এক
" বন্ধু বিনে প্রান বাঁচে না "
স্থান - পাহাড় রানি দার্জিলিং। পর্বত- দ্বীপমালা বেষ্টিত সৌন্দর্য্য সুন্দরী। তার প্রধান দ্বাররক্ষক শ্বেতশুভ্র অহর্নিশ প্রহরী কাঞ্চনজঙ্ঘা। বিভিন্ন বৃক্ষরাজি রানির সাম্রাজ্যে সবুজ গালিচার দায়িত্ব নিয়েছে। সৌন্দর্যায়নের দায়িত্বে নানা বর্ণের পুষ্পদল। রোডোডেনড্রন, ক্যামেলিয়া, ম্যাগনোলিয়া আরও অজানা অচেনা অনেক ফুল।
সময় - মার্চ মাস। পাহাড়ে কোল্ড উইন্ড বইছে। এর প্রভাব সরাসরি হাড়ে গিয়ে আঘাত করে। পাহাড় এই সময়টা দুর্লভ নানা বর্নমালায় রঞ্জিত পুষ্পমালায় সজ্জিত হয়ে থাকে। পাহাড়ি এই সৌন্দর্য যে না দেখেছে, সে জীবনে বহুমূল্য দুর্লভদর্শন থেকে বঞ্চিত হয়েছে। নয়নাভিরাম এই দৃশ্যপট যে কোনো সৌন্দর্যপ্রিয় ভ্রমনপিপাসু পর্যটকের কাছে লোভনীয় আকর্ষণ। বাস্তব কিন্তু বিপরীত কথার সাক্ষী। এই প্রচণ্ড ঠান্ডায় পর্যটক এই সময়ে খুব একটা পাহাড় মূখী হয় না। হোটেল গুলির যথেচ্ছ ডিস্কাউন্ট ও পর্যটক টানতে এই সময় ব্যর্থ হয়। সৌন্দর্যবিলাসী ভ্রমনপিপাসুরা ব্যতিক্রমীদের দলে। প্রকৃতি আপাদমস্তক বহুবর্ণে সজ্জিত হয়ে যাদের অপেক্ষায় থাকে শীতকাতুর সেই পর্যটকের দল নিজেদের বঞ্চিত করে এই লোভনীয় সৌন্দর্য উপভোগ থেকে। পাহাড়ের প্রকৃতি ও সৌন্দর্যদানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। ভাগ্যবান কতিপয় ব্যক্তি শুধুমাত্র এই স্বাদ গ্রহণের সুযোগ পায়।
পাহাড় উত্তাল গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে। মিছিল মিটিং লেগেই আছে। সিআরপির ধরপাকড়, অত্যাচার বেড়েই চলছে। গোলাগুলি, খুনজখম লেগেই আছে। পাহাড়ের আন্দোলন থামার কোনো লক্ষন নেই। চারিদিকে আতঙ্কের পরিবেশ। এই পরিস্থিতিতে দার্জিলিং এর নর্থ পয়েন্ট কলেজে কয়েক মাসের ব্যবধানে জয়েন করে সহজ কারক ও অন্যমুখ সিদ্ধান্ত। দুজনেই শিক্ষকদের একটি মেসে থাকার সুযোগ পায়। সেখানেই পরিচয়। তা থেকে বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠতা। সহজ বাংলার শিক্ষক। অন্যমুখ গ্রন্থাগারিক। দুজনের বিষয় বাংলা। দুজনেই বাংলায় মাস্টার ডিগ্রিধারী। সেই কারণে দুজনের মধ্যে দ্রুত বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। এদের মধ্যে অন্যমুখ আবার সবার প্রিয়। তার মিষ্টি ও শান্ত স্বভাব তাকে সবার কাছে প্রিয় করে তুলেছে। ছাত্র, শিক্ষক ও অফিস কর্মচারি সবার পছন্দের প্রথম সারিতে অন্যমুখ। তাছাড়া, অন্যমুখের অপর একটি গুন হল সে একজন চলন্ত ইনফরমেশন সেন্টার। শুধু লাইব্রেরি নয়, অন্য যে কোনো বিষয়ের তথ্য অন্যমুখের নখদর্পনে।
