর পরিশ্রম করে আর রাত্রে ঠিকঠিক পতঙ্গের মতো ছুটে আসে কমিলার শরীরের নেশায়। কমিলার ঠোঁটের দুষ্টুমিভরা হাসি দেখলে নছিমণের বুকে আগুন ধরে, কি সে আগুন বোঝানো যায় না, ওর মুখে ভালোবাসার কথা শুনলে কান দুঠো কেমন ঝালাপালা করে ওঠে অহনিশি। কোনো-কোনোদিন কমিলা রাত্রের গল্প বেশ রসালোভাবে বলতো নছিমণের কাছে, শুনতে-শুনতে নছিমণের কানে তালা লাগে। রোষে-ক্ষোভে সাগরের উত্তাল তরঙ্গের মতো ফুঁসে ওঠে, এই অসহণীয় জ্বালা মিটাবার কোনো রাস্তা খুঁজে পায় না। কোথায় যাবে, কি বা করবে, মাথায় কোনো পরিকল্পনা খেলে না। আল¬াহ’র কাছে ফরিয়াদ জানায়, আর শুধু কাঁদে, ওর কান্না শুনে রাত্রের চাঁদ-জোনাকি-বাতাস-ডাহুকও বলে, কাঁদে কেনো ওই মেয়ে! কান্নার কি কোনো সময় অসময় আছে,পৃথিবীতে যে তিনভাগ জল, তাই তো মানুষ কাঁদে।
(০২)
একদিন গভীর রাত্রে পায়ের শব্দ শুনতে পায় নছিরন। মুদু পায়ের শব্দটা ক্রমশঃ ঘন হতে থাকে। প্রথমে বিড়ালের পায়ের শব্দ মনে হলেও অল্পক্ষণের মধ্যে নছিরণের ভুল ভাঙে, আসলে এটা কোনো বিড়ালের পায়ের শব্দ নয়। কে যেন বা আসছে সবল পা ফেলে-ফেলে, কে আসে, কে আসে...কে যেন বা আসছে তার কাছে, তার নরোম শরীর কেঁপে ওঠে। আগন্তুকের পা যেন নছিরণের বুকের মধ্যে একটা শিহরণ তোলে, কে আগন্তুক কে আগন্তুক...কে যেন চুম্বুকের মতো কাছে টানে। কে টানে, কে টানে...তবে কি তার প্রার্থনা শুনেছে সৃষ্টিকর্তা। সৃষ্টিকর্তা যে অন্তঃযামী। শুনবে না কেনো তার কষ্ট-জ্বালার কথা। নছিরণ কিসের এক টান অনুভব করে শরীর সাগরে। মনে হয় কেউ যেন আসছে। আসছে-আসছে--ঘোড়া দৌঁড়াচ্ছে...ষাঁড় দৌঁড়াচ্ছে--অনেক-অনেক ঘোড়া তার দিকে ছুটে আসছে...আসছে। তার ফুটন্ত টুইটুম্বুর যৌবনের উত্তাল স্রোতে কে যেন ছুটে আসছে। বুকের মধ্যে নিয়ে দুমড়ে-মুচড়ে দিতে কেউ যেন ছুটে-ছুটে আসছে, কোনো ভয় নেই, আনন্দ আর ভালোবাসার উল¬াসে ঢেউ খেলানো শরীরটা কাঁপতে থাকে নছিরণ। গভীর মমতায় প্রাণটা আকুপাকু করে।
অকস্মাৎ ঘুম ভেঙে যায় নছিরণের, চোখ খুলে দেখে সে প্রচন্ড ঘামছে, নিসঙ্গ বিছানার দিকে তাকিয়ে মনটা ভেঙে যায় আরো। গরমে শরীরের কাপড় খুলে গেছে, উন্নত বুক দুটো ঘামের জন্য কেমন স্যাতস্যাতে হয়ে আছে, নিজের স্তন দুটোকে আদর করে খানিক। নাভীর নীচে সায়ার দড়ি, বিশাল গভীর নাভীতে হাত দেয় নছিরণ।
