মোবাইলের রিং বাজছে।
শিউলির কিছুটা তন্দ্রা এসেছিলো। হুড়মুড় করে উঠে ফোন রিসিভ করলো
হ্যালো? মামা? কি অবস্থা? আব্বুর খবর কি?
ফোন করেছে আনিস সাহেব। শিউলির বড় মামা। শিউলিকে কিভাবে কথাটা বলবেন তাই ভাবছেন।
হ্যালো? মামা? তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ না?
হ্যাঁ হ্যালো। মানে শুনতে পাচ্ছি মা। তোর শরীরের কি অবস্থা ? তোর মামি বলেছে, তুই না কি খাওয়া দাওয়া এক রকম ছেড়েই দিয়েছিস?
মামা এরই মধ্যে সিদ্ধান্ত বদল করে নিয়েছেন। এই ভাবে হুট করে শিউলিকে খবরটা জানাবেন না। ধকল নিতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। তারচেয়ে বাসায় গিয়ে অবস্থা বুঝে ধিরে সুস্থে জানাবেন।
আ রে রাখতো আমার কথা! আব্বুর খবর বলো। একটু কি ইম্প্রুভ করছে? শিউলি আবারও উদ্গ্রীব হয়ে জানতে চাইলো।
শুন মা। আমি আর ঘন্টা খানেকের মধ্যে বাসায় এসে তোকে বিস্তারিত বলব। এখন এখানে নানা ঝামেলা।
বাসায় আসবা কেন? তাহলে হসপিটালে কে থাকবে?
হসপিটালে থাকার জন্যে তোর ছোট মামাকে বলেছি। ও আসলেই আমি রওনা দিব।
আচ্ছা। কিন্তু আব্বু ভাল আছে তো?
মামা বহু কষ্টে গলার ভিতর থেকে উঠে আসা কান্নার দলাটকে গিলে ফেললেন।
শিউলি শোন। তুই এত দুশ্চিন্তা করিস না। আমাকে এখন রাখতে হচ্ছে বুঝলি। ডাক্তার এসেছেন।
ফোনটা রেখেই আনিস সাহেব একটা সি এন জি পেয়ে ওটাতেই চেপে বসলেন। শিউলিকে কিভাবে যে ওর বাবার মৃত্যু সংবাদ জানাবেন তা মাথায় আসছে না। শিউলির পুরো জীবন কাহিনীটা যে সিনেমাকেও হার মানালো।
শিউলির বয়স যখন চার, যখন কি না ফিডার ছাড়ারও বয়েস হয় নি, তার মায়ের ক্যান্সা্র ধরা পড়লো। তার বাবা ছোটখাট চাকুরিজীবি ছিলেন। ক্যান্সারের চিকিৎসা করানোর মত আর্থিক সংগতি তেমন ছিলো না। নানা নানির আর্থিক অবস্থাও খুব একটা ভাল ছিল না। মামারা কেউ তখনো পড়া লেখাই শেষ করেন নি। তাই টোটকা চিকিৎসা নিয়ে ধুকে ধুকে ছয় মাস ভোগার পর শিউলির মা ইহধাম ত্যাগ করলেন। শিউলির তখন এমন একটা বয়স যে মায়ের কথা কিছুই আর মনে নেই। মায়ের চেহারাটা যতটুকু মনে রেখেছে তা ওর বাবার কাছে লুকিয়ে রাখা ছবিগুলো দেখে।
শিউলি যখন নয় দশ বছরের শিশু, নবোদয় এলাকায় একটা ভাড়া বাসায় থাকত। পাশের ফ্ল্যাটের আন্টি ওকে দেখলেই বলে উঠতেন, “এই তো আমাদের সিন্ডারেলা আসছে।“ আর উনার ছেলে মাহিকে বলতেন শিউলির সাথে সময় কাটাতে। শিউলির পরিবারেরও কেউ কেউ ওকে সিন্ডারেলা নামে ডাকত, তবে তা অবশ্যই ওর সৎ মায়ের অনুপস্থিতিতে।
