" কচি, কাই গেলু? কখন নু ডাকিটি। সাড়া দিতে পারুনি?"
" আইসিটি মা। এই লিখাটা শেষ করিয়া আইসিটি।"
হরিপদর বিধবা মা শান্তিবালা তার একমাত্র সন্তান হরিপদকে ডাকছে। ছেলের খাওয়ার বেড়ে তাকে ডাকছে। ছেলে খেয়ে স্কুলে যাবে। আর শান্তিবালা পাড়ার এক অফিসবাবুর বাড়িতে কাজে বেরুবে।
হরিপদর যখন দুবছর বয়স তখন তার বাবা মারা যায়। দুবছরের বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে হরিপদর বিধবা মা তখন অকূল পাথারে। সম্বল বলতে কাঠা দশেক ধান জমি, একটি মাটির কুঁড়েঘর আর লাগোয়া এক চিলতে বাগান। এইটুকুন কোলের বাচ্চা নিয়ে একা মেয়েমানুষ কি করে সংসার চালাবে? আর কি করেই বা ছেলে মানুষ করবে? চিন্তায় চিন্তায় আকাশ মাথায় ভেঙ্গে পড়ার অবস্থা। অগত্যা, গ্রামেরই এক অফিসবাবুর বাড়িতে কাজ জোগাড় করে। সারাদিনের কাজ। বিকেলে বাড়ি ফেরে। ছেলে ও তখন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরে। মা বেটার সংসার আবার চলতে শুরু করে। জমির ধান থেকে খোরাকির অনেকটা সুরাহা হয়। বাড়ির ওই চিলতে বাগানে মরসুমী সব্জি চাষ করে, তাছাড়াও জবা টগর ফুলের গাছ ও লাগিয়েছে। তাতে সংসারের আনাজপাতির প্রয়োজন কিছুটা মেটেতো বটে, বাগানের ফুলে গৃহ দেবতার পূজোও হয়। দুটি প্রানীর আর চাহিদা এমনকি ! তাছাড়া শান্তিবালার দুপুরের খাওয়াটা ও অফিসবাবুর বাড়িতে হয়ে যায়।
আসলে এই ঘটনার পটভূমি হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের এক জেলা পূর্ব মেদিনীপুরের এক প্রত্যন্ত গ্রাম। এই গ্রাম শহর থেকে অনেকটাই দূরে। গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে কথাবার্তা এই গ্রামীন ভাষাতেই চলে। তবে শহরে বা অফিস আদালতে গেলে এরা শহুরে ভাষাতে কথা বলার চেষ্টা করে কিন্তু তাতে যথেষ্ট ভেজাল মিশে যায়। যাইহোক না কেন, মা বেটার সংসার দুঃখ কষ্টে কেটে যাচ্ছিল। একদিন শান্তিবালা ছেলেকে বলে " কচিরে, তোকে আর কদ্দূর পড়িতে পারব জানিনি। আমার তো বয়স হটে। কি করব বুঝিয়া উঠতে পারছিনি। তুই বাপু এবার একটা কাজ টাজের চ্যাষ্টা কর।।
" হঁ মা। মাধ্যমিক পরীক্ষাটা পাশ করিয়া যাই। তখন দ্যাখব। একটা পাশনাই রইলে কুন কাজ পাবনি।"
একটা দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে মা ছেলেকে বলে " ঠিক আছে। তাউ দ্যাখ।"