কয়েকদিন পর একদিন রাত্রে নছিরণ আবার দেখতে পায় একটা সরল হাত। সম্পূর্ণ রোমশ শ্যামলা হাত, সেই মায়াবী রোমশ সবল হাতখানা দেখে নছিরণ আনন্দ আর শিহরণে শীৎকার দিয়ে ওঠে। মনটা ভরে যায় কানায়-কানায়। সকালে অছিমুদ্দি ঘরে ফিরে দেখে নছিরণ অঘোরে ঘুমোচ্ছে, মুখে যেন বা একটু কোমল হাসি। বোধ হয় রাত্রে স্বপ্ন দেখেছে,এবং সেই স্বপ্নের রেশ রয়েছে এখনো। অছিমুদ্দি মৃদু হাসে। অবশেষে প্রতিদিনের মতো গামছা-লুঙি কাঁধে নিয়ে নাইতে চলে যায়। ঘন্টা খানিক পরে ঘরে ফিরে দেখে নছিরণের ঘুম ভেঙে গেছে,স্বামীকে দেখে একটু মুখ ঘোরায়, কেমন একটা ভাব দেখায়। আছিমুদ্দি এসব লক্ষ্য করে না। নছিরণ বিছানা ছেড়ে উঠে মুখে-চোখে পানির ঝাঁপটা দিয়ে আসে কুঁয়োতলা থেকে। অকস্মাৎ রাত্যের কথাগুলো মনে হতেই হাসি পায়। আছিমুদ্দি আড় চোখে একটু দেখে। তাকিয়েই কেমন একটু চমকে ওঠে। নছিরণের মুখের ওপর কেমন একটা ছায়া-ছায়া গ¬ানিভরা ক্লেদ ছেয়ে আছে। মাথার ভেজা চুলগুলো গামছা দিয়ে পট-পট করে ঝাঁড়তে থাকে। আছিমুদ্দির মাথাটা যেন একটু ভারী লাগে। আজকাল কি বা হয়েছে তার, মানুষের দিকে তাকালেই ওই হতচ্ছাড়া মার্কা ছায়া দেখতে পায় চোখের সামনে। অনেক চেষ্টা করেও ছায়াটা মন থেকে কোনোক্রমে সরাতে পারে না। কেনো যে এমন বিভ্রম হয়, বোঝে না কিছুই, মাথা নীচু করে বসে থাকার পর নছিরণের দিকে তাকাতেই দেখে নছিরণ রান্না ঘরে ব্যস্ত, কন্ঠে গুন-গুনানি গানের সুর। মনে হয় আমোদেই রয়েছে, আছিমুদ্দি কিছুক্ষণ কান পেতে গুনগুনাগুন করা সুরেলা কন্ঠের গান শোনে। নতুন কেনা রেডিও খানা এখন নছিরণের নিত্য সঙ্গী, পয়সা জমিয়ে মাস দুয়েক হলো কিনেছে, সেই রেডিও-র গান এখন নছিরণের কন্ঠে খেলে, রুণা-সাবিনার মতো কন্ঠ না পেলেও বেশ দরদ ঢেলে সুর তোলে। যেন বা কোকিলের ডাক। একটু যতœ পেলে কে জানে হয়তো লতা-আশা যে হতো না তাই বা কে জানে। কিছুক্ষণ বেশ মনোযোগ দিয়ে গান শুনতে থাকে,শুধু যে প্রতিভা থাকলেই হয় না, তার বড় প্রমান নছিরণ। কারণ এর প্রতিভাকে একটু আদর-যতœ করে সাজিয়ে-গুছিয়ে তুললে একদিন নক্ষত্র হতো নিশ্চয়, শুধু-শুধু কাদা জলের মধ্যেই জ্বলন্ত প্রতিভা শুকিয়ে নষ্ট হলো। আছিমুদ্দির বড় ভালো লাগে। ঠোঁট গলিয়ে একটু হাসি যেন বা ছড়িয়ে দেয়। কিছুক্ষণ গান শুনে রাত্রের অলস বিছানায় ক্লান্ত শরীরটাকে গড়িয়ে দেয়। তারপর একসময় সারা শরীর জুড়ে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। অছিমুদ্দি হারিয়ে যেতে থাকে ঘুমের রাজ্যে। একসময় নছিরণ রান্নাঘর থেকে ছুটে আসে অছিমুদ্দির কাছে। ঘরে এসে দেখে নাক ডেকে তার স্বামী ঘুমোচ্ছে, পলকে সমস্ত স্বপ্ন সাধ উড়ে যায়। মলিন মুখে কয়েক মুহূর্তে তাকিয়ে থাকে। জানালা দিয়ে