মা মারা যাবার পর প্রথম কিছু দিন সে ছিল নানা নানির কাছে। কিন্তু বাবা ওকে দূরে রাখতে রাজি হলেন না। সে ছিল তার নয়নের মনি। নানা নানি অনেক কাকুতি মিনতি করলেন। বাবা রাজি হলেন না। আর এতে সব চেয়ে বেশি খুশি হয়েছিল শিউলি নিজে। কারন ওর গোটা দুনিয়াটাই ছিলো ওর বাবা। বাবার হাত ধরেই সে এই পৃথিবীটাকে বুঝতে শিখেছে। হাঁটতে শিখেছে। কথা বলতে শিখেছে।
মায়ের শোক ভুলতে ওর বাবার সময় লেগেছিলো মোটামুটি দুই বছর। তারপর নিজের প্রয়োজনে হোক অথবা সমাজের চাপে হোক আবার তাকে বিয়ে করতে হয়েছিলো। আর ওটাই শিউলির সিন্ডারেলা হয়ে ওঠা গল্পের শুরু।
আপন মায়ের আদর ভালবাসার চেয়ে সৎ মায়ের আদর ভালবাসা যে ভিন্ন হবে এটা প্রায় সবাই আন্দাজ করে নিতে পারে। কিন্তু একমাত্র শিউলির মত ভুক্তভোগীরাই বলতে পারবে সুক্ষ্ণ সুক্ষ্ণ ঘটনার মধ্যে কি বিরাট বঞ্চনা লুকিয়ে থাকে। আর এই বৈষম্যের গ্লানী অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছালো যখন সৎ মায়ের ঘর আলো করে দুই জমজ বাচ্চা এলো । ওরা শিউলির সৎ ভাই। ওর নামের সাথে মিলিয়ে বাবা ওদের নাম রাখলেন শিমুল আর পলাশ।
শিউলির এখনও মনে আছে, বাবা মাঝে মাঝে তার নতুন মাকে উদ্দেশ্য করে বলতেন, “ ঐ টুকু মেয়ে কি একা একা খাওয়া-দাওয়া, গোসল, পড়া সব করতে পারে ? তুমি তো নিজেকে নিয়ে আর শিমুল পলাশকে নিয়েই ব্যস্ত। আমি থাকি সকাল সন্ধ্যা অফিসে। ওর দেখাশোনাটা কে করবে শুনি ? “
সৎ মা তাই শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠত। মুখ ঝাপ্টা দিয়ে বলে উঠত, “ সাত বছরের ধাড়ি মেয়েকে তুমি বলছো এই টুকু বাচ্চা? ঐ বয়েসে আমরা নিজেরটা খেয়েছি পরেছি, আবার ছোট ভাই বোনের দেখা শোনা করেছি। ও কি লাট সাহেবের বাচ্চা? নিজেরটা নিজে করে নিতে পারবে না। রান্না করে দিচ্ছি কত না! তা আবার মুখে উঠিয়ে খাইয়ে দিতে হবে। এতো সোহাগ কিন্তু ভাল না।“
কথায় কথায় ঝগড়া আরো বেড়ে যেত। এক পর্যায়ে বাবা হাল ছেড়ে দিয়ে রাগে গজ গজ করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে কোথায় যে চলে যেতেন কে জানে। বেশ অনেক ঘন্টা পর আবার ঘরে ফিরতেন। হয়ত শুধু ছোট্ট অবুঝ মেয়েটার কথা ভেবেই ফিরতেন। আদর করে বুকে টেনে নিতেন। শিউলি সব বুঝত। কিন্তু বাবার সামনে কিছু বলত না। কাঁদতও না। সে কাঁদত আড়ালে চুপে চুপে।
শিউলির নতুন মা ছিলো কঠোর স্বভাবের। অবশ্য শিউলি মনে করে এটা তাঁর কৃত্রিম ব্যক্তিত্ব। যা হয়ত শিউলি আর শিউলির বাবাকে সব সময় কোনঠাসা করে রাখার জন্যেই হতে পারে।