হরিপদ পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের যে এক টুকরো ধান জমি আছে তার চাষাবাদ করে। ছোট্ট বাগানে শাকসব্জি ফলায়। নিজের মতো করে সংসারে সাহায্য করার চেষ্টা করে। মায়ের কষ্ট লাঘবের আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যায়। স্কুলে ওর দারিদ্র্যের কথা সবাই জানে। সেজন্য স্কুলে মাইনে মকুব। বইপত্তর কেনা, পরীক্ষার ফিজ সব কিছুই স্কুলের শিক্ষকরা নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে মিটিয়ে দেন। শিক্ষকরা প্রত্যেকে হরিপদকে খুবই স্নেহ করেন। একদিন হেডমাস্টারমশাই হরিপদকে ডেকে বলেন " হরিয়া, শুন। আর ক মাস পর তোর মাধ্যমিক পরীক্ষা। এ পরীক্ষা জীবনের পথম সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। মন দিয়া পড়। পরীক্ষার ফল ভাল করতে হবে। তোর মার একমাত্র সহায় তুই। এ কথা কক্ষখন ভুলবু নি।"
" হঁ মাস্টারমশাই। তুমাদের আর্শীবাদ আর ভালবাসা আমি জীবনে ভুলব নি।"
" হরিয়া, শুন মাধ্যমিক পরীক্ষার টাকার কথা চিন্তা করবু নি। সে ব্যবস্থা হয়া যাবে। তুই শুধু পড়াশুনা করিয়া যা। রেজাল্ট ভাল কর। জীবনে তোকে দাঁড়িতে হবে শুধু এ কথা মনে রাখ।"
হরিপদ হেডমাস্টারমশাইকে পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে বেরিয়ে আসে। বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
দিনের পর মাস কেমন করে কেটে যায় বোঝা যায় না। হরিপদর মাধ্যমিক পরীক্ষা চলে আসে। দিনরাত পরিশ্রম করে হরিপদ পরীক্ষা দেয়। পরীক্ষার আগের দিন সকল শিক্ষককে প্রনাম করে আর্শীবাদ নিয়ে আসে। প্রতি পরীক্ষার দিন মাকে প্রনাম করে তবে পরীক্ষা দিতে বেরোয়। যা আশা করা গেছিল সব পরীক্ষাই হরিপদর ভাল হয়েছে। পরীক্ষার রেজাল্টে ও তার প্রতিফলন দেখা যায়। স্কুলের মধ্যে হরিপদ প্রথম শ্রেনীতে পাস করেছে। এবং স্কুলের হাইয়েস্ট মার্কস ও হরিপদর দখলে। সবাই ধন্য ধন্য করছে। খুশির হাওয়া শুধু হরিপদর ঘরে নয়, গোটা স্কুলে। আনন্দের মধ্যে ও বিষাদের সুর। হরিপদর মন খারাপ। তার আর পড়া হবে না। উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তির টাকাই নেই। তার ওপর পড়াশোনার খরচ। একে সংসার চলা দায়। মার ও বয়স হচ্ছে। হরিপদ বাড়ির জমি চাষ, বাগানের চাষাবাদ ছাড়াও দিনমজুরের কাজ শুরু করে। কিছু দিন পর হরিপদর স্কুলের হেড মাস্টারমশাই পাড়ার এক ছাত্রের মাধ্যমে হরিপদকে স্কুলে ডেকে পাঠান। হেড মাস্টার মশাইের ডাক অমান্য করার কথা স্বপ্নে ও ভাবা যায় না। হরিপদ পরের দিনই স্কুলে পৌঁছে যায়। হেড মাস্টার মশাইর ঘরে সরাসরি ঢুকে যায়। মাস্টার মশাইকে প্রনাম করে দাঁড়িয়ে থাকে। " হরিয়া, ঘরের খবর সব ভাল রে? "
"হঁ মাস্টার মশাই।"
" তুই কি পড়া ছাড়িয়া দিলু? হায়ার সেকেন্ডারী ক্লাসে ভর্তি হবু নি?"