সকালের আলো এখন ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে, অছিমুদ্দি এখন ঘুমের অতল মহাসমুদ্রে পাড়ি জমিয়েছে, কোনোভাবেই এই ঘুম ভাঙবে না। চিৎ হয়ে পড়ে ঘুমোবে, নাক দিয়ে কেমন একটা শব্দ বের হচ্ছে, মুখটা হা হয়ে আছে বিভর্ষ ভাবে, পেটখানা উঠানামা করছে নিঃশ্বাসের তালে-তালে। যেন বা কামারের হাপড়, নছিরণের কাছে কেমন অসহ্য বোধ হয়। ঘর থেকে বের হয়ে যায়। রান্নাঘরের পাশের পিটালি গাছে একটা ছাঁই রঙের দাঁড়কাক বসে আছে, সজনে গাছের কঁচি-কঁচি পাতারা মাথা দুলিয়ে কি যেন কথা বলছে বাতাসের সঙ্গে। ঝিরিঝিরি বাতাসে মিষ্টি-মিষ্টি শিহরণে মৃদু পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতির শরীরে। দূরে কোথাও কোকিল ডাকছে থেকে- থেকে, কোকিলের ঘর ছাড়া ডাক নছিরণকে দূর কোথাও নিয়ে যায়। নছিরণ উদাস চোখে তাকিয়ে থাকে। ওর বুকের কাপড় কখন যে খসে গেছে জানে না এতোটুকু।
(০৩)
রাত্রি গভীর এখন। বাইরে ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছে, নছিরণ রেলগাড়ির সিগন্যালের মতো অতন্দ্রা এখনো। আকাশে সোনার ডিমের চাঁদটা তারাদের মাঝে দাঁড়িয়ে, নছিরণ জানালা দিয়ে তাকিয়ে আকাশ দেখে। মনটাকে কেনো যেন সামলে রাখতে পারে না। নিসঙ্গ মনে হয় তার কাছে সব কিছু, বেঁচে থাকা কেমন যেন পানসে লাগে। নীরব-নিস্তব্ধ এই রাত্রে কার বা ভালো লাগে একা। চোখের কোণে জমে কান্নার একটা সমুদ্র ,অকস্মাৎ দরোজায় কে যেন হালকাভাবে কড়া নাড়ে। কে? কে? কে... দরোজা খুলতেই দেখে রোমশ সেই লোকটা। ঘরের ভেতর চলে আসে অকপটে, কেউ যে এ’ মুহূর্তে বাঁধা দেবে না, ওর যেন তাও জানা। নছিরণ বুঝতে পারে, অন্তযামী তা প্রার্থনা কবুল করেছে, পরক্ষণে আরো কয়েকজন ঘরে ঢোকে, যেন বা শ্বশুরবাড়ি জামাই ঢুকছে, তার সে অধিকার আছে। রোমশ লোকটা আদেশে সবাই নছিরণকে পাজাকোলা করে বাইরে নিয়ে আসে। সবল শক্তি শরীর সবার।
রাত্রের অন্ধকার ভেঙে নছিরণকে নিয়ে আসে তারা এক ভূতুড়ে বাড়ি, চারদিকে কালো জমাট অন্ধকার দাঁত বের করে হাসছে। সবাই এবার নছিরণকে ঘিরে বসে। দুপুরের খানা খাওয়ার জন্য যেন বুভূক্ষ মানুষের এই আসর। সবাই আনন্দে আত্মহারা। বহুদিনের প্রিয় খাদ্য আজ তাদের সামনে। কে যে আগে স্পর্শ করবে, তা নিয়ে শোরগোল চলছে এখন। পুরুষ শরীর দর্শনে নছিরণ আজ মাতোয়ারা। অনেকদিন নাকি অনেক-অনেক কাল পরে আজ তার স্বপ্ন-সাধ-আকাঙ্খা পূরণ হতে যাচ্ছে, সেই আনন্দ আর উল¬াসে মন ভরে যাচ্ছে কানায়-কানায়। শরীরে অজানা একটা শিহরণ অনুভব করে। কতোকালের ইচ্ছেগুলো বুক ছাপিয়ে যায়।