পুরনো দিন গুলোর কথা শিউলি কখনো ভোলে না। আসলে সে ভুলতে পারে না। তখন শিউলি ক্লাস ওয়ানে পড়ে। ওকে স্কুলে ড্রপ করে বাবা চলে যেতেন অফিসে। আর স্কুলে থেকে আনার জন্য ঠিক করে দিয়ে ছিলেন রিক্সা ভ্যান। হাসমত চাচা ওকে রিক্সা ভ্যানে করে বাড়ির সামনে পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যেতেন। সেই বয়সেই বাসায় ঢুকে নিজে নিজে জামা জুতা খোলা, হাত মুখ ধোয়া এই সব শিখে ফেলেছিলো শিউলি। প্রায় দিন বাসায় ফিরলে খিদায় পেট চো চো করত। ওর মা তখন হয়ত তার দুই ছেলেকে আদর করে নাস্তা খাওয়াচ্ছে। কোন দিন নিজ থেকে শিউলিকে খাওয়াতও না, এমনকি খাবার নিয়ে খেতেও বলতো না।
শিউলিকেই আমতা আমতা করে বলতে হতো, “ মা খিদা পাইছে।“
“ খিদা পাইছে! খিদা পাইছে! না বইলা নিজে যা পারস নিয়া গিয়া খা। দেখছস না আমি এই দুইডারে নিয়া ব্যস্ত। যা রান্না ঘরে গিয়া দেখ কি আছে? যত সব আহলাদ!” সৎ মায়ের সেই ভেংচি কাটা মুখের আদল এখনও শিউলির চোখে ভাসে।
সে ভয়ে ভয়ে রান্না ঘরে গিয়ে পাতিল উলটে উলটে দেখত। হয়ত দেখত সেখানে একটু পানিভাত আর বাসি তরকারি ছাড়া আর কিছু নাই। খাবার পছন্দ না হলেও আবদার করার সুযোগ ছিল না।খিদার তাড়নায় যা পেত তাই গোগ্রাসে খেয়ে নিত।
একটু বড় হয়ে ওঠার পর সে যখন স্কুলের অন্য বাচ্চাদের দেখত, অন্য মা দের দেখত, তখন সে অবাক হতো। মা মেয়ের আচরন গুলো ওকে ভিতরে ভিতরে নাড়া দিতো খুব। ওর সামনে একটা কল্পনার ভিডিও চলে আসত আপনা আপনি। সেই ভিডিওতে সে দেখত স্কুল থেকে ফেরার সময়টায় ওর মা শিড়ির কাছে দাঁড়িয়ে। শিউলি ভ্যান থেকে নেমে আসতেই কাঁধ থেকে ভারি ব্যাগটা উঠিয়ে ওকেও কোলে তুলে নিয়েছে। তারপর নিজ হাতে জামা কাপড় জুতা পালটে দিচ্ছে। আগে থেকেই বানিয়ে রাখা নাস্তা হাতে নিয়ে ওর পিছনে পিছনে ঘুরছে। আর সে নানা বাহানা করে মাকে দৌড়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। এই সব। আর অজান্তেই টুপ টুপ করে কয়েক ফোটা চোখের জল পড়ে পানিভাতের সাথে মিশে যেত। ছোট্ট মেয়েটার সেই নীরব কান্না কেউ দেখত না।
শিউলির বাবা এই রকম ঘটনাগুলি না দেখলেও ঠিকই টের পেত। একদিন তাই গ্রামের বাড়ী থেকে ওর দাদীকে এনে ফ্ল্যাটে ওঠালেন। সেই নিয়েও সৎ মায়ের সাথে বাবার দফায় দফায় ঝগড়া বিবাদ লেগে যেত।
শিউলি পাশের রুম থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনত। কখনোবা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদত।
দাদি কিন্তু ওকে খুব আপন করে নিলেন। তিনি যদিও ছিলেন গ্রামের মানুষ তবু সংসারের ঘোর প্যাচ ভাল বুঝতেন। সৎ মায়ের সাথে সৎ ভাব বজায় রেখেই শিউলকে আগলে রাখার কৌশল ভালই বুঝতেন। রক্তের সম্পর্ক বলেই কি না কে জানে তিনি শিউলির ভাল মন্দ বুঝতেন। ওর আনন্দ শোক বুঝতেন।
এদিকে আস্তে আস্তে শিউলির সৎ দুই ভাই আরো একটু বড় হয়ে উঠলো। প্রায়ই ওরা শিউলির খেলনা নিয়ে যেত। এই সব খেলনা ওকে হয়ত বাবা কিনে দিয়েছে। অথবা ওর নানার বাড়ির কেউ দিয়েছে।