" মার পক্ষে সংসার চালান, আমার পড়ার খরচ যগান আর সম্ভব নয়। সেজন্য আমি ও একটু আধটু দিনমজুরের কাজ শুরু করছি।"
" ওসব কিছু করতে হবে নি। তুই কাল এগার ক্লাসে ভর্তি হয়া যা। টাকার কথা ভাবতে হবে নি। ব্যবস্থা হয়া যাবে।"
বাড়ি ফিরে হরিপদ মাকে সব কথা বলে। মা বলে " হেড মাস্টার মশাই যখন কইছে তুই ভর্তি হয়া যা। আমি ঠিক চালি লুব। তুই তোর পড়াশুনাটা ঠিকঠাক চালি যা। বাকিটা ভগবানের উপর ছাড়িয়া দে।"
কথামত পরের দিন হরিপদ তার সব কাগজপত্র নিয়ে পাসের গাঁয়ের স্কুলে এগার ক্লাসে ভর্তি হয়। ভর্তি ও বই কেনার টাকার ব্যবস্থা হেডমাস্টার মশাই করে দিয়েছিলেন। হরিপদ ও জোরকদমে পড়াশোনার কাজ শুরু করে দেয়। চেয়ে চিন্তে হরিপদর পড়াশোনা এগিয়ে চলে। দেখতে দেখতে দ্বাদশ ক্লাসের ফাইনাল পরীক্ষা ও এসে যায়। আগের বারের মত এবার ও পরীক্ষায় ভাল ফল করে। হরিপদর ভীষণ ইচ্ছে করে আরও পড়াশোনা করার। কলেজে ভর্তি হবে। ভূগোল নিয়ে পড়ার ইচ্ছে তার। কিন্তু উপায় কি?
হরিপদর মা ছেলের ইচ্ছে পূরনের জন্য অফিসবাবুর হাতে পায়ে ধরে। বলে " বাবু, আমার বেটার কলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করিয়া দও। আমি সারা জীবন তুমার ঘরে কাজ করিয়া দুব। মাইনা দিতে হবেনি। আমার বেটার ইচ্ছাটা পূরন হউ।"
এই অফিসবাবু সরকারি অফিসে কাজ করেন। এখন পোস্টিং দার্জিলিং এ। বলেন " ঠিক আছে। মাসী, তুমাকে চিন্তা করতে হবেনি। আমি তুমার বেটার পড়ার সব ব্যবস্থা করিয়া দুব। দার্জিলিং কলেজে তুমার বেটাকে ভর্তি করিয়া দুব। ওর আর পড়ার চিন্তা করতে হবেনি। আমার দার্জিলিং এর বাসায় হরিয়ার থাকার ব্যবস্থা করিয়া দুব। তুমি কুন চিন্তা কর নি।"
একদিন দার্জিলিং মেলে হরিপদকে নিয়ে অফিসবাবু রওনা দিলেন দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে। দার্জিলিং আসার সময় হরিপদ মায়ের আর্শীবাদ ছাড়াও একটি ছোট্ট ব্যাগে ফাটাফুটো যা কিছু দু একটা জামা কাপড় ছিল তা সঙ্গে নেয় আর সবসময়ের সঙ্গী মায়ের আর্শীবাদী তাবিজ। এই সম্বল নিয়ে হরিপদর অচেনা দার্জিলিং যাত্রা। পরের দিন দার্জিলিং পৌঁছে ঠান্ডা টের পায় হরিপদ। রাতে ঠান্ডা আরও বাড়ে। ওই স্বল্প পোশাকে হরিপদর খুবই কষ্ট হয়। অফিসবাবুর দার্জিলিং এর বাসাই এখন হরিপদর থাকার ঠেক। অফিসবাবু তার বাসার রান্নাবান্না, বাসন মাজা, কাপড় জামা কাচার সব দায়িত্বই হরিপদর ওপর চাপিয়ে দেয়। আসা থেকে বেশ কিছু দিন হয়ে গেল কিন্তু অফিসবাবুর তরফ থেকে কলেজে ভর্তির কোন