স্বাধীনতা হরণ

স্বাধীনতা (মার্চ ২০২২)

gcbhattacharya
  • 0
  • ৩৩৭
বাংলার চেতনা তার ভাষায়, বারো মাসের তেরো পার্বনে আর বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে…তবে আজ আমরা তো দু’চার পাতা ইংরেজী পড়েছি আর কোট প্যান্ট টাই পরে সাহেব সেজেছি বলে সেই চেতনাকে শুধু যে ভূলতে বসেছি তাই নয় নিজেদের জাত আর ধর্মের গন্ডিতে আটকা পড়ে গিয়ে এমন এক বিবাদ বিড়ম্বনা আর বৈষম্যের ও সৃষ্টি করে বসে আছি যে বাংলার চেতনা আর ফিরে আসবার কোন পথই নেই।
আর এইটাই তো ইংরেজ বণিকের জাত আসলে চেয়েছিল যখন বাধ্য হয়ে তাদের এই দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়। এমন বিভেদের বীজ তারা পুঁতে দিয়ে গিয়েছে যাবার সময়ে যে আর যেন কোনদিনই ভবিষ্যতে বাঙালির চৈতন্যোদয় হ’তে না পারে কেননা তারা এই দেশে এসে যদি কোন জাতকে ভয় পেয়েছিলো তো সে হচ্ছে এই এক বাঙালী জাতকে…তাদের বুদ্ধিকে ..তাদের নেতাজিকে….গান্ধিজী বা নেহরুজিকে কোনকালেই নয়।
সে সব কথা যাক। আমি বরং গল্পটিই বলি যেটির জন্যে এতো ভনিতা করা ।
গৌরবকে নিয়ে সে’দিন রাতে আমি ডিনার করতে বসেছিলুম আমাদের ডিজনীল্যান্ডের কার্টুনের ছবিওয়ালা সানমাইকা লাগানো চকচকে সিক্সসীটার ডাইনিং টেবিলটি সাজিয়ে নিয়ে…
গৌরব ছেলেটার পরিচয় মনে হয় এখন আর আমাকে নতুন করে দিতে হবে না কেননা ইতিমধ্যেই তাকে অনেকেই বেশ চিনে গেছে আর তারা ফোন করে আমার কাছে গৌরবের বিষয়ে অনেক কিছুই জানতে ও চায়… বিশেষ করে আমার অফিসের বস তো বটেই…
তখন যদি ও বর্ষা কেটে গিয়ে শরৎকাল এসে গেছে তবু ও দেখি যে মাঝে মাঝে বেশ বৃষ্টি হয়েই চলেছে যা আমার একটু ও পছন্দ নয় কেন না জোর বৃষ্টি পড়তে থাকলে তখন যাতায়াতের সমস্যা তো হয়ই আর সব চেয়ে বড়ো মুশ্কিল আমার এই হয় যে গৌরবের দামী ড্রেসগুলো ও আর শুকোতেই চায় না মোটেই…
আর আমি যে রোজ গৌরবকে শুধু ঘরোয়া ও স্কুল ড্রেস পরাই তাই তো নয়… সে ছাড়া ও আমি নিয়মিত ভাবে তাকে কখনো ঠিক ইংরেজদের মতন করে সকালে দামী মর্ণিংস্যুট… ছুটির দিন হ’লে লাঞ্চ… ইভনিং…. ডিনার আর নাইট স্যুট পরিয়ে রাখি আর কখনো স্পোর্টিং ও ট্র্যাক স্যুটে স্পোর্ট্সবয় অথবা কখনো একটা পাঠান ছেলে সাজিয়ে ও রাখি আর তাই সব মিলিয়ে দিনে প্রায় পাঁচ কি ছয় বার করে তার ড্রেস মানে সাজ আর সজ্জা মানে অলঙ্কার যাকে বলে ছেলের সব নানা ধরণের আবরণ ও আভরণই বসে বসে চেঞ্জ করি আমার ছেলেটাকে ইংরেজ ছেলেদের মতন ঝকঝকে স্মার্ট ও এভারফ্রেস করে রাখতে …তাই গৌরবের দামী স্যুট ছাড়াও অনেক রকমের সব পোষাক জামা কাপড় আর অন্তর্বাস সবই আমাকে রোজ কাচতে ও শুকোতে হয়…
অবশ্য গত ঘোর বর্ষার সময় আমি গৌরবের পরামর্শ মতন সফ্ট আয়রণ করে সব ড্রেস শুকিয়ে নিয়ে সেই সমস্যা মিটেয়েছিলুম …
তবে তখন সেইসময় ঠিক আবার ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি না পড়লে ও আমাদের ফোনটা বেজে উঠলো ঝনঝনিয়ে…
‘এই মরেছে…এই সময়ে আবার কে ফোন করছে রে বাবা…উঃ…ভালো জ্বালাতন যা হোক…এতো রাতে ও দেখি যে আমাদের ডিনারে পড়ছে বাধা….নাঃ….মহা মুশ্কিল…’
তবে আমি উঠতে যাচ্ছি দেখে হাত নেড়ে বারণ করলো আমাকে গৌরব…আর আমি ওঠবার আগেই ব্রাউন ভেলভেটের গদি মোড়া ডাইনিং চেয়ার ছেড়ে আমার দশ বছরের ঝকঝকে ফর্সা আর ডীপ ক্রিম কালারের ডিনার স্যুট আর গলায় গোল্ডেন বোয়ের সাথে একটা আসল মুক্তোর লকেট বসানো সোনার চকচকে ইংরেজদের রয়্যাল ফ্যামিলীর প্রিন্সদের মতন ডাইনিং নেকলেস পরে থাকা অতিসুন্দর ও স্মার্ট ছেলে গৌরব তখনি লাফিয়ে উঠে বললো-‘থাক বাপী…তুমি বসো …আমি দেখছি …’
এই বলে একটা ঝকমকে বিদ্যুতের আলোর রেখার মতন গৌরব ছেলেটা ছুটে গেলো আর ফোনটা তুলে নিয়ে বললো-
‘হ্যালো…কে বলছেন? না …আমি তো গৌরব কিশলয় কুমার বলছি … আপনি কে? …’
‘ওঃ… আচ্ছা ..শিওর আংকেল……হোল্ড অন ফর জাস্ট এ মিনিট প্লীজ…’
এই বলে গৌরব ফোনের তারের একস্ট্রা কয়েলটা খুলতে খুলতে পুরো ফোন সেটটাকে আমার কাছে তুলে নিয়ে এসে ফোনটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলো…
কি ছেলে বলো তো …তার মতে না কি খেতে বসে উঠতে নেই…তাই…
‘হ্যালো……হাউ ডু ইয়ু ডু মাই ফ্রেন্ড? …একটু দরকারী আই মিন আর্জেন্ট কথা বলতে চাই আমি…’
‘ও শিওর স্যার……অ্যাঁ…সে কি? তা এই ব্যাপারে আমি কি করতে পারি স্যার? আপনি না হয় পুলিশে …ও আচ্ছা …তবে আর আমি গিয়ে কি করবো স্যার? না… না… পূজোর ছুটিতে হ’লে সে তো হ’তেই পারে স্যার কেননা আমার পূজো নিয়ে কোন মাথাব্যথা আর সিলী ফিলিসং নেই অন্য সব বাঙালিদের মতন আর …হ্যাঁ স্যার…তবে সে তো হয় মোটে তিনদিনের ছুটি স্যার তাইতে..ও হ্যাঁ স্যার.. ওই স্পেশাল ক্যাজুয়াল লিভটা ও পাওয়া গেলে… আচ্ছা… হ্যাঁ… স্যার… তবে আপনি চিন্তা করবেন না স্যার…আমি যেতে পারবো…ও কে স্যার…গুডনাইট…’
‘এই নাও …এখন রাখো এই আধুনিক দূরভাষটিকে দূর করে ফেলে যথাস্থানে গৌরব কেননা এরই কৃপায় এখন হ’য়ে গেলো আমাদের কম্ম কাবার… ও গৌরব… এখন এসো …তুমি এসে বসে আগে দু’টো যা হয় খেয়ে নাও তার পরে সব কথা আলোচনা করতে হবে… তবে কেন যে আমার কপালেই সব সময় এমন সব দুষ্টগ্রহ নাচে তা কে জানে…ওঃ…’
চটপট করে আমার আগেই খেয়ে দেয়ে উঠে পড়লো গৌরব আর নিজের ডিনার স্যুটটা ছেড়ে ফেলে ডিশ ও ডাইনিং টেবিল ক্লিনিংয়ের কাজে লেগে পড়লো… আমি ডিনারের আগে ডাইনিং টেবিল সাজিয়ে ছিলাম তো…তাই এই কাজ গুলো এখন সব সে করবে…
সে যে এখন বেশ বড় হয়ে গেছে তাই আমাকে ছেলেটা দেখাতে চায় আর কি…
হুঁ… ভারী তো ক্লাশ ফাইভে পড়া একটা ১৩০সেন্টিমিটারের কচি বাচ্ছা ছেলে …যার ওজন মোটে ২০ কেজি আর সে নাকি আবার বড়ো ও হ’য়ে গেছে ….এইটুকু একটা ছেলে দিয়ে তো দেখি যে আমার কোন কাজই ঠিকমতন হয় না…হয় তো খালি অকাজ …
সে কথা এখন কে বোঝায় এই ছেলেকে? সে কি আর করা?…
তবে এখন তো গৌরব ছেলেটা একটু হ’লে ও বড়ো হয়েছে.. আগে তো সে একেবারেই একটা কচকচে কচি বাচ্ছা ছেলে ছিলো… আর তখন তাকে ধরে একটু মনের সুখে আদর করতে ও বেশ ভয় করতো আমার… যদি লেগে টেগে যায় তখন তো আবার কান্না শুরু করে দেবে আর তখন তো আমি গেছি…
এখন আর আমার অবশ্য সেই ভয়টা নেই তাই যখন তখন আমি আমার প্রিন্স সাজানো চকচকে ঝকঝকে ছেলেটাকে ধরে বেশ করে আদর টাদর ও করতে পারি ইচ্ছেমতন তা ঠিক তবে একদিনেই তো আর একটা ছেলে তা সে যতোই সুন্দর আর স্মার্ট হোক না কেন…বড়ো হয়ে যাবে না…নিয়ম মতন সে তো একটু সময় লাগবেই….
আমি রঙচঙে বেডকভারটা তুলে রেখে বিছানায় একটা কাচা সাদা বেডশীট পেতে আর বালিসগুলো ঠিক করে গুডনাইট অন করে দিয়ে শয়নের উদ্যোগে লেগে পড়লুম..
গৌরব আধঘন্টা পরে কিচেনের সব কাজ শেষ করে হাত পা তোয়ালে দিয়ে মুছে বেডরুমে ফিরে এলো আর বেশ সলজ্জ ভঙ্গিতে নিজের সুন্দর মুখটা একটু নীচু করে নিয়ে হেসে দিলো কারণ হ’লো তখন ছেলের পরে থাকা আধ ভিজে পোষাকগুলো……
তবে আমি কিছু বলবার আগেই সে এক এক করে তার মেরুন রঙের চকচকে সিল্কের শার্ট ও ভেলভেট কাপড়ের তৈরী সাদা শর্টটাকে খুলে ফেললো আর আলনায় ঝুলিয়ে রেখে দিয়ে নিজের অতি সুন্দর মুখটাকে বেশ কাঁচুমাচু করে গৌরব আমার কাছে এসে দাঁড়ালো…
বর্ষাকালে ছেলের সাথে বসে ইনডোর খেলার সময় আমার শেখানো মুখের এই সব বিচিত্র ভঙ্গিমাগুলো গৌরবের পদ্ম ফুলের মতন সুন্দর আর দুষ্টুমির হাসি মাখা ফর্সা সুন্দর মনোহারী মুখে এমন অপরূপ দেখায় যে এই মুখভঙ্গিমাগুলো দেখলেই তাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে আমার…
তাই আমি আর তখন ঝকঝকে গৌরব ছেলেটাকে তার রঙিন আলোর ঝালর আর রোটেটিং কালার এলইডি রুফ প্রোজেক্টার দিয়ে সাজানো গোছানো শোবার ঘরে না নিয়ে গিয়ে নিজের বিছানাতেই ছেলেটাকে টেনে তুলে নিলুম দুইহাতে চেপে ধরে আর বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেই ঝপ করে শুয়ে ও পড়লুম…
তখনই আমার নাকে গৌরবের সান্ধ্যকালীন অন্তর্বাসের মিষ্টি চন্দনের সুগন্ধ এসে লাগলো…
তখন রাত এগারোটা বেজে গেছে …
বেশ নরম একটা কচি কলাপাতা রঙের পাতলা স্লিভলেস গেঞ্জী আর একটা ছোট গাঢ় নীল জাঙ্গিয়া পরেছিলো তখন আমার ঝকঝকে ফর্সা রূপবান মিষ্টি ও নরম নরম ছেলে গৌরব…… এটা ছেলের ঘরে পরে থাকবার ছোট অন্তর্বাস আর কি…
তবে বাইরে কোথাও ছেলেকে নিয়ে যেতে হ’লে তখন আমি তাকে জকির মোটা ফুল স্লিভ সাদা গেঞ্জী আর এই ছোট ভি শেপের জাঙিয়ার বদলে ইয়ু শেপের বড়ো দামী জাঙিয়া পরিয়ে দিই বইকি…
আসলে আমাদের মানে বিশেষ করে গৌরবের সুন্দরী অল্পবয়সী মায়ের ছেলের সম্বন্ধে কনসেপ্টটাই একটু অন্যরকমের ছিলো যে…যেমন যদি আমাদের এই বাড়িটা একটা ফুলের সাজানো বাগান হয় তবে গৌরবকে হ’তে হ’বে একটা গোলাপ ফুল… অথবা বাড়িটা যদি স্বর্গ হয় তো গৌরব একটা দেববালক হয়ে থাকবে আর বাড়িটা যদি পরীলোক হয়ে যায় তখন গৌরবকে হ’তে হ’বে একটা ছেলে পরী অথবা বাড়িটাকে কখনো একটা মরুভূমি ও মনে করা যেতেই পারে কিন্তু গৌরব তখন হয়ে উঠবে মরুদ্যান বা ওয়েসিস….
সাংঘাতিক সব কল্পনার বিলাস আর কি…উঃ…উঃ…
গৌরব নিজের দু’টো নরম চকচকে বাহু দিয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বললো-‘নাও বাপী… এইবার তুমি তোমার ছেলেকে সব ব্যাপারটা খুলে বলতে পারো…’
আমি গৌরবের মসৃণ নরম দু’টো ফর্সা আর মাখনের মতন নরম গালে আর লাল ঠোঁট দু’টোতে অভ্যাস মতন চুমু খেতে শুরু করলুম আর গৌরব বেশ লজ্জা পেয়ে মুখটা লাল করে বললো-‘এই যাঃ..বাপী..এখনই নয়..ও সব একটু পরে..আগে সব কথা বলো তো দেখি তুমি আমাকে….
