‘ওয়ালাইকুম উস সালাম। কি খবর রানা ? আমাকে ফোন না দিয়েই হাজির?’
‘কি কমু স্যার! আফনারে ফোন দিলে কোন কাজ অইবো না তাই একবারে চইলা আইছি। আমার স্যার ব্যবসা ভাল চলতাছে না। আইজকা যেভাবে হোক স্যার পঞ্চাশ হাজার টেকা লাগবোই।‘
টাকা কি অত সহজ জিনিস যে চাইলাম আর অমনি পেয়ে গেলাম। কিন্তু এই সহজ কথাটা রানাকে বুঝাতে এখন আমার অন্তত আধা ঘন্টা সময় লাগবে। ব্যাটা খুবই ঘাড় তেড়া। নাছোড় বান্দা টাইপ। তবু ঠান্ডা মাথায় ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিদায় করতেই হবে। কারন আমার একাউন্ট একদম শূন্য। কিছু কায়দা কানুন এপ্লাই করতে হবে। পিওন রমিজকে ডেকে কড়া গলায় বললাম,
‘তোকে না বলছি আমার রুমে কেউ আসলে এ সি টা ছেড়ে দিতে? তারপর চা-বিস্কুট দিতে ?’
রমিজ কাচুমাচু হয়ে দৌড় দিয়ে চা বানাতে গেল।
রানা তখনও দাঁত কেলিয়ে হাসতেছে। আমার এই সব কৌশল পুরনো হয়ে গেছে মনে হয়।
‘ স্যার আমার চা-পানি কিছু খাওন লাগত না। টাকাটা দেন তাড়াতাড়ি চইলা যাই।‘
আমি আমার ব্যক্তিত্ব ধরে রেখে ধিরে সুস্থে বললাম
‘ রানা। আসলে তোমাকে আমি সামনের সপ্তায় ডাকতাম। এইবার একটা ইন্সটলমেন্ট মনে হয় পাব। কিন্তু আজকে কিছু করতে পারব না।‘
‘স্যার! আফনারে খুব সম্মান করি বইলা এত ঘুরাইয়েন না । এই এলাকার কমিশনার কইলাম আমার খুব কাছের মানুষ।‘
ব্যাটা মনে হচ্ছে আমাকে কিছুটা থ্রেট করলো ? আমারও অবশ্য রাজনীতির মাঠে কিছু হোমরা চোমরার সাথে খাতির আছে। কিন্তু ওই পথে যাওয়া মানে খাল কেটে কুমির ডেকে আনা। মেজাজ অপরিবর্তিত রেখে বললাম
‘রানা বিশ্বাস করো আমার নিজেরই সংসার চলছে না। ঐ একটা বিল আটকে যাওয়াতে আমি খুব বেকায়দায় আছি। তুমিতো জানোই আমার কিন্তু অযথা কাউকে ঘু্রানোর অভ্যাস নাই।‘
‘ ঠিক আছে স্যার আজকে তয় বিশ হাজার টেকা দেন চইলা যাই।‘
‘ বিশ হাজার ? ‘
আমি হাসলাম।
‘ এখন আমি দুই হাজার টাকাও দিতে পারব না রে ভাই। মাপ চাই।‘
এমন লোকের পাল্লায় পড়লে মাথা ঠান্ডা রাখা সত্যি মুশকিল। কি বললে যে ও ম্যানেজ হবে তাই মাথায় আসছে না। এমন সময় আমার মোবাইলটা বেজে উঠলো। বাসা থেকে শায়লা ফোন দিয়েছে।
‘ হ্যালো।‘
‘এই শুনতেছ ? রকি আজকে ক্লাসে যায় নাই। বলছে আর স্কুলে যাবে না।‘
হ্যালো। হ্যাঁ কি বললা ?
