একা আমি!
কেউ যদি বলে, তারা স্বামী স্ত্রী বুকে জড়াজড়ি করে ঘুমায়, তবে আমার মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানব মানবী তারাই।
অবাক হলেন, এমন মনোভাবে?
কারণ, বিয়ের দশ বছরেও স্বামী স্ত্রীর মাঝে বুকে জড়াজড়ি জিনিসটা কি আমি বুঝতে পারিনি। আমার কোল জুড়ে কোনো সন্তানও আসেনি।
না, আমার স্বামী বা আমি কেউই বন্ধ্যা নই। একবার কিভাবে যেনো ভুলক্রমে তার অতীব দামী বস্তু আমার গর্ভাশয়ে আটকে গিয়েছিলো এবং ক'মাস পর্যন্ত আমাকে মাতৃত্বের স্বাদও দিয়েছিলো।
কিন্তু হঠাৎ একদিন সীমাহীন যন্ত্রণা দিয়ে রক্তের সাগরে ভাসিয়ে সে মাংসপিন্ড আমাকে ত্যাগ করে।
জানিনা, আরো কতটা যন্ত্রণাদায়ক হবে মা হবার মুহুর্তটা! ভাবতে ভয় হয় আবার অতি আনন্দে চোখে জলও এসে যায় আমার। আমি দশ বছর ধরে অপেক্ষা করছি, কখনো কি সে স্বপ্ন পূর্ণ হবে?
আমার স্বামীকে আমি বুঝতে পারিনা, পুরুষ মানুষ এবং বৃটেনের মতো জায়গায় জন্ম, লালিত পালিত। তবে কেনো মেয়েদের প্রতি তার এতো অনীহা?
তার নাকি কোনো মেয়ে বন্ধু ছিলোনা কোনো কালে। এই কি কারণ? তা কি করে হয়!
অনেকেরই মেয়ে বন্ধু থাকেনা, তাই বলে কি তারা বউয়ের সাথে সহজ হয়না?
নাকি এসব দেশে অনেকে আছে ছেলে ছেলেতে আগ্রহ, ও তাদের দলের নয়তো!
অজানা ভয়ে বুকটা কাঁপে। যদি তা হয়, সে ভয়ে মনের সন্দেহটাও বের হতে দিইনি কোনোদিন।
আমাদের বিছানাটা বিশাল, চারজন আরাম করে শুতে পারবে, এমন। আমি সে বিছানার এক কোণে আর সে আরেক পাশে ঘুমায়, ভুলক্রমেও যেনো আমার হাত পা তার শরীর স্পর্শ করতে না পারে তার জন্য একটি বড় সাইজের কোল বালিশ রাখা মাঝখানে।
শুতে আসে রাত তিনটার পর, এসে যদি দেখে আমি জেগে আছি, তবে অবশ্যই ইংরেজীতে বলে দিবে,
আমি খুব টায়ার্ড, জরুরীভিত্তিতে ঘুম দরকার, দয়া করে শব্দ করবেনা।
সবসময় এই এক ডায়লগ দিয়ে ঘুমায় মরার মতো। টায়ার্ড তো হবেই, সন্ধ্যা ছয়টা বাজে কাজ শেষ করে এসে কম্পিউটার নিয়ে বসবে, কিসব করে, তারপর টিভিতে রাজনৈতিক খবর শুনবে মনোযোগী শ্রোতা হয়ে৷ যেনো তার খবর না শুনলে দেশ রসাতলে যাবে। এরপর রাত গভীর হতে হতে ভৌতিক সিনেমা দেখবে৷
এই হলো প্রতিদিনের রুটিন, ঘটনা। এসবের মধ্যে আমি কোনো কথা বলতে পারব না, বোবা দর্শক হয়ে থাকতে হয় আমাকে। কথা শুরু করলেই আবার ইংরেজীতে ভদ্রভাবে বলবে,
দয়া করে বিরক্ত করোনা, জরুরী কাজ বা বিষয় দেখছি।
ভুতের সিনেমা আর খবর এমন কি জরুরী যে বউয়ের সাথে দু'দন্ড কথা বলতে পারেনা?
কখনো যদি বলি, তুমিও দয়া করে আমাকে একটা বাচ্চা দাও, আর কিছু চাইনা আমি। তখন সে আরো বেশী ভদ্র ও লজ্জিত হয়ে জানায়, বাংলাদেশী মেয়েরা তো লাজুক হয়, আমি সেক্সের ইংগিত দিচ্ছি, শরম পাচ্ছিনা কেনো?
ও আমার আল্লাহ, দশবছরের পুরনো স্বামীর সাথেও নাকি সেক্সুয়াল কথা বলতে লজ্জা পেতে হবে, তাও বৃটেনবাসী!