উদ্যোগই চোখে পড়ে না। খাওয়া দাওয়ার ক্ষেত্রেও অফিসবাবুর খাওয়ার পরে যা উচ্ছিষ্ট পড়ে থাকে তা হরিপদর কপালে জোটে। তাতে পেট ভরল কি না ভরল কিছু আসে যায় না। এই বাসা অফিসবাবুর অস্থায়ী ঠিকানা। তিনি এখানে একাই থাকেন। হরিপদ যেন তার সর্বক্ষনের কর্মচারী। কলেজে ভর্তির ব্যাপারে উচ্চবাচ্য না দেখে হরিপদ অফিসবাবুকে জিজ্ঞেস করে " বাবু, আমাকে কবি ভর্তি করিতে লিয়া যাব? অনেক দিন তো হয়া গেল। ভর্তির তারিখ পারি গ্যালে আমার আর পড়া হবেনি।"
" লিয়াব লিয়াব। তোকে অত চিন্তা করতে হবে নি। অফিসের কাজে একটু ফুরসৎ পাই, তখন তোকে লিয়া কলেজে যাব।"
তা অফিসবাবুর এই টালবাহানা দেখে একদিন দুপুরে যখন অফিসবাবু অফিসে চলে গেছেন, হরিপদ বেরিয়ে পড়ে। লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে দার্জিলিং কলেজে পৌঁছে যায়। কলেজের টিচারদের স্টাফরুমে গিয়ে ভর্তির ব্যাপারে জানতে চায়। হরিপদর হতদরিদ্র পোশাক ও ভাষা দেখে বিমল নামের একজন বাঙালি শিক্ষক তার বিষয়ে সবকিছু জিজ্ঞেস করেন। সংক্ষেপে হরিপদর বিষয়ে জেনে তিনি ক্যান্টিন থেকে খাওয়ার আনিয়ে হরিপদকে খাওয়ান। ভর্তির ব্যাপারে পরে আসতে বলেন। পর পর কয়েক দিন সে এসে স্যারের সঙ্গে দেখা করে। স্যার ও তাকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেন। কয়েক দিন পর বিমল স্যারের সাহায্যে হরিপদ দার্জিলিং কলেজে জিওগ্রাফি অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়। স্যার কিছু টাকা ও তার হাতে গুঁজে দেন। বলেন " এই টাকা কটা রাখ। তোর কাজে লাগবে। প্রয়োজন হলে বলবি। লজ্জা করবি না।"
এই সব ঘটনার কথা হরিপদ অফিসবাবুকে জানায় না। কিন্তু কিছু দিন পর অফিসবাবু ঘটনাচক্রে হরিপদর কলেজে ভর্তির বিষয়ে জানতে পারেন। তিনি হরিপদর ওপর অত্যাচার শুরু করতে থাকেন। কিছু দিন পর হরিপদকে তাড়িয়ে দেন। বেচারা হরিপদ এই বিভুঁয়ে কোথায় যায়? কি খায়? অগত্যা শরনাপন্ন হয় বিমল স্যারের। স্যার শিক্ষকদের মেসের নীচ তলায় ছাত্রদের একটি মেসে হরিপদর থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। শর্ত একটাই। বাকি ছাত্রদের রান্না থালা বাসন মাজার কাজ হরিপদকে করতে হবে। বদলে হরিপদর থাকা খাওয়া ফ্রি। মেসের শিক্ষকরা মিলে চাঁদা তুলে হরিপদর পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। হরিপদ একদিন মেসের সব স্যারদের বলে " স্যার, আপনাদের কাছে আমার খণের শেষ নাই। স্যার, কিছু প্রয়োজন মনে হলে আমায় বলবেন। আমি কিন্তু রান্নাবান্না থেকে গৃহস্থালি সব কাজই করতে পারি। এতে যদি আপনাদের কিছুটা সাহায্যে আসতে পারি তো আমি নিজেকে ধন্য মনে করব।"