‘ কানে শুন না না কি ? বলছি রকি বলছে ওর স্কুলের বেতন ক্লিয়ার না করলে ও আর ক্লাসে যাবে না।‘
বিষয়টার গুরুত্ব অনুধাবন করতে আমার কয়েক মুহুর্ত লাগলো। বুঝার পরে বললাম
‘ আমি না বলছি আগামী সপ্তাহে গিয়ে ক্লিয়ার করে দেব। স্কুল যাবে না কেন?‘
‘তোমার আগামী সপ্তাহ যে কবে আসবে আল্লাহই মালুম। এই বলে বলেতো মোট তিন মাস পার করলা। ছেলেটা লজ্জায় আর ক্লাসে যেতে চাচ্ছে না। আমার কোন কষ্টই তো তোমার কাছে কষ্ট না। ছেলেটার কষ্টও কি বুঝবা না?’
কষ্টের চেয়ে সংক্রামক কিছু আছে বলে মনে হয় না। ছেলেটার কি দোষ! আসলে যত দোষ ঐ শালা কোম্পানীর। আমাকে দিয়ে এত বড় একটা কাজ করিয়ে নিলো। নিজের যা কিছু জমানো টাকা ছিলো সবই ইনভেস্ট করে বসে আছি। এখন পাওনা টাকা দিব দিচ্ছি করতে করতে পার করে দিলো ছয় মাস। এ দিকে আমার বউ বাচ্চার কাছেও মান সন্মান যায় যায় অবস্থা।
আজকের মধ্যেই ম্যানেজ করার কথা বলে বউকে কোন রকমে আশ্বস্ত করে ফোন রাখলাম।
রানার দিকে তাকিয়ে দেখি, সে আমার ফোনালাপ শুনে এই বার বিশ্বাস করছে যে আসলেই আমার হাতে টাকা নাই।
“ আইচ্ছা স্যার আজকে তয় গেলাম। আগামি সপ্তায় কিন্তু মিস কইরেন না।“
রানা বিদায় হলেও মাথাটা ভন ভন করে ঘুরতেছে। ঐ কোম্পানির লোকদের আজকেই একটা ধোলাই দেয়া লাগবে। মোবাইল নিয়ে সাথে সাথেই হেনরি ভাইকে কল করলাম
‘হ্যালো! আসসালামুয়ালাইকুম। হেনরি ভাই, অনেক দিন তো হয়ে গেলো আমার বিলটার কি অবস্থা? আজকে কালকের মধ্যে অন্তত একটা ইন্সটলমেন্ট দেয়ার ব্যবস্থা করেন। পাওনাদারদের জ্বালায়তো আর ঘরে-অফিসে থাকা যাচ্ছে না।‘
‘হ্যালো মামুন ভাই। আমার কি করার আছে বলেন? আমি তো সেই কবেই আপনার বিল চেক টেক করে অডিটে দিছি। ওরা যদি একাউন্ট ডিপার্ট্মেন্টে না পাঠায় আমার কি কিছু করার আছে বলেন? এম ডি স্যার তো এই নিয়া ওদের উপর খুব খেপছে। আমার মনে হয় এই বার কাজ হবে। আপনি আগামি সপ্তায় একবার খবর নিয়েন।‘
‘হেনরি ভাই, এই এক কথা আর কয় দিন বলবেন ? এই সব আপনাদের ইন্টারনাল ম্যাটার। আমাকে আজকেই এম ডি সাহেবের সাথে দেখা করার জন্যে একটা এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে দেন। ?’
