" নমস্কার, আমি অশোক "
চোখ তুলে চিরাচরিত দেখে হাত জোড় করে এক ভদ্রলোক তার সামনে দাঁড়িয়ে। সে ও হাত জোড় করে বলে " আমি চিরাচরিত, আপনাকে....?" অশোকের চটজলদি উত্তর " আপনি এই কলেজে পার্টটাইম লেকচারারের ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন তো? আপনাকে ও আমাকে নেবে এখানে।" বাক্যালাপের মধ্যেই পিওন এসে ডাক ছাড়ে " চিরাচরিত কে আছেন?"
" আমি "
" আসুন আমার সঙ্গে।" চিরাচরিত পিওনকে ফলো করে এগিয়ে যায়। পেছন ফিরে পিওন বলে
" ওই ঘরে যান, ভেতরে স্যার আছেন।" চিরাচরিত বাধ্য ছেলের মতো দুরু দুরু বুকে দরজা ঠেলে বলে
" আসব স্যার?"
বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপাশে বিশাল চেয়ারে বসা শুভ্রকেশধারী সৌম্যকান্তি ব্যক্তি গুরু গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠেন
" আসুন, মাঝের চেয়ারটায় বসুন।"
ইনি হলেন নবকৃষ্ণ কলেজের প্রিন্সিপাল সপ্তদর্শী ভট্টাচার্য। একাডেমিক জগতে বিখ্যাত ব্যক্তি। তার লেখা অনেক বই ছাত্রদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। ভয় ভয় মনে চিরাচরিত চেয়ার টেনে বসে। বলে
" থ্যাংক ইউ স্যার।"
মনে মনে ভাবে কি প্রশ্ন করবে জানি না। অধ্যক্ষ বলেন
" আচ্ছা, আপনি সপ্তাহে কদিন ক্লাস নেবেন বলুন।"
বিষয়ের ওপর প্রশ্নের বদলে সরাসরি ক্লাসের কথায় কিছুটা অবাক চিরাচরিত। বলে
" না স্যার, সপ্তাহে একদিনের বেশি পারব না। আমার পিএইচডি, কলেজ ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ইন্টারভিউর জন্য পড়াশোনা আছে।"
" কলেজ সার্ভিস কমিশনের লিস্টে নাম উঠলে আমি আমার কলেজে আপনাকে নিয়ে নেব। চিন্তা করবেন না।" অধ্যক্ষ মশাইের এই কথার মাঝেই পিওন হুড়মুড়িয়ে প্রিন্সিপালের চেম্বারে ঢোকে। বলে
" স্যার, ছাত্ররা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।"
" এখন হবে না বলে দে। পরে আসতে বল।"
অধ্যক্ষ মশাইের কথা শুনে পিওন বেরিয়ে যায়। পরমুহূর্তে সশব্দে দরজা ঠেলে একপাল ছাত্র চেম্বারে ঢুকে পড়ে। নেতা টাইপের একজন অধ্যক্ষের টেবিলে মুষ্টিবদ্ধ হাতে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করে। বলে
" আপনাকে এক্ষুণি আমাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। "
" বাইরের লোকজন আছেন, পরে আয়। "
" না; এক্ষুণি শুনতে হবে। নাহলে আমরা সবাই এখানে বসে পড়ব।"
অগত্যা চিরাচরিতের উদ্দেশ্যে অধ্যক্ষ মশাই বলেন
" আপনার অ্যাড্রেস পিওনকে দিয়ে যান। আমরা যোগাযোগ করে নেব।"
প্রিন্সিপালের চেম্বার থেকে বেরিয়ে অশোকের সঙ্গে দেখা।
"কেমন হোল?"
" ভাল, আচ্ছা আপনি থাকেন কোথায়?" চিরাচরিতের প্রশ্নের উত্তরে অশোক
" ফুলবাগান। পরে দেখা হবে।"
চিরাচরিত নিজের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
কেষ্টপুরের একটি মেসে তিন বন্ধুর সঙ্গে থাকে চিরাচরিত। নিজেরা পালা করে বাজার করা থেকে রান্না বান্না সবই করে। আজ চিরাচরিতের রান্নার পালা। সব কিছু জোগাড় করে সবে রান্না চাপিয়েছে, এমন সময় বাইরে কেউ জিজ্ঞেস করছে
" চিরাচরিত বাবু এখানে থাকেন?"
এ বাড়ির কেউ উত্তর দেয় " হ্যাঁ এখানে থাকে।" চিরাচরিত দেখে নবকৃষ্ণ কলেজের পিওন আসছে।
" আপনি, কি ব্যাপার?" চিরাচরিতের প্রশ্নের উত্তরে পিওন
" প্রিন্সিপাল স্যার এই চিঠিটা আপনাকে দেওয়ার জন্য দিয়েছেন।" পিওন চিরাচরিতের হাতে ব্রাউন কালারের একটি খাম ধরিয়ে দেয়। পিওন চলে যাওয়ার পরে খাম খুলে দেখে চিরাচরিত। পার্টটাইম লেকচারারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার । সপ্তাহে ছখানা ক্লাস। মাসে একশ পঁচিশ টাকা মাইনে। শিগগির জয়েনের অনুরোধ।
সপ্তাহের প্রথম দিন কলেজে জয়েন করল। ওই দিন কলেজে উজ্জ্বল নামে এক সহকর্মীর সঙ্গে পরিচয় হল। উজ্জ্বল অর্থনীতির। পরিচয়ের পর উজ্জ্বল বলল
" চল তোমাকে আসল জায়গাটা চিনিয়ে দি।"
দুজনে মিলে অফিসে ক্যাশিয়ারের রুমে গেল। উজ্জ্বলকে দেখে ক্যাশিয়ার বলে উঠল " আসুন স্যার, ভাল আছেন তো?"
"হ্যাঁ, আপনি কেমন আছেন?"
"ভাল আছি স্যার।"
" ইনিই আসল লোক। চিনে রাখ। মাসের শেষে কুড়ি পয়সার রেভিনিউ দিয়ে এনার কাছ থেকে তোমার মাইনে নিতে হবে।"
ক্যাশিয়ারকে দেখিয়ে উজ্জ্বল চিরাচরিতের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলে। চিরাচরিত ক্যাশিয়ারের সঙ্গে নমস্কার বিনিময় করে। পরে দুজনে কলেজ থেকে বেরিয়ে নিজের নিজের গন্তব্যে রওনা দেয়। এই হল চিরাচরিতের কলেজে শিক্ষকতা জীবনের শুরু।
পূজোর ছুটিতে চিরাচরিত দেশের বাড়িতে পূজো কাটাতে চলে গেল। ছুটি কাটিয়ে মেসে ফিরে দেখে তার নামে ব্রাউন রঙের খামে একটা চিঠি এসেছে। চিঠি খুলে দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ফেলোশিপের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। ভুলেই গেছে যে এই ইন্টারভিউটা বেশ কিছু দিন আগে সে দিয়েছিল। খুশির খবর। মেসের বন্ধুরা সবাই খুশি। তারা জানতো চিরাচরিত ভাল অফার পাবেই। চিরাচরিত বরাবরই পড়াশোনায় ভাল। সবার আবদার ট্রিট দিতে হবে। সব বন্ধুরা মিলে মেসে আজ গ্রান্ড ফিস্টের ব্যবস্থায় মেতে উঠল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ স্কলার হিসেবে জয়েন করল চিরাচরিত। রিসার্চ গাইডের পরামর্শ মতো ন্যাশনাল লাইব্রেরির মেম্বার হল। নিয়মিত লাইব্রেরী যাতায়াত শুরু হল। কলেজের ক্লাস, লাইব্রেরীতে পড়াশোনা, মাঝেমধ্যে ইউনিভার্সিটি যাওয়া। এভাবেই কাটছিল চিরাচরিতের জীবন। এমন সময়ে আর একটা সুখবর এল। সরকারি কলেজে শিক্ষকতার অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটার। রিসার্চ স্কলার হিসেবে জয়েন করার পরেই পাবলিক সার্ভিস কমিশনে এই ইন্টারভিউটা দিয়েছিল চিরাচরিত। এই আনন্দের মধ্যেও একটু মন খারাপ হল চিরাচরিতের। কারণ এমন কিছু নয়। পোস্টিং দার্জিলিং সরকারি কলেজে। প্যানেলে এক নম্বরে থেকেও দূরের কলেজে পোস্টিং। কিছুটা হতাশ চিরাচরিত। অগত্যা সরকারের কাছে একটা রিপ্রেজেন্টেশন জমা দেয়। তার রিসার্চ এখন কমপ্লিশনের অ্যাডভান্সড স্টেজে। কিছু দিন পর রিপ্রেজেন্টেশনের কি হাল জানতে রাইটার্স বিল্ডিংস গেল। সেক্রেটারির সঙ্গে বহু কষ্টে দেখা করল। সেক্রেটারির চেম্বারে ঢুকতেই প্রশ্ন " বলুন, কি বলতে চান?"