একসময় চোখের সামনে দেখতে পায়, রোমশ লোকটা পায়ে-পায়ে তার দিকে কেমন নেশা ধরা চোখে এগিয়ে আসছে, নছিরণ নিরীক্ষণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে হরিণী চোখ দিয়ে। বেশ ভালো লাগে তরতাজা সব যুবকদের দিকে তাকাতে। কিসের যেন নেশা ওদের চোখে-মুখে। একসময় নছিরণের কাছে মনে হলো সমস্ত মুখগুলো অবিকল একই, কোথাও কারো পার্থক্য নেই। নছিরণ এবার একটু হাসলো। চোখের ইশারায় কাছে ডাকলো সামনে। হাত নাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে বাধ্য ছেলের মতো সবাই উলঙ্গ হয়ে নাচতে লাগলো, গান গাইতে-গাইতে এ’ওর গায়ে হেলে পড়লো সবাই। তারপর দুজনে টর্স করে ঠিক করলো, কে আগে মেয়েটার কাছে যাবে। নছিরণ একটু ভীত হলেও শারীরিক উত্তেজনা নিয়ে প্রথমজনের সঙ্গে ঢুকে যায় পাশের ঘরে। এক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে শুরু হয় আদিম খেলা। তারপর দ্বিতীয় জনের পালা, এক যন্ত্রণা আর কষ্টের মধ্যে নছিরণ অসার হয়ে ডুবে থাকে। একসময় জ্ঞান হারিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় নিঃসাড় হয়ে যায়। তৃতীয় যুবক ঘরে ঢুকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে বাইরে। ¤¬ান কন্ঠে বলে ওঠে, দূর ছাই---কি হলো ফিরে এলি যে বড়! শালা একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। মানে কি রে বোকাচোদা,বুঝলাম না তো! মানে কি জানিস না, কি বলবো? একেবারে এঁটেল কাদা যেন, চিৎ হয়ে পড়ে আছে, পানির ঝাঁপটা দিতে হবে। কথাটা শুনে সবাই হালকা হাসলো মুখ টিপে। নছিরণ একসময় কেঁদে ওঠে ডুকরে। তারপর অন্ধকার ঘর থেকে বাইরে বার হয়। সোনার থালার মতো চাঁদ আকাশের গায়ে লেপ্টে আছে। রক্তাক্ত নিঃস্ব শরীরখানা টলছে, তবুও খোঁড়াতে-খোঁড়াতে হাঁটছে সে। এলোমেলো শাড়ি মাটির দিকে নেতিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে তাকালো একবার। কেউ নেই আশেপাশে, জোনাকিরা মিটিমিটি আলো বিতরণ করে যায় শুধু। রোমশ লোকটার পৌরুর্ষপূর্ণ বিশাল শরীরের চাপ এখনো নছিরন যেন অনুভব করে। মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে, মনে-মনে একটু যেন হাসে, বড় চমৎকার খেলোয়ার সে, নিপূণ শিল্পীর মতো সুক্ষè ধারণা আছে বটে। ওর শরীরের গন্ধটা নছিরনের নাকে লাগে এখনো। রাত্রের কালো অন্ধকারের মধ্যে রোমশ লোকটার কৌশলের খেলা বেশ লেগেছে, নছিরণ ওর বুকের মধ্যে ডুবে গিয়েছিলো। কিন্তু ধকলটা বেশিক্ষণ নিতে পারলো না উঠতি শরীর। ওই সমস্ত তাগড়া-তাগড়া মানুষগুলোর ওই নিষ্ঠুর অত্যাচার সহ্য করা কি চাট্টিখানি কথা। সুখের চেয়ে কষ্ট বেশি হয়,তা তো বোঝে না পুরুষ।