" সে দরকার পড়লে বলব। তুই মন দিয়ে পড়াশোনা কর। "
একদিন কাজের মাসি না আসায় শিক্ষকদের মেসের হাল খারাপ। কে চা বানাবে, কে ব্রেকফাস্ট রেডি করবে আর কেই বা লাঞ্চ? এই ঠিক করতে করতে বেলা গড়িয়ে যায়। সেই সময় জিওগ্রাফির টিচার দুলাল ধরের কাছে হরিপদ আসে বিশেষ একটি চ্যাপ্টার বোঝার জন্য। এসে শোনে স্যারেদের খাওয়া হয় নি। তড়িঘড়ি সে হাত লাগায়। দক্ষ হাতে চা থেকে ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ সব একা হাতে রেডি করে ফেলে। স্যাররা হরিপদকে খাওয়ার কথা বললেও হরিপদ রাজী হয় না। তার মেসে বাকিরা খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে। সে দৌড় লাগায়। নিজের মেসে ফিরে যায়।
আজ হরিপদর মন খারাপ। মায়ের কথা মনে পড়েছে। দার্জিলিং এ আসাতক মায়ের সঙ্গে কোন যোগাযোগ করতে পারে নি। এতদিন হল মা ও ছেলের কোন খবর না পেয়ে নিশ্চয়ই ভাল নেই। মায়ের কষ্টের কথা মনে আসতে হরিপদর চোখে জল এসে যায়। এখানে এত কষ্টে থেকে পড়াশোনা করাও তার কাছে কোন কষ্টের মনে হয় না, যতটা তার হয় মায়ের জন্য। দার্জিলিং যে " Queen of Hills" এ কথা হরিপদর মনেই আসে না। সকাল থেকে রাতে শোয়া অবধি হাড়ভাঙা পরিশ্রম, তার মধ্যে নিজের পড়াশোনা আর প্রচণ্ড শীতের অত্যাচার। কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য তাকে আকর্ষণ করে না। রোডোডেনড্রন, ক্যামেলিয়া, ম্যাগ্নোলিয়া, এমনকি সুন্দর সুন্দর বিভিন্ন পাহাড়ি ফুল, ঝর্না সবকিছুই হরিপদর দর্শনসূখ থেকে বঞ্চিত। এসব তার কাছে " পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি"। এই পাহাড়ি সৌন্দর্য দেখার অবকাশ তার নেই। এ যেন তার কাছে বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয়।
অবশেষে কলেজে শীতের ছুটিতে হরিপদ বাড়ি ফিরে যায়। বাড়িতে মাকে দেখে জড়িয়ে ধরে। মা ও ছেলেকে জড়িয়ে ধরে। এতদিনের বিরহের জ্বালা। আবেগে দুজনের চোখ জলে ভরে যায়। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে বসে। মাকে জিজ্ঞেস করে " মা, ক্যামন আছ? তুমার শরীর ঠিক আছে ত? কুন কষ্ট হয় নি?"
একসঙ্গে এতগুলি প্রশ্ন শুনে মা হেসে ফেলে। বলে " হঁ রে বাপু হঁ। আমি ভাল আছি। তকে আমাকে লিয়া চিন্তা করতে হবে নি। তুই কচি, ক্যামন থাইলু অতদিন? কুন অসুবিধা হয় নি? কলজে ভর্তি হয়া যাইছু?"