‘মামুন ভাই, আপনিতো জানেন আমাদের অফিস রুল। বিশ্বাস করেন ভাই ,আপনার বিলটা অটো পাশ হয়ে যাবে। আপনার চেক রেডি হয়ে গেলে একাউন্টস থেকেই আপনাকে ফোন দিবে। আমাদের কোম্পানী অযথা কাউকে ঘুরায় না। আপনার আসা না আসা সমান কথা।‘
ইচ্ছে করে ব্যাটাদের গালে কসে দুইটা চড় লাগাই। কর্পোরেট কোম্পানীর এই লোক গুলা খুব ভদ্র ভাষায় মিথ্যা কথা বলতে শিখছে। আমাদেরকে মনে করে বলির পাঠা। কিন্তু পাওনা টাকার মায়ায় এই রাগ মনেই পুষে রাখতে হয়। উলটা খুব অনুনয় করে বললাম
‘মামুন ভাই, বাসা অফিস সব জায়গায় প্রেস্টিজ বলে আর কিছু নাই। আর কিছু দিন পরে পাওনাদাররা মাস্তান ভাড়া করে অফিসে আসবে। প্লিজ এই বার আর মিস কইরেন না। যেভাবে হোক আগামী সপ্তায় একটা চেক দেয়ার ব্যবস্থা করেন।‘
‘ও কে মামুন ভাই। আপনি কোন টেনশন নিয়েন না। আমি আজকেই অডিটে গিয়া আর একবার ঠেলা দিতেছি।‘
আমি জানি এই সব কথার কথা। আসলে বেটাদের ফান্ডে টাকা নাই। এই কথা সেই কথা বলে টাইম কিল করবে। কি যে করি মাথায় আসছে না।
শায়লা্তো প্রায়ই ফোড়ন কাটতে ছাড়ে না। বলে
‘এই রকম মিউ মিউ করে বিল আদায় আর কবে হবে শুনি? কত আগে থেকে বলছি এই চোর বাটপারের দেশে তোমার মত সোজা মানুষ দিয়ে ব্যবসা হবে না। চাকরি কর। চাকরি কর। নয়ত বিদেশ চলো। শুনছো আমার কথা? এখন নিজের ঠেলা নিজে সামলাও।‘
খোঁচাটা একদম পৌরষের জায়গা মত গিয়ে লাগে। কিন্তু উত্তর দেবার মুরদ আমার আপাতত নাই। তাই নিরুত্তর থেকে সুসসময়ের জন্যে শুধুই অপেক্ষা।
অফিসের কাজে আর মন বসছে না। রকির বেপারটা না মেটালে আর হচ্ছে না। দেখি কারও কাছে ধার করতে পারি কি না।
সাড়ে বারটার মধ্যে বন্ধু তুহিনের অফিসে ঢুকলাম। সে একটা ইলেক্ট্রিক্যাল সাপ্লাই ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক।
ওর রুমে ঢুকতে যাব, তখনই দেখি সে হন্ত দন্ত হয়ে তার রুম থেকে বেরিয়ে আসছে।
‘কি রে মামুন ? এই সকাল সকাল আমার এখানে ? সব ঠিক ঠাক চলছে তো?’
‘না মানে তোর সাথে একটা ইম্পর্ট্যান্ট কথা ছিলো রে।“
‘বন্ধু, এই মুহুর্তে আমার হাতে একদম সময় নাই রে। তারচেয়ে চল আমার সাথে। যেতে যেতে গাড়িতে না হয় আলাপ সারা যাবে।‘
অগত্যা ওর সাথে গাড়ীতে গিয়ে উঠলাম। আট দশ বছরের পুরনো একটা প্রবক্স।
আমাকে সামনে বসিয়ে তুহিন নিজেই ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলো। গাড়ি স্টার্ট হতেই এক গাল হাসি দিয়ে বললো
‘নে এবার বল দেখি কি ব্যাপার?‘
‘ কি আর বলবো বন্ধু। আমার কথা তো তুই সবই জানিস। হাতে আপাতত কোন কন্ট্রাক্ট নাই। গত বছর যে বড় কাজটা করছি এখনও তার ফাইনাল বিলটা পাই নাই। হাতে টাকা পয়সা কিছুই নাই। খুব খারাপ অবস্থা যাচ্ছে।‘
“ ওখানে যেন তুই আর কত টাকা পাবি ?”