রাত্রি ক্রমশ ফিকে হয়ে আসে। ভোরের সূর্য পূবআকাশের কোলে দুষ্টু বালকের মতো উঁকি দিচ্ছে, নছিরন নির্বাক এখন। কোনো ভাষা নেই মুখে তার। শুধু সে এলোমেলোভাবে হাঁটছে মেঠোপথ ধরে, বাড়ির রাস্তা আজ এতো দীর্ঘ লাগছে কেনো বোঝে না। কাকতালীয়ভাবে বাড়ি ফেরৎ আছিমুদ্দি ও’পথ দিয়ে আসতে গিয়ে নছিরনকে দেখে থামলো একটু। এ’অবস্থায় কি বলবে কিছু ভেবে পেলো না, মাথা নীচু করে নছিরন স্বামীকে একবার দেখে নিলো তারপর। অছিমুদ্দি হতবাক। তামাম পৃথিবী যেন তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, চোখে খানিক অন্ধকার দেখে, শরীরের সমস্ত শক্তি ক্রমশ শিথিল হয়ে আসছে, একসময় নছিরন একটু নড়ে ওঠে। তৎক্ষণাৎ আবার কথা বলে ওঠে, আমাকে বাপের বাড়ি দিয়ে আসো! অছিমুদ্দি নির্বাক হয়ে যায়। দ্বিতীয় কথা আর মুখ দিয়ে বের হয় না। কানের কাছে বারংবার নছিরনের কথাগুলো বাজতে থাকে। আমাকে বাপের বাড়ি দিয়ে...আমাকে বাপের বাড়ি...
একসময় দিনের সূর্যটা মাথার উপর পা মেলে বসে যেন। অছিমুদ্দির কাছে মনে হয় দিন নয় যেন গোধুলি বেলার মুহূর্ত। তামাম বনভূমি অছিমুদ্দির মতো ডুকরে কাঁদছে এখন, কেউ জানে না, কেউ জানে না, সে কান্নার ধ্বনি শুধু আছিমুদ্দি বোঝে, বোবা পাথর হয়তো বোঝে, অথবা নদী বোঝে, দূরে কেউ যেন কাঁদছে, কে কাঁদে, কে কাঁদে...মুহূর্তে মনে হয় নছিরন কাঁদে। কেনো কাঁদে কেনো! নাকি ভোরের কৃষ্ণচূড়া কাঁদে, ভোরের কাক তবু নির্বাক চোখে তাকিয়ে থাকে সুদূর পানে। পরক্ষণে বোঝে আশেপাশে কেউ নেই। কাঁদে তারপরও অছিমুদ্দি। কপোত ছাড়া কপোতি কেঁদে-কেঁদে মরে, অছিমুদ্দি কাঁদে কেনো কেউ বোঝে না, ধূসর গোধুলি বেলার সূর্যটাকে দেখে অছিমুদ্দি কেঁদে- কেঁদে কি যেন বা বলতে চায়, কি বলতে চায়, কি বলতে... কেউ বোঝে না, কেউ বা বোঝে, কেউ শুধু ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে থাকে বিশাল আকাশের মতো আকাশ হয়ে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী সুন্দর প্রকাশ।পাঠে মুগ্ধ হলাম।
ভালো লাগেনি ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২১

০৭ জুলাই - ২০২১ গল্প/কবিতা: ৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“ডিসেম্বর ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ ডিসেম্বর, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী