বিলের ধারে থাকে এক ছেলে । নাম নীল। তার মা বাবা নেই ।সে জানেও না তার মা বাবা কে ? কোথায় থাকে ?কেউ যদি তাকে জিজ্ঞেস করে যে তার মা বাবা কে কিংবা কোথায় থাকে ? ম আকাতখন নীল উত্তরে বলে , "বাবার নাশ , মায়ের নাম শাপলা , আর আমার নাম নীল , আমি থাকি শাপলা বিল ।" বিলের ধারেই তার দিন রাত কাটে । গ্রামের সবাই তাকে খুব ভালোবাসে । সকালের আকাশ তার বাবা , তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে । বিলের শাপলা তার মা , তাকে মুখ ধুইয়ে দেয় , খাইয়ে দেয় । তার কেউ নেই, কিন্তু তার সবই আছে । সে গ্রামের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায় । তাকে আটকানোর কেউ নেই ।একদিন হঠাৎ যখন সে নদীর ধারে বসে বালিতে আঁকিবুকি করছিল তখন সে দেখে একদল বাদামী পোশাক পরা লোক সবুজ চাচাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে । সবুজ চাচাকে নীল খুব ভালোবাসত । তিনিই তাকে নাম দিয়েছিলেন নীল । সবুজ চাচাকে দড়ি বাঁধা অবস্থায় দেখে নীল তাদের পিছু নেয় ।পিছু নিতে নিতে নীল ঐ বাদামী পোশাকীদের তাঁবুতে গিয়ে পৌঁছে ।সেখানে গিয়ে দেখে গফ্ফার চাচা, বুড়ো দাদু এরা সবাইকে বাঁশের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে এবং তাঁদের সঙ্গে সবুজ চাচাকেও বাঁশে বাঁধা হচ্ছে । নীল আড়ি পেতে শুনতে পাই তাঁদের নাকি তিন দিন ধরে খাবারও দেয়নি তারা । নীল তাই তাঁদের জন্য বিন্নি পিসির বাড়ি থেকে ভাত আর ডিম আলুর তরকারি নিয়ে আসতে যায় । বিন্নি পিসি নীলকে খুব ভালোবাসেন । নীলকে প্রায়ই খেতে দেন ; নীল অসুস্থ হলে তাকে সেবা শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তোলেন । নীলও তাকে খুব ভালোবাসে । নীল তখন বিন্নি পিসিকে সব খুলে বললো । তিনি তখন নীলকে বারণ করলেন যাতে সে তাঁদের কাছে আর না যায় । বাদামী পোশাকীরা ওকে দেখলে ওকেও মেরে ফেলবে । তিনি নীলকে অনেক বুঝালেন যে তারা পাকিস্তানি সেনা । তারা নিজেদের স্বার্থে কিংবা বিনা কারণে বাঙালিদের উপর অত্যাচার করছে । কিন্তু নীল কি করবে! নীল যে গফ্ফার চাচা, বুড়ো দাদু আর সবুজ চাচাকে খুব ভালোবাসে । ওরা সেদিকে না খেতে পেয়ে কষ্ট পাচ্ছে । আর সে কিনা মরার ভয়ে তাঁদের কাছে যাবে না । তাই নীল বিন্নি পিসির কথা না শুনে তাদের জন্য ভাত আর ডিম আলুর তরকারি নিয়ে গেল গফ্ফার চাচা, বুড়ো দাদু আর সবুজ চাচাকে দিতে। তারা নীলকে দেখে কিছুটা অবাক হলেও খিদের জ্বালায় কিছু বলেননি । নীল পরদিন আবার যায় তাদের সাথে দেখা করতে । গিয়ে দেখে রক্তভেজা মাটিতে শুয়ে আছেন সবুজ চাচা, গফ্ফার চাচা আর বুড়ো দাদু । নীল তাঁদের কত ডাকল কিন্তু কেউ উঠল না । নীল বুঝতে পারেনি যে তাঁরা মারা গেছেন । তখন এক লোক ক্ষেতের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল । নীলের এ অবস্থা দেখে তিনি নীলকে বললেন , " তুই কাকে ডাকছিস রে , নীল । ওঁরা আকাশের তারা হয়ে গেছে রে । বাড়ি যা । ওঁদের ডেকে লাভ নেই ।" তখন একথা শুনে নীলের মন যেন এক বিষাদ বিলে পড়ে যাচ্ছিল । যে বিলের পানি রক্তের মতো লাল যে বিলে শাপলার বদলে মানুষের লাশ ভাসে । এসব ভাবতে ভাবতে নীল মুখে বিড়বিড় করে বলে লাগল , "শাপলার জয় তো বাংলার জয়, শাপলার জয় তো বাংলার জয় " ।