এই হলো আমার স্বামী৷ তবে সে যে একেবারে আমাকে স্পর্শ করেনা তা নয়, ক্যালেন্ডার দেখে দশবছরে কয়বার, তা সঠিক বলতে পারব।
আড়াই তিন মাসে একবার তার মাঝে পশুত্ব বা পুরুষত্ব জাগে, তখন সে আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে নেয়। সে সময়টা হয়তো আমরা গর্ভ উর্বরের সময় নয়। মনে হয়, তাই এখনো আমি গর্ভশূন্য।
প্রায় সময় অন্যান্য বান্ধবীদের দেখি সকাল সকাল চুল ভেজা। এতো তাড়াতাড়ি গোসল করলো কেনো শীতের মধ্যে, প্রশ্ন করলে, ওরা লাজুক হেসে বলে,
আর বলোনা, সপ্তাহে তিন চারবার চায়৷ কি করবো, পুরুষ মানুষ, যদি অন্যদিকে চোখ দেয়! তাই না করিনা কখনো।
ওদের লাজুক হাসিমাখা মুখটাকে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী মুখ মনে হয়। আমারটাতো অন্যদিকে দূরের কথা, ঘরের দিকেও চোখ দেয়না।
আমি যে অসুন্দরী তা না। সাধারণ একজন পুরুষকে মোহিত করার মতো সৌন্দর্য্য আমার আছে। আমার স্বামীর কাজ আর ঘর, যেন বউপাগল মানুষ, বাইরে অযথা সময় ব্যয় করেনা।
কাউকে বলতেও পারিনা, এই না পাওয়ার কথা। সহ্য করতে করতে, নির্ঘুম দীর্ঘশ্বাসের রাত অতিবাহিত করতে করতে আমি হয়তো মানসিক রোগীতে রূপান্তর হবো একদিন।
খুউব ইচ্ছে করে ওর বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে দীর্ঘ একটা সুখের ঘুম দিই, ওটা আমার কাছে স্বপ্ন মাত্র।
শ্বাশুড়ী মাঝে মাঝে জানতে চান, বেবী না হবার কারণ কি, ডাক্তার কি বলে?
ডাক্তার কি বলবে আর, বেবী আসার বড় ডাক্তার তো উনার ছেলে, কি করে বলি সেই-ই চিকিৎসা করছেনা।
কারো বেবী হবে শুনলে খুউব খুশী হই, কারো না কারো কোল তো ভরলো। আবার ক্ষীণ ঈর্ষা যে মনের মাঝে উঁকি দেয়না তা বলতে পারবোনা জোর দিয়ে।
তখন আবারো মনে হয়, আমার একটা বেবী হতো! দেশে গেলে অনেকে জানতে চায়, কেউ বন্ধ্যা বলতেও কুন্ঠাবোধ করেনা।
এরপরও আমি কাউকে আমার স্বামীর আমার প্রতি অনীহার কথা বলতে পারিনা।
মা থাকলে হয়তো বলতে পারতাম, হয়তো তার সাথে শেয়ার করতে পারতাম৷
বিয়ের তিন বছর আগে, অনেক বছর শয্যাশায়ী থেকে উনি চলে গেছেন। ঘরের বড় মেয়ে হিসেবে অন্যদের সুখ দুঃখে আমিই আগলিয়ে থেকেছি সবসময়ই।
পাশের প্রতিবেশী খালার প্রবাসী বোনের শিক্ষিত সুদর্শন ছেলের প্রস্তাবটি অনেক ভালো প্রস্তাব ভেবেই বাবা আমাকে অনেক সুখী করার জন্যই বিয়ে দিয়েছেন।
সুখী হয়তো হতাম, আমার কপালে সুখ না থাকলে হবো কিভাবে? কি জানি সব কিছুর পরও মানুষটাকে ভালো লাগে, মায়া বসে গেছে। তাকে ছেড়ে দিবো এমন ভাবনাও মনে আনতে ইচ্ছে করেনা। সে মানুষ হিসেবে খারাপ না, আমার অসুস্থতায় যত্ন নেয়; কোনোদিন ধমক দিয়ে কথা বলেনি। কোথাও যেতে বাঁধা দেয়না।
ও কখনো, মায়া...
বলে ডেকে যখন কিছু জানতে চায়, মনে হয় ওর ডাকার স্বরেও মায়া ঝরে ঝরে পড়ছে।
হয়তো এভাবেই আমাদের দু'জনের দিন একসময় দু'একাকিত্বে শেষ হয়ে যাবে। আমার স্বামী, সেও তো একা। একই ঘরে ও যান্ত্রিকতার মধ্যে থেকে একা, আমি নিঃসঙ্গতায়। মাঝে মাঝে এ নিঃসঙ্গতা কিছুদিনের গর্ভ মেহমানটির স্মৃতিচারণ করে কাটাই।
ঐ সময় হসপিটাল থেকে গিফট হ্যাম্পার দিয়েছিলো একটা, আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম।
ওটা খুলে দেখি, আবার গুছিয়েও রাখি। বাচ্চার ক'টা ডায়পার, টিস্যু, একটা বাথ টাউয়াল, এসব টুকিটাকি।
আমি দেখি, স্পর্শ করি, নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ নিই। এবং আবারও প্রতিবারের মতো স্বামীর কাছে বাচ্চা চেয়ে লজ্জিত হয়ে একা ঘুমুতে যাই।
বুকের কষ্ট বুকে লুকিয়ে রাখি।
আর ভিজে যায় বালিশের কিছু অংশ অভিমানী অশ্রুতে।
কাল সকালে বালিশটা আবার রোদে দিতে হবে!