একবার একটি ঘটনা সহজ ও অন্যমুখকে আরও কাছে এনে দিয়েছে। সেবার কলেজের অনেকেই দার্জিলিং মেলে কলেজে যাওয়ার জন্য সওয়ারী হয়েছে। নর্থ বেঙ্গলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ট্রেন ফরাক্কায় পৌঁছনোর পর ভীষনভাবে স্লো হয়ে যায়। ফরাক্কা থেকে মালদা টাউন পৌঁছতে সকাল হয়ে যায়। ট্রেন আর এগোয় না। পরে জানা গেল রেললাইনে জল উঠে গেছে, ট্রেন আর এগুবে না। সবার মধ্যে একটা অজানা আতঙ্ক কাজ করতে থাকে। কলেজে না যাওয়া হোক, কিভাবে বাড়ি ফেরা যাবে? সবাই মিলে স্টেশন সুপারেন্টেন্ডেন্টের সঙ্গে দেখা করে। তর্কাতর্কি লেগে যায়। বহুবার ও বহুক্ষন আলোচনার ফলে একটি সিদ্ধান্তে রেল কর্তৃপক্ষ রাজি হয়। যে ট্রেন শিয়ালদা থেকে এসেছিল, সেই ট্রেনই সবাইকে নিয়ে আবার শিয়ালদা ফিরে যাবে। রেলের এই সিদ্ধান্ত বাকিসব যাত্রীর মনে আশার আলো দেখায়। সবাই তাড়াহুড়ো করে ট্রেনে ওঠার জন্য। এর মধ্যে কিছুজন রেলের ওপর ভরসা না রেখে নিজেরাই নিজেদের ব্যবস্থা করে নিয়েছে। বাসে করে বাড়ির পথে অলরেডি রওনা দিয়ে দিয়েছে। সারাদিন এই লড়াইয়ে সব সহকর্মীরা ক্লান্ত। তবু রক্ষে, এরা সবাই রেলের ওয়েটিং রুমে স্নান করে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। রেলের ক্যান্টিনে হালকা খাবার ও খেয়ে নিয়েছে। বাড়ি ফেরার অনিশ্চয়তা, স্টেশনের কোলাহল অন্য কোনো চিন্তার অবকাশই দেয় নি। অবশেষে, গার্ডের হর্নের প্রচণ্ড শব্দের অনুমতি নিয়ে ধীর লয়ে ট্রেন চলতে শুরু করে।
দুই
সারাদিনের চিন্তা ও ধকলের জেরে কারুর আর বর্ষার প্লাবনে ভরা যৌবনের যুবতী গঙ্গাকে দেখার চোখ নাই। এই যৌবনরূপী জল যেন পরপুরুষ রেলব্রীজের স্পর্শ পাওয়ার লোভ সামলাতে পারছে না। রাতে ব্রীজের উজ্জ্বল আলোর রোশনাই সেই মিলন দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে থাকতে চাইছে। সহজ ও অন্যমুখ মুখোমুখি সিটে বসে এই ভয়ংকর দৃশ্য উপভোগ করছে। বাকিরা যে যার বার্থে নিন্দ্রাদেবীর আরাধনায় রত। এই অবস্থায় ট্রেন খুব ধীরে ধীরে ফরাক্কা ব্রিজ পার হচ্ছে। কিছু পরে দুই বন্ধুর একটু তন্দ্রা আসে। ট্রেনের দুলুনিতে তাতে ছন্দ আসে। তন্দ্রাছন্ন দুই বন্ধু বসে বসেই দুলতে থাকে। ট্রেন এগিয়ে চলে।
শিয়ালদায় যখন ট্রেন পৌঁছল, তখন রাত সাড়ে এগারটা। প্লাটফর্মে ট্রেন ঢোকার পর হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যায়। কে আগে নামবে তার লড়াই। একটু ফাঁকা হতে সহজ ও অন্যমুখ নিজেদের লাগেজ নিয়ে ট্রেন থেকে নামে। কিন্তু অন্যমুখের সমস্যা হলো এতরাতে সে কি করে বাড়ি যাবে? সেই দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা। কি করবে এই চিন্তার মধ্যে সহজ ঠেলা লাগায়। " এত চিন্তার কি আছে? চল আমার সঙ্গে। আজ আমার বাড়িতে থাকবে। কাল তখন দেখা যাবে।"
" না। এত রাতে তোমার বাড়ির লোকজনকে ব্যতিব্যস্ত করে লাভ নেই। আমি এখানে একটা হোটেল থেকে যাব। "
" তা হয় নাকি! একটা রাত্রি আমার বাড়িতে কাটাতে তোমার এত অস্বস্তি? ঠিক আছে যা ভাল বোঝ কর। আমার ও মনে থাকবে!"
