আমি, নিতু, মিতা, ফারিয়া আমরা চার বান্ধবী । ও আমার নাম তো বলা হয়নি, আমি কণা । আমরা চার জন ই মহা ব্যস্ত কারণ আগামীকাল পহেলা বৈশাখ । তাই ক্লাস শেষ করেই চার জন ই ছুটলাম নিউমার্কেট এর উদ্দেশে । বৈশাখ এর শাড়ি কেনা শেষ এখন আনুষঙ্গিক জিনিস কেনাকাটা করতে হবে। ঘণ্টা দেড় এক ঘোরাঘুরি করে যার যার জিনিষ নিয়ে আমরা হোস্টেল এ ফিরলাম । চার জন ই মহা খুশি । সেদিন রাতে সব কাজ তাড়াতাড়ি মিটিয়ে আগেভাগে ই আমরা শুয়ে পড়লাম । শোবার আগে সবাই আমাকে দায়িত্ব দিলো যে, সকালে সবার জন্য ফুল আনতে যেতে হবে আমার । তাই আমি চট জলদি অ্যালার্ম দিয়ে শুয়ে পরলাম । পরদিন ভোরে অ্যালার্ম বাজতেই উঠে পড়লাম । বের হবো এমন সময় দেখি নিতু ও রেডি । নিতু এসে বলল “চল আমি ও যাবো তোর সাথে”। যেকোনো কাজ সেটা যত ছোট বা বড় যেমন ই হোক সাথে এক জন সঙ্গী পাওয়া গেলে অনেক ভাল লাগে । তাই খুশি মনেই নিতুর সাথে ছুটলাম শাহবাগ এর উদ্দেশে । আমাদের দেখে ই রহিম মামা ( উনার কাছ থেকে আমরা সব সময় ফুল নেই ) বললেন “আফারা আইছেন, আফনাগো ফুল রেডি । এই লন” । ফুল গুলো হাতে নিয়ে দেখতে ই মন টা খুশিতে ভরে গেলো কারণ ফুল গুলো একদম আমাদের মন মত হয়েছে ।
হোস্টেলে ফিরে এসে দেখি মিতা আর ফারিয়া আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ফুল গুলো দেখে ওরাও খুশি হল । এরপর আমরা বৈশাখ এর সাজে সাজতে শুরু করলাম । একটা মজার ব্যাপার হল আমরা কেউ কারো শাড়ি আগে দেখিনি । রেডি হবার পর সবাই সবাইকে দেখলাম । আমার শাড়িটা ছিল লাল এর উপর সাদা, মিতা আর ফারিয়ার তা ছিল সাদার উপর লাল, আর নিতুর তা ছিল পুরোটাই সাদা।
নিতু কে দেখে মিতা বলল “কিরে নিতু তুই একেবারে সাদা শাড়ি পরলি যে?” মিতার প্রশ্নে নিতু বলল “আমার সাদা শাড়ি পরার অনেক দিনের শখ ছিল রে । এবার শাড়ি কিনতে গিয়ে এই সাদা শাড়িটা খুব ভাল লাগলো তাই পহেলা বৈশাখ আর জন্য এই শাড়িটাই নিয়ে নিলাম। কেন রে আমাকে ভাল দেখাচ্ছে না এই শাড়িতে? ” আমি বললাম “সত্যি রে নিতু তোকে অনেক সুন্দর লাগছে ।” ফারিয়াও দুষ্টুমি করে বলল “হে রে তোকে একদম ভিন গ্রহের মানুষ মনে হচ্ছে আজ কে...হা হা হা ।”
হাসতে হাসতে ই আমরা হোস্টেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম। তারপর মঙ্গল শোভা যাত্রায় অংশ নিলাম, এদিক সেদিক ঘুরে তারপর আসলাম রমনা বটমূলে । এক কর্নারে জায়গা পেয়ে আমরা বসে পড়লাম । অনুষ্ঠান দেখছি, মজা করছি আর ছবি তুলছি । ছবি তোলার এক পর্যায়ে মিতা বলে উঠল “এই রে ভুল হয়ে গেছে রে। আমি তাড়াহুড়ো করে আমার ক্যামেরা নিয়ে এসেছি, ভুলে ই