শিউলি তবু ওদের সাথে মিশতে চাইত। খেলতে চাইত। কিন্তু ওরা খেলত না। ওরা বলত, মা বলেছে তুমি একটা পঁচা। তোমার সাথে আড়ি।
শিউলি্র মন খারাপ দেখে দাদি এস ওকে টেনে নিয়ে অন্য কোন খেলনা ধরিয়ে দিতেন। ছোট্ট মেয়েটা তখন সংগীহারা হয়ে একা একাই পুতুল সাজাত। আপন মনে পুতুলের ঘর গোছাত।
এভাবেই একটা বৈষম্য মূলক আবহের মধ্যে শিউলির পুরো শৈশব আর কৈশরের বেড়ে ওঠা। এই নিরবিচ্ছিন্ন অবহেলার মধ্যেও বাবার ভাগ করে পাওয়া আদর আর দাদির স্নেহ ছায়ায় সে কিছুটা হলেও বেঁচে থাকার প্রেরণা খুঁজে নিয়েছিল। বেশ কয়েক বছর এভাবেই কেটে গেল।
কিন্তু ওর সেই একবিন্দু ছায়াটাও হারিয়ে গেল, যখন একদিন হঠাৎ দাদি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সে তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। আসলে দাদির বয়েস হয়েছিলো। দাদির সেই অসুখ আর ভাল হলো না। শিউলিকে আর ওর বাবাকে অসহায় করে দিয়ে দাদি একদিন পরকালে পাড়ি জমালেন। দাদিকে গ্রামের বাড়িতে কবর দেয়া হলো। দাদিকে শেষ বিদায় জানিয়ে কাঁদতে কাঁদতে শিউলি আর ওর বাবা যেদিন ঢাকায় ফিরে আসলো, বাবা বললেন,
“ জানিস মা শিউলি এতদিন আর যাই হোক আমার মাথার উপরে একটা বিরাট বড় ছায়া ছিলো। তোকে নিয়ে আমার যত দুশ্চিন্তা তার একটা নিরাপদ আশ্রয় ছিলো । “
শিউলি ভেঙ্গে না পড়ে বাবাকে বুঝালো
“ আমি এখন আর তোমার ছোট্ট খুকি নেই বাবা। এখন আমি মোটামুটি সব কাজ নিজ হাতে করতে শিখে গেছি। আমাকে নিয়ে না ভেবে বরং তোমাকে নিয়ে ভাব । পরিশ্রম করে করে শরীরের কি হাল করেছ। মা তো তোমার দিকেও একটু খেয়াল দিলে পারে।“
বাবা চোখে জল আর হাসি মুখে বললেন,
“ হ্যাঁ! কত টুকু বড় হয়েছিস তা তো দেখতেই পাচ্ছি। আমার যদি সাধ্য থাকত তবে শুধু তোর জন্যেই একটা আলাদা কাজের লোক রেখে দিতাম।“
শিউলিও হাসতে হাসতে বললো, “ আর কাজ নাই মায়ের সাথে ঝগড়া করার নতুন উসিলা বানানোর। আমি এমনিতেই বেশ সামলে নিতে পারব।“
“ আমার পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সব চেয়ে বড় সুখ হচ্ছিস তুই মা। তোকে স্বাবলম্বী করে তোলা আমার সব চেয়ে বড় দায়িত্ব। আর সে কারনেই বাড়তি কিছু ইনকামের চেস্টা করছি রে মা। বাকি আল্লাহর ইচ্ছা।“ শিউলির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বাবা বললেন।
শিউলি আস্তে করে বাবার বুকে মাথা রেখে বললো
“ আমাকে নিয়ে অত ভাবতে হবে না বাবা। দেখ আমি পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যাব। ইন্ সাল্লাহ।“
দেখতে দেখতে আরো কয়েক বছর পার হলো। শিউলি কলজের দ্বিতীয় বর্ষে উঠলো।