“ এখনও সব মিলিয়ে সাতাশ লাখ টাকার মত পাই।“
“ আর তোর লাইবেলিটিস সব মিলিয়ে কত ? “
“ সাব-কন্ট্রাকটরদের পাওনা আর আমার ব্যক্তিগত ধার দেনা মিলিয়ে তা প্রায় বার লাখের মত হবে।“
“ সত্যি বলতে কি তোর অবস্থা আমার চেয়ে অনেক ভাল। আমার টোটাল দেনা কত জানিস ?”
“ না। কত ?”
“ মোর দেন সিক্সটি লাখ। আর সব মিলিয়ে মার্কেট থেকে আমি পাব পনের লাখের মত। তার মানে আমি নেট হিসাবে পঁয়তাল্লিশ টাকা মাইনাসে আছি। আর তুই আছিস নেট পনের লাখ টাকা প্লাসে।“
“ আরে আমার টাকা আমি আদৌ পাব কি না কে জানে! “
“ পাস না পাস। একটা আশাতো আছে। আমার অবস্থা দেখ। পাওনাদারদের প্রতিমাসে প্রায় লাখ টাকার মত শুধু লাভই দিয়ে যাচ্ছি। তার উপর অফিস খরচতো আছেই।“
“ যাই হোক তোর তো তবু ব্যবসায় রোলিং হচ্ছে। প্রতিমাসে প্রচুর অর্ডার পাচ্ছিস। “
“ সে কারনেইতো মার্কেটে টিকে আছি রে দোস্ত। কিন্তু পাওনাদের দের টাকার চিন্তায় রাতে ঘুম আসে না।“
“ হুম। তোর অবস্থায় থাকলে আমি নির্ঘাত হার্ট ফেইল করতাম।“
“ যাক গে। বাদ সে এই সব কথা। আজকে কেন আসছিস সেই টা বল ?“
“ কি আর বলবো। রকি আজকে থেকে স্কুল যাওয়া ছেড়ে দিসে। ওর স্কুলের বেতন বাকি পড়ছে প্রায় পাঁচ মাসের উপরে। প্রিন্সিপাল না কি বলছে আজকে কালকের মধ্যে অন্তত তিন মাসের টিউশন ফি না দিলে ওরে টিসি দিয়া দিবে।“
“ তোর লাগবে কত টাকা ?”
“ আপাতত হাজার বিশেক টাকা হইলে ক্রাইসিসটা পার করতে পারতাম। আমার আগামী সপ্তায় কিছু পেমেন্ট পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।“
তুহিন কিছুক্ষণ চুপ। আমি আড় চোখে বোঝার চেষ্টায় আছি ওর মনোভাব। আমার মনোকষ্ট যাতে ওকে সংক্রমিত করে মনে মনে সেই দোয়া করছি। ও দৃষ্টিটা ড্রাইভ ওয়ে থেকে সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে শেষ মেশ বললো
‘এখন এক মালদার পার্টির কাছেই যাচ্ছি। লাখ খানেক টাকা পেমেন্ট করার কথা। যদি পাই তাহলে ধরে নে তোর সমাধান হয়ে গেছে।‘
একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললাম ‘ আলহামদুলিল্লাহ! বাঁচাইলি বন্ধু। ‘
আরে রাখ! এখনও গাছে কাঠাল গোঁফে তেল।
যেই মালদার পার্টির কাছে আমরা গেলাম সেই ব্যাটা আসলেই একটা বিগ সট। গুলশান এভিনিউর উপরে বিশাল ডেকোরেটেড অফিস। নীচে গ্যারেজে দেখলাম তিনটা দামি গাড়ী। প্রাডো, লেক্সাস আর লিমুজিন।
“ এদের ব্যবসা কি রে ?”
“ ঠিক জানি না। আমার ধারনা স্মাগলিং! ”
“ ধুৎ! সত্যি করে বল।“
“ আরে বোকা! এরা ইম্পোর্ট- এক্সপোর্টের বিরাট জায়ান্ট। তার উপরে গার্মেন্টস ব্যবসাও আছে। সব মিলাইয়া বার হাজারের উপরে কর্মকর্তা-কর্মচারি।
“ মাই গড! এতো এলাহী ব্যাপার!”