গিয়েছিলাম যে আমার টায় চার্জ নেই তাই ফারিয়ার টা আনার কথা ছিল ।” মিতার কথা শেষ না হতে ই আমরা এমন দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালাম যে ও সাথে সাথে বলে উঠল “ok ok আমি এক দৌড়ে নিয়ে আসছি ।” মিতা উঠে দাঁড়াতেই ফারিয়া বলল “দাঁড়া আমিও আসছি তোর সাথে ।” এই বলে ওরা ছুটলও । ওরা চলে যেতেই আমার ফোন বেজে উঠলো । মা ফোন দিয়েছেন তাই দেখে খুশিতে ফোন ধরে ই বলে উঠলাম “হ্যালো মা, শুভ নববর্ষ । হ্যালো হ্যালো হ্যালো মা তোমার কথা শুনতে পাচ্ছি না। হ্যালো হ্যালো। । ।” তখনই নিতু আমাকে ডেকে ইশারায় বলল ভিড় থেকে দূরে গিয়ে কথা বলতে তাহলে কথা শুনতে অসুবিধা হবেনা । আমিও ওর কথা মত বেশ খানিকটা দূরে চলে গেলাম কথা বলতে । মার সাথে কথা শেষ করে সামনে তাকাতেই দেখি ice-cream পাওয়া যাচ্ছে । চট জলদি ৪ টে ice-cream নিয়ে নিলাম । ice-cream নিয়ে সামনে তাকাতেই দেখি মিতা আর ফারিয়া আসছে । আমার হাতে ice-cream দেখে মিতাতো মহা খুশি । ice-cream নিয়ে আমরা নিতুর কাছে যাবার জন্য যেই ফিরতে লাগলাম তখন ই বিকট এক শব্দ শুনতে পেলাম আর বাতাসের প্রচণ্ড ধাক্কায় আমরা ৩ জন ই মাটিতে পরে গেলাম ।
ঘটনাটা বুজতে কিছু সময় লাগলো । যখন ই বুজতে পারলাম এ ছিল মাটিতে পুতে রাখা বোমার বিস্ফোরণ তখন ই চট জলদি মুখ ঘুরিয়ে তাকালাম যেখানে নিতু বসে ছিল । চারপাশে তখন শুধু ই বালি আর ধোঁয়া । আমার পাশে ই তখন উঠে বসলো মিতা ও ফারিয়া । আমরা এক জন আরেক জন কে দেখলাম তারপর উঠে পড়লাম নিতুর খোঁজ নিতে । চারপাশের সব কিছু তছনছ হয়ে গেছে, অনেকে ই পড়ে আছে আহত হয়ে, মনে হচ্ছে কেউ কেউ নিহত ও হয়েছে । এর ই মাঝে দেখতে পেলাম আমাদের নিতু আহত অবস্থায় উঠে বসার চেষ্টা করছে । আমরা দৌড়ে গেলাম ওর কাছে । আমাদের দেখে ই নিতু সামান্য হাসল । আমি অবাক হয়ে ভাবলাম কি করে এই অবস্থায় ও হাসছে । আমরা ওর কাছে যেতে ই ও বলল “ দেখ রে আমার সাদা শাড়ি আর সাদা নেই এখন এতে লাল রঙ ও আছে। এখন তো আমাকে তোদের গ্রহের মানুষ মনে হচ্ছে নাকি? ” কথাটা শেষ করে বড় একটা দম নিল নিতু । আমি দেখলাম সত্যি ই তো নিতুর ধবধবে সাদা শাড়ির অনেক অংশে এখন ওর তাজা লাল রক্ত লেগে আছে । আমি তখন ই বললাম “মিতা জলদি কর নিতুকে hospital এ নিতে হবে ।” তখন ই নিতু আমার হাত চেপে ধরল “please সময় নষ্ট করিস না। আমার কিছু কথা শুন।” আমরা কেউ কিছু বলার আগেই নিতু বলতে লাগলো “ তোরা ছাড়া তো আমার আর কেউ নেই তাই তোরা আমরা ছোট ভাই টাকে দেখিস । তোরা তো জানিস ই যে ও এবার admission নিলো university তে। ” এই সময় মিতার হাতের camera দেখে ই