তার আগে যেদিন মেট্রিক পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুলো। শিউলি গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে পাশ করলো দেখে কি খুশি খুশি চেহারা বাবার। সবাইকে ফোন করে গর্ব করে ওর সুকীর্তির কথা জানাচ্ছিলো। তৃপ্তিতে শিউলির মনটা ভরে গিয়েছিলো। বাবাকে বললো, “ বড় হয়ে আমি ডাক্তার হতে চাই।“
বাবা শিউলির মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করলেন।
কলেজে উঠার পর পড়ার চাপ বেড়ে গেল। শিউলিকে এখন রাত জেগে পড়া শোনা করতে হয়। আবার নিজের কাজ ছাড়াও ঘরের প্রায় অর্ধেক কাজও করতে হয়। পাশাপাশি বাবার দেখা শোনাটাও করে।
মাত্র কদিন আগের কথা। বাবাকে দেখলো অফিস থেকে ফিরেই বিছানায় শুয়ে পড়তে। শিউলি তাড়াতাড়ি একটা ডিম অমলেট করে এনে বললো,
“ উঠ বাবা তাড়াতাড়ি এটা খেয়ে নাও। ইদানিং তোমার চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। “
বাবা শিউলির দিকে তাকিয়ে একটা ক্লান্তি মেশা হাসি দিলেন। স্নেহ ভরে বললেন, “রেখে যা। আমার আজ একটু শরীর খারাপ লাগছে। আমি খেয়ে নেব। তোর পড়ার সময় চলে যাচ্ছে।“
শিউলি কপালে হাত দিয়ে দেখে বাবার গায়ে বেশ জ্বর। হঠাৎই মনে হলো এখন তো চারদিকে করোনা হচ্ছে। তাহলে আবার করোনা হয়ে যায় নি তো! ভয়ে ভিতরটা কুকড়ে গেল। বুঝতে না দিয়ে বললো-
“ বাবা তোমার তো মনে হচ্ছে জ্বর হয়েছে। তুমি কি ঠিক মত মাস্কটাও দিয়ে চলাফেরা করতে পার না?
বাবা বললেন, “মাস্কতো দিয়েই বের হই রে মা। কিন্তু এই গরমে একটানা মাস্ক পরে থাকলে নিঃশ্বাসে কষ্ট হয়। এটা মনে হয় সিজনাল জ্বর। দেখবি এমনিতেই সেরে যাবে। যা তুই তোর পড়ায় মন দে।“
শিউলির মনে যে কু ডাক টা দিচ্ছিলো সেটা মনে হয় সত্যি হতে যাচ্ছে। বাবার জ্বরটা তিন দিন হয়ে গেল ভাল হচ্ছে না। নাপা খেলে একটু কমে তারপর টেম্পারেচার আবার আগের জায়গায়।
শিউলি বললো, “বাবা এভাবে বসে থাকা ঠিক হচ্ছে না। চলো তোমাকে একটা ডাক্তার দেখাই।“
অবশেষে ডাক্তার দেখানো হলো। ডাক্তার করোনা সন্দেহ করে ঔষধ দিয়ে গেলেন। ইমিডিয়েটলি স্যাম্পল টেস্ট করাতে বললেন। শিউলি ভয়ে হাউ মাউ করে কেঁদে ফেললো।
বাবা কিন্তু মোটেই নার্ভাস হলেন না। ওকে একা কাছে নিয়ে বললেন, “ আমার রুমে এখন থেকে মাস্ক পরে আসবি। আমাকে এই ঘরে আইসোলেশানে থাকতে হবে, বুঝলি। আরে বোকা! করোনা সবারটাই অত সিরিয়াস হয় না। দেখবি আমি সেরে উঠব আবার।“
রাতে নামাজ পড়ে শিউলি বাবার জন্যে আল্লাহর কাছে প্রাণ ভরে দোয়া করলো। “ হে আল্লাহ এই গোটা দুনিয়ায় তোমার পরে বাবাই আমার ভরসার জায়গা। তাকে তুমি এই অবেলায় নিয়ে যেও না। আমি এমনিতেই দুখী একটা মেয়ে। বাবা চলে গেলে আমার মত একা এই পৃথিবীর আর কেউ হবে না।“