" আমার রিসার্চের কাজটা প্রায় কমপ্লিট হওয়ার পথে। এখন যদি কলকাতা বা আশেপাশে কোথাও পোস্টিং দেওয়া যায় তো আমার খুব উপকার হয়"
"বলুন, চাকরির দরকার নেই। কিছু করার নেই। শিগগির জয়েন করুন " - গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে সেক্রেটারি।
ভগ্ন হৃদয়ে ফিরে চিরাচরিত তার রিসার্চ গাইডের সঙ্গে দেখা করে। স্যারের কাছে আলোচনা করে পরামর্শ চায়। বলে
" স্যার,আমি ভাবছি এ চাকরিটা নেব না। পিএইচডিটা কমপ্লিটের পথে। এটা হয়ে গেলে কিছু একটা পেয়ে যাব।"
"না, তুমি জান না কিছু দিন আগে অব্দি এই চাকরি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির থেকে ও সম্মানের ছিল। এখন ও সরকারি চাকরির গুরুত্ব অনেক। তুমি এখনই জয়েন কর। পিএইচডি নিয়ে চিন্তা কোর না। ও ঠিক হয়ে যাবে।"
আজ চিরাচরিত দার্জিলিং মেলে উঠে বসেছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছে দার্জিলিং সরকারি কলেজে জয়েন করবে। তাকে সী অফ করতে মেসের বন্ধুরা এসেছে। গাইড স্যার ও স্টেশনে এসেছেন চিরাচরিতকে সী অফ করতে। স্যার ট্রেনের কম্পাটমেন্টে উঠে চিরাচরিতের বার্থে বসে তাকে উৎসাহ ও আশীর্বাদ দিয়ে গেছেন। ট্রেন ছাড়ার পর চিরাচরিতের মন কিছুটা উদাস হয়ে যায়।
মেসের থেকে রাতের খাবার খেয়ে এসেছে। কিছুটা টিফিন কৌটয় ও নিয়ে এসেছিল। বর্ধমান স্টেশনে ট্রেন পৌঁছনোর পর সেই টিফিন বের করে খেয়ে নেয়। হাত মুখ ধুয়ে টয়লেট সেরে বার্থে শুয়ে পড়ে। রাতে শোয়ার সময় বই পড়া চিরাচরিতের বরাবরের অভ্যেস। সাইড ব্যাগ থেকে বই বের করে। 'War and Peace'। লিও টলস্টয়েরলেখা। নেপোলিয়নের সৈন্যদের রাশিয়া আক্রমন, স্পিরিচ্যাুয়ালিটি ও ফ্যামিলি হ্যাপিনেস নিয়ে লেখা। পড়তে পড়তে বুকের ওপরে বই রেখে চিরাচরিত ঘুমিয়ে পড়ে। কু ঝিক ঝিক শব্দে যন্ত্রদানব প্রচন্ড গতিতে অন্ধকারের গর্ভ ভেদ করে এগিয়ে চলে। ট্রেনের দুলকি চালে চিরাচরিতের ঘুমের কোন ব্যাঘাত হয় নি। নতুন চাকরির আনন্দে হয়তো সুখ নিদ্রায় মগ্ন। ট্রেনের শব্দ ও ঝাঁকুনি সেই নিদ্রায় কোন বিঘ্ন ঘটাতে পারে নি।
রাতভোরে ট্রেনের প্রচন্ড ঝাঁকুনি ও চাওয়ালার ডাকে ঘুম ভাঙে চিরাচরিতের। মুখ তুলে চাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে
" ভাই, কি হয়েছে? এটা কোথায়?"
"সামনে লরি ব্রেক ডাউন হয়েছে। এটা ডালখোলার কাছে।"
চিরাচরিত বার্থ থেকে নেমে নীচে রাখা চটি পায়ে গলিয়ে নেয়। ব্রাশ পেস্ট নিয়ে টয়লেটে যায়। ফিরে এসে হ্যান্ড তোয়ালে দিয়ে হাত মুখ মোছে। বার্থের এক কোনায় বসে চওয়ালাকে বলে " একটা চা ভাই।"
"স্যার এখন কফি। চা হতে একটু দেরি হবে।"
" ঠিক আছে। কফিই দাও।"
ব্যাগ থেকে বের করা বিস্কুটের সঙ্গে গরম কফি তারিয়ে খেতে থাকে চিরাচরিত। এমন সময়
" মা, দেখবে এসো। ফুল রেঞ্জ কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে। একদম পরিষ্কার।"
কোন এক মেয়ে তার মাকে ডেকে বলছে। লরি ব্রেক ডাউনের জন্য ট্রেন দাঁড়িয়ে গেছে। অনেকেই ট্রেন থেকে নেমে পায়চারি করছে। তাদের মধ্যে কোন মেয়ে হবে। রোদ ঝলমল পরিষ্কার আবহাওয়া। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না চিরাচরিত। রাতের পাজামা পাঞ্জাবি পরা অবস্থায় চটি গলিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়ে। রৌদ্রচ্ছটায় কাঞ্চনজঙ্ঘাকে শ্বেতশুভ্র রমণীর মতো লাগছিল। প্রতিটি চূড়া নিখুঁতভাবে বোঝা যাচ্ছে। নিজেকে ভাগ্যবান ধন্য মনে হল চিরাচরিতের। জীবনে প্রথম কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা। আগে কখনো দার্জিলিং যায় নি সে। মনে মনে আপ্লুত হয়ে ভাবছিল। এমন সময় কেউ যেন বলে উঠল
" সবাই ট্রেনে উঠে পড়ুন। সিগন্যাল হয়ে গেছে।"
হুড়মুড়িয়ে সবাই ট্রেনে উঠে পড়ে। চিরাচরিত ও উঠে নিজের সিটে বসে পড়ে। জীবনের প্রথম কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকে।
ট্রেন এনজেপি পৌঁছনোর আগে চিরাচরিত জামা কাপড় চেঞ্জ করে নেয়। রাতের পোশাক ও চটি ব্যাগের মধ্যে ভরে নেয়। সুটকেস টেনে বের করে। ট্রেন একটা ঝাঁকুনি দিয়ে এনজেপি স্টেশনে থামল। সবার মধ্যে আগে নামার হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। এর মধ্যে কুলীদের দৌরাত্ম শুরু হয়ে গেল। চিরাচরিত নিজের লাগেজ নিয়ে নেমে পড়ে। রেলের রিটায়ারিং রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। পাশেই ক্যান্টিন। ক্যান্টিনে দেখে ভাতের থালি পাওয়া যাচ্ছে। বেশ সস্তা। গরম গরম সব্জি ভাত সঙ্গে দই। পরিতৃপ্তি করে খেয়ে দার্জিলিং যাওয়ার ট্যাক্সি ধরার জন্য রওনা দেয়। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে যায়। তাকে দেখে এক ট্যাক্সি ড্রাইভার জিজ্ঞেস করে " কোথায় যাবেন?"
"দার্জিলিং"
" দার্জিলিং এর কোথায়?"
" দার্জিলিং গভর্মেন্ট কলেজ "
" আসুন, পঞ্চাশ টাকা লাগবে"
অগত্যা লাগেজ ডিকিতে দিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে বসে চিরাচরিত। ট্যাক্সিতে ড্রাইভার নিয়ে আট জন। এটাই এখানকার নিয়ম। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসার সুযোগ পেল চিরাচরিত। দার্জিলিং সফর তার জীবনে প্রথম। ইচ্ছে ছিল টয়ট্রেনে চড়ে দার্জিলিং যাবে। পাহাড় ও প্রকৃতিকে অনেক কাছ থেকে দেখা যেত। কিন্তু তা তো হওয়ার নয়। টয়ট্রেন এখন বন্ধ। ট্যাক্সির সামনে ড্রাইভারের কাছের সিট সেই সুযোগ চিরাচরিতের কাছে এনে দিল।
ট্যাক্সিতে উঠেই বাঙালি ড্রাইভারকে চিরাচরিত বলে " দাদা, আমাকে দার্জিলিং গভর্মেন্ট কলেজে পৌঁছে দেবেন তো? আমি কিন্তু এখানকার কিছুই চিনি না।"
" চিন্তা করবেন না। ঠিক পৌঁছে দেব।"
ড্রাইভারের আশ্বাসে চিরাচরিত মনে ভরসা পেল। গাড়ি সুকনার জঙ্গল ধরে এগিয়ে চলেছে। রাস্তা সমতল। দুদিকে শাল সেগুন শিশু দেওদার বনরাজি। ছোট্ট যন্ত্রদানব অরন্য বিদীর্ন করে এগিয়ে চলেছে। মাঝে ছবির মতো ছোট্ট সুন্দর বন বাংলো। সুকনা পেরতেই পাকদন্ডী বেয়ে গাড়ি এগোতে থাকে। পাহাড়ে পথ চলা শুরু। রাস্তায় অল্প দূরত্বেই পথের বাঁক। 'গো স্লো' ' হর্ন প্লিজ ' লেখা প্রতি বাঁকেই। রাস্তার একদিকে পাহাড় গাছ লতা ফুল, অন্য দিকে খাদ। ড্রাইভার একটু ভুল করলেই গাড়িসুদ্ধু সবাই অতল অজানা খাদে। চিরাচরিত প্রকৃতির সৌন্দর্য্য লেহন করতে করতে যাচ্ছিল। গাছপালা লতাগুল্ম ফুল তার মনকে বড়ই প্রসন্ন করেছে। কিছুটা আবেশে তন্দ্রা এসে গেছিল, এমন সময় প্রচন্ড জলস্রোতের শব্দে তন্দ্রাহরণ হল। সামনে তখন পাগলা ঝোরার উদ্দাম নৃত্য। অনেক পর্যটক দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য উপভোগ করছে। চিরাচরিতদের ট্যাক্সি পাগলা ঝোরায় অপেক্ষা না করে চলতে থাকে। কিছুক্ষনের মধ্যে ছবির মতো সুন্দর একটি শহরে ট্যাক্সি পৌঁছে যায়। কার্শিয়াং শহর। একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে ট্যাক্সি দাঁড়াল। সবাই ট্যাক্সি থেকে নেমে রেস্টুরেন্টে ঢোকে। ড্রাইভার ও ঢোকে। সবাই চা স্ন্যাক্স দিয়ে টিফিন সেরে ট্যাক্সিতে এসে বসে। ট্যাক্সি দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