নিতু বলে উঠল “please তোদের সাথে আমার শেষ একটা ছবি তোল, দেখ এখন তো আমি তোদের মতো বৈশাখ এর সাদা লাল শাড়ি পড়েছি । ” ফারিয়া বলল “নিতু please চুপ কর তুই । এই কণা জলদি কর নিতুকে hospital এ নিয়ে যেতে হবে । ” আমরা নিতুকে উঠিয়ে বসানোর চেষ্টা করতে গেলাম তখন ই নিতু এবার বলল “please আমার শেষ ইচ্ছা তা রাখবি না তোরা, please তোদের সাথে আমার একটা ছবি তোল please । ” নিতুর অবস্থা দেখে আমরাও বুজতে পারলাম যে ওকে আর বাঁচানো যাবে না । মিতা চট জলদি camera রেডি করে বলল “ এই তোরা সবাই রেডি ...... ”
সেদিনের সেই ছবিটা আজ আমার হাতে। ছবিটাতে শুধু নিতু হাসছে আর আমাদের চোখে জল । আমি, মিতা আর ফারিয়া আজ এসেছি রমনা বটমূলের সেই জায়গায় যেখানে নিতু ওর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিল । আমার এখনও মনে আছে যাবার আগে নিতু বলেছিল “আমি এভাবে মরতে চাই না রে, আমার সাথে কেন এমন হল ? ” এই কথাটা শেষ করেই নিতুর চোখ বন্ধ হয়ে গেলো এবং ও হারিয়ে গেলো না ফেরার দেশে । নিতু চলে যাবার পর থেকে প্রতি পহেলা বৈশাখ এ আমরা তিন জন আসি রমনা বটমূলের সেই জায়গায় এবং আমাদের তিন জনের ই পড়নে থাকে সাদা শাড়ি, ঠিক যেমনটি নিতু পড়েছিল সেদিনের পহেলা বৈশাখ এ।
আজ ও পহেলা বৈশাখ । পড়ন্ত বিকেলে ঘরে ফেরার জন্য আমরা হাঁটতে লাগলাম, হঠাৎ দেখি পাশে নাইম নেই । নাইম হল নিতুর ছোট ভাই, আমরাই এখন ওর পরিবার, আমাদের সাথে তাই সবসময় ও আসে এই জায়গায় । পেছনে ফিরে দেখি ও তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে । ওর চোখে ছিল কিছু প্রশ্ন আর সব হারানোর এক অন্য রকম কষ্ট । ওর সেই প্রশ্ন গুলো হয়তো আমাদেরও এবং আরও অনেকেরই । তাই সেই প্রশ্ন গুলোর উত্তর খুঁজতেই আমারাও আকাশের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে জানতে চাইলাম “কি দোষ ছিল নিতুর কিংবা সেই সব মানুষের যারা এভাবে অকালে হারিয়ে গেল? কি ভুলের জন্য সেই পরিবারগুলো হারাল তাদের স্বজনদের ? কর্ম ব্যস্ত জীবন থেকে একটি দিন কাজকে ছুটি দিয়ে প্রিয়জনদের সাথে আনন্দ করাই কি তাদের দোষ ছিল নাকি ধর্ম, বরন, রাজনীতির ঊর্ধ্বে এক জন মানুষ হয়ে বাঁচতে চাওয়াটাই ছিল তাদের দোষ ? পহেলা বৈশাখ এর রঙ তো “সাদা লাল” তবে কেন সেদিনের পহেলা বৈশাখ অনেকের জীবনে ছড়িয়ে দিয়েছিলো শোকের কালো রঙ ? ” এইসব প্রশ্নগুলোর উত্তর আজও পাইনি, কখনো পাবো কিনা তাও জানি না । হয়তো পাবো কিংবা পাবোনা । ।
১৬ ফেব্রুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৫ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