“ কিন্তু মালিক একা নিজেই সব ডিল করে। দেখবি আমার এই সামান্য টাকার বিলটাও উনার সাথে দেখা করেই আনতে হবে।“
প্রায় দুই ঘন্টা অপেক্ষা করার পর সেই বিগ শট
তুহিনকে রুমে ডাক দিলো। আমার এমনিতেই খুব কৌতহল হচ্ছিলো। তাই তুহিন বলার আগেই তার সাথে ভিতরে ঢুকলাম।
“এই যে ইয়ং ম্যান। হাও আর ইউ।“বলেই হাসি মুখে তুহিনের সাথে হ্যান্ড শেইক করলেন কালো মত বেটে খাট লোকটা।
“ আই এম ফাইন। হাও আর ইউ স্যার।“
কথাটার উত্তর দেয়া প্রয়োজন মনে করলেন না তিনি। নিজের দামি মোবাইলের স্ক্রীণ চেক করতে করতে বললেন
“ আমার কাছে আজকে কি মনে করে ?”
“ স্যার আপনার হয়ত মনে আছে গত মাসে কিছু ইউপিএস সাপ্লাই দিয়ে ছিলাম। সব মিলিয়ে লাখ দেড়েক টাকার একটা ইনভয়েস জমা দিয়েছিলাম। স্যার আজকে আমাকে লাখ খানেক টাকা পেমেন্ট করার কথা।“
তুহিন তার স্বভাব সুলভ স্মার্ট ভঙ্গিতে কথা গুলি বললো।
“ আই সি ! জাস্ট এ মিনিট।“ সেই বিগ শট টেবিলে থাকা একটা ফাইল উলটে পালটে দেখতে থাকলেন। দেখা শেষ করে বললেন,
“ আমার মনে হয় আকাউন্টস আপনার বেপারটা কগ্নিজেন্সে নেয় নি। যদি নিত পেমেন্ট রিকুইজিশনে আপনার নাম আর টাকার অংক লেখা থাকত। আমার এখানে প্রতিদিনের পেমেন্ট হিসাব সকাল দশটার মধ্যেই চলে আসে । “
আমার গলা শুকিয়ে গেল। আস্তে করে তুহিনকে ডান হাত দিয়ে একটা গুতা দিলাম।
কিন্তু তুহিন তেমনি নির্বিকার।
“স্যার! আমাকে গত কালকেও আপনার পি এস কনফার্ম করছে। না হলে আমি এত কষ্ট করে আসতাম না। স্যার আমাদের দিকে একটু যদি সহানুভুতি না দেখান তাহলে আমরা চুনোপুটিরাই কিভাবে বাঁচি।“
এই কথায় ভদ্রলোক চশমার ফাঁক দিয়ে চোখ গোল গোল করে আমাদের দিকে তাকালেন।
“ লেট মি চেক ।“
ইন্টারকম করে তিনি তার পি এস কে বললেন তুহিনের ফাইল নিয়ে রুমে আসতে। তারপর বেশ গম্ভীর হয়ে বললেন-
“ শুনেন মিঃ তুহিন। এই যে সহানুভুতির কথা বললেন , এই বিষয়টা আমি আমার মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছি বহু আগেই। আপনি কি জানেন আমার এই বিশাল অফিস আর ফ্যাকট্রি শো রুম এসব চালাতে মাসে কত টাকা লাগে? “
তুহিন বিনয়ের সাথে মাথা দোলায়।
‘মোর দ্যান টেন ক্রোর! দশ কোটি টাকা। আমার এই দায় আমাকে একাই মেটাতে হয়। এক মাস চালাতে না পারলে কেউ এসে সহানুভুতি দিয়ে দশ কোটি টাকা দিয়ে যাবে না।‘
‘কি যে বলেন স্যার! আমরা ছোট আদার ব্যাপারি। এই সব বিশাল ব্যাপার স্যাপার মাথায় ঢুকবে না।‘ তুহিন হাসতে হাসতে বললো।