এবারে ট্যাক্সি ননস্টপ চলতে থাকে। পথিমধ্যে দুজন যাত্রী নেমে যায়। বাকীদের বসায় একটু স্বাচ্ছন্দ্য আসে। গাছপালা ফুল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পাহাড়কে মোহময়ী সুন্দরী করে তুলেছে। সুন্দরী পাহাড়ের অপূর্ব রূপ চিরাচরিত এনজয় করতে করতে কাব্যিক হয়ে ওঠ। মনে মনে বলে ওঠে
' আই আম সাকিং নেচার
ও গড হাউ পার্টিজান ইউ আর
সামহয়ার ইউ আর মাইজার সামহয়ার ইউ আর জেনারাস'
পাকদন্ডীর রাস্তায় বাঁকের মোড়ে থেকে বেশ কয়েক জায়গায় কাঞ্চনজঙ্ঘার নির্মল হাতছানি। মন ভরে যায়। পথের ক্লান্তি কোথায় উবে যায়। ট্যাক্সি এখন চড়াইের পথ ধরে উঁচুতে উঠছে। মাইল ফলকে চিরাচরিত দেখে আট হাজার ফুট উচ্চতা। রাস্তা কালো মেঘে ঢেকে আছে। ট্যাক্সি ফগলাইট জ্বালিয়ে সেই কালো মেঘ ভেদ করে মন্থর গতিতে এগিয়ে চলে। ট্যাক্সির জানালা দিয়ে মেঘ গুলো ভেতরে ঢুকে আসে। ট্যাক্সির কাঁচ তুলে দেয় ওরা। এটা ঘুম রেল স্টেশন। পৃথিবীর অন্যতম উচ্চ রেল স্টেশন। এখানে পুরো অন্ধকার। ফগলাইট ছাড়া এক পা ও এগোন সম্ভব নয়। ঘুমের দেশ পেরিয়ে ট্যাক্সি এবার উৎরাই এর পথ ধরে। ট্যাক্সি এখন দার্জিলিং এ ঢুকছে। বাঁদিকে বর্ধমান মহারাজার গোলাকাকৃতি গম্বুজ বাড়ী দেখা যাচ্ছে। একটু এগিয়ে দার্জিলিং রেলস্টেশন। ট্যাক্সি আর ও এগিয়ে চকবাজারে ঢোকে। চকবাজার এখানকার ধর্মতলা। এখানে বাকি যাত্রীরা নেমে যায়। চিরাচরিত ও নামতে যায়। ড্রাইভার বলে
"না, আপনার নামার জায়গা এখনো আসে নি। বসুন।"
"আচ্ছা, আর কত দূর?"
"বেশি না।"
চিরাচরিতকে নিয়ে ট্যাক্সি লেবং রোড ধরে এগিয়ে চলে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এক জায়গায় দাঁড়ায়।
" আপনার কলেজ এসে গেছে।"
" আপনি দাদা কাইন্ডলি একটু ওয়েট করুন। আমার লাগেজ রইল। আমি এসে আপনাকে ভাড়া দিচ্ছি।"
এই বলে চিরাচরিত সাইড ব্যাগটা নিয়ে ট্যাক্সি থেকে নামে। দেখে নেয় অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার ও অন্য কাগজপত্র ঠিক আছে কিনা। সামনে ছবির মতো সুন্দর একটি রাস্তা ওপরে উঠে গেছে। চিরাচরিত সেই রাস্তা ধরে ওপরে উঠে যায়। এই রাস্তা কলেজে গিয়ে শেষ হয়েছে। কলেজে পৌঁছে স্লিম চেহারার কালো কোর্ট ও কালো চশমা পরিহিত মধ্য বয়সী দলবাহাদুর নামের এক ব্যক্তি চিরাচরিতকে দেখে জিজ্ঞেস করে
" হুম ডু ইউ ওয়ান্ট?"
"আই ওয়ান্ট প্রফেসর বিমল চক্রবর্তী।"
" কাম উইথ মি।"
দলবাহাদুরকে ফলো করে দোতলার একটি গোলাকার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে চিরাচরিত। এটাই প্রিন্সিপালের চেম্বার। আর এই দলবাহাদুর প্রিন্সিপালের খাস বেয়ারা। সেইজন্য সর্বত্র তার অবাধ বিচরন। কয়েকজন শিক্ষক প্রিন্সিপালের সামনে বসে মিটিং এ ব্যস্ত। ওঁদের মধ্যে সুট পরিহিত সৌম্যকান্তি এক শিক্ষককে দলবাহাদুর ইঙ্গিতে দেখিয়ে দেয়। ধীর পায়ে চিরাচরিত ওই শিক্ষকের কাছে এগিয়ে যায়। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে
" আপনি প্রফেসর বিমল চক্রবর্তী?"
এই প্রশ্নে প্রফেসর চক্রবর্তী ফিরে চিরাচরিতকে দেখে। প্রথম দর্শনে প্রফেসর চক্রবর্তী চিরাচরিতকে কোন ছাত্র ভাবেন। কিছুটা অবজ্ঞার স্বরে বলেন
" হ্যাঁ। কি হল?"
চিরাচরিত সাইড ব্যাগ থেকে একখানা চিঠি বের করে প্রফেসর চক্রবর্তীর হাতে দেয়। চিঠি পড়ে প্রফেসর চক্রবর্তী উঠে দাঁড়িয়ে পড়েন। প্রিন্সিপালের উদ্দেশ্যে বলেন
" স্যার, আমাদের নতুন শিক্ষক। কলকাতা থেকে এসেছেন জয়েন করতে।"
" ওনাকে জয়েন করানোর ব্যবস্থা করুন।"
প্রিন্সিপালের অনুরোধ প্রফেসর বিমল চক্রবর্তীকে। প্রফেসর বিমল চক্রবর্তী অর্থাৎ বিমলদা চিরাচরিতকে নিয়ে বাইরের আসেন। এই সময় চিরাচরিত বিমলদাকে বলে
" ট্যাক্সিতে আমার লাগেজ নিচে আছে। আনতে হবে।"
" ও তাই? একটু দাঁড়ান।"
এই বলে বিমলদা নিচে নেমে ডাক ছাড়েন।
" অর্জুন, অর্জুন।"
অর্জুন হাজির। অর্জুন কলেজের দ।রোয়ান। বিমলদাকে বলে
" বলুন স্যার।"
" ইনি নতুন স্যার। স্যারের সঙ্গে নিচে গিয়ে ট্যাক্সি থেকে লাগেজ নিয়ে এসো।"
বিমলদার কথায় অর্জুন চিরাচরিতের সঙ্গে নিচে গিয়ে ট্যাক্সি থেকে লাগেজ নিয়ে আসে। চিরাচরিত পকেট থেকে পার্স বের করে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট ড্রাইভারের হাতে দেয়। বলে
" দাদা সরি, একটু দেরি হয়ে গেল। অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।"
" না না স্যার। ও ঠিক আছে। আপনি ও ভালো থাকবেন।"
নমস্কার জানিয়ে ড্রাইভার ট্যাক্সি নিয়ে শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ওপরে উঠে চিরাচরিত দেখে লাগেজ নিয়ে অর্জুন দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে বিমলদা ও।
" ওগুলো গেস্ট হাউসে রেখে এসো। রুমের চাবি স্যারকে দিয়ে দিও।"
বিমলদা অর্জুনের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলেন। ঘাড় নেড়ে অর্জুন লাগেজ নিয়ে দোতলায় গেস্ট হাউসে রেখে আসে। চাবি চিরাচরিতের হাতে দেয়। বিমলদা চিরাচরিতকে নিয়ে কলেজ অফিসে যান। অফিসের বড়বাবু ও অন্যান্য স্টাফদের সঙ্গে চিরাচরিতের পরিচয় করিয়ে দেন। হাবিব বাবু অর্থাৎ কলেজের বড়বাবুকে চিরাচরিতের জয়েনের ব্যবস্থা করার অনুরোধ করেন। বড়বাবু কলেজের টাইপিস্ট গনেশ দাজুকে রিকোয়েস্ট করেন জয়েনিং এর কাগজপত্র রেডি করতে। এখানে দাজু কথার অর্থ দাদা। গনেশ দাজু কাগজপত্র রেডি করে বড়বাবুকে দেন। বড়বাবু চিরাচরিতকে ওই কাগজপত্রের বিভিন্ন জায়গায় সই করান। সই সাবুদ শেষ হলে চিরাচরিত বড়বাবুকে জিজ্ঞেস করে
" আর কিছু দরকার নেই তো?"।
" প্রিন্সিপালের সই হয়ে গেলে আপনার কপি আপনাকে দিয়ে দেব।"
বড়বাবু চিরাচরিতকে জানান। মাথা নেড়ে সায় দেয় চিরাচরিত। বিমলদা এতক্ষন বসে চিরাচরিতের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কাজ শেষ হতে বিমলদা চিরাচরিতকে নিয়ে নিজের ডিপার্টমেন্টে নিয়ে যান। কলেজের অনেক উঁচুতে এই ডিপার্টমেন্ট। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হাঁফ ধরে যায়। বিমলদা ডিপার্টমেন্টাল হেড। অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে চিরাচরিতের পরিচয় করিয়ে দেন। বিমলদার খেয়াল হয় যে চিরাচরিতের হয়তো খাওয়া হয়নি। চিরাচরিতকে জিজ্ঞেস করেন
" আপনার তো কিছু খাওয়া হয়নি?"
