১
গ্রামের মধ্যে এমন দোতলা বাড়ি দুটো নেই। অনেক খরচ হয়েছে এতে।
ইমদাদ সাহেব মাসে একবার আসার চেষ্টা করেন এখানে। কখনো কখনো এর বেশিও আসা হয়, আবার কখনো কম। ঢাকা শহরে ব্যস্ততা অনেক। এতোদিক সামলাতে হয় যে, গ্রামের এই সুন্দর বাড়ির কথা ভুলেই যান কখনো। ছেলেমেয়েদেরও তেমন ইচ্ছা নেই। শহরের বদ্ধ ফ্ল্যাটেই তারা অভ্যস্ত। বড় কথা হলো – গিন্নি চান না গ্রামে আসতে। আর জীবনটা এমন হয়েছে যে, তার কথা ফেলতে পারেন না। গিন্নির কথা ফেলতে না পারা ইমদাদ সাহেবের এক পুরনো অভ্যাস!
এবার হঠাৎ করেই চারদিনের ছুটি পাওয়া গেছে। সবাইকে রাজি করিয়ে গ্রামে এসেছেন। কয়েকটা দিন গ্রামের হাওয়া গায়ে লাগালে মন্দ হয় না।
আজ সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই বেলকনিতে চা নিয়ে বসেছেন তিনি। সামনে আছে আজকের দিনের টাটকা পত্রিকা। চা পানের বিরতিতে ইচ্ছে হলে খুলে দেখবেন। বাড়িটার একদিকে নানা ফসলের ক্ষেত, প্রচুর গাছপালা। বাড়ির খুব কাছাকাছি জমিতে সবে লাঙল চাষ করা হয়েছে। নতুন কোন ফসল বোনা হবে।
কত যে পাখির কিচিরমিচির! খুব ভালো লাগছে তার। তার তো এমন ক্ষেতের সাথে, লাঙল দেওয়া জমির সাথেই গভীর সম্পর্ক হবার কথা ছিলো। কিন্তু সৌভাগ্য কেমন বাঁধভাঙ্গা হতে পারে, তা তার চেয়ে আর কে বেশি জানে?
আজ থেকে বার বছর আগে যখন চাকরিটা পেলেন, সেটা তেমন বড় কিছু ছিলো না। সেসময় ভাবতেই পারেন নি, এই চাকরিই তার জীবনে কত পরিবর্তন নিয়ে আসবে! সময় বয়ে গেছে, আর তিনি তার সাথে ভেসে গেছেন সফলতার দিকে। পূরণ হয়েছে সেসব স্বপ্ন যা দেখতেও তার একসময় অস্বস্তি হতো। প্রভাব, প্রতিপত্তি, অর্থ – আজ কী নেই তার জীবনে?
ইমদাদ সাহেবের চোখ গেলো একদল শালিকের দিকে। যারা সদ্য লাঙল দেওয়া জমিতে খেলছিলো, উড়ছিলো, কেউ হয়তো খাবার খুঁজছিলো। এর মধ্যে একটি পাখি বেশ মরিয়া হয়ে ঠোঁট দিয়ে ছোট ছোট মাটির টুকরো সরিয়ে দেখছিলো, হয়তো তার খুব প্রয়োজন ছিলো খাবারের।
বেশ কিছু সময় পর তার ঠোঁটে দেখা গেলো একটি পোকা, সকালবেলার আকাঙ্খিত খাবার। পাখিটি তার সংগৃহীত খাবারটুকু খাবে কি খাবে না, এমন দ্বিধায় পড়ে গেলো যেন। একটুপর সে খাবারটুকু ঠোঁটে করে নিয়ে উড়াল দিলো পাশের একটি আমগাছে। এ সবকিছুই ইমদাদ সাহেবের মনে বেশ আগ্রহের জন্ম দিলো। তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন।
বোঝা গেলো, আমগাছেই পাখিটির বাসা। খড়কুটো দিয়ে বানানো সেই বাসার কাছাকাছি যেতেই দু-তিনটে পাখির বাচ্চার কিচিরমিচির শোনা গেলো। বুঝতে বাকি রইলো না যে, এটি মা পাখি। মা পাখিটিকে দেখে পাখির ছানারা হা করে এগোতে লাগলো। মা খুব যত্ন করে তার মুখের খাবারটি ভাগ করে দিতে লাগলো বাচ্চাদের মুখে। কি অপূর্ব দৃশ্য! ইমদাদ সাহেব বিমোহিত হলেন।
২
ইমদাদ সাহেবের নিজের মায়ের কথা মনে হলো। সব মায়েরাই তো এরকম হয়! তার নিজের মা তো এরকমই ছিলো, তিনি জানেন এবং তা খুব ভালমতোই।