তারপর এক ছুটে সারা গ্রাম সে একথা বলেই দৌড়াতে লাগল । তারপর অনেক দিন চলে গেল । নীলের বয়স দশ বছর হলো । নীল তখন মুক্তিযুদ্ধের তেমন আঁচ পাচ্ছিল না । কারণ সে থাকে রাজশাহী বিভাগের সিরাজগঞ্জ নামে প্রত্যন্ত এক গ্রামে থাকে । তাছাড়া ঐ গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা তেমন ছিল না । প্রাপ্ত বয়স্ক যারা ছিল তারা সকলেই পাকিস্তানীদের হয়ে কথা বলত । আর মুক্তিযোদ্ধা গুটিকয়েক যাঁরা ছিলেন তাঁদের সবাইকে পরিবার সহ মেরে ফেলত ঐ রাজাকাররা । তাই নীলকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বলার মতো কেউ ছিল না । একদিন নীল অণিমাদের আম-তলায় বসে আম খাচ্ছিল তখন দেখে আবার এক বাদামী পোশাক পরা লোক সোনা চাচার মুখে চুন কালী মাখিয়ে, গলায় জুতোর মালা পরিয়ে সারা গ্রাম হাঁটাচ্ছে । নীল তখন রাগে একটা আমের আঁটি ঐ বাদামী পোশাকী লোকটির দিকে ছুঁড়ে মারে । তখন লোকটি নীলের দিকে এগিয়ে আসে । নীল পিছু সরেনি ; দাঁড়িয়ে ছিল । লোকটি কাছে এসে নীলের গালে কষে চড় আর বলে , "এই কুত্তার বাচ্চা , আমের আঁটি ছুড়লি কেন ?" উত্তরে নীল বলল , "কুত্তার বাচ্চা বলবি না, আমি বাংলা মায়ের বাচ্চা ।" লোকটি তখন "তবে রে" বলে নীলের দিকে ধেয়ে আসে । তখনই নীলকে অণিমা টেনে নিয়ে যায় আমগাছের নিচে। লোকটি তখন মনে করে যে নীলের চেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে সোনা আলীকে মেরে ফেলা ।নীল অণিমার হাত ছাড়িয়ে দৌঁড়ে আসল সোনা চাচাকে বাঁচানোর জন্য এসে দেখে সোনা চাচাকেও ওরা সবুজ চাচাদের মতো মেরে ধানখেতে ফেলে দিয়ে গেছে । সোনা চাচা নীলকে খুব ভালোবাসত । নীলকে নীল রূপাই বলে ডাকত । নীলকে প্রায়ই বলত," দেশমাকে বাঁচানোর জন্য তুই একদিন রূপার কাঠি হবি ।" যখনই দেখা হতো তখনই নীলকে বিস্কুট, কলা নতুবা কিছু টাকা দিয়ে যেত খাওয়ার জন্য । সোনা চাচার উপর করা পাকিস্তানীদের এই নির্মম হত্যাকাণ্ড নীল সহ্য করতে পারে নি । কাঁদতে কাঁদতে সে দৌড়ে বিলের ধারে বটগাছের নিচে এসে বসে হঠাৎ চেঁচিয়ে বলে উঠে , "ঐ কালপুরুষ, তুই আমার সোনা চাচাকে কেন মারলি ?এখন আমায় বিস্কুট দেবে কে ? এখন আমায় নীল রূপাই বলে ডাকবে কে ? " তখন ঐ পথেই যাচ্ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক কাইয়ুম স্যার । মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা পর্যবেক্ষণ করতে তিনি এই গ্রাম ঐ গ্রাম ঘুরছিলেন । নীলের চিৎকার শুনে তিনি বটগাছের পিছনে যান । গিয়ে নীলকে দেখে তিনি খুবই কোমল সুরে জিজ্ঞাসা করলেন ,"তুমি কে , বাবা ?