" হঁ মা। সবকিছু ঠিক ঠাক হইছে। আমার কলেজের মাস্টার মশাইরা খুব ভাল। তারা সব ব্যবস্থা করিয়া দিছে। থাকা, পড়া, বইপত্তর, কলেজের মাইনা সব ব্যবস্থা আমার মাস্টাররা করিয়া দিছে। কুন অসুবিধা নেই।"
" এঠি তো অন্য ঘটনা হইছে রে কচি। তুই চলিয়া যায়ার ক মাস পর অফিসবাবু ঘরে আইল। আইসা আমাকে কইল ' মাসী, তুমার বেটা একটা বেইমান। আমি সব করিয়া দিলি। আমাকে কুন কিছু না কয়া চলিয়া গ্যাল। তুমার বেটার কুন খবর আমি জানি নি। আমার আর কুন দায়িত্ব নেই। একটা বেইমান। আর শুন, বেইমানের মাকে আমি আর কাজে রাখতে পারব নি। তুমাকে কালনু আর কাজে আসতে হবে নি।' কচি কি হইছে রে। আমি জানি আমার বেটা কখনও বেইমানি করবে নি।"
" মা, তুমার বেটা কুনদিন বেইমানি করতে পারে? আসলে আমাকে অফিসবাবু তার দার্জিলিং এর বাসায় কাজের লোক হিসাবে লিয়া যাইছিল। আমাকে দিয়া রান্না, বাসন মাজা, কাপড় কাচা সবই করিত। খাবার ও ঠিক মত দিত নি। আমি নিজের চেষ্টায় আর মাস্টার মশাইের সাহায্য লিয়া ভর্তি হইছি। মা, মাস্টার মশাইরা সবলোক মিলিয়া আমার থাকা খাওয়ার সব বেবস্থা করিয়া দিছে। আমি খুউব ভাল আছি।"
" দ্যাখ কচি। একদিন তুই ঠিক একটা ভাল চাকরি পাবু। আমানকের একটা পাকা ঘর হবে। তার সাথে একটা বারান্দা রইবে। বারান্দায় আমার মা বেটা বুসিয়া গল্প করব। সুখ দুঃখের কত কথা !"
মা ছেলের কথার মধ্যে রাত বাড়তে থাকে। মা ছেলের জন্য রান্না করতে যায়। ছেলে ও হাতে হাতে মাকে সাহায্য করে। দুজনে পরম আনন্দে ও পরিতৃপ্তি সহকারে রাতের খাবার খেয়ে শয্যা গ্রহণ করে। পরদিন হরিপদ স্কুলে গেল। হেড মাস্টার মশাইর ঘরে গিয়ে স্যারকে পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে। স্যারের শরীর স্বাস্থ্যের খবর নেয়। হরিয়া এসেছে শুনে অন্য স্যাররা চলে আসেন। হরিয়ার খবরাখবর নেন। দার্জিলিং এর গল্প একজোটে শোনেন। অবশেষে হরিপদ স্যারেদের আর্শীবাদ নিয়ে বাড়ি ফেরে। তিন মাসের শীতকালীন ছুটি দেখতে দেখতে কেটে যায়। নিজের পড়াশোনা, বাড়ির কাজকর্ম এসবের মধ্যে হরিপদর সময় কেটে যায়। দার্জিলিং যাওয়ার দিন এসে যায়। মায়ের আর্শীবাদ নিয়ে হরিপদ দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। যাওয়ার আগে মাকে বলে " মা, আমি দার্জিলিং পঁউছি করিয়া চিঠি দুব। তুমি হেডমাস্টারের কাছে যায়া চিঠি পড়ি লিয়া আইসব। দরকার হইলে মাস্টার মশাইকে দিয়া আমাকে চিঠি লিখব।"
" হঁ রে বাপ, আমাকে লিয়া তোকে ভাবতে হবে নি। আমি ঠিক রইব। তুই সাবধানে রইবু।"