আমি মুখ ভার করে ঠোঁট উল্টে একটা বিশেষ মুখভঙ্গিমা করে শুধু বললুম-‘বলছি আমার প্রিন্স….রায় বাহাদূরগঞ্জ ওরফে রায়গঞ্জ…কিছু বুঝলে?…’’
আমার সেই লাস্যময় মুখ দেখে আর এই কথা শুনে গৌরব খিল খিল করে হেসে উঠে বললো-‘ও বাপী… বুঝেছি… তবে সে তো এই ইয়ু.পিতে নয় বলে মনে হয়… ‘
‘না…বঙ্গদেশে…’
‘ওরে বাবা…তা তোমার ওই অবাঙালী বস আংকেলের হঠাৎ এই বঙ্গ চেতনা জাগলো কেন মানে তিনি আমাদের দরিদ্র বাংলাকে নিয়ে পড়লেন কেন আর যেতেই বা বলছেন কেন তোমাকে?’
‘জরুরী দরকার…’
‘তবে নিশ্চয়ই ওনার কোন জাত ভাই বা আত্মীয় স্বজন কেউ আছেন সে’খানে …’
‘হুঁ…সে তো থাকতেই হবে….’
‘তা থাক তবে যতো দূর আমি জানি কোন রেল স্টেশন তো নেই ওই জায়গাতে আর বেশ ইন্টিরিয়র কান্ট্রিসাইড হতে পারে জায়গাটা…মনে হয় কর্ড লাইন হয়ে যেতে হবে…’
‘তোমার ওই সব গালভরা ইংরিজী নামগুলো রাখো তো নর্দমাতে ফেলে…আমি ইংরেজদের পরিচ্ছন্নতা ..সুবিধাজনক সাজ পোষাক …সময়ানুবর্তিতা… হার্ড ওয়ার্ক আর অনেষ্টির গুণগুলো পছন্দ করে নিয়েছি বটে তবে তাদের ওইসব গালভরা কথাবার্তা মোটেই নয়… ওঃ… বলে কিনা ইন্টিরিয়ার কান্ট্রিসাইড.. ..ছাই সাইড… সোজা বাংলায় তাকেই বলা হয়… অজ গ্রাম ‘হিঃ…হিঃ…হিঃ…অজগ্রাম আবার কি বাপী?…’
‘সেটি তুমি সে’খানে একবার গেলেই হাড়ে হাড়ে মজ্জায় মজ্জায় আর বত্রিশটি পাঁজরে ঠিক টেরটি পেয়ে যাবে…হ্যাঁ না তো..কোন আধুনিক সুখ সুবিধার বালাই নেই আর তিন চারটে গ্রাম মিলিয়ে হয়তো একটা পোস্টঅফিস আর পুলিশ স্টেশান আছে মনে হয়…সেই মশাগ্রাম ছাড়িয়ে যেতে হবে… রেল স্টেশন তো দূর হয়তো বাসস্টেশন ও মিলবে না….ওঃ…যতো সব আপদ এসে জোটো দেখি এই আমার পোড়া বরাতেই…..’
‘আচ্ছা বাপী…সেই গ্রামে কি কোন কেউকেটা… মানে গন্যমান্য লোক আছেন?’
‘তা সে তো একজন আছেনই…’
‘তিনি কে?’
‘তাঁর নাম রায় বাহাদূর রঞ্জিৎ সিংহ… আমাদের বসের ঘনিষ্ট বন্ধু…তাই মনে হয় অবাঙালী তবে বাংলায় এসে বাঙালী সেজে বসে আছেন… বিরাট ধনী… আগেকার দিনের জমীদারের পরিবার…হয়তো গ্রামের পত্তনীদার ও…আমি ওই সব পাড়া গাঁ জায়গা ভালোই চিনি…ওখানে সব কিছুই হ’তে পারে…’
‘তার মানে আবার কি বাপী? কি হ’তে পারে?’
‘মানে আবার কি? ঘটন ও অঘটন…গাঁইয়াদের সব কারবার আলাদা আর কি…’
‘তার মানে বাপী?…’
‘এই যেমন মনে করো কাউকে গুম বা খুন করা খুব সহজ কাজ ওইসব জায়গায় আর…’
‘আর বাপী?’
‘চুরী ডাকাতি থেকে শুরু করে যতো সব কুসংস্কারের ব্যাপার ও হতে পারে…’
‘যথা…’
‘তুকতাক গুণজ্ঞান তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপ এমন কি হয়তো গ্রামের শ্মশানে ভূতপ্রেতও পিশাচ নিয়ে সাধনা মানে ব্ল্যাক ম্যাজিক অবধি করা হতে পারে… …এই বিজ্ঞানের যুগে ও মন্ত্র তন্ত্র হোম যজ্ঞ বলি…সব সব চলে আর পুলিশের কোন ফাঁড়ি ও আশেপাশে কয়েক মাইলের মধ্যে না থাকলে পাহারার ব্যবস্থা ও যে রামভরোসায় চলবে সে আর বেশী কথা কি গৌরব?…সুতরাং তুমি বুঝতেই পারছো নিয়ম কানুনের অবস্থা কি হ’তে পারে সেখানে…জোর যার মুল্লুক তার অবস্থা হওয়া মোটেই বিচিত্র ব্যাপার নয় ওই সব জায়গায়…হুঁ…যত্তোসব…’’
‘তা সে তো বেশ বোঝাই যাচ্ছে বাপী তবে তো আমাদের সে’খানে না গেলেই হয়…’
‘তা তো হয়… কিন্তু কি করে হবে রে ভাই… বসের বন্ধু বা জাতভাই বলে কথা আর তাঁর প্রয়োজন মানেই বসের প্রয়োজন…এইজন্যেই বলে পরের চাকরী…বার কয়েক বেশ ভালোমতন জব্দ হ’য়ে এখন আমার এই বসটি হয়তো মনে করেন যে গৌরব যেখানে… মুশ্কিল আসান সব সেখানে… আর সেইসাথে একজন বড়ো হেভিওয়েট মিনিস্টারের রিকমেন্ডেশন ও আছে এর পেছনে… সুতরাং….’
‘ওঃ… তবে তো মহা মুশ্কিল বাপী…নাঃ সত্যিই ভারী জ্বালাতন হ’লো দেখছি…’
‘তবে আর আমি বলছিটা কি এতোক্ষণ ধরে তোমাকে গৌরব? রায় বাহাদূরের অনেক সব জ্ঞাতি গোষ্ঠি নিয়ে বিশাল এক যৌথ পরিবার আর তাঁর বাড়িতে প্রতিবছর এখনও ধুমধাম করে দোল থুড়ি হোলী আর দুর্গোৎসব মানে যাকে বলে নবরাত্রের পূজো তাই হয়… পয়সা থাকলে যা হয় আর কি? তবে এইবার তিনি দিল্লীর ওপর মহলের কাছে না কি আর্জি জানিয়েছেন যে তাঁর পুলিশ প্রোটেকশান চাই…’
‘কেন বাপী?’
‘তাঁর সব সচল দেবোত্তর সম্পত্তি অপহৃত হতে পারে বলে ভয় তাঁর …তাই তিনি নিরাপত্তা চাইছেন….তাঁর এক ছেলে এখন এম পি আর তিনি নিজে ও আগে একজন মিনিষ্টার ছিলেন সেন্টারে…… সুতরাং এখন বুঝতেই পারছো গৌরব যে কি কান্ড হবে সব….একজন সরকারী ডিটেকটিভ অফিসারকে দিল্লী থেকে পাঠানো হচ্ছে আর কয়েকজন বিশেষ আর্মড পুলিশ ও থাকবে গেট ও আমাদের পাহারায়….
‘তবে আর আমাদের যাবার কি দরকার বলো বাপী?’
‘বস আর রায়বাহাদূর সাহেব দু’জনেই চাইছেন তাই…’
‘ কিন্তু বাপী…এই দেবোত্তর অচল সম্পত্তিটা কি জিনিষ সেটা একটু তুমি এখন আমাকে বুঝিয়ে বলো না..’
‘’হুঁ…এটা মনে হয় নেটের গুগল সার্চ ইঞ্জিনের বাবা কেন তার ঠাকুর্দা ও বলতে পারবে না …তাই তুমি জানো না…’
‘ওঃ বাপী…তুমি ও না…’
‘আচ্ছা… বলছি শোন আমার রূপকুমার পুত্ররত্ন… এর মানে হ’লো যে কোন বনেদী পরিবারের কুলদেব বা দেবী থাকেন একজন আর তাঁর নামে উৎসর্গীকৃত বা আইনানুসারে সমর্পিত এমন সব সম্পত্তি ও আমাদের বাংলাতে থাকে যা স্থাবর বা অস্থাবর মানে অচল বা সচল দু’টোই হ’তে পারে তবে সচল সম্পত্তি হ’লো এই যেমন ধরো… টাকা পয়সা… সোনা দানা.. হীরে মাণিক… অলঙ্কার …এই সব আর অচল হয় জায়গা জমী ক্ষেত খামার বাড়ী ঘর মন্দির যার মালিক সেই কুলদেব বা দেবী বলে এই সব সম্পত্তি কেউ অন্য কোন লোক বা সরকার ও নিতে বা হস্তান্তরিত করতে পারে না…’
‘ওঃ… এইবারে আমি সব বুঝেতে পেরেছি বাপী …ঠাকুরের ধন সম্পত্তি …তবে সমস্যাটা মনে হয় এই সব নিয়েই তৈরী হয়েছে…’
’সে তো হ’তেই পারে…তাই হয়তো সেই ভয়েতেই চাওয়া হয়েছে প্রোটেকশন…’
‘তবে এখন শুধু সেই শয়তানির মানে চুরী ডাকাতী বা অপহরণের মূল পদ্ধতিটা জানতে পারলেই তো মিটে গেল সব…এইটুকু তো কাজ বাপী…মনে হয় বেশ সহজ ব্যাপার… হিঃ হিঃ হিঃ হিঃ…’
‘সেটা আর এই ঘরে বসে কি করে জানা যাবে বলো গৌরব যথা স্থানে না গেলে? আর বেশী সহজ কাজই অনেক সময় বেশী গোলমেলে ও হয় যে…’
‘সে যা হয় তাই হোক…আগে রেলের টিকিট তো তুমি হাতে পেয়ে নাও বাপী… এখন ও দিন দশেক সময় আছে… আমি আমাদের লাগেজ ও সব দরকারী জিনিষপত্র গুছিয়ে নেব ঠিক তবে এই সুযোগে মনে হয় যে আমাদের পূজোর সময় বেড়ানোর মজাটা বেশ ভালোই হবে …কু… ঝিক ঝিক… করে রেলগাড়িতে চড়ে…কি মজা… কি..মজা… হিঃ… হিঃ… হিঃ ..হিঃ… ‘
‘হুঁ…তা রেলগাড়ী পাগল কচি ছেলেদের কাছে এটা বেশ একটা মজা তো হ’তেই পারে তবে আমার জন্যে যে এটা সাজা… তা ঠিক কেননা আমি মোটেই ভ্রমণ রসিক বাঙালী নই রে ভাই…তাই বাঙালির এই ভ্রমণ চেতনা থুড়ি সংস্কৃতি আমার মাথায় উঠে বসে থাকলেই আমার বেশ ভালো লাগে…’
‘ওঃ…বাপী…তুমি না বাপী সব কাজকেই সাজা বলে ভাবো কেন বলো তো?’
‘তবে কি সাজের মজা ভাববো…হুঁ…কেন যে ভাবি তা সময় এলেই ঠিক টেরটি পেয়ে যাবে তুমি…’
‘তা সে যখন যা পাই পাবো …এখন তুমি একটু ঘুম করো তো বাপী ভালো ছেলের মতন…আমি না হয় ঘুমকে ডাকছি… আয় ঘুম আয় ঘুম রায়গঞ্জ দিয়ে বলে… হিঃ… হিঃ… হিঃ…হিঃ… ‘
‘তবে রে দুষ্টু পাজী ছেলে …’
বলেই আমি বেশ রাগ করে গৌরব ছেলেটার গায়ে একটা নীল সিল্কের চাদর চাপা দিলুম… কি আর করি? জল ঘেঁটে এসে তখন গৌরবের হাত পা’গুলো সব যে বেশ ঠান্ডা কনকন করছে…আর রাতে এখন তো দেখি যে বেশ একটু ঠান্ডামতন ভাব ও লাগছে… ’
অতঃপর দিন কয়েক কেটে গেছে…
শেষে দেখি যে ট্রেনের দু’টো টিকিট এলো আইআরসিটিসির ওয়েবসাইট থেকে আমার ই-মেলে আর আমার অ্যাকাউন্টে এলো পাঁচ হাজার টাকা রাস্তার খরচখরচা বাবদ….
গৌরব দেখামাত্র টিকিট দু’টো ডাউনলোড করে নিলো আর এ টি এম থেকে টাকাটা ও আমার সঙ্গে গিয়ে তুলে এনে সেই পূজোর ছুটির মজার জোগাড়ের জন্যে উঠে পড়ে লেগে পড়লো …গুগল সার্চ করে দেখে দেখে কতো কি যে সব জিনিষ সে কিনে আনলো আর নিজের পিঠের ব্যাগ মানে কি যে ছাই বলে আজকাল… হ্যাঁ…ব্যাকপ্যাকেতে ভরলো তা সেই জানে তবে আমাকে ও গৌরবের জন্যে কেনা পূজোর নতুন সব পোষাকগুলো সমেত বেশ করে তৈরী হ’তে হলো বইকি…
যথাসময়ে আমাদের যাত্রা শুরু হ’লো…
গৌরবের তো দেখি ট্রেনে চড়বার মজাই আলাদা…
আমরা একটা রিজার্ভ অটো নিয়ে বেনারস ক্যান্ট স্টেশনে পৌঁছে ফ্লুরোসেন্ট কালার চার্ট দেখে ৯ নম্বর প্ল্যাটফর্মে গিয়ে হাজির হলুম আর গৌরব প্ল্যাটফর্মে নেমেই ছুটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নীলরঙের ট্রেনে আমাদের কোচ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো…
দামী ঝকঝকে ও ভেতরে স্পঞ্জের লাইনিং দেওয়া গোলাপী রঙের বেশ নরম একটা tween boy স্যুট পরা গৌরব দৌড়ে দৌড়ে ফিরে এসে সব ট্রলি ব্যাগ ট্যাগ টেনে নিয়ে গিয়ে ট্রেনেতে এক এক করে সব লাগেজ তুলতে আমাকে সাহায্য করলো …সীট নম্বর খুঁজে নিয়ে যথাস্থানে গিয়ে বসবার ব্যবস্থা করে আবার ট্রেনের কোচের বাইরে লাগানো চার্ট দেখে নাম সীট নম্বর সব চেক করে নিশ্চিত হয়ে তখন সব লাগেজ সীটের নীচে গুছিয়ে রেখে দিলো আমার পারফেক্সনিস্ট ছেলে আর আবার নীচে নেমে গিয়ে স্টল থেকে কোল্ডড্রিংক মিনারেল ওয়াটার কেক বিস্কুট চিপস চকলেট চানাচুর… যা পাওয়া গেলো সে সব ও কিনে আনলো …
সে কি আনন্দ আর উৎসাহ ছেলের…তার মজা খুব..
ওরে বাবা..এই ছেলের মায়ের মতন দেখি যে ছেলের ও মজার জগৎটাই যেন আলাদা… সঙ্গে দেখি আবার নিজের ডবল লুডোটা ও নিয়ে এসেছে কাল সকালে বসে খেলবে বলে তবে এসী টু টিয়ার কোচ বলে গরমের কষ্টটা আমাকে তেমন পেতে হবে না… এই যা রক্ষা… কিন্তু রাত ন‘টায় স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে উঠতেই যে আমার কালঘাম ছোটবার অবস্থা হয়ে গেলো তার বেলায় কি?
গৌরবের মজার না নিকুচি কিয়া হ্যায়…যত্তোসব…ওঃ..’
আমি নিজের নিচের বার্থে তখন একটা কম্বল আর বেড সীট পেতে বালিশে হেলান দিয়ে আড় হয়ে বসেছি আরাম করে…
‘এখন গাড়ী ছাড়লেই বাঁচি…
গৌরবকে বললুম- ‘এই ছেলে… এইবার তুমি আমার কাছে এসে জানলার ধারে চুপটি করে বসে পড়ো তো দেখি… আর তোমার কিনে আনা একটা চকলেটই খাও তো বসে…উঃ…কি ছটফটে একটা ছেলে হয়েছে রে বাবা …বুঝতেই তো আমি পারছি না যে এটা একটা ছেলে না চিংড়ি মাছ…অ্যাঁ….’
‘হিঃ…হিঃ…হিঃ…হিঃ….ও বাপী…রেল গাড়ী চলছে …রেল গাড়ী চলবে… ’

আমাদের গাড়ী যথাসময়ে ছাড়লো তো বটে তবে সেই গাড়ী দেখি গুড় গুড় করে চলে বেশ লেট ও করতে লাগলো…
মাঝপথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আর ঢিকঢিকিয়ে চলে গাড়িটা বর্দ্ধমানের পরে কর্ড লাইন হয়ে হাওড়া রওনা হ’লো আর তাই পরের দিন বিকেলে প্রথমেই গিয়ে আমাদের নামতে হ’লো মশাগ্রাম… সে’খানে নেমে বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে নীলপুর যাত্রা…
সেইখানে বাস বদল করে মানে বাস ছেড়ে ট্রেকারে খানিকপথ গিয়ে শেষে মাণিকপুর থেকে অটো নিয়ে যেতে হ’লো রায়গঞ্জ…
তাই সেই গ্রামে গিয়ে পৌঁছতেই তো আমি একেবারে হয়রাণ…
আর সেই গ্রামেতে থাকতে যে আমাদের কেমন সুবিধা আর মজা হ’বে …সে তো বেশ বোঝাই গেলো…সে আর কহতব্য নয়…না আছে লাইট আর না আছে পাথা…এসী ফ্রিজ কুলার বাথটব ও গীজার…সে সব তো দূর অস্ত…
শুধু দেখা গেলো যে পথের ধারে ল্যাম্প পোস্ট বসানো হয়ে গেছে আর পোস্টের মাথায় তার ও লেগেছে তখন আর শুধু গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান বলে জমীদার বাড়িতে তার টেনে লাইট নিয়ে যাওয়া হয়েছে…
তবে আরো কাজ চলছে একটা ট্রান্সফর্মার বসানোর আর মনে হয় তারপরে এখনি স্টীট লাইট না লাগলে ও আগামী তিন মাসের মধ্যে হয়তো সবঘরেই ইলেক্ট্রিকের আলো এসে যাবে… তবে এখন যে আমাদের এই ঝামেলায় পড়তে হ’লো তার কি?
তবে গৌরব দমে যাবার পাত্রই নয়…
গৌরবকে একটা বিদেশী নাইট ভিজন চশমা ও চোখে পরিয়ে দিলুম রাতে....কেননা সারা গ্রাম নিষ্প্রদীপ… শুধু বাবুদের দু’তলা বাড়ির তিন চারটে ঘরে লাইট আর চন্ডী মন্ডপে আলো জ্বলছে পেট্রোম্যাক্সের… সে’খানে নাকি প্রতিমা রঙ ও পালিশ করা আর সাজানো হচ্ছে… রাত বারোটা অবধি কাজ চলবে…
কাল পঞ্চমী… প্রতিমার বিশেষ অলঙ্করণ করা হবে আর ঘট স্থাপন করা হবে… তার পরের দিন বোধন হবে…ঠিক বাঙালির পূজো না হ’লে ও বাংলার পূজোতো বটেই আর এই পূজোতে শুধুমাত্র এই গ্রামেরই নয় আশে পাশের দশ বারোটা গ্রামের আপামর সবাই হয় আমন্ত্রিত,, এ’টাই বাংলার পূজোর সংস্কৃতি যাকে বলে…অবারিত দ্বার..তা সে যে কোন জাত বা ধর্মের লোকই হোক না কেন? মা যে সবাকারই মা …আর সে না মানলে তখন তো নিজের মা ও পর হয়ে যায় নিজেদের ঘরে…অর্থাৎ মানলে গঙ্গা আমার মা..পদ্মা আমার মা হ’তে পারে আর না মানলে …সেই যে একটা হিন্দী গান আছে না? মানো তো মৈ গঙ্গা মা হুঁ.. না মানো তো বহতা পানী… তাই আর কি?…
তবে দেখা গেলো যে সে’খানে আমাদের থাকবার জন্যে ব্যবস্থা জমীদার বাড়ির পাশে আলাদা একটা চারদিকে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা আর লোহার গেট লাগানো একতলা ছোট বাড়িতে করা হয়েছে তবে সেই বাড়িতে ও লন্ঠন আর মোমবাতিই ভরসা….
আমরা অটো নিয়ে কোনমতে সেই বড়ির গেট পেরিয়ে সবে ঢুকতে না ঢুকতেই ঝম ঝম করে বৃষ্টি পড়া ও শুরু হ’য়ে গেলো…আবছা আলোতে সামনেই মনে হ’লো টালির ছাদওয়ালা একটা লম্বা ঘর আর উঁচু দাওয়া …চারটে সিঁড়ি উঠে তবে উঠতে হয় তবে বড়ো দাওয়াতেও টালির চাল আছে বলে ভিজতে হ’লো না…
ম্যানেজারবাবু আমাদের সঙ্গে ছিলেন…
তিনি দরজা খুলতেই দেখি যে সামনেই বড়ো একটা ঘর আর সামনের দেওয়ালে ঠিক সামনে আছে আর একটা দরজা …সেটা খুললে ও’দিকে ও নাকি একটা বারান্দা আছে …. ঘরে সামনা সামনি চারটে জানলা আছে আর ডানদিকে আর একটা দরজা আছে…
আর আছে একটা বিছানাপাতা বড়ো খাট আর তার পাশে একটা গোল টেবিল …তার ওপরে আছে জলের জাগ তিনটে গ্লাশ ঢাকা সমেত…আর একটা লন্ঠন মোমবাতি দেশলাই ও একটা টর্চ…
একটা কাঠের আলমারী গোটা চার কাঠের চেয়ার আর একটা বড়ো টেবিল যেটা ডাইনিং টেবিলের কাজ করতে পারে… ডানদিকের দরজার পাশে আছে একটা কাঠের আলনা … সেই দিকের দরজাটা খুলতে দেখা গেলো আরো একটা ঘর আর সে’খানে আছে একটা জল ভর্তি বড়ো ড্রাম …দুটো বালতি আর মগ.. এক পাশে একটা চাকাওয়ালা স্টিলের ফ্রেমে বসানো একটা বেসিন … একটা গামছা তোয়ালে রাখবার রেক আর একপাশে নতুন বসানো কমোড …এই হ’লো টয়লেট কাম বাথরুম…
‘স্যার…এই আমাদের কুঁড়েঘর …পূজোর কটা দিন একটু কষ্ট করে থাকতে হ’বে স্যার এখানেই আপনাদের… তবে পূজোর কয়েকদিন মানে কাল পঞ্চমী থেকেই সকলের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা তো বাবুদের বাড়িতেই করা হয়েছে…. তাই বেশী অসুবিধা হয়তো আপনাদের হবে না… আর সকাল ও বিকেলের চা জলখাবার সব ঘরেই পাঠিয়ে দেবো স্যার…
আজ রাতের খাবার ও বাবুদের বাড়িতে বলা আছে … আপনারা এখন আগে একটু রেস্ট নিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলে ভালো হয়… ততক্ষণে আমি চা টা পাঠিয়ে দিচ্ছি… রাত সাড়ে দশটার মধ্যে ডিনার এসে যাবে ….তবে আমাকে এখন যেতে অনুমতি দিন স্যার… কি আর বলি? ’
আমাদের জিনিষ পত্র সব সেইঘরে এনে রেখে দিয়ে তপনবাবু মানে ম্যানেজারবাবু বিদায় নিলেন আর আমাদের ঘিরে ধরলো এক দারুণ গ্রাম্য নৈশব্দ আর অন্ধকার….যদি ও দাওয়াতে একটা আর ঘরের ভেতরে একটা লন্ঠন বেশ জোরেই জ্বলছিলো …
‘ও… গৌরব… এই হ’লো আমাদের আপাতত আস্তানা…এখানে লাইট নেই পাখা ও নেই গীজার চুলোয় যাক এমন কি বাথটব ও তো নেই…কি করে থাকবো?’
‘ওঃ… বাপী…শহরে থেকে দেখছি তুমি না এখন একটুতেই বড় বেশী ঘাবড়ে যাও… ওই দেখো না …খাটের মাথার কাছে দেওয়ালের তাকে আছে হাতপাখা আর নীচে আছে একটা স্টোভ আর কিছু বাসনপত্র… একটা বড়ো ডেকচি ও আছে… আমি আছি কি করতে বলো তো বাপী? আমি সকালে স্নানের গরম জল রেডি করে নেবো…’
‘ও রে বাবা… তাই তো… এতোবড়ো একটা ছেলে থাকতে আমার আর ভাবনা কিসের? তবে সে ও কি সহজ কাজ হ’বে না কি? এ আমরা কোথায় এসে পড়লুম রে বাবা?’
‘আঃ বাপী তুমি না বড্ড ছটফটে ছেলে একটা…সহজ কাজ হ’বে না কেন বাপী? তবে….’
‘তবেটা আবার কি গৌরব?’
‘বাপী…আমার মনে হয় এই জায়গাটা তেমন বিশেষ সুবিধের নয় কেননা গ্রামের কোন বাড়িতে এমন পাকা পাঁচিল আর বড়ো গেট… এই সব তো থাকবার কথা নয়… বড়ো জোর গরু ছাগল শেয়াল আটকাতে থাকে বাঁশ ও কঞ্চির বেড়া ও তার একটা আগল…তাই মনে হয় যে আমাদের রাত্রিবাস একটু সাবধান হয়েই করতে হবে বাপী…’
‘তার মানে নিশ্চিন্ত হয়ে একটু ঘুমোতে ও পাবো না…ওঃ কি আপদ রে বাবা…’
‘সে যাক…তুমি না বাপী এখন এক কাজ করো…’
‘কি করবো?’
‘বাথরুমে যেতে হবে তো তাই তার আগে দাওয়া থেকে তুমি আলোটা নিয়ে এসো কেননা বাথরুমে তো আলো নেই… তবে…সবার আগে মেন গেটটা বন্ধ করে দিয়ে এসো বাপী…’
‘যো হুকুম মেরে আকা…’
‘এই মা… ছিঃ… ছিঃ বাপী…ওইভাবে কি বলতে আছে নিজের ছেলেকে কখনো? …ঠাকুর তো পাপ দেবেন আমাকে….তা আগে দেখা যাক জলখাবার কি দেয়… তারপরে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লেই হবে তবে জেনে নিতে হ’বে যে গেটে তালা দেওয়া হয় কি না রাতে…’
চা দুধ বিস্কুটের দেখা মিললো খানিক পরেই আর রাতে মিললো হাতে গড়া আটার মোটা মোটা রুটি অড়হরের ডাল বেগুনের ভর্তা মানে পোড়া আর কি…. সাথে আলুকপির তরকারী চাটনী থুড়ি আমের আচার আর মিহিদানার বড়ো বড়ো গোটা দুই লাড্ডু…
মনে হয় এখানে এই সব নিরামিশ আর দেহাতের ভোজনই ভরসা…
খাবার দেখে গৌরব ছেলেটা আমার দিকে চেয়ে মুখে এমন একটা অপরূপ সুন্দর ভঙ্গি করে নিজের পাতলা লাল ঠোঁটদুটো টিপে ভ্রুভঙ্গি করে একটু হাসলো যা দেখেই রাগে আমার সারা গা জ্বলে গেলো কেননা এই সব খাবার যে আমি আজ অবধি সাতজন্মে ও কখনো খেয়েছি বলে মনে পড়লো না…
আমি রাগ করে বলে ফেললুম-‘ আরে ছাতার মাথা… তা তোদের লিট্টিপোড়াটাই বা শুধু বাদ গেলো কেন? আর বিশেষ করে তার জন্যে যখন নুন লঙ্কা দিয়ে মাখা বেগুনের ভর্তা ও রয়েছে… সেইটাই তো বুঝছি না…’
আর তাই শুনেই গৌরব ও নিজের বিশেষ জলতরঙ্গ সুরে খিল খিল করে হেসে ফেললো…’ও বাপী…সে কাল হয়তো দেবে ঠিক …তুমি বাপী একটু ধৈর্য্য ধরোই না বাপী…’
হিঃ..হিঃ,,,হিঃ হিঃ…করে হেসে ছেলেটা একেবারে কুটিপাটি হয়ে গেলো… আর তাই দেখে রাগে তখন আমার ইচ্ছে করছিলো যে গৌরব যেমন ছোটবেলায় আমার সাথে করতো ঠিক সেই মতন করে করে দিই তার একটা নরম হাতে ঘ্যাঁক করে এক কামড় বসিয়ে… যত্তো সব জ্বালাতন আর কি…ওঃ..’
তখন আর কি? তবে আমার খেতে খেতেই মনে হ’লো যে তাহ’লে এরা যতোই বলুক আর একটা মা দুর্গার মূর্তি চন্ডীমন্ডপে তৈরী করে এনে যতোই বসাক না কেন এখন ও হয়তো এদের পূজো ঠিক আমাদের মতন দুর্গাপূজো নয়… মনে হয় এদের হবে তান্ত্রিকমতে নবরাত্রের নবদুর্গার পূজো …তবে জাঁকজমক আর আড়ম্বরের ঘটা মনে হয় খুব বেশিই থাকবে আর তাই পূজোর দিন হয়তো ক্ষীর পুড়ি হালুয়া আর গুলাবজামুন খাওয়াবে…দেখাই যাক…
তবে ঝাল তরকারী খেয়ে আর গৌরবের জন্যে এক গ্লাশ দুধ ও দিলো না তাই দেখে তখন রাগে আমার গা জ্বলছিলো তাই খেয়ে উঠেই হাত মুখ ধুয়ে এসে ঢিপ করে শুয়ে পড়লুম বিছানায় উঠে…
গৌরব ও আমার পাশে এসে বসলো আর আমার দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে চেয়ে রইলো একমিনিট…
এটা ও গৌরবের সুন্দর মুখের একটা বিশেষ অপরূপ মুখমুদ্রা যার মানে ও আমি জানি আর সেটা হ’লো… কেমন মজার নতুন সব খাবার খেলে বলো তো…আর তাই আমি রেগে ওঠবার আগেই সে আমার হাতে দু’টো হাজমোলার গুলি ধরিয়ে দিয়ে ঝপ করে আমার পাশে শুয়ে পড়লো…আর খানিক পরেই দেখি যে সে দিব্যি করে ঘুমিয়ে ও পড়লো…
যা বাব্বা… আর এদিকে তখন ডালরুটি আর দারুণ ঝাল তরকারিদের নৃত্য শুরু হয়ে গেছে আমার পেটের ভেতরে… হাজমোলা দু’টো কপ করে আমি মুখে পুরে দিলুম বটে কিন্তু এতে শানালে তো… মনে হয় গৌরবের ব্যাকপ্যাক থেকে বের করে তিন চামচ ডাইজেস্টো না খেলেই নয়… ওঃ..আমার পোড়া কপালে কি সব গেরো রে বাবা…
তা এইসব ভাবতে ভাবতেই আমি ও কখন যে গৌরবের মতন ঘুমিয়ে পড়েছি তা ঠিক জানি না তবে হঠাৎ কেমন যেন একটা অস্বস্তিতে আচমকা আমার ঘুমটা ভেঙে গেলো… এটা মনে হয় আমার সিক্সথ সেন্স…
মনে হ’লো তখন অনেক রাত আর বাইরে বৃষ্টি ও আর পড়ছে না…তবে হয়তো মেঘ করেই আছে আর তাই বাইরে ঘোর অন্ধকার আর কেমন যেন একটা গুমোট ভাব ঘরে…হয়তো তাই অস্বস্তি হচ্ছে আমার…
আমি আমার বুকের ওপর লেপ্টে পড়ে থাকা গৌরবের গলার বড়ো চকচকে সোনার চেনটাকে আগে খুব আস্তে করে সরালুম আর তারপরে আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকা গৌরবের নরম মসৃণ বাঁ হাতটা ও আলতো করে ধরে তুলে সরিয়ে দিয়ে উঠে জানলায় গিয়ে দাঁড়ালুম একটু খোলা হাওয়ার আশায়…
আর তখন যেন মনে হ’লো যে গেটের বাইরে কে বা কারা যেন বেশ ভারী পা ফেলে চলে বেড়াচ্ছে …
গেটের সামনে হয়তো কাদা আছে তাই কেমন যেন চট চট করে একটা অদ্ভূত শব্দ ও হচ্ছে…তবে রাতে খাওয়া দাওয়ার পরে আমি নিজের একটা তালা লাগিয়ে দিয়ে গেটটা যেমন বন্ধ করে দিয়েছিলাম সেটা তেমনই বন্ধ আছে ভেতর থেকে…
এতো রাতে কে রে বাবা? চোর ডাকাত না কি? তা চোরের পায়চারী? সেটা কেমন কথা? চোর পা টিপে টিপে পদচারী হ’তেই পারে কিন্তু পায়চারী করবে? মন হয় না… অতোটা বাড়াবাড়ি ডাকাত হ’লে করতে পারে..কোন চোরের তা করা সাজে না…
হঠাৎ দেখি অন্ধকারে জ্বলে উঠলো এক বিন্দু আলো …
ঠিক যেন একটা জোনাকি জ্বলছে… আবার একটা… আবার ও …
এই করে শেষে গেটের ফাঁক দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি ঢুকে পড়তে লাগলো আর একটা গোল আলোর বৃত্ত তৈরী হ’য়ে গেলো ঠিক একটা মানুষের মাথার মতন দেখতে…এমন কি তার মধ্যে দু’টো জ্বলন্ত চোখ ও দেখা গেলো… সেই বৃত্তের মধ্যে ফুটে উঠতে লাগলো একটা হিংস্র মুখাবয়ব…
এ’সব আবার কি কান্ড হচ্ছে রে বাবা এই রাতদুপুরে?
এতো রাতে … এতো জোনাকি পোকা এলো কোথা থেকে তবে গ্রামগঞ্জ জায়গা তার ওপরে আবার বেশ বৃষ্টি ও হয়ে গেছে …তাই সন্ধ্যের বদলে বেশী রাতে ও জোনাকির সবুজ আলো তো জ্বলতেই পারে …
তবে তারা একত্র হয়ে এমন একটা আলোর বৃত্ত আর আকৃতি তৈরী করবে কেন আর ক্রমে এগিয়েই বা আসবে কেন এই জানলার দিকে এমন দল বেঁধে?
নাঃ ……ভূত প্রেত বা তান্ত্রিকদের পিশাচ টিশাচে আমার বিশ্বাস মোটেই নেই তা বটে তবে সে যাই হোক এই সব কিন্তু লক্ষণ মোটেই ভালো নয়… আমাকে সাবধান হতে হবে…আত্মরক্ষা করতেই হবে এখন কিন্তু আমি তখন যেন ধীরে ধীরে কেমন মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ছি সেই আলোর মায়াতে …
শুনেছি যে রাতে সাপ ও বাঘের চোখের দীপ্তিতে এমন একটা মোহ থাকে যা শিকারকে নড়তে দেয় না এক বিন্দু ও তবে জোনাকির তৈরী চোখের আলোতে ও যে এমনটি হয় তা তো শুনিনি কখনো ….এইগুলো সব জোনাকিই তো না কি অন্য কিছু?
তবে আর কি হ’তে পারে?
আলেয়া?
মনে তো হয় না কেননা সেটা তো হয় জলাভূমির মিথেন গ্যাসের আলো…
তবে এটা যাই হোক… এতো রাতে যখন এসেছে তখন এর উদ্দেশ্য খুব একটা সাধু বলে তো মনে হয় না…
কিন্তু আমি যেন অসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছি আর সেই আলোর বৃত্তটা ভাসতে ভাসতে ক্রমেই এগিয়ে এসে প্রায় ধরে ফেলেছে আমাকে…
হঠাৎ যেন সেই আলোর বৃত্তটা দড়ির একটা ফাঁসের মতন হয়ে লাফিয়ে এসে আমার গলায় চেপে বসলো আর কট কট করে মশার মতন কিছু আমার সারা শরীরে কামড়ানো শুরু করে দিলো…সে এক অদ্ভূত কান্ড…
সেই আলোর দড়ির প্রবল চাপে আমার যেন দম বন্ধ হয়ে এলো…
এ..এ..এ…একি কান্ড হচ্ছে সব…ওঃ…মনে হয় এখন আর আমার নিস্তার নেই…আমি ওঁ… ওঁ… ওঁ… ওঁ. .ওঁ…করে উঠলুম…
হঠাৎ আমার পাশে কেমন যেন কট করে একটা শব্দ হ’লো… আর সিঁ… সিঁ… সোঁ… করে একটা যেন সাদা ধোঁওয়ার মেঘ আমার পাশ দিয়ে ছুটে গেলো সেই আলোর বৃত্তের দিকে…
কেমন যেন মিষ্টি মিষ্টি আর বেশ ঝাঁঝালো একটা তীব্র গন্ধ….
সঙ্গে সঙ্গে ছত্রভঙ্গ হ’য়ে চারদিকে ছিটকে গেলো সেই জোনাকির আলোর বৃত্ত …ছিটকে পড়লো সব বাইরের ভিজে মাটিতে আর আমি বুক ভরে শ্বাস নিতে পারলুম যেন…
‘আঃ বাঁচলুম…’
‘আলোগুলো সব নিভে গেলো আর তার সঙ্গে সঙ্গে বাইরে কে যেন আর্তনাদ করে উঠে দৌড়ে পালিয়ে গেলো…
আমি একেবারে হতবাক…
ওঃ… এ’সব কি ভয়ানক কান্ড রে বাবা?...এই কি গ্রামের ভূত প্রেতের খেলা?
অভ্যাস মতন আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলো-‘ও গৌরব…এটা কি হ’লো…?’
আমার পাশে পাতলা নীল রঙের একটা নাইলনের নাইট গাউন বা স্লিপিং স্যুট পরে দাঁড়িয়ে থাকা গৌরব বলে উঠলো-‘ও বাপী …এটা হ’লো মর্টিন টু ইন ওয়ান মানে মশা ও ইনসেক্ট কিলার স্প্রে… নগদ সোওয়া দু’শো টাকা দাম নিয়েছে তবে মনে হয় আমার আর একটু দেরী হ’লেই পাশা উল্টে যেতো বাপী…’
‘আরেঃ… এ যে দেখি সত্যিই গৌরব আমার পাশে রয়েছে …তা গৌরব …তুমি জেগে উঠলে কখন?’
‘সেই যখন তুমি আমার হাতটা সরিয়ে দিয়ে আমাকে ছেড়ে নিজে উঠে গেলে বাপী তখনই… আমার যে খুব বাজে একটা অভ্যাস দোষ আছে বাপী…জানো তো… হিঃ… হিঃ.. হিঃ…..
তুমি পাশে না থাকলে একলা শুয়ে আমার কি ঘুম হয় বাপী? তবে তুমি না বাপী বড়ো অসাবধান ছেলে একটা…যাঃ… মা দেখি ঠিক কথাই বলে… আমাকেই সামলে রাখতে হবে দেখছি তোমাকে…. এখনি কি কান্ড হ’তো বলো তো…’
‘ও রে বাবা…এ ঠিক…ভূতের হাতে আজকে মরি…হয়ে যাচ্ছিলুম যে আজ…ও গৌরব…’
‘যাঃ বাপী… ওই সব কথা বলতে নেই….তবে পরিচয়াদি না হতেই যখন নতুন ধরণের আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে…তখন বিশেষ সুবিধের জায়গা এটা মোটেই নয়…আর আমাদের পরিচয় ও হয়তো ফাঁস হয়ে গেছে…তাই কাল রাতে আবার হয়তো এমন কিছু হবে যা আমি ও বুঝতে বা আটকাতে পারবো না বাপী…এ’খানে মনে হয় রাতেই পূজোর সব আসল মজা হয় বাপী…’
আমি তখন গৌরবকে কোলে তুলে নিয়ে গিয়ে আদর করে বিছানায় আবার শুইয়ে দিলুম আর ছেলেটা ও দিব্যি করে আমাকে আবার তার দুটো চকচকে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে একটু পরেই দেখি ঘুমিয়ে ও পড়লো তবে সেই রাত দু’টো থেকে আর সারারাতে আমার আর ঘুমই হ’লো না একটু ও….
পরের দিন খুব ভোরেই উঠে পড়লুম আমি তবে সেই নতুন পরিবেশে প্রাতঃকৃত্য ও স্নান টান সব সেরে তৈরী হ’তে আমাদের বেশ সময় লেগে গেলো…
সে কি আর করা যাবে? যখন যেমন দশা…
গৌরবকে ঘুম থেকে তুলে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে তাকে ব্রাশ করানো ও প্রাতঃকৃত্যের পরে জল গরম করে তাকে বডি ওয়াশ মাখিয়ে স্নান করানো… অনেক কাজ তো আমার…
গায়ে নীল তোয়ালে জড়ানো সদ্যস্নাত ছেলে গৌরবকে হাত ধরে আমি ঘরে নিয়ে এলুম আর জানলা দু’টো বন্ধ করে দিয়ে দামী বিদেশী বডি লোশন ক্রীম পাউডার ডিও…এইসব দিয়ে একটু সামান্য প্রসাধন করেই গৌরবকে একটা ছোট পকেট বসানো অন্তর্বাস পরিয়ে দিলুম আগে আর সেই পকেটে যথারীতি রেখে দিলুম একটা ছোট দেশলাই…তারপরে গৌরবকে একটা গোপন ও দু’টো সাধারণ পকেট ওয়ালা একটা বিশেষ মেরুন রঙের দামী বয়স্যুটের মতন বাইরের ড্রেস ও পরিয়ে দিলুম আর তার সেই গোপন পকেটে রইলো একটা ছোট ফোল্ডিং ছুরী… ব্যস… এইবারে গৌরবের বড়ো বড়ো চোখ দু’টোতে দামী মধ্য প্রাচ্য দেশের একটু ইম্পোর্টেড সুরমা আর কপালে ছোট ছোট করে চন্দন ও রোলির সরু লাল একটা ইয়ু টিপ পরিয়ে দিলেই আমার কাজ তখন শেষ… এইটুকু মাত্র সাজেই তখন আমার রাজকুমারের মতন দেখতে স্টার ছেলেটা তৈরী…
শুধু একটা টুপী মোজা জুতো আর চশমা পরা রইলো বাকি…
সে সব গৌরব নিজেই পরে নিতে পারবে আর তার পকেটে ও নিজের রুমাল টুমাল সব নিয়ে নেবে ব্যাগ থেকে …কখন যে কি জিনিষ কোন কাজে লেগে যাবে তা বলা তো যায় না…
তারপরে তখন আমি নিজে ও তৈরী হ’য়ে ক্রিম কালারের একটা ফুলহাতা সাফারী স্যুট পরে নিলুম…
এইসব করতে সাতটা বাজলো …
আমি তখন আগে গিয়ে গেটটা খুলে দেখি যে সত্যিই কাদার ওপরে আছে একজন লোকের বেশ বড়ো সড়ো অনেকগুলো পায়ের ছাপ তবে খানিকটা দূরে গিয়েই তা হয়েছে অদৃশ্য…
সব দেখে শুনে ঘুরে এসে গৌরব বললো-‘ও বাপী…লোকটা মনে হয় সাইকেলে উঠে পালিয়েছে তবে লোকটার বেশ ভালো স্বাস্থ্য আছে আর সে বেশ লম্বা চওড়া মানুষ…এমন লোক কখনোই নিরামিষ মানে ওদের ভাষায় ঘাসফুস খাবার খায় না কেননা ওই সব ওদের কাছে অচল আর হয়তো মদ টদ ও খায় মাংস হজম করতে…কিন্তু এই পূজোর বাড়ির লোকজন লিট্টি খেলে ও মনে হয় শাকাহারী মানে নিরামিষ ভোজন বিলাসী…তাহ’লে বাপী? এই লোকটা কে হতে পারে বাপী?
‘আমার মনে হয় এই লোকটা কোন সাধু বা তান্ত্রিক ও হ’তে পারে….’
‘সাধু মোটেই নয় বাপী… ছদ্ম সাধু মানে অসাধু হওয়া সম্ভব…’
‘কিন্তু তার এতো আক্রোশ কেন আমাদের ওপরে?’
‘কেননা হয়তো তারা ঠিক জানে যে পুলিশ আর সরকারী ডিটেক্টিভকে টাকা দিয়ে বা ভয় দেখিয়ে কেনা গেলে ও তোমাকে টাকা দিয়ে কেনা যাবে না… হিঃ…হিঃ…হিঃ…কিন্তু বাপী… ওরা এটা জানলো কি করে বলো তো…’
‘হুঁ………..ঠিক বলেছো তুমি…আমার মনে হয় যে ওই রায় বাহাদূর যখন ফোনে আমার বসের সাথে একজন প্রাইভেট ডিটেক্টিভ চেয়ে কথা বলেছেন তখনই এই খবরটা রাষ্ট্র হয়েছে তাঁর মুখ শাবাসির জন্যে…কেউ ছিলো সেই সময় তাঁর সাথে তখন যাকে তিনি খুব বিশ্বাস করেন…গৌরব রে… একেই বলে সর্ষের মধ্যেই ভূত…’
‘বাপী…তোমার বসের কল্যাণে এই কল্যাণকর কাজটি যখন হয়েছে… তখন আমাদের বেঁচে থাকবার অধিকার ও খতম হয়েছে তাই এখন আমাদের মা কল্যাণিই ভরসা বাপী.. তুমি আমাকে একটা ছোট দূরবীন দিও শুধু কেননা ক্যামেরা তো আমার ফোনেই আছে… আমাকে রোজ গোটা কয়েক করে ছবি তুলতে হবে বাপী আর খুব সতর্ক নজর ও রাখতে হবে চারদিকে…’
‘সে এনেছি আমি…আমার নীল ব্যাগটাতেই আছে….’
‘তবে এখন ঘরের ভেতরে চলো বাপী… মনে হয় সেই ম্যানেজার বাবু আসছেন আমাদের চা জলখাবার নিয়ে … তবে ওনাকে এই সব কথা কিছুই বলবার দরকার নেই বাপী…তুমি সাবধানে আজ দিন ভোর সবার সাথে পরিচয়াদি করবে ও তথ্য নেবে যখন তখন তোমার পকেট টেপ রেকর্ডার অন করে রাখবে বাপী আর আমি ও মোবাইলে ফটো ও ভয়েস রেকর্ডিং করবো… চলে এসো…’
তপনবাবু এলেন… সঙ্গে জলখাবার ও…
তাঁর কাছে জানা গেলো যে প্রতিমা তৈরী হয়ে গেছে… দুপুরে মায়ের অলঙ্করণ করা হবে… আমাদের তখন মন্ডপে নিয়ে যাওয়া হবে …
তবে তার আগে আমি এক বার রায় বাহাদূর সাহেবের সাথে দেখা করতে চাই বলতে তপন বাবু বললেন-‘ তিনি নিজেই আসবেন এক ঘন্টা পরে আপনাদের সাথে দেখা করতে যাতে আপনাদের পরিচয় কেউ জানতে না পারে…তবে বয়স হয়েছে বলে তিনি একবারই নীচে নামবেন আর তাঁর সঙ্গে থাকবে পিস্তলধারী দু’জন পাহারাদার সমেত মায়ের অলঙ্কারের ছোট সিন্দুক বা পেটিকা…’
‘এইসব অলঙ্কার কি খুব দামী?’
‘হ্যাঁ …আর শুধু দামিই নয় …দুষ্প্রাপ্য ও বটে…সেই নবাবী আমলের সব দুর্লভ মণি মুক্তো হীরে পান্না বসানো খাঁটি সোনার অলঙ্কার ও অস্ত্র শস্ত্র…সেই সিন্দুক নিয়ে তিনি মন্ডপের ভেতরে যাবেন তবে দর্শক কেউ প্রতিমার কাছে মানে দশ হাতের ভেতরে যেতে পারবে না …দশ হাত দূর থেকে গোটা প্রতিমা বুলেট প্রুফ কাঁচের শিল্ড দিয়ে চার দিকে ঘিরে রাথা হয়েছে … …ভেতরে শুধু রায় বাহাদূর নিজে ও একজন প্রধান পুরোহিত একজন সহকারী পুরোহিত আর একজন মাত্র থাকবেন… তাঁর নাম সুরজিৎ সিংহ… তিনি রায় বাহাদূরের বড়ো ছেলে …. তিনি অলঙ্কারের লিষ্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে এক এক করে মিলিয়ে নিয়ে সব গয়না প্রধান পুরোহিতকে দেবেন মাকে পরিয়ে দেবার জন্যে…’
‘তিনি কি আশঙ্কা করছেন যে এই সব মহা মূল্যবান অলঙ্কার অপহরণ করা হ‘তেপারে?’
‘হ্যাঁ…যদি ও সেটা অসম্ভব…তবে তিনি একটা উড়ো চিঠি পেয়েছেন এই বিষয়ে আর তাই এতো বেশী সতর্কতা নেওয়া হয়েছে এইবারে… আমি এখন যাই স্যার… রায় বাহাদূর সাহেবের সঙ্গে আবার আসবো… তবে উনি বৃদ্ধ মানুষ আর খুব কম কথা বলেন…তবে বেজায় রাশ ভারী সেই ইংরেজের আমলের সম্মানিত মানুষ …. উনি যা বলবেন তা আপনারা শুনে যাবেন… যেন কোন কথা বা কাজে মানা করবেন না ওনাকে…তা হ’লেই হবে স্যার…’
তপনবাবু চলে গেলেন আর আমরা জলখাবারের সদ্গতি করতে বসে গেলুম…
যথা লাভ আর কি?
ছ’টা করে বড়ো বড়ো গরম পুড়ি আলুর সব্জি সুজির হালুয়া চারটে করে পেঁড়া আর একটা পটে চা ও এক গেলাশ দুধ ছিলো…তথাস্তু…
একঘন্টা পরে একজন গৌরবর্ণ বিরাট দেহী বৃদ্ধ কিন্তু বেশ সামর্থ্যবান ভদ্রলোক এলেন আর আমরা উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে …গুডমর্ণিং স্যার… বলতেই তিনি গম্ভীর গলায় বললেন –‘গুড মর্ণিং… তপন কি সব কথা বলেছে তোমাদের?’
‘হ্যাঁ…স্যার…’
‘ভেরী গুড… তপন তুমি এনাকে চেক আর কাগজখানা আগে দিয়ে দাও আর চলো মন্ডপে যেতে হবে …সময় হয়ে গেছে…পন্ডিতজী এসে গেছেন… আমি অকারণে কাজে লেট করা পছন্দ করি না…চলো..’
তপনবাবু চট করে আমার হাতে দু’টো লম্বাসাদা খাম ধরিয়ে দিলেন আর আমি সেই দু’টো হাতে নিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই একজন পুলিশের পোষাক পরা লোক এসে ঘরের দরজায় দাঁড়ালো… বাঃ… সুরক্ষার আয়োজন তো দেখছি মন্দ নয়…
মন্ডপে পৌঁছে এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে খাম দু’টো খুলে আমি দেখলুম যে একটা হচ্ছে মা দুর্গার সব অলঙ্কার আর অস্ত্র শস্ত্র ও দামী জিনিষপত্রের লিস্ট আর অন্যটায় রয়েছে একটা পঞ্চাশ হাজার টাকার ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার বেয়ারার চেক… মনে হয় আমাদের কাজের আগাম পারিশ্রমিক…’
ও’দিকে তখন কাঁচের শিল্ডের ভেতরে শুরু হয়ে গেছে প্রতিমার অলঙ্করণ…
মা দুর্গার প্রতিমাকে পরানো হচ্ছে লম্বা ধরণের একটা ছোট ছোট খান দশেক সোনার প্রজাপতি জুড়ে তৈরী করা ফোল্ডিং সোনার মুকুট… মুক্তো বসানো কানের দুল.. গলায় সাতনরী মুক্তোর হার… হীরের কন্ঠিহার …গোলাপী মুক্তোর মালা.. দশহাতে সোনার বাজুবন্ধ… কোমরে মেখলা… পায়ে নুপূর… হাতে টেলিস্কোপিক অ্যান্টেনার মতন দেখতে সোনার ফোল্ডিং ত্রিশূল… খড়্গ… চক্র… সর্প… ছোট একটা ধনুক বাণ… তলোয়ার… গদা …অঙ্কুশ…দশবিধ সব মহার্ঘ্য অস্ত্র আর সেইসাথে বীণাপাণির হাতে সরু লম্বামতন ফোল্ডিং সোনার বীণা লক্ষীর সোনার ঝাঁপি গণেশের সোনার লাড্ডুর ছোট থালা কার্তিকের হাতে ও ফোল্ডিং সোনার তীর ধনুক…অসুরের হাতের রূপোর খড়্গ….
বহুবিধ সোনা রূপো আর মণিমুক্তোখচিত পুরোণো দিনের তৈরী সব ভারী ভারী ঝকঝকে গয়ণা আর সাজসজ্জার জিনিষের জৌলুষে মন্ডপ ঝলসে উঠতে লাগলো…সে এক দেখবার মতন দৃশ্য বটে … নানা রত্নের সাজে সাজানো হচ্ছে তখন মা দশভূজাকে … ওঃ… সত্যিই রাজরাণির সাজের সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য…
আমি লিস্ট মিলিয়ে যাচ্ছি আর গৌরব ফটো তুলছে প্রতিমার…
সব সজ্জা শেষ হ’তে তিন ঘন্টা সময় কেটে গেলো আর রায় বাহাদূর আর তাঁর ছেলে খালি সিন্দুক নিয়ে চলে গেলেন আর মন্ডপ ঘিরে পুলিশের পাহারা বসে গেলো তৎক্ষণাৎ…
আমরা ও নেমে এলুম মন্ডপ থেকে আর দুপুরের খাবার খেতে চললুম বড় বাড়ির হলঘরে … সত্যিই দেখি যে খাবার আয়োজন বেশ ভালোই আছে …ক্ষীর পুড়ী ফুলকপির সব্জি দেশী ঘি দেওয়া অরহরের ঘন ডাল পনীরের ডালনা পনীর পালক থেকে শুরু করে বাসন্তী পোলাও পাঁপড় ভাজা আচার আর গুলাব জামুন অবধি বহুবিধ পদের সে কী বাহার…
একটু একটু করে সব খেলে ও আমার পেট ফুলে জয়ঢাক হয়ে গেলো তবে গৌরব খুব সামান্যই খাবার খেলো ….
আমি জানি যে কাজের সময় এমনকি স্কুলের পরীক্ষার সময়ে ও আমি দেখেছি যে গৌরবের ভেতরে তখন জ্ঞানার্থির পঞ্চগুণ মানে স্বল্পাহারী শ্বাননিদ্রা বকোধ্যানের মতন সব গুণগুলোই সব একে একে জেগে ওঠে আপনিই আর তার ফলে সে সবসময় দারুণ স্মার্ট আর এভাররেডি হ’য়ে থাকতে পারে যে কোন পরিস্থিতির সাথে মোকাবিলা করবার জন্যে….
ওঃ ছেলে বটে একটা… তবে এখন দেখতে হ’বে সে এই ভবিষ্যতকালের চুরির চ্যালেঞ্জের খেলার মোকাবিলা সে কেমন ভাবে করে …
আমি গৌরবের একটা হাত শক্ত করে ধরে নিজেদের ঘরে ফিরে এসে বিছানায় লম্বা হ’য়ে শুয়ে পড়তে বাধ্য হ’লুম আমার উদরের ভারে আর গৌরব বললো-‘আচ্ছা…বাপী… সাইকেলের চাকার দাগ দেখে কি পায়ের দাগের মতন বলা যায় যে সাইকেলটা কোন দিকে গেছে?’