এভাবে চিৎকার করলে কেন?" নীল বলল, "আমি নীল । আমি এখানেই থাকি । আমার বাবা মা কেউ নেই । সবুজ চাচা, গফ্ফার চাচা ,বুড়ো দাদু আর সোনা চাচা আমাকে খুব ভালোবাসত । কিন্তু ঐ বাদামী পোশাক পরা লোকগুলো তাঁদের মেরে ফেলেছে ।" কাইয়ুম স্যার তখন নীলকে জিজ্ঞাসা করলেন , "তুমি কি বাঁচাতে চাও ঐসব মানুষদের যাঁরা তোমার সবুজ চাচা , সোনা চাচাদের মতো মারা যাচ্ছে । যারা ঐ বাদামী পোশাকীদের হাতে বন্দী ?"নীল বলল , " হ্যাঁ "। তখন কাইয়ুম স্যার বললেন,"তবে যুদ্ধ করতে হবে । করবে যুদ্ধ? মুক্তির জন্য যুদ্ধ । দেশের মানুষকে মুক্ত করতে । দেশমাকে মুক্তি দিতে ঐ পাকিস্তানী হিংস্র পশুদের হাত থেকে । বঙ্গবন্ধুর ৭-ই মার্চের ভাষণ ; ২৬শে মার্চের রেডিও বার্তা ; শুননি তুমি ! তিনি যে ডাক দিয়েছেন বাংলা মায়ের সন্তানদের বাংলা মাকে বাঁচানোর জন্য !" তখন নীল বলল ," আমি জানি তো শাপলার জয় তো বাংলার জয় ।" স্যার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "এর মানে কী?" নীল উত্তরে বলল , "শাপলারা যেমন এক জোট হয়ে নদীতে ভেসে বেড়ায় আমরাও তেমন এক জোট হয়ে বাংলা মাকে রক্ষা করব ।" তখন নীল আবারও চিৎকার করে বলে উঠলো, " শাপলার জয় তো বাংলার জয় ।" কাইয়ুম স্যার যেন নীলের মুখে এক অস্পষ্ট বিজয়ের নিশান দেখলেন । তখন হঠাৎ নীল বলে উঠল," বঙ্গবন্ধু কে?" স্যার উত্তরে বললেন, " তিনি হচ্ছেন এই বাংলার সেরা সন্তান । তার জন্যই আজ মোরা বিজয়ের কেতন উড়ানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছি ।" নীল বলল," আমিও বাংলা মায়ের সেরা সন্তান হব । স্যার বললেন,"নিশ্চয়ই হতে পারবে যদি তুমি দেশমাকে মুক্ত করতে পার তবে অবশ্যই দেশমা তোমাকে তার সেরা সন্তানের প্রতীক দেবেন ।" নীল যেন এক অপার সাহসে বলে উঠল, " আজ থেকে আমার বাংলা মা আমার মতোই স্বাধীন । আমি - ই তাকে স্বাধীন করব ।" কাইয়ুম স্যার নীলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন । আর ভাবছিলেন যেন এইটুকু ছেলের মধ্যে এত সাহস আসল কি করে । কিছুক্ষণ পর বললেন,"আজ থেকে তোর নাম নীল নয় তোর নাম মুক্তিযোদ্ধা । তুই লড়বি । এই বাংলার জন্য লড়বি । এই বাংলার মানুষের জন্য লড়বি । আমি দূর থেকে তোর জন্য দোয়া করব ।" তখন নীল জিজ্ঞেস করল ," আপনি কোথায় যাবেন?" স্যার উত্তরে বললেন , "আমি শহরে ফিরে যাব রে । ওখানেও যে শত শত মানুষ দেশকে মুক্ত করার জন্য লড়ছে । তুই ভালো থাকিস , মুক্তিযোদ্ধা । আমি চললাম ।" স্যারের মুখে মুক্তিযোদ্ধা নামটা শুনে নীলের মনে এক অদ্ভুত আনন্দানুভূতির সৃষ্টি হলো । তাই সে আবার সেদিনের মতো শাপলার জয় তো বাংলার জয় বলে সারা গ্রাম ছুটে বেড়াল । সবাইকে যেন জানাতে লাগল যুদ্ধ করতে হবে দেশের জন্য ; দেশের মানুষের জন্য; স্বাধীন ভাবে বাঁচার জন্য ।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
একটি অনাথ ছেলের মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা ও তাকে রক্ষা করার চেতনা নিয়ে এই গল্পটি লেখা হয়েছে ।
১৫ জুন - ২০২১
গল্প/কবিতা:
২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