এবারের দার্জিলিং যাত্রা হরিপদর দৃষ্টিভঙ্গিতে আমূল পরিবর্তন এনেছে। মায়ের সঙ্গে দেখা হওয়া তার মনে শান্তি র শীতল বারি বর্ষন করেছে। এরফলে হরিপদর এই মানসিক পরিবর্তন। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং ওঠার পথে হরিপদ পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে এগোয়। পাহাড়ের বাঁক, ঝোরা, নানান রঙের ফুলের বাহারি রূপ তাক আকৃষ্ট করে। হৃদয় ভরা তৃপ্তি নিয়ে এগিয়ে চলে। রোডোডেনড্রন এর গুচ্ছ আগুনে রূপ পাহাড়কে আধুনিকা রূপসী বানিয়েছে। পাহাড়ের গা বেয়ে লতিয়ে চলা বিভিন্ন রঙের ক্যামেলিয়া যেন পাহাড়ি রমনীর আভরণ এর শোভা বর্ধন করছে। পাগলাঝোরা যেন এক ভয়ংকর সৌন্দর্যের প্রতীক। তাকে দেখা বোঝার চোখ থাকা চাই। এবার হরিপদ যেন সেই চোখে প্রকৃতির এই রূপ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘার ক্ষনিক দর্শন হরিপদর মনকে আর ও উচাটন করে তোলে। আসলে মায়ের সঙ্গে দেখা, গাঁয়ের লোকেদের সঙ্গে দেখা সবকিছুর এটি একটি পজেটিভ ইমপ্যাক্ট। দার্জিলিং পৌঁছে যথারীতি হরিপদর জীবনযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। একে একে ফার্স্ট ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ার, থার্ড ইয়ার কেটে যায়। হরিপদ অনার্স নিয়ে জিওগ্রাফিতে প্রথম শ্রেণিতে পাশ করে।
জীবন যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় হরিপদর জীবনে। বিভিন্ন জায়গায় অ্যাপ্লিকেশন জমা করতে থাকে। একটি চাকরি খুব জরুরি তার কাছে। সঙ্গে কিছু প্রাইভেট টিউশন ও চালিয়ে যায়। তাতে নিজের খরচ মোটামুটি চলে যায়। মাঝেমধ্যে তার থেকে সঞ্চয় করে কিছু টাকা মাকে ও পাঠায়। কখনও নিজে বাড়ি গেলে মায়ের হাতে দিয়ে আসে। চাকরির ইন্টারভিউ ও কম দিল না। কিন্তু ভাগ্যদেবতা প্রসন্ন হোল কোই? অবশেষে উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলারটাকির একটি স্কুল থেকে হরিপদর অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটার আসে। কিছু দিন আগে এখানে ইন্টারভিউ দিতে এসেছিল। এই স্কুলটি ইছামতি নদীর তীরে অবস্থিত। মিশন কর্তৃক পরিচালিত। সেজন্য এখানে কোনরূপ তদ্বির তদারকির দরকার পড়েনি। হরিপদ তার নিজের যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছে। এই চাকরিতে জয়েন করার পরপরই হরিপদর জীবনে সবচেয়ে দুঃখের খবর আসে। তার একমাত্র সহায় তার চিরদুঃখিনী মা জীবন জগতের মায়া ত্যাগ করে পরলোকে গমন করেছেন। মায়ের মৃত্যু সংবাদ হরিপদকে বড্ড ধাক্কা দেয়। নতুন চাকরির স্থলে হেডস্যারের অনুমতি নিয়ে মায়ের শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে দেশের বাড়ি যায়। মায়ের পারলৌকিক কাজ সম্পন্ন করে স্কুলে জয়েন করে। কালের নিয়মে ধীরে ধীরে হরিপদ ও সাংসারিক দুঃখ ভুলে জীবনের অন্য যুদ্ধে নিজেকে ব্যস্ত করে তোলে। ছাত্র পড়ানোর কাজে অধিক মনোনিবেশ করে।
ইছামতি দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। হরিপদ আজ দুই সন্তানের পিতা। একটি দোতলা বাড়ির মালিক। এই বাড়ি ও নদীর তীরের খুব কাছেই। বারান্দা থেকে ইছামতিকে কুলুকূলু রবে বয়ে যেতে শোনা যায়। ইছামতির স্বচ্ছ জলরাশি গ্রীষ্মের দাবদাহে চড়ায় পরিনত হয়, তখন লোকজন গরুছাগল তার বুকের ওপর দিয়ে এপার ওপার করে।দুই দেশের মেলবন্ধন করে যেন এই নদী ইচ্ছামতি। হরিপদ মাঝেমধ্যে বারান্দার এই এক কোনায় একটি চেয়ার নিয়ে বসে থাকে। কচুরি পানায় আবদ্ধ ইছামতিকে দেখে। হরিপদর বড় কষ্ট হয়। তার চোখে আজ জল। মায়ের কথা মনে পড়েছে। যবে তার জীবনে সুখ স্বাচ্ছন্দ এল, মা তাকে ছেড়ে চলে গেল। মাকে তার এই আনন্দের ভাগীদার করতে পারল না।