আমার তখন বেশ তন্দ্রামতন আসছে…
চমকে উঠে বললুম-‘হ্যাঁ তা বলা যায় বইকি গৌরব… তবে খুব সুক্ষ্ম অনুশীলন চাই তার জন্যে কেননা আরোহী তো সাইকেলে উঠে বসে মাঝখানে … তা ঠিক… তবে হ্যান্ডেল ধরবার জন্যে এমনিতেই তাকে একটু যে সামনে ঝুঁকতেই হয় আর লোকটা একটু দোহারা চেহারার যদি হয় আর তাকে একটু স্পীড ও নিতে হয় তখন তো আর কথাই নেই তবে পিছনের কেরিয়ারে কোন ভারী কিছু না থাকলে স্বাভাবিক ভাবেই তখন সামনের চাকার দাগ কাদার ওপরে পড়লে হয় একটু বেশী স্পষ্ট মানে গভীর…এই আর কি…’
‘ওঃ…বাপী…এটা তুমি আমাকে আগে বলবে তো …আমি তখন থেকে ভাবছি মিছেই …যাঃ… তবে বাপী আমি এখনই একটু বাইরে থেকে ঘুরে দেখে আসতে যাচ্ছি…’
‘এই ছেলে… এখন একলা একদম কিছুটি তোমার করা নয়… এটা কি বেনারস বলে মনে হয় তোমার? মনে রাখতে হ’বে সব সময় যে এখানে আমরা নিরাপদ নই মোটেই …তুমি ও একটু এসে আমার পাশে ভালো ছেলের মতন শুয়ে পড়ো দেখি …এক ঘন্টা পরে তৈরী হ’য়ে তখন গেলেই হবে আমার সাথে …এখন এসো বলছি…’
এই বলেই গৌরবের ডান হাতটা ধরে আমি জোরে একটা টান দিলুম আর দশ বছরের গৌরব ছেলেটা সোজা এসে আমার বুকের ওপরে পড়লো ঝপ করে আর সঙ্গে সঙ্গে আমার নাকে এসে লাগলো ডিও আর দামী মেল মাস্ক সেন্টের মিষ্টি সৌরভ…
‘এই যাঃ বাপী… সত্যি তুমি কি যে সব কান্ড করো না আমাকে নিয়ে দরকারী কাজের সময়… ওঃ…আঃ.. এখন না ..এখন না…ও বাপী…এখন আমাকে এতো বেশী করে আদর করতে হবে না …আঃ…এই যাঃ … আরে ও বাপী…’
‘হুঁ…’
‘কি হুঁ?…..ওঃ বাপী…এইবারে আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি তোমার সন্দেহের কারণটা … তাই আনন্দের তোমার এতো ঘটা…আচ্ছা ঠিক আছে বাপী …তবে এখন তোমার যা ইচ্ছে হয় তাই করো তোমার ছেলেকে নিয়ে …আমার আর কি? কাজ নষ্ট হ’লে সে ও তখন তুমিই বুঝবে ঠ্যালা তবে এখন একটুক্ষণের জন্যে অন্তত তুমি আমাকে ছেড়ে দাও তো বাপী… আমি আমার এই নতুন আর দামী জামা প্যান্টগুলো সব খুলে রেখে দিয়ে চলে আসছি নইলে তো আমার নতুন জামার ক্রীজ নষ্ট হয়ে যাবে একদম… ওঃ… বাপী … তুমি ও না…একটা একেবারে যা ইচ্ছে হয় তাই ছেলে…যাঃ…’
বিকেলে যখন আমরা বের হলুম তখনো আকাশের মুখ বেশ ভার হয়ে আছে আর তাই দেখে আমি আমার স্পেশাল ছাতাটি হাতে নিয়ে তবে বেরিয়েছি …… ছোট ফোল্ডিং ছাতা আর তাই জোর বৃষ্টি শুরু হ’লে তখন আমাদের দু’জনের মাথা বাঁচানো বেশ কঠিন হবে এই ছাতার সাহায্যে তা ও ঠিক তবে এই ছাতার আরো একটা অন্য গুণ ও আছে …তাই আমাকে ছাতাটি সঙ্গে নিতেই হ’লো আর গৌরব পথে নেমেই সেই সাইকেলের চাকার দাগ দেখে ডান দিকে ঘুরে দৌড় দিলো…
অগত্যা তখন আমাকে ও কোনকাজ না করে…’এই ছেলে আরে…থাম…থাম…দাঁড়া…বলছি…’
এই বলতে বলতে ছুটতে হ’লো সেই পাগল ছেলের পেছনে… কি আর করা? যেমন একটা যাচ্ছেতাই ধরণের ছেলের জন্ম দিয়ে নিজে চলে গেছেন এক সুন্দরী মহারাণী আমার ভাগ্যে…. বুদ্ধি শুদ্ধি কিছু তার ঘটে থাকলে তো…
ছুটতে ছুটতে আমরা একটা বড় দিঘির ধারে এসে পড়লুম আর একটা তেঁতুল গাছের নীচে গিয়ে গৌরব থামতেই আমি গিয়ে তার চকচকে বাঁ হাতটা খপ করে চেপে ধরে বললুম-‘এই দুষ্টু ছেলে …বলেছি না যে এইভাবে ছুটবে না একদম …এই রে এখানে আর তো কোন দাগই নেই এই ঘাসের মধ্যে যে …..আর এ..এই মরেছে…. এখন আবার যে বৃষ্টি ও এলো ঝেঁপে…. ওঃ এখন এই তেঁতুল গাছের ঝিরঝিরে পাতায় কি ছাই এই বৃষ্টি আটকাবে না কি? …কি গেরো রে বাবা…’
এই বলেই আমি ফটাস করে ছাতাটা খুললুম সুইচটিপে আর তৎক্ষণাৎ কে যেন খচাৎ করে একটা শব্দ করলো ঠিক আমার মাথার কাছে… আমি গৌরবকে টেনে ছাতার নীচে আনতেই দেখি যে আমার পেছনে মাটিতে ঠক করে এসে পড়লো একটা ছয় ইঞ্চি মতন লম্বা লিক লিকে ধারালো ছুরী…
‘ওরে বাবারে…গেছি রে ….এ আবার কি? ও গৌরব?’
গৌরব তৎক্ষণাৎ প্যান্টের পকেট থেকে তার খেলনার পিস্তলটা টেনে বের করে এনে তার ট্রিগার টিপলো আর দুম ফটাস করে জোর এক শব্দ হ’তেই সঙ্গে সঙ্গে কে যেন হুড়মুড় শব্দ করে পাশের একটা ঝোপ থেকে ছুটে পালিয়ে গেলো…
‘যাক…আপদটা বিদেয় হয়েছে মনে হয় …মরুক গিয়ে পড়ে….’.
এইবলে আমি আর কাল বিলম্ব না করে ঝপ করে নীচু হ’লুম আর ছেলেটাকে একটানে কোলে তুলে নিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই ছাতা সামলে ছুট দিলুম নিজেদের আস্তানার দিকে সেই বিপজ্জনক জায়গা ছেড়ে…বেড়ানোর না কাঁথায় আগুন..
ভাগ্যিস ছাতাটা সঙ্গে এনেছিলুম… এটা ও একটা বিদেশী সুরক্ষার জিনিষ তাই কোন ছোরা ছুরী দিয়েই এর বিশেষ ভাবে তৈরী কাপড়টা কাটা যায় না…এই রক্ষা… .বাড়ির গেটে এসে আগে গৌরবকে নীচে নামিয়ে দিয়ে তার বাঁ হাতটা ধরে গেট দিয়ে ঢুকলুম আমি নইলে কেউ গৌরবকে আমার কোলে দেখতে পেলে তখন ছেলেটা যে খুব লজ্জা পাবে… তাই… তবে ছেলের ডান হাতে দেখি যে সেই ছুরিটা ধরা রয়েছে… আমি তার মুখের দিকে তাকাতেই সে ছুরিটা আমার প্যান্টের ডান পকেটে বেশ সাবধানে ঢুকিয়ে দিলো…
আমি বৃষ্টির ছাঁট এড়াতে ঘরে গিয়ে ঢুকে পড়লুম তবে ততক্ষণে আমরা দু’জনেই বৃষ্টির দাপটে ভিজে একসা হয়ে গেছি আর গৌরবের অতো সাধের নতুন ড্রেস আর তার ক্রীজের পুরো বারোটা বেজে গেছে….
সে যাক… আমি চট করে ঘরের দরজা আর সব জানলাগুলো বন্ধ করে দিয়ে একটা এমার্জেন্সী চার্জেবল টর্চ জ্বেলে নিলুম… এটা আমি বাইরে কোথা ও গেলে তখন সঙ্গে নিয়ে যাই কেননা দিনের বেলাতে ও যখন আমার অতি সুন্দর এই রাজপুত্রের ড্রেসগুলো সব চেঞ্জ করতে বসি তখন তো আর আমি ঘরের দরজা জানলা কোন কিছুই খোলা রাখতে পারি না তাই তখন তো ঘর অন্ধকার হয়ে যায়ই… অবশ্য হোটেলের ঘর হ’লে সে আলাদা কথা…
এখন আমাকে বসে আগে গৌরবের পরণের সব ভিজে ড্রেস আর অন্তর্বাসগুলো আবার খুলতে হ’লো আর তোয়ালে দিয়ে গৌরবের ভিজে গা মাথা মুছিয়ে দিয়ে অন্য ড্রেস এনে চেঞ্জ করে দিতে হ’লো নইলে তো বাচ্ছা ছেলেটার আবার ঠান্ডা লেগে যাবে…
আপাতত গৌরবকে একটা ধপধপে সাদা পিওর সিল্কের পাজামা আর হাল্কা নীল রঙের চকচকে চায়না সিল্কের পাঞ্জাবী পরিয়ে দিয়ে ছেলের সেই নতুন ড্রেসেতে ওর মায়ের ভীষণ পছন্দের দামী মাস্ক সেন্ট স্প্রে করে দিলুম আর নিজের ও ড্রেস চেঞ্জ করে নিলুম…
গৌরব আমাদের সব ভিজে পোষাকগুলো আলনায় মেলে দিয়ে এসে আমার পাশে বিছানায় উঠে বসে বললো—‘বাপী… ছুরিটা একটা রুমালে জড়িয়ে টেবিলে রেখে দাও কেননা ওটা আমাদের তেমন কাজে আসবে না কেননা আমি তো আর ওদের মতন ছুরী ছুঁড়তে পারি না … তবু ও একটা প্রমাণ হিসেবে নিয়ে এসেছি…’
‘তা তুমি ঠিকই করেছো গৌরব কেননা কখন যে কি জিনিষ কোন কাজে লেগে যায় তা কি আর আগে থেকে কিছু বলা যায়…গৌরব?’
‘তার মানে বাপী ?’
নিজের সরু কালো ভ্রুজোড়াকে কুঁচকে ছেলে জানতে চাইলো…
‘তুমি কি নাইফ থ্রোয়িং স্কিল কিছু জানো বাপী?’
‘কিছু কিছু হয়তো জানি গৌরব আর তা দেখাতে ও হয়তো পারতুম তবে তখন বৃষ্টি পড়া শুরু হ’তে আর সে চেষ্টা ও করা গেল না যে…. যার জিনিষ তাকেই ফেরৎ দিয়ে দিতে ও পারলুম না …সে যাক….কথায় আছে…নিয়তি কে ন বাধ্যতে আর গতস্য শোচনা নাস্তি রে গৌরব…’
‘আচ্ছা বাপী… তুমি এখন বসো… আমি মোবাইলে তোলা ফটোগুলো সব কেমন উঠেছে তাই দেখি বসে… এই…এই দেখো বাপী… প্রত্যেক ঠাকুরের ফটো আলাদা করে ও তোলা আছে …ক্লোজ আপ দেখে বলো তো বাপী যে কে বেশী সুন্দর লাগছে?’
‘সে তো মা দুর্গা নিজেই সবচেয়ে বেশী সুন্দর গৌরব…দশবিধ অস্ত্রে সজ্জিতা সর্বালঙ্কার ভূষিতা…’
‘তা তো বটেই বাপী কিন্তু আমার তো এই বড়ো সিংহটাকেই বেশী পছন্দ হচ্ছে বাপী ….কতো বড়ো হাঁ করে আছে দেখো বাপী…’
‘সিংহ? তা কেন গৌরব?’
‘কেননা তার কাছে তো কোন অস্ত্রই নেই… ঠিক আমাদের মতন অবস্থা আর সে কোন দামী পোষাক ও পরেনি আর কোন দামী অলঙ্কার ও তার নেই বাপী… একদম সে সবার উপেক্ষিত …ঠিক যেন সর্বহারা কিন্তু তবু ও সে কেমন এক রাজকীয় ভঙ্গিমায় খড়্গধারী বিশাল অসুরকে দেখে কামড়বে বলে হাঁ করে রুখে দাঁড়িয়েছে বলো তো বাপী… কোন অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াই সে যেন একাই একশো… বলো বাপী… আসল বীর যোদ্ধা তো সেই না বাপী…’
আমার ছেলের সরল সুন্দর মুখে এই অদ্ভূত যুক্তি শুনে আমি চুপ একেবারে আর পরক্ষণেই একটা আরো অদ্ভূত সন্দেহ আমার মাথায় যেন ঝিলিক দিয়ে উঠলো ছেলের এই যুক্তিতে…
কিন্তু সেটা কি সম্ভব হ’তে পারে না কি?
না… না কখনোই না …এ হচ্ছে আমার মনের এক অলীক বাজে কল্পনা তবে এইখানেই যে বিরাট বড়ো একটা তফাৎ আছে… সাইকোলজিক্যাল কনভার্জেন্ট আর ডাইভার্জেন্ট থিকিং প্রসেসের মধ্যে যে তফাৎ…এটা ও তাই…. একটা আমাদের দেয় বুদ্ধি… লজিক …যা অপরাধী ধরতে অপরিহার্য্য তবে যদি সেই অপরাধী যদি কোন নসাধারণ লোক না হয়ে একটু কল্পনাবিলাসী হয় তখন ? আমাদের ওপরে যে ধরণের সব আক্রমণ হচ্ছে তাই দেখে তো সেই রকমের সন্দেহই হ’তে বাধ্য আর তাই যদি হয় তবে তো সে অপরাধের সব নতুন পদ্ধতি নিজেই আবিষ্কার করে ফেলবে আর তখন তাকে ধরতে হ’লে চাই দ্বিতীয়টি যা আমাদের দেয় সৃজনীশক্তি …আর সেটি না থাকলে আজ ও আমরা যে এখন ও সেই প্রস্তরযুগেই পড়ে থাকতে বাধ্য হতুম …তা ও ঠিক….
সিংহ… হ্যাঁ তাই তো…গৌরব মনে হয় ঠিকই বলেছে …মা দুর্গার অসুর নয় …সিংহই আসল বীর…সে যে মা দুর্গার বাহন… অমিত শক্তিশালী পশুরাজ সে… মা দুর্গার পছন্দ আছে বেশ বলতে হবে… রাজকীয় পছন্দ আর তাই তার রাজকীয় জৌলুস তো থাকবেই…
‘ও বাপী… তুমি কি সব বিড় বিড় করছো বলো তো? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না…ও বাপী…শুনছো?…নাঃ…আমার বাপী কে নিয়ে দেখি যে আর তো পারাই যায় না কেননা বাপী ও দেখছি যে একটা বেশ পাগল ছেলে… থেকে থেকে কি যে হয় না বাপির…ওমা… তুমিই এখন এসে একবার একটু দেখো না মা …আমার বাপী তো একদম স্ট্যাচু হয়ে বসে আছে…’
‘আরেঃ…না গৌরব…আমি ঠিক আছি তবে একটা ইনট্যুশনাল ফ্ল্যাশ … এখন আমি তোমাকে কি করে বোঝাই বলো তো? মনোবিজ্ঞানে এম এ যারা করেছে তারা ঠিক জানে… আমি সেই সব জটিল কথা তোমাকে কিভাবে বোঝাই এখন বলো তো? সে তো সম্ভব নয় কেননা তোমার মেন্টাল এজ যতোই বেশী হোক না কেন গৌরব তোমার ফিজিক্যাল মানে বায়োলজিকাল এজ যে সবে দশ বছর মাত্র… তবে মূলভূত জ্ঞান যার আছে সে একটু সংকেত পেলেই সব বুঝে নিতে পারে গৌরব… সেই যে কথায় বলে না… সমঝদারোঁ কে লিয়ে ইসারা হি কাফী হ্যায়… বুঝলে গৌরব……’
‘তার মানে বাপী?’