" না তা নয়। কার্শিয়াং এ একটু খেয়েছি।"
চিরাচরিতের উত্তর।
" সে তো অনেকক্ষন হল।" এই বলে বিমলদা ডিপার্টমেন্টের বেয়ারাকে ডেকে ক্যান্টিন থেকে চিরাচরিতের জন্য খাবার আনতে বলেন।
কিছুক্ষনের মধ্যে এক প্লেট বনান্ডা এক প্লেট পকোড়া সঙ্গে গরম চা চলে এল। বনান্ডা এখানকার চটজলদি তৈরি করা যায় এমন একটি জনপ্রিয় খাবার। বান রুটির ভেতরে ডিমের ওমলেট ভরে দেওয়া একটি ফাস্ট ফুড। তৈরি করার কোন ঝামেলা নেই। এতে তাড়াতাড়ি কাস্টমারদের চাহিদা মেটানো অনেক সহজ। এই দিয়ে ক্ষুধার্ত চিরাচরিতের দ্বিপ্রাহরিক ক্ষুণ্ণিবৃত্তি হল। এই সময় বামনাকৃতির এক অধ্যাপক এসে বিমলদাকে বলেন
" বিমলদা, আমার সব ক্লাস হয়ে গেছে। আমি এখন মেসে চলে যাচ্ছি।"
" হরু, ইনি চিরাচরিত। আজ আমাদের কলেজে নতুন জয়েন করেছেন। কলকাতা থেকে এসেছেন। তোমাদের মেসে এনার থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। সঙ্গে নিয়ে যাও। আমি অর্জুনকে বলে ওনার লাগেজ তোমাদের মেসে পাঠিয়ে দিচ্ছি।"
বামনাকৃতি হরুর উদ্দেশ্যে বিমলদার নির্দেশ।
"চিরাচরিত, আপনি গেস্টরুমের চাবিটা আমায় দিন। আর হরুর সঙ্গে যান। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।" এই কথাগুলো বিমলদা চিরাচরিতকে বলেন। ঘাড় নেড়ে কৃতজ্ঞতা জানায় চিরাচরিত। হরু অর্থাৎ হরেকৃষ্ণের সঙ্গে অধ্যাপকদের মেসে যায়। সেখানে প্রথমে কুন্তিদির সঙ্গে পরিচয় হয়। কুন্তিদি মেসের রাঁধুনি। এখানকার লোকাল হলে কি হবে কুন্তিদি সুন্দর বাংলা বলেন। রান্নায় ও যথেষ্ট দড়। এই বাড়িকে মেস বানানোর সুযোগ ও সামর্থ্য কোনটাই এর আগে অধ্যাপকদের ছিল না। হরিদাস হাট্টায় বেশির ভাগ অধ্যাপকরাই থাকতেন। সেটা কলেজ থেকে একটু দূরে। আর এই নতুন মেসটা কলেজের একেবারে কাছে। উপরি পাওনা লাগোয়া মুদি দোকান। এই দোকানে শুধু মুদি সামগ্রী নয়, সব্জি, কেরোসিন ও পাওয়া যায়। পাহাড়ের বেশির ভাগ দোকানই এই ধরনের। পেছনে ভুবন ভোলানো পাহাড়ি ল্যান্ডস্কেপ। এখানকার সূর্যাস্ত দেখা মাউন্ট আবুর লংগেস্ট সানসেট থেকে কোন অংশে কম নয়। আর উপরি পাওয়া ' হ্যাপিভ্যালী' টি গার্ডেন। হ্যাপিভ্যালী টি গার্ডেনের ফ্যাক্টরী থেকে চা ফার্মেন্টেশনের সুবাস বায়ু বাহিত হয়ে যখন ঘ্রাণেন্দ্রিয়কে উত্তেজিত করে, মনপ্রাণ ভরে ওঠে। এ যেন "ঘ্রাণেন অর্ধ........।" বিকেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির এই অপূর্ব শোভা দেখতে দেখতে প্রবাসের সব জ্বালা যন্ত্রনা উবে যায়। আসলে এই মেস বাড়িটি এক সময় স্টেটব্যাংকের হলিডে হোম ছিল। সুবাস ঘিসিং এর নেতৃত্বে গোর্খাল্যান্ড মুভমেন্ট শুরুর পর ব্যাংক আর এটা রিনিউ করে নি। অনিশ্চিত পরিবেশে কেই বা এখানে আসতে চায়? চাকুরে ও ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়ে থাকে। গোর্খাল্যান্ড মুভমেন্ট অধ্যাপকদের সামনে এই সুযোগ এনে দেয়। সেই থেকে এই মেস বাড়ি সরকারি কলেজের অধ্যাপকদের। চার তলায় চারটি মেস মিলিয়ে তিরিশের ও বেশি অধ্যাপক এই লামা মেস বাড়িতে থাকেন।
গোর্খাল্যান্ড মুভমেন্টের শুরু থেকে লাগাতার বনধ, মিটিং মিছিল, বম ব্লাস্টিং, মার্ডার লেগেই আছে। দিনের পর দিন ক্লাস বন্ধ। দোকান বাজার বন্ধ। মানুষ নিজেকে সুরক্ষিত ও নিরাপদ ভাবছে না। ফলস্বরূপ, অধিকাংশ শিক্ষকই সমতলে নিজ গৃহে ফিরে গেছে। চিরাচরিত ও অল্প গুটি কয়েক শিক্ষক ব্যতিক্রমী। বনধের মধ্যে ও তারা বাড়ী না গিয়ে মেসে থাকে। বেশি দিনের বনধ হলে উপায় কিছু থাকে না, তখন সবাইকে বাড়ি ফিরে যেতে হয়। এই ঘন ঘন ওঠা নামায় সবচেয়ে অসুবিধে ট্রেনের টিকিট জোগাড় করা। এক কলীগ দুলাল দাস এই ব্যাপারে মুস্কিল আসান। সবাই এই বিষয়ে দুলালদার ওপরে ভরসা করে। এই ভাবেই চিরাচরিতের দার্জিলিং গভর্মেন্ট কলেজে শিক্ষকতার জীবন কাটছিল।
বনধের কারনে এখন চিরাচরিত কলকাতায় আছে। হস্টেল জীবনের এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা। বন্ধু সুভাষ চিরাচরিতকে বলে
" দেখ চিরাচরিত, আমি তোমার খোঁজ করছিলাম।"
" কেন, কি হল?"
" ভাই, বিয়ের একটা সম্বন্ধ আছে। তোমায় রাজী হতেই হবে। আমি তোমার বিষয়ে সবকিছু জানিয়েছি মেয়ের বাবা মাকে। ওরা এক কথায় রাজী। এখন তুমি মত দিলে ওরা এসে তোমার সঙ্গে দেখা করে কথা পাকা করে যাবে।"
" আচ্ছা, ভেবে দেখি।"
" না ভাই, ভাবার আর কিছু নেই। আগে দেখ। কথাবার্তা বল। তারপর যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নিও।"
সুভাষের পীড়াপীড়িতে চিরাচরিত নিম রাজি হয়। বলে
" ঠিক আছে। ওনারা কবে আসবেন?"
" তুমি কতদিন আছো এবার?"
চিরাচরিতের উত্তর পেয়ে সুভাষ বলে
" সামনের সোমবার তোমার ফ্ল্যাটে দুপুরে আসতে বলে দি?"
মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় চিরাচরিত।
কেষ্টপুরের দুই রুমের এই ফ্ল্যাটটি চিরাচরিত ভাড়া নিয়েছে কলকাতায় এলে থাকার জন্য। তাছাড়া ছুটিছাটাতে রিসার্চের কাজের জন্য ও। এখানে থেকে ন্যাশনাল লাইব্রেরি যাওয়ার সুবিধে হয়। দেশের বাড়ি থেকে লোকজন এলে এখানে থাকে। নিরিবিলি পরিবেশ এই ফ্ল্যাটকে চিরাচরিতের কাছে আর ও আকর্ষণীয় করেছে। চিরাচরিত দিদিকে সবকিছু বিশদে জানায়। মা বাবাকে ছোটবেলায় হারিয়েছে চিরাচরিত। তার এই প্রতিষ্ঠায় দিদির ভূমিকা মূখ্য। সব শুনে দিদি আগেই চলে আসেন এই ফ্ল্যাটে। সোমবার দিদি সকালবেলা উঠে ঘরদোর পরিষ্কার করে সবার জন্য টিফিন লাঞ্চ রেডি করে রাখে। দুপুরে মেয়ের বাড়ির লোকজন আসে। মেয়ের বাবা মা ছোট দাদা ও ছোট বৌদি। দেখাশোনা কথাবার্তা হল। জল মিষ্টি খাওয়া ও হল। এবার মেয়ের বাড়ির লোকজন বাড়ি ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে। দিদি বলে
" দুপুরের খাওয়া না খেয়ে যাওয়া হবে না।"
" না না। আমরা বাড়ি গিয়ে খাব। বাড়িতে বলা আছে।"
" তা কখনও হয়? রান্নাবান্না সব হয়ে গেছে। আপনারা না খেলে এতসব নষ্ট হবে।"
দিদির পীড়াপীড়িতে মেয়ের বাড়ির লোকজন রাজি হয়ে যায়। দুপুরের খাওয়া খুব পরিতৃপ্তি সহকারে সবাই খায়। বিশেষ করে গয়না বড়ির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। যাওয়ার সময় চিরাচরিতকে একটি বারের জন্য মেয়েকে দেখার জন্য অনুরোধ করেন।
" তার দরকার নেই।"
" না বাবা। একবার দেখা ও হবে কথা ও হবে। চলে এসো। কবে দার্জিলিং যাচ্ছো?" মেয়ের বাবা
" পরশু রাতের দার্জিলিং মেল।"
" তবে কাল চলে এসো।" মেয়ের মা
অগত্যা রাজি হয়ে যায় চিরাচরিত। পরের দিন কন্যাপক্ষের দক্ষিণ কলকাতার বাড়িতে বিকেলে চিরাচরিত পৌঁছে যায়। মেয়ের বাবা মা চিরাচরিতকে বসার ঘরে নিয়ে যান। খুব সুন্দর করে সাজানো পরিচ্ছন্ন লিভিং রুম। রুম সজ্জার প্রতি পরতে পরতে রুচিবোধের পরিচয়। মেয়ের বাবা চিরাচরিতকে বলেন
" বোসো বাবা।" সোফায় বসে চিরাচরিত।
" ঠিকানা খুঁজে পেতে কোন অসুবিধে হয় নি তো?" মেয়ের বাবা
" না। এক চান্সেই পেয়ে গেছি।"
আলাপচারিতার মধ্যে মিষ্টি স্ন্যাক্স ও চা আসে।
" নাও বাবা, খেতে শুরু কর।" মেয়ের বাবার কথায় চিরাচরিত খাবারে হাত লাগায়।
" দ্যুতিকে ডাক। নিয়ে এসো।" মেয়ের মায়ের উদ্দেশ্যে বাবা।
একটু পরে মেয়ে দ্যুতিপ্রিয়া মায়ের সঙ্গে বসার ঘরে আসে। সাইডের সিঙ্গল সোফায় বসে। ফর্সা সুন্দরী। সুস্বাস্থ্যের অধিকারিনী। বিদুষী ও আধুনিকা তো বটেই। ইংরেজি সাহিত্যের উজ্জ্বল ছাত্রী দ্যুতিপ্রিয়া। চোখ ধাঁধানো রেজাল্ট। এক চান্সেই নেট ও সেট দুটোই ক্লিয়ার করেছে। কলেজ সার্ভিসের ইন্টারভিউ ও দেওয়া হয়ে গেছে। প্যানেল বেরুলে উপরের দিকে থাকায় আশাবাদী। এই হল পাত্রী দ্যুতিপ্রিয়ার পরিচয়। চিরাচরিতের সঙ্গে কিছু বাক্য বিনিময় হল। কিছুক্ষন দুজনে চুপ। তা দেখে মেয়ের বাবা বলে ওঠেন " আর কিছু কথা জিজ্ঞেস করবে বাবা?"
" না ঠিক আছে। এবার আমি উঠি তাহলে?"
" আমি পরে যোগাযোগ করে নেব।" মেয়ের বাবা
সবার অনুমতি নিয়ে চিরাচরিত বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। মাস তিনেক পরে বিয়ের দিন পাকা হয়। নির্দিষ্ট দিনে চিরাচরিত দার্জিলিং মেলে চেপে বসে। এবারে পাহাড় আরও উত্তাল। রাজ্য সরকার দমন পীড়ন যত বাড়িয়ে যাচ্ছে, আন্দোলন ও তত আগ্রাসী ও মারমুখি হয়ে উঠছে। মিছিল মিটিং নিত্য নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিছিলের ধরন ও চেঞ্জ হয়ে গেছে। এখন মিছিলের সামনের সারিতে শিশুরা। পরের সারিতে মহিলারা। সবশেষে পুরুষ আন্দোলনকারীরা। পুলিশ সিআরপির পক্ষে একে প্রতিহত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। লাঠিচার্জ করা ও প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। এরমধ্যেই একদিন দিনেদুপুরে চকবাজার বাটার কাছে একটা মার্ডার হয়ে গেল। মুহূর্তে দোকান পাট সব বন্ধ। চারিদিকে একটা অশান্ত আতঙ্কের পরিবেশ। পাহাড় সুনসান। পর্যটক নেই দোকান বাজার সব বন্ধ। সংবাদ মাধ্যমের কিছু লোক আর কিছু চাকুরীজীবি। লোকাল লোকজন ছাড়া এরাই কেবল বাইরের লোক। এইচ এম আই চিড়িয়াখানা দিনের পর দিন বন্ধ। প্রকৃতির শোভা দার্জিলিং এর আকর্ষন কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে ভুলে গেছে এখানকার লোকজন। পুলিশ রাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরুষদের ধরে এনে ভানুভক্ত ভবনে নিয়ে গিয়ে স্টীমরোলার চালিয়ে অত্যাচার চালায়। এই ভানুভক্ত এখানকার বিখ্যাত কবি। এখানকার প্রত্যেকের কাছে তিনি আদরণীয় ও জনপ্রিয়। সেই কবির স্মৃতির উদ্দেশ্যে তৈরি এই ভানুভক্ত ভবন। সংস্কৃতি চর্চার পীঠস্থান। এখানকার লোকেদের বড় আবেগের জায়গা। সেই জায়গায় কিনা পুলিশের হেডকোয়ার্টার্স। এতো সরাসরি আবেগের ওপর আঘাত। গোর্খাল্যান্ড মুভমেন্টের সঙ্গে এই আবেগ মিশে আন্দোলন ভয়ংকর ও অপ্রতিরোধ্য রূপ ধারণ করেছে। আন্দোলন নিয়ন্ত্রনে আনা প্রসাশনের পক্ষে কঠিন থেকে কঠিনতর হয় উঠেছে।
এই সময় পুলিশ ছত্রে সুব্বা নামে জিএনএল এফের এক যুবা নেতাকে অ্যারেস্ট করে। অভিযোগ কিছু দিন আগে পুলিশের ডিএসপি আর কে হান্ডার ওপর আক্রমণকারীদের নেতৃত্বে ছিল এই ছত্রে সুব্বা। পুলিশ ওত পেতে ছিল। সুযোগ পেতেই তাকে গ্রেপ্তার করে ভানুভক্তভবনে নিয়ে গিয়ে প্রচণ্ড অত্যাচার চালায়। এর তীব্র প্রতিবাদে পাহাড়ে আগুন জ্বলে ওঠে। বাজে সুভাষ ঘিসিং এর ডাকে গোটা পাহাড় আজ এক হয়ে উঠেছে। ঘিসিং বাজে পাহাড়ের একছত্র নেতা। তার কথাই এখানে শেষ কথা। সবাই তার নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে। লোকাল 'গোর্খালী' ভাষায় 'বাজে' কথার অর্থ দাদু। সেই বাজে একটানা চল্লিশ দিনের বনধ ডেকে বসেছেন এই অত্যাচারের প্রতিবাদে। যানবাহন দোকানপাট স্কুল কলেজ সব বন্ধ। বনধ শুরু হচ্ছে সপ্তাহের প্রথম দিন থেকে।
চিরাচরিত ও তার সহকর্মীদের মধ্যে কলকাতা ফেরার হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। ট্রেনের টিকিট জোগাড়ে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে। সবাই একে একে পাহাড় ছেড়ে নেমে পড়ে। দূর থেকে নিঃসঙ্গ পাহাড় যেন তাদের পালিয়ে যাওয়া দেখে। কাঞ্চনজঙ্ঘা একাকী দাঁড়িয়ে থেকে পাহাড়কে পাহারা দেয়। গাছপালা ফুল সবাই যেন সাজতে ভুলে গেছে। সবকিছুই এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের গহ্বরে।
এই বনধ চিরাচরিতের কাছে আশীর্বাদ স্বরূপ। এই মাসেই তার বিয়ে। বনধের ছুটির মধ্যে নির্দিষ্ট দিনে যথাবিধি চিরাচরিতের বিয়ে সুসম্পন্ন হল। চিরাচরিতের দেশের বাড়িতে ধূমধাম সহকারে বৌভাত ও হল। দেশের বাড়ি থেকে কয়েক দিন পর সস্ত্রীক কেষ্টপুরের ফ্ল্যাটে ফিরে আসে চিরাচরিত। এইখানে পৌঁছে চিরাচরিত খবর পায় পাহাড়ে আন্দোলনের চাপে প্রশাসন কিছুটা পেছু হটেছে। ছত্রে সুব্বাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়েছে। বনধ ও উঠে গেছে। আবার হুড়োহুড়ি পাহাড়ে ওঠার জন্য। অগত্যা দুলালদা শরণ। দল বেঁধে দার্জিলিং মেল। এয়ার ভিউ হোটেলে ফ্রেশ হয়ে নেওয়া। সবাই মিলে ট্যাক্সি ধরা। সেই লামা মেস, সেই ছকবাঁধা রুটিন। কুন্তিদির রান্না, কলেজের বনান্ডা, ঘোলা রঙের চা। সব চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এবারের উপরি পাওনা মোড়ে মোড়ে গাছে আগুন ধরানো রোডোডেনড্রন। বিভিন্ন রঙের বিশালকায় ম্যাগনোলিয়া। প্রায় পাতাহীন গাছের শোভাবর্ধন করছে। লতানে গাছে সুন্দরী গোলাপরূপী ক্যামেলিয়া দীর্ঘ ট্রেন যাত্রার ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়। এরা যেন পাহাড়ের ফুল সাম্রাজ্যের রানি। এদের সৌন্দর্য্য সুধা পানের জন্য পর্যটকরা বারে বারে পাহাড়ে আসে। এছাড়া ও নাম না জানা অজস্র সুন্দরী ফুল পাহাড়ের সারা দেহ পুষ্প সৌন্দর্যে ভরিয়ে রেখেছে। শৈল শিখরে ওঠার পথে এই মনহারিনী দৃশ্য পর্যটকদের কাছে দার্জিলিংকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।