‘ তবু আপনাদের ধারনা থাকা দরকার। আমার টোটাল এসেট কত জানেন ? প্রায় তিনশ কোটি টাকার মত। আর ব্যাংক লোন সহ লাইবেলিটি কত শুনবেন ? চারশ কোটির উপরে। মানে আমি প্রায় একশ কোটি টাকার দেনায় ডুবে আছি।‘
“ স্যার! আপনারা স্যার হাই প্রোফাইলের লোক। ঠিকই ম্যানেজ করে নিতে পারবেন। আমরা এই সব অংক বুঝিও না। বুঝে লাভও নাই কোন।“
তুহিন কথা শেষ করার আগেই পি এস একটা ফাইল নিয়ে রুমে ঢুকলো।
‘এই তুমি না কি উনাকে বলছ আজকে উনার পেমেন্ট হবে ? তাহলে এই পেমেন্ট রিকুইজিশন সিটে উনার নাম নাই কেন ? ‘ ভদ্র লোক যেন গর্জে উঠলেন।
‘স্যার। আমি পোস্টিং দিয়ে সি এফ ও স্যারের কাছে পাঠাইছিলাম। উনি মনে হয় ইনক্লুড করতে ভুলে গেছে।‘পি এস অনেকটা কাচু মাচু ভঙ্গিতে বললো।
“ দ্যান লুক আফটার হিস কেইস। আমিতো একটু পরে গাজিপুরে ফ্যাকট্রি ভিজিটে চলে যাব। “
“ জি স্যার। আমি ম্যানেজ করে নিচ্ছি স্যার।" কথাটা বলে পি এস তুহিনের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলেন।
আমার মনের শেষ আশাটাও নিভে গেল। তুহিন তবু দমে যাওয়ার পাত্র না। শেষ চেষ্টা হিসেবে বললো
“ স্যার! স্যার! আজকে প্রায় এক মাস ধরে এই বিলের ব্যাপারে পারসু করে আসছি। আজকে মিস হইলে মান ইজ্জত কিছু থাকবে না। আমাদের স্যার তেমন কোন ক্যাপিটাল নাই। গুড উইলটাই এক মাত্র সম্পদ। প্লিজ স্যার কিছু একটা করেন।“
আমিতো এই দিকে দোয়া দরুদ পড়া শুরু করে দিছি। হে আল্লাহ দেয়ার মালিক তুমি। এই লোকটার মধ্যে দয়া মায়া পয়দা করো।
এক মুহুর্ত পরে ভদ্রলোকের মুখ থেকে কথা বের হলো।
“ ও কে। আপনার কপাল ভাল। আজকে আমার মুডটাও ভাল। “ তারপর পি এস কে উদ্দেশ্য করে বললেন
“ পেটি ক্যাশ থেকে উনার টাকার ব্যবস্থা করে দাও। “
“ থ্যাং ইউ সো মাচ স্যার ! গ্রেটফুল টু ইউ। “ এই কথা বলে সালাম দিয়ে বাইরে এসে লাউঞ্জে বসলাম আমরা।
সেই এক লাখ টাকা পেতে আরও প্রায় তিন ঘন্টা বসে থাকতে হলো।
যাক বাবা তাও তো টাকাটা পাওয়া গেল। তুহিন সাথে সাথেই তার কথামত আমাকে বিশ হাজার টাকা বুঝিয়ে দিলো। আমি যেন চাঁদ হাতে পেলাম।
সকালের চেয়ে দিনের শেষটায় এসে মনে হলো জীবন অত খারাপ না। এই ক’দিন টাকার অভাবে গোল্ড লিফ সিগারেট টানলেও আজকের শেষ টানটা বেনসনেই সেরে নিলাম। গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে গৃহে প্রবেশ করলাম।
প্রথমেই রকির রুমে গিয়ে গুনে গুনে বার হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললাম
‘ কি রে? এই বার স্কুলে যেতে আর সমস্যা আছে?”