’না…কিছু না….তবে আমার এখন বেশ একটু আনন্দ হচ্ছে গৌরব আর এটা হ’লো সৃজনের আনন্দ …যা পেতে স্বয়ং ঈশ্বরকে ও সৃষ্টি করতে হয়েছিলো এই বিশাল জগৎ সংসার সব কিছু…তবে আন্দাজটা এখন ও পরীক্ষাধীন আর প্রমাণ সাপেক্ষ…এই যা…’
‘ওরে বাবা…সে আবার কি কথা? নাঃ…আমার বাপিকে মনে হয় বৃষ্টিতে ভিজে এসে ঠিক কালকের সেই ভূতে পেয়েছে এই ভর সন্ধ্যে বেলাতে…’
‘আরেঃ…না …তুমি চিন্তা করো না গৌরব… আমি ঠিক আছি … দাও তোমার তোলা অন্য সব ফটোগুলো আমি দেখি তো এখন ……’
আমি মনে মনে বললুম আমাকে খুব সাবধান হ’তেই হবে এখন দেখছি কেননা ক্রমেই বিপদ বাড়ছে এখানে আর কেউ বা কারা চাইছে না যে আমরা ঘরের বাইরে যাই আর কোন কিছু অনুসন্ধান করবার বা খোঁজখবর নিয়ে জানবার চেষ্টাটুকু ও করি আর তা করতে গেলে বিপদ আরো বাড়তেই পারে আর এখনো আমাদের পুরো পাঁচটা দিন এখানে কাটাতে হবে যে…
সেই রাতে খেয়ে দেয়ে তাড়া তাড়ি করে শুয়ে পড়া গেলো তবে আমি একটু সাবধান হলুম …তপনবাবুর কাছে মশা কামড়ায় রাতে এই ছুতোয় একটা পুরণো মশারী চাইলুম আর বললুম যে একটু আধটু ছেঁড়া ফাটা হ’লে ও আমার কাজ চলবে কিন্তু ওই সব জিনিষের বালাই নেই তো কি হয় উপায়…. শেষে খুঁজে পেতে তিনি মিটার দুই লম্বা সবুজ রঙের একটা নাইলনের মাছ ধরবার জালের টুকরো এনে দিলেন আর তাই নিয়েই আমি রাতে খাওয়া দাওয়ার পরে কাজে লেগে পড়লুম… পিছনের জানলা দু’টোই বন্ধ করে দিয়ে সামনের জানলা দু’টোর মাপে জালটাকে কেটে নিয়ে টেপ দিয়ে এক এক করে দু’টো টুকরোই আটকে দিলুম…
অতঃ শান্তিঃ…দেখা যাক কি হয়? তবে এই সামান্য জাল দিয়ে পোকা মাকড় আটকানো গেলে ও আক্রমণ হ’লে তখন কি আর তা ঠেকানো যাবে? মনে তো হয় না তবে যথাসাধ্য চেষ্টা করা গেলো …এইআর কি… রাতে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়বার আগে আমার জাপানী বয় ডলের মতন দেখতে ছেলে গৌরবকে একটা মোটা ফুল স্লিভ রাত্রিবাস ও পরিয়ে দিলুম…
মোবাইলে আমার দিয়ে রাখা খুব মৃদু অ্যালার্মের শব্দে আমার ঘুম যখন ভাঙলো তখন মাঝরাত… গৌরব নিশ্চিন্ত মনে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে কিন্তু আমাকে এখন প্রতি রাতেই সজাগ থাকতে হবে কেননা আমাদের ক্ষতি করবার জন্য এখন রোজই মনে হয় কিছু না কিছু নতুন ধরণের সব চেষ্টা ঠিক করা হবেই … শত্রুর দল তা করবেই যাতে আমরা তাদের আসল কাজের দিকে নজরই দিতে না পারি…
কিন্তু গৌরবের ঘুম যাতে না ভাঙে এমন ভাবে আমাকে এখন সব কাজ করতে হবে… বাইরে অবশ্য পুলিশের পাহারায় থাকবার কথা তবে সে তারা যে কেমন পাহারা দিচ্ছে তা কে জানে… আজ হয়তো …আরেঃ কেমন যেন ধুপ করে একটা শব্দ হ’লো না বাইরে …তবে এইবার হয়তো মহাপ্রভুদের আগমন হয়েছে ঠিক …দেখা যাক কি হয় এখন…
আরেঃ… ঠপ করে কি একটা যেন জানলাতে এসে পড়লো না…কি ওটা?
অন্ধকারে আমি কিছু বোঝবার আগেই জানলায় লাগানো জালে লেগে সেটা ছকাস শব্দ করে আবার বাইরেই ছিটকে চলে গেল আর ফটাস করে আবার একটা যেন শব্দ শোনা গেল…
ওরে বাবা …শুনেছি যে এমন ভাবে তো গ্যাস বোমা ফাটে …
তবে কি আজ আমাদের কোন বিষাক্ত গ্যাসের সাহায্যে দক্ষিণ দরওয়াজা দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে না কি? তা হ’তে ও পারে বইকি… যাই গিয়ে দেখি আমি উঠে যে … আমি গিয়ে জানলায় দাঁড়ালুম তবে বাইরে দেখি যে সাদা ঘন ধোঁয়া বা কুয়াশার কুন্ডলিতে সব কিছুই বেশ তখন ঝাপসা দেখাচ্ছে… আর মনে হ’লো কে একজন বাইরে ধপ করে কোথা থেকে লাফিয়ে পড়ে পালিয়ে গেলো ছুটে…
আর কোন পুলিশ পাহারার বালাই নেই নইলে তাদের বাঁশী বেজে উঠতো ঠিক… নাঃ… কালই দেখছি কমপ্লেন করতে হবে আমাকে……
আমি গ্যাসের ভয়ে জানলা দু’টো টপাটপ করে বন্ধ করে দিচ্ছি হঠাৎ পেছন থেকে ঘুম জড়ানো স্বরে গৌরব বলে উঠলো-‘যেতে দাও না বাপী… হাওয়া উল্টো দিক থেকে বইছে তাই তুমি এখন এসো… শুয়ে পড়া যাক… ও’গুলো অতি পাজী ছুঁচোর দল তবে কাল সকালেই আমি জানলার নেট দু’টো আবার খুলে রাখবো যাতে কেউ ব্যাপারটা বুঝতেই না পারে ঠিক যে আজ হয়েছিলো কি…’
‘তুমি শুয়ে পড়ো গৌরব …আমার ঘুম উড়ে গেছে …এখন কোন মতে দিন চারটে ভালোয় ভালোয় কাটাতে পারলেই আমি বাঁচি… উঃ কি জ্বালাতন রে বাবা…’
‘তবে তুমি বাপী ঘুমোবে কখন…?’
‘কেন? দিনের বেলায়… পুজো দেখে আর এক পেট ভালো মন্দ ঠেসে খেয়ে এসে তখন … দিনের বেলায় লোকজন আর পুলিশ ও থাকবে পাহারায় ….হয়তো এখন ও আছে তবে মনে হয় তারা চডীমন্ডপ ঘিরে বসে আছে…তাই দিনের বেলায় তখন মনে হয় শত্রুরা সাহস করে বেশী কিছু করতে পারবে না…’
‘তা ঠিক আছে বাপী…দিনে তুমি ঘুমিয়ে নিও আর রাতে আমি… সেই ঠিক হবে …’
‘সেই মতনই ঠিক করে কাজ শুরু হ’লো আমাদের …পরের দিন ষষ্ঠী ..
সেই রাতে ও একটা অদ্ভূত ঘটনা ঘটলো…
রাত দু’টোর সময়ে শোনা গেল জলের শব্দ…
বৃষ্টি পড়ছে?
তা হ’বে হয়তো…
তবে একটু পরেই সে ভূল ভাঙলো আমার … নাঃ… বৃষ্টি নয়… ঝড় হচ্ছে বাইরে… সে এক ভয়ানক ঝড় আর সেই ঝড়ের দাপটে আমাদের জানলায় লাগানো পর্দা দু’টোই ছিঁড়ে গেলো…. ওরে বাবা… এই কি আশ্বিনের ঝড় না কি? কিন্তু সে তো হয় বিকেলে ও সন্ধ্যের সময় …এখন এই রাত দুপুরে…ওরে বাবা… মড় মড় শব্দ করে গাছের সব ডাল পালা ভেঙে ছিটকে এসে আমাদের এই ঘরের দরজা জানলা ছাদে আর বারান্দায় এসে আছড়ে পড়ছে যে দুম দাম ফটাস করে…এ আবার কি অঘটন? সেই রাতে ও আমার আর ঘুমোবার সাহস হ’লো না।…
পরের দিন সপ্তমী থেকে পূজো শুরু হয়ে গেলো…
সকাল থেকে গিয়ে চন্ডীমন্ডপে বসে পূজো দেখে অঞ্জলি দিয়ে আর পেটভরে প্রসাদ গ্রহণ করে ঘরে এসে আমি বিছানায় গড়িয়ে পড়তেই গৌরব এসে আমার পাশে বসে বললো-‘এক মিনিট বাপী… একটা কথা তুমি আমাকে বলো তো বাপী… আমার যেন কেমন একটা খটকা লাগছে মনে… আজ ঠাকুরের ভোগের সময়ে কাঁচের ভেতর থেকে ঠাকুরকে সাদা কাপড় ফেলে পুরো পাঁচ মিনিট সময় ঢেকে রাখা হ’লো কেন বাপী?’
‘ওঃ এই কথা। তা কি হয়েছে? তাই তো নিয়ম যে গৌরব কেননা তখন মায়ের ভোগ হ’লো তো আর সেই সময় কাউকে দেখতে দেবার নিয়ম নেই …ভেতরে একজন শুধু পূজারী থাকেন ভোগ নিবেদন করবার জন্যে …আর অন্যজন বাইরে বসে তখন করেন চন্ডীপাঠ….’
‘তবে কি রোজই হবে এই ব্যাপার বাপী?’
‘হ্যাঁ…তা তো হবেই গৌরব… দিনে দু’বার করে আরতির পরে ভোগ হবেই আর কাল অষ্টমির দিনে সন্ধিপূজো ও আছে বলে তিনবার হবে…’
আমি পাশ ফিরে শুয়ে পড়লুম কেননা আমার তখন খুবই ঘুম পাচ্ছিলো কিন্তু সেই ঘুমের ঘোরেই শুনতে পেলুম যে গৌরব বিড় বিড় করে বলছে… ‘হুঁ…বুঝেছি… তার মানে বাপী …সব শুদ্ধু হবে ৩৫ মিনিট সময় তাই না বাপী?’
‘হ্যাঁ…তবে তুমি ঠিক কি বলতে চাইছো সেটা যে আমি এখন কিছুই বুঝতে পারছি না…ও গৌরব…’
‘সে সব তোমার পরে বুঝলে ও হবে বাপী… এখন তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও তো বাপী… কাল রাতে তো তেমন বেশী কিছু উৎপাত হয়নি…তবে আমি আজ আবার পর্দা দু’র্টো বদলে দেবো… আমি এখন সেই কাজটি করে ফেলছি বাপী…’
আমি তখন ঘুমের বাড়ী পৌঁছে গেছি তবে রাতে ঘুমোলে তখন যে সোজা যমের বাড়ী পৌঁছে যেতে হবে তা ঠিক… মরুক গিয়ে… এখন তো ঘুমিয়ে নিই তারপরে উঠে সন্ধ্যের সময় তখন মায়ের আরতি ভোগ সব দেখতে মন্ডপে গেলেই হ’বে এখন… উঃ…পোলাওটা একটু কম খাওয়া উচিৎ ছিলো আমার… পেটটা দেখছি জয়ঢাকের মতন ফুলে গেছে আমার। রাতে আজ আর আমি কিছুই খেতে পারবো বলে তো মনে হয় না…
ঠিক তাই হ’লো…রাতে ঘরে খাবার আসতে আগে গৌরবকে খাইয়ে দিলুম আমি পরে খাবো বলে…
তা ছেলেটা দেখি খেয়ে উঠে তখনি বিছানায় এসে শুতে না শুতেই ঘুমিয়ে পড়লো …নিজের চাঁপা ফুলের রঙের নতুন স্যুট টাই কিছুই ছাড়লো না…আমি গৌরবের গলার টাই আর কোমরের কালো চামড়ার সোনালী বাকল লাগানো বেল্টটা শুধু খুলে নিলুম…তা এইবার এখন ঘুমোক ছেলে…
আমি এখন জেগেই থাকি …আর বসে মনে মনে গৌরবের দুপুরবেলার সময়ের হিসেবটা একটু বুঝতে চেষ্টা করি…
কিন্তু হিসেব করবো কি বসে বসেই আমার যেন একটু তন্দ্রামতন এসে গেছিলো…বাইরে একটা ধপ করে শব্দ হ’তেই আমি উঠে বসলুম বাঁ হাতে টর্চ নিয়ে… হঠাৎ আবার ফ্যাঁস ও ঠনন করে কেমন শব্দ হ’লো…
ও টা আবার কি? জানলায় কি যেন একটা নড়ছে না অন্ধকারে… কি ওটা? ওঃ… আমি যে নিরস্ত্র আর গতিক তেমন সুবিধের বলে তো মনে হচ্ছে না আমার … কি করি এখন?
চট করে হাত বাড়িয়ে আমি পাশের গোল টেবিল থেকে সেই ছুরিটাই তুলে নিলুম আর টর্চের বোতাম টিপে দিলুম… পরক্ষণেই আমার ডান হাত থেকে ছুরিটা অব্যর্থ লক্ষ্যে ছুটে গেলো সাঁ করে … আর কচাৎ করে দু’টুকরো হ’য়ে যে জিনিষটা ঘরের ভেতরে মেঝেতে এসে পড়ে দারুণ ছট ফট করতে দেখা গেলো সেটা একটা কালো হাত তিনেক লম্বা বিষধর সাপ আর দেখা গেলো যে জানলার নেটের পর্দাটা ও ফর্দাফাঁই হয়ে গেছে…
ওঃ… কি সব আপদ বলো তো এই রাত দুপুরে… মেঝেতে আরো একটা ছুরী পড়ে আছে যার মানে হ’লো যে দূর থেকেই কেউ এই ছুরিটা আগে ছুঁড়েছে আর তারপরে হাতে নিশ্চয়ই একটা কোন শিকড় বাকড় কিছু রেখে হয়তো পাঁচিলের ওপর থেকে কেউ এই সাপটাকে ও জানলার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে… এইসব শিকড় বাকড় শুনেছি যে গ্রামের সবাই সঙ্গে রাখে বিশেষ করে বৃষ্টির সময়ে আর আমরা শহুরে মানুষ হয়ে এসেছি খালি হাতে এইখানে লড়াই করতে… নাঃ…এই বিপদের স্থানে আর নয়…
পরের দিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে গৌরব সব দেখে শুনে বললো-‘বাপী আমার কিন্তু সন্দেহ হচ্ছে খুব যে আমাদের কালকের রাতের খাবারে কেউ ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয় নি তো নইলে আমার ঘুম ভাঙলো না কেন বাপী?’