করোনা হয়েছে শুনে শিউলির মা তার দুই পুত্র নিয়ে বাবার বাড়ি চলে গেলেন। বাবার জীবনসঙ্গীর এমন আচরনে শিউলি মোটেই অবাক হয় নি। কারন ওর মাকে ওর চেয়ে ভাল আর কেউ জানে না। টুটুল আর মুকুল অবশ্য যেতে চাইছিল না। মা অনেকটা জোর করে বকুনী দিয়ে ওদের রাজি করালো। বাবাও বললেন , এক সাথে সবার রিস্ক নেয়ার দরকার নাই। “
গোটা ঘরে এখন শিউলি আর ওর অসুস্থ বাবা।
আজ সাত দিন হতে চললো বাবার জ্বর ভাল হচ্ছে না। করোনা টেস্ট পজিটিভ এসেছে। আত্নিয় স্বজনরা ফোনে খবর নিচ্ছেন। কিন্তু বাসা পর্যন্ত আসার সাহস করছেন না কেউ। এই ঘোর বিপদে পাশে দাঁড়ালেন আনিস সাহেব। বাসার বাজার অন লাইনে অর্ডার করে জিনিস পত্র যা লাগে পাঠিয়ে দিলেন।
দশম দিনের দিন শিউলির বাবার একটু একটু শ্বাস কষ্ট শুরু হলো। এই সময়ে সারা দেশেই করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার সংবাদ পাওয়া যাচ্ছিলো। রুগীরা না কি হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেও সিট খালি নাই বলে ভর্তি হতে পাচ্ছে না। শিউলির র উদবেগ বেড়ে গেল কয়েক গুণ। বাবার কেয়ার নি্বে কি, দুশ্চিন্তায় খাওয়ার রুচি এত কমে গেল যে শিউলি নিজেও খুব দুর্বল হয়ে গেল।
সেই রাতে বাবার কাছে বসে ছিলো। বাবা তার রুগ্ন একটা হাত দিয়ে শিউলির একটা হাত ছুলেন। শ্বাস কস্ট সত্বেও বললেন, মা তোকে আজকে একটা কথা বলি। “ আমার ঘরের ওয়াড্রোপে একটা সবুজ রঙের ফাইল রাখা আছে, যা তো সে টা নিয়ে আয়।“
শিউলি বললো, “ এই অসুখের মধ্যেও অফিসের কাজ? তোমার কি মাথা টাথা ঠিক আছে?”
বাবা দম নিতে নিতে বললেন, “আমি যা বলছি তাড়াতাড়ি তাই কর মা। আমার শ্বাস কস্টটা আরও বেড়ে গেলে কাজটা শেষ করে যেতে পারব না।“
অগত্যা শিউলি ফাইলটা খুঁজে এনে বাবার হাতে দিলো।
বাবা অনেক কষ্টে ফাইল থেকে কিছু কাগজ বের করে ওকে বললেন , “এবার একটা কলম দিবি আমাকে।“
শিউলি হন্ত দন্ত হয়ে একটা কলম এনে দিলো।
বাবা আধ শোয়া হয়ে তার কাঁপা কাঁপা হাতে কয়েকটা সই করলেন। তারপর ওকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন,
“মা রে সারা জীবন তোর দুঃখই দেখে এসেছি। জীবন বাস্তবতার কারনে তোর সৎ মায়ের দূর্ব্যবহার গুলি আমি সৈহ্য করে গেছি। জানি তুই আমার চেয়েও ধৈর্যশীল। মুখ ফুটে কোন দিন তোর কস্টের কথা আমাকে বুঝতে দিস নি। এখন অবেলায় যদি আমাকে বিদায় নিতে হয় এক আল্লাহর কাছে জিম্মা করা ছাড়া আমার আর কিচ্ছু করার থাকবে না। তবে আমি আমার সারা জীবনের সঞ্চয় থেকে দুটা কাজ তোর কথা ভেবে করে রেখেছি গোপনে। মোহাম্মাদপুরে একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট, আর তোর নামে একটা পাঁচ লক্ষ টাকার এফ ডি আর। এই ফাইলে তার সমস্ত কিছু কাগজ রেডি করা আছে। এটা তোর কাছে রাখ।“