সে ফিক করে হাসি দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
“ চল দেখি তোর আম্মুকে সুখবরটা দেই।“
“ চলো ”
রান্না ঘরের কাছে গিয়ে দেখি শায়লা আর রত্নার মা কথা বলছে। রত্নার মা হলো আমাদের বাসার প্রাক্তন কাজের বুয়া। বলা যায় রকি অনেকটা ওর হাত দিয়েই এত বড় হইছে।
আমাকে দেখে শায়লা প্রায় দৌড়ে এলো।
“ রত্নার না কি এপিন্ডিসাইটিস অপারেশন হবে। ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে ওর বাপ ওকে ভর্তি করাইসে। এখন অপারেশনের জন্য দশ বার হাজার টাকা লাগবে।“
রত্নার মা আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললো
“ ভাইজান আমার মাইডারে আপনি বাঁচান। আমি গরিব মানুষ এক দিনের মইদ্যে এতো টাকা পামু কই !”
শায়লা আমার মুখের দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে যেন এই আকালে আমিই সেই টাকা দেনেওয়ালা গৌরি সেন।
কষ্টের চেয়ে সংক্রামক ব্যাধি আসলেই কিছু নাই। একজনের কষ্ট অন্য জনের মধ্যে সংক্রমিত হয় বলেই হয়ত আমরা মানবিক হয়ে উঠি । একটা অদৃশ্য চক্র যেন আমাদের এই ভাবে তাড়িয়ে নিয়ে সংসারের চাকা ঘুরিয়ে নেয়। সেই চক্রের ফাঁদে পড়ে এখন আমি মনে মনে হিসাব কসছি রত্নার মা কে কত টাকা দেয়া যায়। এমন সময় রকি দৌড় দিয়ে এসে রত্নার মায়ের হাতে পুরো বার হাজার টাকা তুলে দিলো।
“ এই নাও খালা। এতে তোমার হবে না ? ”
রত্নার মা টাকাটা পেয়ে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললো। তাকিয়ে দেখি শায়লার চোখও খানিক ভিজা ভিজা।
আর আমার ক্লাস সিক্স পড়ুয়া ছেলে রকির চোখে বিশ্ব জয়ের আনন্দ।
‘কি রে তোর ক্লাসের কি হবে?’
কথাটা আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল।
কষ্টের মত মহা সংক্রামক ব্যাধির এটাই মনে হয় ভাল একটা দিক। এত এত কষ্টের মধ্যেও হঠাৎ এমন একটা সুখের অনুভুতি হলো যে আমারও চোখ দিয়ে কিছুটা জল বেরিয়ে এলো। ওরা দেখতে পাবে বলে দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে নিজের রুমের দিকে হাঁটা দিলাম।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
আমাদের কারো জীবনই আসলে কস্টের উর্ধে নয়। জীবন পথে নানারকম কস্টকে মানিয়ে নিয়েই আমাদের পথ চলা। কিন্তু সেই কষ্টকে ছাপিয়ে আমরা একে অন্যের পাশে দাঁড়াই কারন অপরের কষ্ট আমাদেরকে সংক্রমিত করে। আর এটা ঘটে অনেকটা একটা চক্রের মত যা আমাদের মানবিক জীবনের চাকাকে ঘুরিয়ে নিয়ে সামনে আগিয়ে যেতে সাহায্য করে।
১৭ মে - ২০২১
গল্প/কবিতা:
২ টি
সমন্বিত স্কোর
৪.৪
বিচারক স্কোরঃ ১.৪ / ৭.০পাঠক স্কোরঃ ৩ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।