তারা ছিলো চার ভাইবোন। তাদের যে জমিজমা ছিলো তা অনেকটাই নিচু। ফলে সবরকমের ফসল তাতে ফলতো না। সংসারের আয় ছিলো কৃষিনির্ভর। ভিটে মাটি বা উঁচু জমি খুব বেশি না থাকায়, ফসল ফলতো হাতে গোণা। ধান, ভুট্টা – এরকম দু-তিন প্রকার ফসলই ছিলো সারা বছরের চাষের ফল। সবমিলিয়ে স্বাভাবিকভাবেই অভাব ছিলো সংসারে।
মা কি যে পরিশ্রম করতেন! কাজের লোকের পিছে বাড়তি খরচ না করে, নিজের পরিশ্রমে সেটা পুষিয়ে নিতেন। যতদূর পারতেন, খেয়াল রাখতেন – ছেলেমেয়েদের কষ্ট যেন না হয়।
বড় আশা ছিলো, দুই মেয়ের বিয়ে দেবেন। ছেলেদুটো পড়াশুনা করছে। তাদের চাকরি হলে আর অভাব থাকবে না। তিনি তো তার দীর্ঘ সংসার জীবনে এটুকু ভালমতোই জেনেছেন যে, অভাব না থাকলে আপনিই সুখ আসবে।
মেয়ে দুটোর বিয়ে ঠিকই হলো। তারা সুখের সংসার পেলো। কিন্তু নিজের ঘরে অভাব দূর হয় না। মেয়ের বিয়ে দিতে, যদিও যৌতুক দিতে হয় নি, তবু খরচ একেবারে কম হলো না। সেসব খরচেই সংসারে আরেক ধাক্কা লাগলো যেন। ছেলেদুটোর চাকরি নেই, বাড়তি আয়ের কোন পথ নেই। তারা যথেষ্ট বড় হয়েছে যদিও, কিন্তু তাদের টুকটাক যা খরচ সেটাও তো এই সংসার থেকেই পূরণ করতে হচ্ছিলো।
এরকম যখন নানা শঙ্কা ভর করেছে চারদিক, তখনি তখনকার তরুণ ইমদাদের চাকরি হলো। আহামরি কিছু নয়। কোম্পানির মালিকের সাথে থাকতে হবে, পার্সোনাল সেক্রেটারির মত কিছু একটা। অনেকেই সেসময় পাত্তা দেয় নি। কেউ কেউ তো বলতো – এ আবার এমন কি! সরকারী চাকরি হলে না হয় কথা ছিলো।
কিন্তু ফল ভালোই হলো। কিছুদিন যেতে না যেতেই তার কিছু অবদান আসতে লাগলো পরিবারে। যে অভাবগুলো শরীরের দগদগে ক্ষতর মত স্পষ্ট ছিলো, সেসব সংসার থেকে হারিয়ে যেতে লাগলো। মা-বাবা খুশী হলেন।
দিন যেতে লাগলো আর সকলে একটি বিষয়ের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে লাগলো যে, ইমদাদের এবার বিয়ে দেওয়া দরকার। পাড়াপড়শিও বলতো, আত্মীয়স্বজনও বলতো কেউ কেউ। শেষে একদিন মা ডেকে বললেন – ইমদাদ, চাকুরি তো হলো। এবার একটা বিয়ে কর। ইমদাদ স্পষ্ট করে কিছু বললো না।
বাবা খোঁজ করতে লাগলেন। কয়েক গ্রাম পরেই এক পাত্রীর খোঁজ পাওয়া গেলো। দেখতে সুন্দরী, গায়ের রঙ ফর্সা। মায়ের পছন্দ। কিন্তু বাবা বললেন – ছেলে আমাদের শ্যামবর্ণের, বলতে গেলে কালোর দিকেই। এ ছেলের ওরকম বউ হলে, সে হবে অহংকারী। শেষে দেখো, সংসারে ছেলের যেন অশান্তি না হয়।
বাবা মত দিলেন বটে, কিন্তু ছেলে আর ছেলের মায়ের মতের কাছে হেরে গেলেন। বিয়ে হলো। আগের অবস্থার উন্নতি হয়েছে, তাই বিয়ে হলো বেশ ধূমধাম করেই।
ইমদাদের দিন ভালোই কাটতে লাগলো। বরং খুব শীঘ্রই তার ভাগ্য খুলে গেলো এক বিশেষ ঘটনায়। তার কোম্পানির মালিক গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ইমদাদের ভাগ্য খুলতে হবে, একারণেই হয়তোবা কোম্পানির মালিকের দায়িত্ব দেওয়ার মত কেউ ছিলো না। ছেলেমেয়েরা খুব কম বয়সী। সবমিলিয়ে কোম্পানির অনেককিছু দেখভাল করার দায়িত্ব পড়লো ইমদাদের উপর। আবার কর্তার এমন স্নেহও সবাই পায় না, কারণ তিনি চাইলে হয়তো অন্য কাউকে দায়িত্ব দিতে পারতেন।