সহজের এই সেন্টিমেন্টাল খোঁচায় কাজ হলো। অন্যমুখ সহজের সঙ্গে তার বাড়ি যেতে রাজি হলো। সহজ থাকে উত্তর কলকাতার বিডন রোর এক বনেদি বাড়িতে। একান্নবর্তী পরিবার। বাড়িতে হৈচৈ লেগেই থাকে। সবার খেতে এমনিতে রাত হয়। সহজ ও অন্যমুখ এতরাতে পৌঁছতে ও বাড়ির লোকজনের কোনো হেলদোল নেই। দু একজন গেস্ট তো নিত্যদিনের ব্যাপার। সহজের মা অন্যমুখের যত্নের কোনো খামতি রাখলেন না। খাওয়া দাওয়ার পর রাতে সহজ আর অন্যমুখের একঘরে শোওয়ার ব্যবস্থা হলো। গল্প করতে করতে দুই বন্ধু ঘুমিয়ে পড়ে। জ্যোৎস্নার নিঃসঙ্গ চাঁদ ঘুরতে ঘুরতে এই বাড়ির খোলা জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে এরা ঘুমিয়ে পোড়েছে। অভিমানী চাঁদ যেন আবার তার নিস্তব্ধ যাত্রায় ফিরে যায়!
পরদিন ঘুম থেকে উঠে চা খেয়ে অন্যমুখ তৈরি হতে যায় নিজের বাড়ি যাওয়ার জন্য। সহজের মা এসে বলেন, " বাবা, কাল এতরাতে ঠিক মতো খাওয়া হয় নি। আজ তোমার জন্য তাড়াতাড়ি রান্না করতে বলে দিয়েছি। একটু খেয়ে তুমি তোমার বাড়ি যেও। এতদিন পর বাড়ি যাচ্ছো! বাড়ির লোকজন ও আশায় আছে। নিশ্চয়ই যাবে বাবা। তোমায় আর আটকাবো না। খেয়ে দেয়ে যেও।" অগত্যা, তাতেই রাজি হতে হলো। দুপুরের খাওয়া একটু তাড়াতাড়ি খেয়ে অন্যমুখ নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
তিন
অন্যমুখেরা দুই ভাই। দাদা দেশমুখ। সোনারপুর কলেজের অধ্যক্ষ। বৌদি ও কলকাতার এক মহিলা কলেজের অধ্যাপিকা। দুই ছেলে মেয়ে। ছেলে বড়। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বেঙ্গালোরে এক কোম্পানিতে ভাল মাইনের চাকরি করে। মেয়ে ডাক্তারি পড়ছে। ফাইনাল ইয়ার। রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত ফ্যামিলি। দেশের বাড়িতে এদের যাতায়াত নেই বললে কম বলা হয়। এদিকে অন্যমুখ এই চাকরি পাওয়ার আগেও হস্টেলে বেশি সময় কাটিয়েছে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার গোসাবার এক প্রত্যন্ত গাঁয়ে অন্যমুখের দেশের বাড়ি। সেই মাটির বাড়িতে থাকার মধ্যে এক বিধবা পিসি। প্রায় বাল্যবিধবা পিসি প্রথম থেকেই এই বাড়িতে থাকেন। অন্যমুখ ছোট বয়সে মাকে হারিয়েছে। এই পিসিই কোলে পিঠে তাকে মানুষ করেছেন। বাবা ও বহুদিন শয্যাশায়ী ছিলেন। তাঁর সেবাযত্ন ও এই পিসিই করেছেন। অন্যমুখের সেই কারণে পিসির প্রতি আলাদা এক টান কাজ করে। সুযোগ পেলেই সেজন্য অন্যমুখ দেশের এই বাড়িতে চলে আসে। এখন এই বাড়িতে পিসিই একা থাকে। অন্যমুখদের এখানে এই মাটির বাড়ি ছাড়া এক চিলতে জলা জমি ও এক টুকরো বাস্তুজমি। জলাজমি ভাগচাষিকে