জ্যোৎস্না রাতের আলো আঁধারিতে বারন্দায় বেতের রেকলাইনারে হালকা দুলুনি খেতে থাকে হরিপদ। এই পরিবেশ এনজয় করার জন্য হরিপদ বারান্দার আলো ইচ্ছে করে জ্বালায় নি। ইচ্ছামতির মৃদুমন্দ শীতল হাওয়া হরিপদর চোখে তন্দ্রার আবেশ এনে দেয়। সামান্য ঝিমুনির মধ্যে হরিপদ দেখে এক আবছা নারীমূর্তি তার সামনে এসে দাঁড়ায়। তন্দ্রালু হরিপদ মনে হয় সেই নারীমূর্তি যেন বলছে,
" কি রে কচি, কইথিলি না? আমানকের একটা পাকা ঘর হবে। একটা বারান্দা রইবে। তাতে মা বেটা সুখ দুঃখের গল্প করব।".......
[ এই গল্পের পটভূমি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের এক জেলা অধুনা পূর্ব মেদিনীপুর জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম। পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রায় অধিকাংশ জায়গায় এই কথ্য ভাষায় মানুষজন নিজেদের মধ্যে কথা বলে। কিন্তু, অফিস আদালতের কাজে বা বাইরের লোকজনের সঙ্গে চলিত বাংলা ভাষায় কথা বলে। ভাষা আসলে মনের কথা প্রকাশ করার একটি মাধ্যম। মানুষের আবেগ, ইচ্ছা, ভাব, ভালবাসা, ভাললাগার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই ভাষার মাধ্যমে। মানুষ নিজের ভাষায় তার মনের কথা যেভাবে প্রকাশ করতে পারে অন্য ভাষায় হয়তো সেভাবে সম্ভব হয় না। সেই জন্য বিশ্বব্যাপী মাতৃভাষার এত কদর। এটাই তাদের নিজস্ব ভাষা। এই ভাষাতে তারা নিজেদের মধ্যেই কথা বলে। উড়িষ্যা সংলগ্ন পূর্ব মেদিনীপুরের কিছু এলাকা ও আদিবাসী অধ্যুষিত পশ্চিম মেদিনীপুরের বেশ কিছু এলাকা ব্যতিরেকে বাকি অংশের এটাই কথ্য ভাষা। বিস্তীর্ন অঞ্চলের বহু লোকের ভাষা হওয়া সত্ত্বেও এই ভাষায় সাহিত্য চর্চা লেখকের নজরে তেমন আসে নি। এই অনুভূতি থেকে এই মাটির ভাষায় সাহিত্য চর্চার এক ক্ষুদ্র প্রয়াস লেখকের তরফ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। পাঠককূলের পছন্দ হলে ভাল লাগলে লেখকের প্রয়াস সার্থক হবে।]
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
এই গল্প এক প্রত্যন্থ গাঁয়ের দুঃখী মা ছেলের কাহিনি। ছেলের পড়ার জন্য মায়ের কঠিন পরিশ্রম ও ছেশের নিজের প্রচন্ড পলিশ্রমের কাহিনি এই গল্ফের পরতে পরতে। অবশেষে সুপ্রতিষ্ঠিত সন্তান মায়ের জীবধ্দশায় যে স্বপ্ন পূরণ করতে পারে নি, মায়ের মৃত্যুর পর সেই স্বপ্ন হফল হয়। সেই বেদনার স্মৃতি ছেলের স্বপ্নে সত্যি হয়ে ওঠে।
১৯ জুন - ২০২১
গল্প/কবিতা:
২৩ টি
সমন্বিত স্কোর
৫.৩৩
বিচারক স্কোরঃ ২.৩৩ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ৩ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