এরকম অপ্রত্যাশিত দায়িত্ব পেয়ে ইমদাদের যেমন কোম্পানিতে পদটা ভারি হলো তেমনি পকেটের স্বাস্থ্যও বাড়তে লাগলো।
৩
সংসারে মানুষ বেশি নেই। তবে ইতোমধ্যে ইমদাদের এক মেয়ে হয়েছে। বউয়ের হিসেবে বাবা-মা আর ইমদাদের ছোটভাই এখন সংসারের বাড়তি মানুষ। সকলের সাথে থাকতে তার ভালো লাগে না। যদিও তারা এ বাড়িতে তেমন থাকতো না, তারপরেও যখন ঢাকা থেকে আসতো – মার সাথে নানা বিষয়ে খিটিমিটি লেগেই থাকতো। ইমদাদ কারণ আবিষ্কার করতে পারতো না। কিন্তু বাবা আড়ালে মাকে আক্ষেপ করে বলতেন – আমি জানতাম এরকম হবে।
মায়ের অসম্মান ইমদাদও মানতে পারতো না। কিন্তু কি এক বাঁধার কারণে যেন, সে বউকে কিছু বলতো না। মা এটা বুঝে আরো বেশি কষ্ট পেতেন। মা মনেমনে চাইতেন, ছেলে ঢাকাতেই থাকুক। বাড়িতে এলেই যখন তাকে কষ্ট পেতে হয়, তাহলে ওদের ঢাকাতে থাকাই ভালো।
ইমদাদের যখন দ্রুত অবস্থার উন্নতি হচ্ছিলো, তখনি এই নতুন বাড়ি তৈরির কাজ শুরু হলো। ওদিকে মা-বাবা বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছেন। বেশি অসুস্থ দেখায় বাবাকে। এখন তাদের দিন ফুরোবার কাল।
দেখতে দেখতে বাড়িটা তৈরি হয়ে গেলো। বউয়ের এক কথা, মা-বাবাকে নতুন বাড়িতে আনা যাবে না। তাদের বয়স হয়েছে, কাজের ঠিক নেই। কিছুদিন পর হয়তো প্রসাব-পায়খানাতেও আর নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। এই সুন্দর বাড়িটা নষ্ট করে ফেলবে। কিন্তু কি হলো, ইমদাদ প্রতিবাদ করতে পারলো না। মা যে কি ভীষণ কষ্ট পেলেন! তিনি সব জেনেশুনে শুধু এটুকু বললেন – বুঝবি রে, ইমদাদ।
মায়ের কথা ফলে গেছে অক্ষরে অক্ষরে। প্রতিনিয়তই ইমদাদ সাহেব বুঝতে পারেন। এলাকায় তিনি ইমদাদ থেকে ইমদাদ সাহেব হয়েছেন বটে, কিন্তু মায়ের শেষজীবনে মায়ের কাছে হয়েছিলেন ব্যর্থ ছেলে। শালিক পাখির পরিবার দেখে তার অনুতাপ হয়, অন্য কারো মা দেখলে তার অনুতাপ হয়। এমনকি নিজের সংসারের দিকে তাকালেও তার কষ্ট হয়।
তার নিজের এই সংসারের চেয়েও অনেক মায়ায় পূর্ণ ছিলো তার বাবা-মার পরিবার, যেখানে তার শিকড়, যেখান থেকে বেড়ে উঠে আজকের ইমদাদ সাহেব হয়েছেন। মা তাকে কতই না স্নেহ করতেন! অথচ তার নতুন বাড়িতে মাকে তিনি উঠাতে পারেন নি। অনেক সফলতার আড়ালে এ ব্যর্থতা হারিয়ে যায় নি। বরং তার এ ব্যর্থতা, তার সকল সফলতাকে ডুবিয়ে দেয় মাঝেমাঝে।
শালিক পাখিটি তার বাচ্চাদের নিয়ে এখনো খাবার ভাগাভাগি করছে, বাচ্চারা কিচিরমিচির করে জানান দিচ্ছে তাদের আনন্দ। এদিকে কাপে চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, কিন্তু কি এক বিতৃষ্ণায় বউকে বলতে ইচ্ছা করলো না – আরেক কাপ চা দাও।