দেওয়া আছে। সে যা দেয় তা নিয়েই সন্তুষ্ট। আর বাস্তুজমিতে পিসি মাঝেমধ্যে শাকসব্জির চাষ করে। যখন অন্যমুখ এখানে থাকতো, সেও হাত লাগাতো। পিসিকে সাহায্য করতো। এখন পিসির বয়স হয়েছে। খাটাখাটুনি করতে পারে না। অন্যমুখ ও এখন নিয়মিত আসতে পারে না। সেকারনে এই বাগান ফাঁকাই পড়ে থাকে। অন্যমুখ পিসিকে একজন কাজের লোক নেওয়ার কথা অনেক দিন থেকে বলছে। কিন্তু পিসি এই কথায় কান দেননা। তাছাড়া এসব জায়গায় কাজের লোক তেমন খুব একটা পাওয়া যায় না। এখানে জান হাতে নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যায়। আয়লার সময় তো একই গাছে সাপে মানুষের সহাবস্থান দেখা গেছে। এমনকি কখনও কখনও বাঘ ও কুমীরকে দেখা গেছে ওই গাছের তলায় দাঁড়িয়ে থাকতে। এই মানুষ পশুতে পরস্পর লড়াই করলেও আয়লা বিধ্বস্ত এই বিস্তীর্ন অঞ্চলে এদের সহাবস্থান বহু জায়গায় প্রত্যক্ষ করা গেছে। ওই সময়ে এখানকার লোকজনের কাছে 'রুপোলী চাঁদ ' আর জ্যোৎস্না ঝরায় না। তা কেবল 'ঝলসানো রুটি '। আয়লার সেই ক্ষত এখন ও এখানে দগদগে ঘা হয়ে থেকে গেছে। অন্যমুখ দেশের বাড়িতে এলে কখনো সখনো দাদার বাড়িতে গিয়ে ও দু একদিন কাটিয়ে আসে। সবাই এখানে অন্যমুখের যত্ন নেয়। এবারে প্রথমে দাদার বাড়িতে যায়। সেখানে একরাত কাটিয়ে সকালে গোসাবায় যায়। অনেকদিন পর আদরের ভাইপোকে পেয়ে পিসি যারপরনাই খুশি। এই বৃদ্ধ বয়সের অশক্ত শরীর নিয়ে ও ভাইপোর যত্ন আত্তির ত্রুটি রাখেন না।
এদিকে উত্তরবঙ্গে বন্যার জল কিছুটা কমেছে। তবে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয় নি। অল্প কিছু দূরপাল্লার ট্রেন অনিয়মিতভাবে চলা শুরু করেছে। সহজ ও অন্য দু একজন সহকর্মী মিলে কয়েকটি চেন্নাই বঙ্গাইগাঁও সুপার ফাস্টের টিকিট জোগাড় করতে পেরেছে। অন্যমুখের জন্য ও একটি টিকিটের ব্যবস্থা হয়েছে। সামনের বৃহস্পতিবার হাওড়া থেকে ট্রেন ধরতে হবে। দুপুর আড়াইটায় ট্রেন ছাড়বে।
চার
দুটোর মধ্যে সবাই হাওড়া স্টেশনের বড়ঘড়ির সামনে হাজির। ট্রেন ও মোটামুটি ঠিক সময়ে পৌঁছে গেছে। ট্রেনে উঠে যে যার বার্থে জিনিসপত্র রেখে নিজেদের সীটে বসে পড়ে। আসলে হাওড়ায় এই ট্রেন থেকে বহু প্যাসেঞ্জার নেমে যাওয়ায় ট্রেন অনেকটা খালি। চাওয়ালা যাচ্ছিল। তাকে দেখে সহজ ডাকে। বলে, " চা কত ভাই? "
" দশ টাকা।"
" দামটা একটু বেশি বলছো।"
" না বাবু। বড় কাপ আছে।"
" ঠিক আছে। পাঁচ কাপ দাও।" চাওয়ালা চা দিয়ে চলে যায়। ফেরার পথে পয়সা নেয়।