এবারের পাহাড় যেন অস্বাভাবিক রকমের শান্ত। ঝড় আসার আগের স্তব্ধতা নয়তো! এই পরিবেশে আগুনে ঘি পড়ার ঘটনা ঘটল। সরকারি দল সিপিএম পার্টি নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করার জন্য চকবাজারে মে দিবস পালনের সিদ্ধান্ত ঘোষনা করে। এই ঘোষনার পর দিন থেকে রোজ কোন না কোন জায়গায় বম ব্লাস্টের শব্দ শোনা যায়। মিছিল মিটিং এর সংখ্যা ও বেড়ে গেছে। চিরাচরিতের আপনজনদের চিন্তা ও বেড়ে গেছে। এখানকার অবস্থা এমনই যে চিঠি আসতে মাস খানেক সময় লেগে যায়। নো নিউজ ইজ গুড নিউজই ভরসা। মে ডে যত এগিয়ে আসছে, তত বম ব্লাস্ট ও খুনের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। একদিন চকবাজার পুলিশ পোস্টের চার কোনায় প্লাস্টিকে ভরা চারটি কাটা মুন্ডু ঝুলে থাকতে দেখা গেছে। লামা মেস প্রায় ফাঁকা। সুযোগসন্ধানীরা সুযোগের সদব্যবহারে বড়ই দড়। সারা মেস বাড়িতে মাত্র ছজন শিক্ষক এখন আছেন। বাকিরা স্ব স্ব গৃহে প্রত্যাবর্তন করেছেন। রাতে সবাই যখন একসঙ্গে টেবিলে ডিনার সারছিল এমন সময় এক্কেবারে কাছে কোথাও বম ব্লাস্টের প্রচন্ড শব্দে প্রত্যেকে চেয়ার থেকে লাফিয়ে ওঠে। সবার মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল হয় বম নিশ্চিতরূপে কলেজে পড়েছে। কারণ ইদানিংকালে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি আন্দোলনকারীদের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে। ভারাক্রান্ত মনে সবাই রাতের শয্যা গ্রহন করে। সকালে যে আরও বিস্ময় ও আতঙ্ক অপেক্ষা করে আছে, কে তা জানতো? গোটা হ্যাপিভ্যালী টি গার্ডেন ভর্তি গোর্খা যুবা সেনায়। প্রত্যেকে চেহারায় এক একটা ব্রুস লি। প্রত্যেকের পিঠে পাইপগান হাতে খুকরি। চা ঝোপের আড়ালে পজিশন নিয়ে অপেক্ষা করছে। আর ওপরে লেবং রোডে প্রতি পঞ্চাশ মিটার অন্তর দুজন সিআরপি জোয়ান টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। চিরাচরিত ও তার দুই সহকর্মী অদম্য উদ্বেগ নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে রাস্তার উপরে উঠে আসে। তিন জনে দাঁড়িয়ে সিআরপিদের যাতায়াত লক্ষ্য করে। ওদের সামনে দিয়ে দুই জোয়ান এগিয়ে যায়। একজন কৃষ্ণবর্ণ হয়তো দক্ষিণ ভারতীয় আর একজন ফর্সা লাল গোঁফওয়ালা সম্ভবত রাজস্থানী। সাহস সঞ্চয় করে ওদের সহকর্মী জামাল বলে ওঠে
" ভাই সাব, কাল যো বম গিরা থা, কাঁহা গিরা?"
ধীরে ধীরে দুই জোয়ান এগিয়ে আসে ওদের তিন জনের দিকে। লাল গোঁফওয়ালা জোয়ান বলে
" কৌন বম গিরাতা কিঁউ গিরাতা আপকো পতা নেহি?"
জামালের লুঙ্গি দেখিয়ে বলে
" ইস লুঙ্গিকা অন্দর বম রহতা হ্যায়।"
শাল পরিহিত চিরাচরিতকে দেখিয়ে বলে
" ইস শাল কা অন্দর বম রহতা হ্যায়।"
নির্বাক তিন বন্ধু দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করে হয়তো ওরা এবার কিছু করবে। না! তেমন কিছু ঘটল না। দুই জোয়ান লেবং রোড ধরে এগিয়ে চলে। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। দৌড়ে তিন বন্ধু নিজেদের মেসে ফিরে আসে। সব কটি ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে দেয়। দিনের বেলাতেই পর্দা টেনে দেয়। ভেতরের একটি ছোট্ট ঘরে ছজন প্রাণী জবুথবু হয়ে বসে থাকে। এমন সময় বাচ্চা ও মেয়েদের কান্নার শব্দ ভেসে আসে। সিআরপি জোয়ানেরা কোন বাড়িতে রেড করেছে। মেয়ে বাচ্চা কাউকে রেয়াত করেনি। এই চিৎকার তারই ফল। এই আতঙ্ক চিরাচরিতদের মধ্যে ও সঞ্চারিত হয়। প্রকাশ্য দিবালোকে ভয়ে শঙ্কায় এই কটি প্রাণী মৃত্যু ভয়ের আস্বাদ নিয়ে নিশ্চুপ নিস্তব্ধ অবস্থায় জড়সড় হয়ে ছোট্ট এক বিছানায় কোনমতে মৃতবৎ বসে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ এমনভাবে কাটার পর অল্প বিস্তর সাহস সঞ্চয় করে দুপুরের খাওয়া কোনমতে গলাধঃকরন করে যে যার শয্যা গ্রহন করে। বিকেলে মিটিং এর শব্দে ওদের ঘুম ভাঙে। খবর নিয়ে জানতে পারে শাসকদল অল্প সংখ্যক লোক নিয়ে চকবাজারে মে দিবসের মিটিং করেছে। পুলিশ সিআরপি মিলে গোটা এরিয়া ঘিরে রেখেছিল।
এই ঘটনা আগুনে ঘি ফেলল। বাজে সুভাষ ঘিসিং এর প্রতিবাদে পাহাড় জুড়ে টানা দশ দিনের বনধ ডেকে বসল। চিরাচরিতদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল কলকাতা নেমে পড়ার জন্য। এত তাড়াতাড়ি ট্রেনের টিকিট জোগাড় করা সম্ভব নয়। অগত্যা সবাই মিলে রকেট বাসে করে কলকাতা নামার সিদ্ধান্ত নেয়। দার্জিলিং এর টেলিগ্রাফ অফিস থেকে দিদি ও দ্যুতিপ্রিয়াকে ফোন করে এই নামার খবর জানায়। এই সময় দিদির কাছ থেকে জানতে পারে দেশের বাড়িতে এক খুড়তোত ভাইঝির একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। পাঁচ বছরের বাচ্চা মেয়ের অন্ত্রে এয়ার গানের গুলি ঢুকে গেছে। বাচ্চাদের মধ্যে খেলা করতে করতে এই ঘটনা ঘটে গেছে। জরুরি ভিত্তিতে চার পাঁচ জন মিলে কলকাতার পিজি হসপিটালে নিয়ে এসে ভর্তি করেছে। অপারেশন করতে হবে।
মনে চিন্তার কাঁটা নিয়ে চিরাচরিত রকেট বাসে চেপে বসে। সকাল বেলায় রকেট বাস ধর্মতলায় পৌঁছে যায়। কোনমতে একটা ট্যাক্সি ধরে কেষ্টপুরের ফ্ল্যাটে পৌঁছয় চিরাচরিত। দ্যুতিপ্রিয়া সকালবেলাই বাবার বাড়ি থেকে এখানে চলে এসেছে। কাজের মাসিকে ডেকে নিয়েছে। ঘরদোর পরিষ্কার করে সব কিছু গুছিয়ে রেখেছে। চিরাচরিত এখানে না থাকলে দ্যুতিপ্রিয়া বেশি সময় বাবা মার সঙ্গে থাকে। চিরাচরিতের আসার খবর পেলে এখানে ফ্ল্যাটে চলে আসে। চিরাচরিত ব্যাগপত্তর রেখে ফ্রেশ হয়ে নেয়। এরমধ্যে দ্যুতিপ্রিয়া চা টিফিন নিয়ে এসে চিরাচরিতকে দেয় নিজে ও নেয়। খেতে খেতে চিরাচরিত দ্যুতিপ্রিয়াকে দার্জিলিং এর খবর ও ভাইঝির অ্যাকসিডেন্টের কথা জানায়। ব্রেকফাস্ট সেরে বাজারের থলি নিয়ে চটজলদি বাজারে ছোটে চিরাচরিত। গ্রোসারি শাকসব্জি মাছ মাংস কিনে এনে দ্যুতিপ্রিয়ার হাতে ধরিয়ে দেয়। বলে
" দ্যুতি, আমি একটু পিজি হসপিটাল থেকে আসছি। মেয়েটা কেমন আছে দেখে আসি।"
" হ্যাঁ। সাবধানে যেও।"
সাইড ব্যাগ নিয়ে চিরাচরিত দ্রুত বেরিয়ে পড়ে। পিজিতে পৌঁছে এদিকে ওদিকে খোঁজে। পিজি হসপিটাল চিরাচরিতের চেনা। এর আগে কয়েকবার এখানে এসেছে সে। দেখে চারিদিকে রোগী অ্যাম্বুলেন্স রোগীর আত্মীয় স্বজনের ভিড়। রোগীর আত্মীয়দের থাকার জায়গাটা একদম ফাঁকা। অপরিচ্ছন্ন অপরিষ্কার। আলো হাওয়ার অভাব। সবাই গাছের তলায় শেডের তলায় প্লাস্টিক পেতে বসে আছে। এমন এক জায়গায় ওদের দেখা পায় চিরাচরিত। ভাইঝির লেটেস্ট খবর নেয়। এখানকার প্রথা ডাক্তার দেখে প্রেশক্রিপসন লিখে দিয়ে যায়। তা নিয়ে ওষুধ কিনে নার্সের হাতে দিতে হয়। সেই সময় ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়। তখন জানা গেল আগামীকাল অপারেশন হবে। প্রেশক্রিপসন নিয়ে ওষুধ কিনে দেওয়ার পর চিরাচরিত ওদের সবাইকে চা টিফিন খাওয়ায়। সবাইকে রাজী করিয়ে কেষ্টপুরের ফ্ল্যাটে নিয়ে যায়। এতজনকে একসঙ্গে দেখে দ্যুতিপ্রিয়ার মাথায় হাত। এতগুলি লোককে এই অল্প সময়ের মধ্যে কি করে খাওয়াবে? দ্যুতিপ্রিয়া চিরাচরিতের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে
" কি করব? এত জনের খাওয়ার ব্যবস্থা হবে কি ভাবে?"