শিউলি ফাইলটা ছুড়ে ফেলে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। “ আমার এ সব কিচ্ছু লাগবে না বাবা। আমার শুধু তোমাকে চাই। শুধু আমার কথা ভেবে তুমি আরও কটা দিন বেঁচে থাক। মন শক্ত কর।“
বাবার চোখেও জল নেমে এলো। শিউলিকে মৃদ ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললেন, “ পাগলি! করছিস কি? করোনা কিন্ত খুব সংক্রামক। তুই দূরে থাক। বেঁচে থাক। “
বাবার সাথে ভাল ভাবে এ গুলিই শিউলির শেষ কথা। এরপর বাবার অবস্থা দ্রুত অবনতি হতে লাগলো।
আনিস সাহেব অনেক চেস্টা তদবির করে সেই রাতে এম্বুল্যন্স ম্যানেজ করলেন, হাসপাতালের সিটও ম্যানেজ করলেন।
বাবাকে দ্রুত আই সি উ তে নিয়ে অক্সিজেন দেয়া হতে লাগলো। শুরু হলো যম আর মানুষের লড়াই। আই সি উ তে থাকলে এমনিতেই হাসপাতালে থাকা যায় না। তার উপর করোনা রোগী।
শিউলির শত অনিচ্ছা সত্বেও আনিস সাহেব জোর করে ওকে তার বাসায় নিয়ে রাখলেন। নামাজ পড়ে কান্না কাটি করা আর দোয়া করা ছাড়া তখন আর শিউলির কিছুই করার নাই।মাঝে মাঝে এর ওর কাছ থেকে খবর নেয় বাবার। এক অসহ্য দুশ্চিন্তায় শিউলির খাওয়া নাওয়া ঘুম নাই।
যম আর মানুষের সেই লড়াই চলছিলো গত চার দিন ধরে। আজ হঠাৎ হসপিটালে অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দিলো। আই সি ইউ তে থাকা রোগীদের শ্বাস কষ্ট শুরু হয়ে গেল।
আনিস সাহেব চাইছিলেন শিউলির বাবাকে দ্রুত অন্য কোন হসপিটালে শিফট করতে। তার ব্যবস্থা করার আগেই ঘটে গেল মর্মান্তিক এই মৃত্যু।
আনিস সাহেব জানত শিউলি অনেক দুখী একটা মেয়ে। কিন্তু ওর দুঃখের সীমা যে আরও অনেক বড়, ঐ প্রশান্ত মহা সাগরের মত অতল গভীর তা কে জানতো!
আনিস সাহেব ভাবছেন শিউলি আর রুপকথার সিন্ডারেলার গল্প আসলে এক না। এই গল্পে আকাশ থেকে কোন এঞ্জেল নেমে এসে যাদুর কাঠি দিয়ে এখন ওর বাবাকে বাঁচিয়ে তুলবে না। মেয়েটার একাকীত্বের কথা ভেবে তিনি কোন কুল কিনারা খুঁজে পেলেন না।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
এই গল্পের প্লট আমাদের আশপাশের জীবন থেকেই নেয়া। খুব কম বয়সেই মা হারা এক মেয়ের গল্প। যে কি না জীবনের চড়াই উৎরাই পেরুতে পেরুতে এক সময় ভাগ্যের পরিহাসে কিভাবে খুব নিঃসংগ হয়ে পড়ে এটা তারই গল্প। নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে যেতে যেতে কিভাবে কোন মানুষের জীবনে একাকীত্বের অন্ধকার নেমে আসে এই গল্পে সেটাই তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
১৭ মে - ২০২১
গল্প/কবিতা:
২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