বন্যার জল এখনো পুরোপুরি নামেনি। ট্রেন সেই কারণে অনেক স্লো চলছিল। বহু কষ্টে ট্রেন এনজেপি স্টেশনে পৌঁছল। সুপার ফাস্ট এল না লোকাল এল বোঝা মুস্কিল। রিটায়ারিং রুমে একটু ফ্রেশ হয়ে ওখানকার ক্যান্টিনে থালি লাঞ্চ সেরে চটজলদি ট্যাক্সি ধরে দার্জিলিং এর পথে রওনা দেয় সবাই। এখন কুয়াশার ঘোমটায় পাহাড়রানি মুখ ঢেকেছে। তার সুন্দর মুখ পরপুরুষ পর্যটকের দেখা বারণ। এরমধ্যে আবার পাহাড়ের 'ঘুম' রানি রাস্তাকে দুর্গম ও দুর্ভেদ্য করে তুলেছে। হলুদ রঙের ফগ লাইট ও এই কুয়াশাচ্ছন্ন পথে চড়াই উৎরাইের পাহাড়ি রাস্তাকে সুগম করতে খুব একটা সাহায্য করছেনা। ট্যাক্সির ভেতরের যাত্রীরা ঘুমের ঢুলুনির মধ্যেই দার্জিলিং পৌঁছে যায়। পরের দিন থেকে আবার পুরোনো রুটিন চালু।
এইবার বাড়ি থেকে ফেরার পর বেশ কিছুদিন ধরে পেটের যন্ত্রণায় ভুগছিল সহজ। আসলে সহজের রোগ ভোগার একটি পুরোনো ইতিহাস আছে। ছাত্রাবস্থায় সহজ পড়াশোনার জন্য রাতজাগা, খাওয়া দাওয়ায় অনিয়ম যথেচ্ছভাবে করেছে। তখন মাঝেমধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়তো সে। কিছুদিনের মধ্যে দেখা গেল কালো রঙের পায়খানা হচ্ছে সহজের। ম্যালিনা রোগে আক্রান্ত। সঙ্গে সঙ্গে হসপিটালে ভর্তি। অনেক বোতল ব্লাড দিতে হলো। কিছুদিন হসপিটালে কাটিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে। এরপর মাস্টার ডিগ্রি পড়ার সময় হঠাৎ আবার অসুস্থ। এবার যমে ডাক্তারে টানাটানি। কিডনির সমস্যা। এবং সে সমস্যা এতই জটিল যে দুই কিডনির মধ্যে একটিকে কেটে বাদ দিতে হবে। নাহলে সহজকে বাঁচানো সম্ভব নয়। অগত্যা, ডাক্তার সহজের একটি কিডনি কেটে বাদ দেন। সহজ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে। এতদিন সহজ সবকিছুই করছে একটি কিডনি নিয়েই। এখন আবার সেই পুরোনো ব্যথাটা ফিরে এসেছে। মাঝে মাঝে সেটা সহ্যের সীমানা ছাড়িয়ে যায়। অন্যমুখ বন্ধুকে এখানকার হসপিটালে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখায়। ডাক্তার ওষুধ দেন। কিন্তু সাময়িক কিছু রিলিফ হয় বটে, তবে অবস্থার আরও অবনতি হয়। কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে অন্যমুখ বন্ধুকে ফ্লাইটে কলকাতায় নিয়ে আসে। নামী বেসরকারি হসপিটালে সহজের চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়। নামী ডাক্তারের আন্ডারে ট্রিটমেন্ট চলে। একের পর এক পরীক্ষা করা হয়। সহজের পা থেকে প্রায় সারা শরীর ফুলে যেতে থাকে। ডাক্তার বলেন, " ডায়ালিশিসে ও কাজ হচ্ছে না। একমাত্র উপায় কিডনি রিপ্লেশমেন্ট। এবং তার ব্যবস্থা খুব শিগগিরই করতে হবে। এছাড়া অন্য কোন রাস্তা নেই।"