" চিন্তা কোরনা। সবাই মিলে হাত লাগাব। আলুসেদ্ধ ভাত প্রেসারে বসিয়ে দিলে আধ ঘন্টায় হয়ে যাবে।"
এই বলে চিরাচরিত বাইরের জামা কাপড় চেঞ্জ করে নেয়। সবাই মিলে হাত লাগায়। একটা প্রেসারে চাল আলু ডিম বসে যায়। আর একটাতে ডাল। প্রেসারে হতে হতেই বাকিরা সবাই স্নান সেরে নেয়। এরমধ্যে রান্না ও কমপ্লিট। গরম গরম ভাতের সঙ্গে আলুমাখা ডিমসেদ্ধ ও বাটার। সঙ্গে গরম ডাল। প্রত্যেকেই পরম পরিতৃপ্তি করে খেল। দুপুরে শুয়ে একটু জিরিয়ে নিল। বিকেলে সবাইকে নিয়ে চিরাচরিত আবার হসপিটালে গেল। রাতে আবার ওদের নিয়ে বাসায় ফিরে এল। এই রুটিন এক সপ্তাহ ধরে চললো। দ্যুতিপ্রিয়ার পরিশ্রম এই ঝামেলার মধ্যে একটু বেশিই হল। হৈ হুল্লোড়ের মধ্যে এই কটা দিন কিভাবে কেটে গেল বোঝাই গেল না। দ্যুতিপ্রিয়া হাসি মুখে সব ঝামেলা সামলে নিল। খাওয়া শোওয়া সব ব্যবস্থাই একাহাতে সামলাল। আতিথেয়তায় সবাই যারপরনাই খুশী। সবাই দ্যুতিপ্রিয়ার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অবশেষে খুশির খবর ভাইঝি সুস্থ হয়েছে। কাল রিলিজ। এর ফাঁকে চিরাচরিতের বনধজনিত ছুটি ও শেষ। দুলালদাকে ধরে ট্রেনের টিকিটের ব্যবস্থা করা গেছে। দুদিন পরেই ফিরতে হবে।
পরের দিন হসপিটালে গিয়ে জানতে পারে কাগজপত্র কমপ্লিট করে রিলিজ পেতে সেই বিকেল গড়িয়ে যাবে। তাই সবাই ব্যাগপত্তর গুছিয়ে একটু তাড়াতাড়ি দুপুরের খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়ে। চিরাচরিত ওদের সঙ্গ নেয়। হসপিটালে পৌঁছে এক একেকটা কাগজ সই করাতে এদিক ওদিক দৌড়াতে হয়। এক সময় এই কাজ কমপ্লিট হয়। কিন্তু ডাক্তারবাবু আসেন নি। তিনি আসতে বিকেল গড়িয়ে গেল। অবশেষে ডাক্তারের সইস্বাক্ষর ও পরামর্শ পাওয়া গেল। পেশেন্ট রিলিজ ও হল। দেশের বাড়ি থেকে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করা গেছিল। সবাই মিলে ভাইঝিকে নিয়ে সেই গাড়িতে ওঠে। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ধীরে এগোতে থাকে। গাড়ির জানালা দিয়ে ওরা সবাই চিরাচরিতের দিকে হাত নাড়তে থাকে। চিরাচরিত ও প্রত্যুত্তরে হাত নাড়ায়। গাড়ি দৃষ্টির বাইরে চলে যায়। চিরাচরিত কিছুক্ষণ আবেগ বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সম্বিত ফিরতে এগিয়ে গিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে। ফ্ল্যাটে ফিরে আসে। কলিংবেল বাজাতে দ্যুতিপ্রিয়া দরজা খুলে দেয়। বলে
" কি গো, ওরা সবাই চলে গেছে? সবকিছু ঠিকঠাক মিটে গেছে?"
" হ্যাঁ, ডাক্তার আসতে দেরি হল। তাই একটু দেরি। ওখান থেকে গাড়ি এসেছিল। সবাই ওই গাড়িতেই গেল। ওদের তুলে দিয়েই আসছি।" এই কথা বলতে বলতে চিরাচরিত ঘরে ঢোকে। খুব ক্লান্ত দেখায়।
" তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি চা বসাচ্ছি।"
" না। তার দরকার নেই। ভীষন টায়ার্ড লাগছে। তুমি ডিনার রেডি কর। আমি ফ্রেশ হয়ে আসচ্ছি।"
চিরাচরিত তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে যায়। এদিকে দ্যুতি ডাইনিং টেবিলে ডিনার সাজায়। চিরাচরিত বাথরুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসে। দ্যুতি একে একে সব কিছু সার্ভ করে প্লেট চিরাচরিতের দিকে এগিয়ে দেয়। নিজের জন্য ও সাজিয়ে নেয়। খেতে খেতে দুজনের বাক্যালাপ চলে।
" ডাক্তার কি বলল?"