সহজের পরিবারের সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে কিডনি জোগাড় করার জন্য। এজেন্ট লাগানো থেকে পেপারে বিজ্ঞাপনে ও কোন কাজ হয় না। এদিকে ডাক্তার তাগাদা লাগিয়ে যাচ্ছেন। " কিডনি জোগাড় করতে যত দেরি করবেন, তত পেশেন্টের হাল খারাপ হবে। এরপর আমার হাতের বাইরে চলে যাবে। তখন কিচ্ছু করার থাকবে না।"
" ডাক্তারবাবু, আমরা আপ্রান চেষ্টা করছি। কিন্তু কোন হদিস করে উঠতে পারছি না। চেষ্টার কোন বাকি নেই। ভগবানের ওপর ভরসা। আমাদের এমন যোয়ান ছেলে, তার কি যে হলো!" সহজের বাবা মা ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
অন্যমুখ ও চেষ্টার কোন কসুর করে নি। সহজের হসপিটালে ভর্তি থেকে সব ব্যাপারেই সে অগ্রনী ভূমিকা নেয়। সহজের বাবা মাকে আশ্বস্ত করে " মাসিমা মেসোমশাই, আপনারা চিন্তা করবেন না। একটা কিডনির ব্যবস্থা করা গেছে। এবং এরজন্য কোন টাকা পয়সার দরকার নেই। এক ভদ্রলোক তার একটি কিডনি দিতে রাজি হয়েছেন। তার একটিই শর্ত। তার পরিচয় জানতে চাইবেন না।" অন্যমুখের কথায় সহজের বাবা মা ভরসা পান। কিডনি রিপ্লেসমেন্টের সব পরীক্ষাই হলো। সব রেজাল্ট পজেটিভ। অবশেষে, রিপ্লেসমেন্টের দিন এল। সহজকে ওটিতে ঢোকান হল। অনেকক্ষন ধরে অপারেশন চলল। অপারেশন সাকসেসফুল। জ্ঞান ফিরে সহজ প্রথমেই বন্ধু অন্যমুখের খোঁজ করে। বাবা মা অন্যেরা কেউই কিছু বলতে পারেন না। মা বলেন, " ওই তো সব ব্যবস্থা করল। অপারেশনের দিন থেকে তো ওকে দেখছি না। কি ব্যাপার হলো?" সবাই এ ওকে জিজ্ঞেস করছে অন্যমুখের ব্যাপারে। কিন্তু কারুর কাছে কোনো উত্তর নেই। এই সময় ডাক্তারবাবু ভিজিটে এসেছেন। এই বিষয়টি তার কানে ও যায়। তিনি সহজের কাছে এসে বলেন, " আপনার বন্ধু পাশের ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন। ভাল আছেন। চিন্তার কিছু নেই।"
" কি হয়েছে অন্যমুখের?" সহজের গলা শঙ্কায় কম্পমান।
" ওনার কিচ্ছু হয় নি। ওনার একটি অঙ্গ উনি বন্ধুকে ডোনেট করেছেন। তাই ছোট্ট একটা অপারেশন করতে হয়েছে। এখন দুই বন্ধুই সুস্থ আছেন।"
ডাক্তারের কথা শুনে সহজের দু চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রুবিন্দু ঝরতে থাকে। তার বাবা মা অপলক নয়নে উদাস দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে থাকেন।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
বন্ধুর জন্য এক বন্ধুর নিঃশব্দে সবরকম সাহায্য, এমনকি বন্ধুকে প্রানদানের জন্য নিজ অঙ্গদান তাও সবার অজান্তেই। বন্ধুত্বের এই তো উদাহরণ। এই তো আসল বন্ধুত্ব।
১৯ জুন - ২০২১
গল্প/কবিতা:
২৩ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