" সবই ঠিক আছে। আর ভয়ের কিছু নেই। তবে রেস্টে থাকতে হবে। "
" কয়েকটা দিন যেন ঝড় বয়ে গেল।"
" হুঁ। ভেবেছিলাম তোমাকে নিয়ে এবার নন্দন ও অ্যাকাডেমিতে যাব। একদিন সীমা গ্যালারী ও যাব ভেবেছিলাম। ভাল একটা এগজিবিশন চলছে। কিছুই হল না। "
" কি আর করা যাবে? সে সব পরে হবে।"
" হ্যাঁ তাই। আবার কালকেই চলে যেতে হবে। যাক, ট্রেনের টিকিটটা কনফার্মড হয়ে গেছে।"
চিরাচরিত খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ে। হাত মুখ ধুয়ে শুতে যায়। মশারি টাঙিয়ে শয্যা গ্রহন করে। বেডরুম থেকে চেঁচিয়ে বলে
" দ্যুতি, আমি শুয়ে পড়লাম।"
" ঠিক আছে।" রান্না ঘর থেকে দ্যুতির উত্তর।
শয্যা গ্রহনের সঙ্গে সঙ্গেই চিরাচরিত ঘুমের দেশে হারিয়ে যায়। কয়েক দিনের প্রচন্ড খাটুনি আর টেনশন। শরীরের আর দোষ কোথায়? এত কিছু সহ্য করার জন্য প্রয়োজনীয় বিশ্রাম টুকু ও পায় নি। শরীর তো ঘুমের দেশে পাড়ি দেবেই। এদিকে দ্যুতি সব জিনিস পত্তর গুছিয়ে রান্নাঘর পরিষ্কার করে। মুখ হাত ধোয়। বাথরুমে গিয়ে গায়ে মুখে জল দেয়, পরিছন্ন হয়। রাত পোশাক পরে নেয়। ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে একটু প্রসাধন সারে। ঘরের আলো নিভিয়ে নাইট ল্যাম্প জ্বালিয়ে দেয়। বিছানায় উঠে শুতে গিয়ে দেখে চিরাচরিত একদিক ঘেঁষে ঘুমে কাদা হয়ে শুয়ে আছে। মনে মনে ভাবে ' হ্যাঁ, সত্যিই তো কি খাটুনি টা না গেল।' নিজে শুয়ে পড়ে। তার খাটুনি ও তো কম হয় নি। একটু বিশ্রাম দরকার। শোয়ার পরে পরেই দ্যুতি ও গভীর ঘুমসাগরে ডুবে যায়।
মাঝরাতে চিরাচরিতের ঘুম ভাঙে। ঘুম চোখে বাথরুমে যায়। ফিরে এসে জল খায়। আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। নাইট ল্যাম্পের হালকা সবুজ আলোয় আলো আঁধারি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এই মায়াবী আলোয় চিরাচরিত দ্যুতিপ্রিয়াকে দেখে। অঘোর ঘুমে নিমজ্জিত দ্যুতিপ্রিয়া। পরনে নামী ব্রান্ডের রাত পোষাক। লাল রঙের রাত পোষাকের ভেতর দিয়ে দ্যুতিপ্রিয়ার ফর্সা কমনীয় অবয়ব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। কালো রঙের কনট্রাস্ট কালারের স্বল্পাকার বক্ষাবরণী। ততোধিক স্বল্পাকার কালো নিম্নাঙ্গাবরনী। অন্তর্বাস যেন দ্যুতিপ্রিয়ার ভরা যৌবনকে ধরে রাখার অপারগতা পরতে পরতে জানান দিচ্ছে। চিরাচরিতের লোলুপ দৃষ্টি ঘুমন্ত দ্যুতিপ্রিয়ার শরীর আপাদমস্তক অবলোকন করে। রাত পোষাক দ্যুতিকে আরো মোহময়ী আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে। চিরাচরিত মনে মনে ভাবে ' সত্যিই তো অনেক দিন হোল তাদের কোন শারীরিক মিলন হয় নি।' আস্তে আস্তে সে দ্যুতির দিকে এগিয়ে যায়। দ্যুতির কপালে আলতো চুম্বন দেয়। তারপর গাল, ঠোঁট। তখনও ঘুমে দ্যুতির চোখ বন্ধ। ঘুমে আচ্ছন্ন। চিরাচরিত এবার দ্যুতির ঠোঁট নিজের ঠোঁটের মধ্যে নেয়। চুম্বনে চুম্বনে ভরে দেয়। এখন দ্যুতির ঘুম ভেঙে যায়। কিন্তু সে চোখ বন্ধ অবস্থায় থাকে। স্বামীর আদর উপভোগ করতে থাকে। চিরাচরিত অভ্যস্ত হাতে দ্যুতির শরীরের সবকটি অঙ্গাবরণ একে একে অপসারিত করে। দ্যুতির নিরাবরন শরীরে উদ্যত কমলকলি সম বক্ষযুগল কয়েক মুহূর্ত দেখে, উদ্যত হাতছানির অমোঘ আকর্ষণ শরীরে আলোড়ন তোলে। চিরাচরিতের ক্ষুধার্ত শরীরে আগুন ধরে যায়। সে দ্যুতির কপাল থেকে চুম্বন শুরু করে ধীরে ধীরে দ্যুতির সারা শরীর চুম্বনে ভরে দেয়। দ্যুতির নিম্নাঙ্গের ওষ্ঠযুগল, উরু জঙ্ঘা কোন অঙ্গই এই চুম্বন আদর থেকে বঞ্চিত হয় না। দ্যুতির পীনোন্নত বক্ষ চিরাচরিতের মস্তকে হাজার ওয়াট জ্বেলে দেয়। সে দ্যুতির বুকে মুখ এক হাত দিয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দেয়। অন্য হাত তখন দ্যুতির ক্লীন শেভেন নির্লোম স্ত্রীঅঙ্গে লুকোচুরি খেলতে ব্যস্ত। এত কিছুর মধ্যে ও দ্যুতি নিমীলিত চক্ষে স্বামীর সোহাগসুখ তার সম্ভোগ তৃষ্ণার্ত শরীরকে উপভোগ করার জন্য উৎসাহিত করতে থাকে। চিরাচরিত আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। নিজেকে দ্যুতির উরুদ্বয়ের মধ্যে সমর্পন করে। দুই নগ্ন নরনারীর বহু অপেক্ষিত সম্ভোগ তৃষ্ণায় ক্ষুধার্ত শরীর সৃষ্টি খেলার উত্তেজনায় উন্মত্তের মতো মেতে ওঠে। এই সম্ভোগ উত্তেজনায় চিরাচরিতের শরীরের উত্তপ্ত তরল দ্যুতির শরীরে প্রবাহিত হয়। অর্গাজিমের আবিষ্টতা ও উত্তেজনায় দ্যুতি তার হাত পা দিয়ে চিরাচরিতের শরীর জড়িয়ে ধরে। চিরাচরিত ও দ্যুতির বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে নিজের শরীর দ্যুতির শরীরে এলিয়ে দেয়। কতক্ষণ দুজনে এ অবস্থায় ছিল তা নিজেরাই জানে না। হঠাৎ দ্যুতির মৃদু ঠেলায় চিরাচরিতের সম্বিত ফেরে।
" অ্যাই ওঠ।"
" হ্যাঁ " চিরাচরিত দ্যুতির ঠোঁটে আলতো চুম্বন দিয়ে ওর শরীর থেকে নিজের শরীর বিচ্ছিন্ন করে। বাথরুমে যায়। দ্যুতি ও উঠে অ্যাটাচড বাথরুমে যায়। পরিচ্ছন্ন হয়ে ফিরে পরিতৃপ্ত হৃদয় মনে দুজনে আবার ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যায়।
সকালে দ্যুতির ঠেলায় চিরাচরিতের ঘুম ভাঙে।
" ওঠ। বাজার যেতে হবে।"
" হ্যাঁ, তুমি চা রেডি কর। আমি চট করে বাথরুম থেকে আসছি।"
" দেরি কোরো না।"
" না। চা খেয়েই বাজার যাচ্ছি। জলদি বাজার করে আনছি।"
চা খেয়ে চিরাচরিত বাজারের থলি নিয়ে দৌড় লাগায়। চটজলদি মাছ মাংস সব্জি নিয়ে ফেরে। কাজের মাসি ও এসে গেছে। মাসি কুটনো কাটা থেকে গৃহস্থালি সব কাজই করে। আজ চিরাচরিতের দার্জিলিং মেল রাত্রে। দ্যুতির আজ অনেক কাজ। চিরাচরিতের ব্যাগ গুছোনো, রান্না করা। চিরাচরিতের ট্রেনের টিফিন রেডি করা সবই দক্ষ হাতে করে সে। তৃপ্ত মন ও শরীরে দ্যুতি যেন আজ দশভূজা। সে তাড়া দিয়ে একটু আগেই চিরাচরিতকে ডিনার খাইয়ে রেডি করে দেয়। সাইড ব্যাগে জল টিকিট ভরে দেয়। টিফিন কৌটো যত্ন করে ব্যাগের মধ্যে ভরে দেয়।
সন্ধে হয়ে গেছে। ব্যাগপত্তর গুছিয়ে চিরাচরিত রেডি। ট্যাক্সি আনতে বেরিয়ে যায়। ট্যাক্সি নিয়ে ফিরে দ্যুতিকে ব্যাগপত্তর আনতে বলে। দ্যুতি ওগুলো এগিয়ে দেয়। ড্রাইভার ডিকিতে ভরে নেয়। চিরাচরিতের সঙ্গে দ্যুতি ও ট্যাক্সিতে ওঠে। সী অফ করতে শিয়ালদায় যায়। রাস্তার মাঝে ট্রাফিক জ্যাম চিন্তায় টেনশন বাড়ে চিরাচরিতের। ট্যাক্সিওয়ালাকে বলে
" ভাই একটু শর্টকাট করে নিয়ে চল। ট্রেনের টাইম হয়ে যাচ্ছে।"
ড্রাইভার ট্যাক্সি ঘুরিয়ে অন্য পথ নেয়। ঘুর পথে শিয়ালদা পৌঁছয় ওরা। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে দিয়ে দিয়েছে। চিরাচরিত একটু পা চালিয়ে গিয়ে সরাসরি নির্দিষ্ট কোচে উঠে পড়ে। সঙ্গে দ্যুতি ও। নিজের বার্থ খুঁজে মালপত্তর সেখানে রাখে। দ্যুতি ওগুলো এগিয়ে দেয়। কলীগরা অনেকেই এসে গেছে। চিরাচরিত দ্যুতির সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। ট্রেনের সিগন্যাল হয়ে গেছে। দ্যুতি ট্রেন থেকে নেমে জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়। চিরাচরিত জানালার মাঝখান দিয়ে দ্যুতিকে ফিসফিসিয়ে বলে
" এর পরের বার আলাদা বাড়ি ভাড়া করে আসব। তোমায় সঙ্গে নিয়ে ফিরব। সাবধানে বাড়ি ফিরে যেও।"
" তুমি ও সাবধানে যেও। মনে করে টিফিনটা খেয়ে নিও। কাল ও বাড়িতে মায়ের কাছে যাব। পৌঁছে ফোন কোরো।"
ট্রেন ছেড়ে দেয়। চিরাচরিত জানালা দিয়ে হাত বের করে নাড়তে থাকে। দ্যুতি ও হাত নাড়তে থাকে। চিরাচরিতের হাত ট্রেন দ্যুতির চোখে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকে..........।