‘হুঁ …তা অবশ্য হতেই পারে গৌরব… ভাগ্যিস কাল রাতে আমি কিছুই খাইনি …এখন এই সব খাবার দাবার সাপ খোপ সব পিছনের বারান্দা থেকে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিই গিয়ে আর ঘরদোর পরিস্কার করে চট করে নিজেদের চান টান সব সেরে নিয়ে চলো যাই পুজোর চন্ডীমন্ডপে মাকে অঞ্জলী দিতে …’
‘তাই চলো বাপী…’
‘হুঁ…তাই যাই…তবে আমার ঠিক কেমন যেন আজ মনে একটা সন্দেহ হচ্ছে গৌরব যে কেউ আমাদের বাঁচিয়ে দিচ্ছে বার বার এসে..আমরা তো সঙ্গে একটু কার্বলিক এসিড ও আনিনি…’
‘মাআআআআআ…’ বলেই মুখে হাত চাপা দিয়ে লাফিয়ে উঠে ছেলেটা বাথরুমে ছুটলো…
কি পাগল ছেলে বলো তো…. যে যায় সে যায় চলে… সে যে আর কখনো ফিরে আসতেই পারে না সেই বোধ টুকু ও এখনো হ’লো না দেখি এই ছেলেটার…ওঃ ভগবান…’
সেই দিন তো মহাষ্টমী পূজো আর তাই খুব বেশী ধুম ধাম আর ফল ফুল প্রসাদ ও অনেক… অষ্টমী পূজোর ভোগ আরতির আগে অঞ্জলী দেওয়া হ’লো তবে ফুলবেল পাতা আজ ও ছুঁড়ে মাকে দেওয়া গেলো না… মন্ত্র পড়ে অঞ্জলির ফুল সব একটা বড়ো গামলায় রাখতে হ’লো সবাইকে …আর সব শেষ হ’তে সেটা ভেতরে নিয়ে গিয়ে সহকারী পুরোহিত মায়ের পায়ের কাছে সব ঢেলে দিলেন… এই হ’লো অঞ্জলী দেওয়া…
তখনই আবার সন্ধিপূজোর আয়োজন ও পূজো শুরু হয়ে গেলো…
সন্ধিপুজোর অঞ্জলী ও ভোগ আরতি সব কিছু শেষ হ’তে বেলা তিনটে বাজলো কেননা এক’শো আটটা পদ্মফুল ফুটিয়ে সাজানো হ’লো আর এক’শো আট প্রদীপের মালা ও সাজিয়ে জ্বালানো হ’লো আর তাইতেই তো এক ঘন্টা সময় লেগে গেলো…
গৌরব দু’বারই পূজোর পরে অঞ্জলী দিলো আমার সাথে আর প্রতিমা… পদ্মফুল ও প্রদীপের মালার ও ফটো তুললো আর সব শেষে আমরা প্রসাদ খেতে গেলুম…
অষ্টমির প্রসাদের ব্যবস্থা দেখি যে আরো ভালো… পাটালী গুড় আর খাঁটি দুধ দিয়ে ক্ষীর যা একটা বানিয়ে ছিলো না …সাথে মাখা সন্দেশ কাঁচা গোল্লা আর গরম পুড়ী দিয়ে আমি তাই খেয়ে ফেললুম এক বাটি… সঙ্গে চাটনী আর সন্দেশ ছিলো তিন রকমের… ফ্রায়েড রাইস পনীরের ডালনা চার রকমের ভাজা.. পাঁপড় এই সব খাবারের পরে আবার এতো কখনো খাওয়া যায়? তবে আজ দেখলুম যে গৌরব ও একটু বেশী করেই খেয়ে নিলো…
হুঁ… মনে হয় কাল রাতে ছেলেটার বেশ আক্কেল হয়ে গেছে তাই আজ রাতে আর মনে হয় সে ও কিছুই খাবে না… সে যাই হোক… আমি খেয়ে দেয়ে ঘরে চলে এলুম আর শুয়ে ও পড়লুম ঢিপ করে…
গৌরব তার তিন দিনে তোলা সব ফটোগুলো নিয়ে দেখতে বসলো খাটে উঠে…প্রিন্ট পরে নেওয়া যাবে আর দরকার পড়লে হোয়াটস আপ করে দিলেই হ’বে……
সন্ধ্যের পরে আমার ঘুম ভাঙলো আর আরতি দেখে এসে শুরু হ’লো আবার সেই রাতের প্রতীক্ষা আর সেই রাতের অভিজ্ঞতাটা ও বেশ এক নতুন ধরণের হ’লো…
রাতে আমরা কেউ কিছু আর খেলুম না বটে তবে গৌরবকে আমি একটা পাতলা মেরুন রঙের নাইলনের নাইটির মতন ড্রেস পরিয়ে শুইয়ে দিলুম আর খাটে উঠে বসে নিজে জেগে রইলুম.. তবে কখন যে ছাই বসে বসেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছি তা মা দুর্গাই ঠিক জানেন তবে আমার চটকাটা ভাঙলো একটু পরেই যখন আমার মাথায় এসে খটাস করে একটা কিছু পড়লো তখন…
উঃ…এটা আবার কি? ও হরি… এটা তো দেখি যে সেই হাতপাখাটা… তা এটা তো ছিলো তাকে… উড়ে এসে সে আমার মাথায় ক্রাশ ল্যান্ডিং করতে গেলো কোন দুঃখে? হাতপাখার কি আবার পাখা গজালো না কি রে বাবা? না হয় বসে বসে আমার একটু তন্দ্রামতন এসে গিয়েছিলো তা আমি মানছি তাই বলে আমার মুন্ডুতে পাখার বাড়ি পড়বে দুম করে…কে জানে বাবা? হয়তো কেউ আমাকে জাগিয়ে দিলো… ওঃ… এই দেশে সব কিছুই হ’তে পারে …
আরেঃ…হঠাৎ বাইরে ওটা আবার কিসের আওয়াজ শোনা যায়? এ তো মনে হয় কেউ একটা বাঁশী বাজাচ্ছে খুব ধীরে তবে সঙ্গে যে আরো একটা স্বর আছে…ঠিক যেন কেউ কাউকে,,, মিহি গলায় গানের সুরে… আয়… আয়.. এমন করে ডাকছে তবে বাঁশির সুরের জন্যে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না… বেশ অদ্ভূত ঘটনা তো… ক্রমেই সেই শব্দটা যেন কাছে চলে আসছে আর তাই বেশ জোর হ’য়ে উঠছে..
এ’সব আবার কি?
গ্রামের ভূতের খেলা আবার শুরু হ’লো না কি? নাঃ… উঠে একটু আমাকে এখন দেখতে হচ্ছে তো… রোজ রাতদুপুর হ’লেই একটা না একটা এ’সব কি ঝামেলা রে বাবা? আর তো ভালো লাগে না ছাতা…
আরেঃ… এ.. এ আবার কি? অ্যাঁ… ও গৌরব… তোমার ঘুম ভাঙলো কখন? আমি তো কোথাও যাইনি…আর তোমাকে আমি ডাক নি তো… আরে… তুমি উঠছো কেন? ওঃ…. বুঝেছি… বাররুমে যাবে? তা চলো আমি টর্চ ধরছি… সাবধানে এসো গৌরব..
গৌরব কোন উত্তর বা কোন জবাবই দিলো না…
উল্টে সে ঘুমের ঘোরেই বিছানা থেকে নেমে পড়লো আর দরজার দিকে এগিয়ে চললো নিজের দু’টো হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে হাতে লাঠি না থাকা ঠিক একটা অন্ধ ছেলের মতন…
ওঃ… এটা আবার কি কান্ড? নাঃ… আর তো দেখি যে পারা যায় না… আরেঃ… গৌরব যে দরজার খিল খুলে সোজা বেরিয়ে চলে যাচ্ছে… এ আবার কি? ঘুমের মধ্যে হাঁটা বা স্লিপ ওয়াক না কি? তবে সে তো শুনেছি যে একটা রোগ আর সেই অসুখ তো গৌরবের কোন কালেই নেই… সে থাকলে আমার ছেলে আর আমিই জানবো না তবে আমি ততক্ষণে লাফিয়ে উঠেছি….
‘গৌরব… ও গৌরব… আরে … এতো রাতে বাইরে কোথায় যাচ্ছো তুমি? দাঁড়া ও …দাঁড়া ও… আমি ও আসছি টর্চ নিয়ে কেননা সাপ খোপ থাকতে পারে …ও গৌরব..শোন..শোন…’
গৌরব যেন তখন বদ্ধ কালা… কিছুই সে যেন শুনতে ও পারছে না তবে সে গেটের কাছে পৌঁছে গেছে আর গেট তালা বন্ধ দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে …
আমি তখন বারান্দা থেকেই এক লাফ মেরে নীচে গিয়ে পড়েছি কেন না সিঁড়ি পার হয়ে নামবার সময় নেই…
‘ও গৌরব থামো.. আরেঃ… ও আবার কি? গেট তালা বন্ধ দেখে তখন গৌরব যে চার হাত পা দিয়ে টিকটিকির মতন গেট বেয়ে উঠতে শুরু করেছে…
ওঃ… গৌরব কি এখন একটা টিকটিকি হ’য়ে গেলো না কি? আমি দৌড়ে গিয়ে খপ করে করে গৌরবের নাইটিটা চেপে ধরলুম খুব শক্ত করে দু’হাতে…
‘এই গৌরব… কি হচ্ছে কি এই সব তোমার এই রাতদুপুরে?… এইবার তুমি ঠিক ঘা কতক মার খাবে আমার হাতে ...’
‘নামো… গৌরব নামো… না হ’লে… ও রে বাবা রে..এএএকি? এ তো দেখি যে আমাকে শুদ্ধু টেনে নিয়ে সে উঠে যেতে চেষ্টা করছে সমানে …. গৌরবের গায়ে তখন যেন অসুরের বল এসে গেছে আমি সামলাতে না পেরে গৌরবের নাইটিটা গেটের একট রডের সাথে বেঁধে দিলুম প্রাণপণ জোর দিয়ে…
পড় পড় পড়াৎ…. গৌরবের দারুণ শক্ত নাইলনের নাটটিটা হঠাৎ ছিঁড়ে একেবারে দু’টুকরো হয়ে গৌরবের গা থেকে খুলে বেরিয়ে গেলো …
এ কি অসম্ভব কান্ড?
আমি কি স্বপ্ন দেখছি?
তবে আমি আর দেরী না করে তৎক্ষণাৎ হাত বাড়িয়ে দিয়ে গৌরবের পরণের নতুন পাতলা অন্তর্বাস দু’টোই একসাথে তার কোমরের কাছে চেপে ধরলুম মুঠো করে আর আমার গায়ের সব শক্তি দিয়ে প্রচন্ড জোরে এক টান দিলুম…
নাঃ… এখন আর কোন দয়া মায়া করাটা কিছু নয় …নইলে এখনই ছেলেটা দেখছি ওই সর্বনাশা বাঁশির বাজনার সুরের টানে বেহাত হ’য়ে যাবে তা ঠিক ….
পড়পড় করে গৌরবের পরণের নতুন অন্তর্বাসগুলো ও ছিঁড়ে ফর্দা ফাঁই হ’য়ে গেলো তবে সেই ভীষণ জোর টানেতে ছেলেটা শুদ্ধু এসে ঠিকরে পড়লো আমার গায়ের ওপরে আর দু’জনেইে পড়লুম গিয়ে মাটিতে ঠিকরে… আমি পড়লুম নীচে আর গৌরব পড়লো আমার ওপরে… ফলে গৌরবের তেমন আঘাত না লাগলে ও আমার পিঠ আর কোমরে ভয়ানক চোট লাগলো তবে তখন সে’দিকে নজর দেবার মতন সময় আমার নেই… গৌরবকে ধরেই কোনমতে উঠে পড়লুম আমি আর সে আমাকে তখন জোর একটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো আর আবার গেটের দিকে ছুটে গেলো…
এইবারে আমি রাগ করে সোজা গৌরবের ওপরে লাফিয়ে পড়লুম আর তাকে পেছন থেকে জাপটে জড়িয়ে ধরে টেনে নামিয়ে আনলুম নীচে আর চট করে গৌরবের ঘাড়ের পেছনে আর কোমরের নীচেতে আমার হাত দু’টো দিয়ে চেপে ধরে একটানে নিজের বুকে শুধু যে তুলে নিলুম তাই নয় শরীরের সব শক্তি দিয়ে গোটা ছেলেটাকেই ওপরের দিকে ছুঁড়ে দিলুম ….
ছেলেটার ধপধপে ফর্সা চকচকে সাদা শরীরটা পুরো চার হাত ওপর দিকে উঠে গেলো শূন্যে আর পরক্ষণেই নীচে এসে পড়লো আমার দুই প্রসারিত হাতে জড়িয়ে থাকা গৌরবের ছেঁড়া রাত্রিবাস আর অন্তর্বাসগুলোর ওপরে ঝপাৎ করে….
আমি সঙ্গে সঙ্গে হাত দু’টোকে নীচে নিয়ে গেলুম প্রায় মাটি অবধি সেই একুশ কেজি ওজনের ধাক্কাটা সামলে নিতে … তবে আমি থামলুম না…
তখনি আবার সোজা হয়ে দাঁড়ালুম আর গৌরবকে আমার দুই হাতের ওপরে সেই চিৎ করে ফেলে রাখা অবস্থাতেই আবার ছুঁড়ে দিলুম ওপর দিকে একটা দু’বছরের বাচ্ছা ছেলের মতন করে …আবার….আবার ও… তিন চারবার এই বিষম ঝাঁকুনির পরেই দেখি যে গৌরবের লুপ্তচেতনা যেন একটু ফিরে এলো আর তখন সে এলিয়ে পড়লো আমার বুকেতে…
তৎক্ষণাৎ বাইরে দূরে যেন মাটির হাঁড়ির মতন কিছু একটা জোর ফটাস শব্দ করে ফেটে গেলো বলে মনে হ’লো আর কেউ যেন কেমন একটা গোঁঙানির মতন বিশ্রী আর্তনাদ করে উঠলো আর সেই বাঁশির আমন্ত্রনের সুর ও এতোক্ষণ পরে থেমে গেলো তবে আমি সে সব কিছুই না দেখে বা না শুনে গৌরব ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে দাওয়াতে উঠে ঘরে ঢুকে পড়ে দরজা বন্ধ করে দিলুম আর লন্ঠনের আলোটা জোর করে দিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লুম কোমরের ব্যথা আর ক্লান্তিতে…
তবে গৌরবকে আর আমি ছাড়লুম না…
আধ ঘন্টাপরে গৌরব বেশ একটু সুস্থ হয়ে উঠে বসলো আর নিজের ছেঁড়া রাত পোষাকের অবস্থা দেখে লজ্জায় নিজের লাল টুকটুকে জিভটা বের করে বলে উঠলো—‘এ মা ছিঃ ছিঃ… ও বাপী… আমার নতুন সব অন্তর্বাস আর নাইট ড্রেসের এ কি অবস্থা … ও বাপী… এ’সব কি করে হ’লো? আর তুমি আমাকে এই ভাবে নিয়ে শুয়েই বা আছো কেন? ও বাপী…’
‘আছি কি আর শখ করে রে গৌরব? এক রাম আছাড় খেয়ে কোমর আর পিঠের ব্যথায় পড়ে আছি রে ভাই আর তোমার জ্ঞান না ফিরলে আর নতুন ড্রেস তোমাকে আমি পরাই কি করে বলো তো… তাই তোমার ও এই অবস্থা গৌরব …’
‘তুমি সব কথা আগে আমাকে খুলে বলো তো বাপী যে আজ রাতে আবার কি কান্ড হয়েছিলো … ওঃ সরি বাপী…. একমিনিট দাঁড়াও তুমি… আগে আমি গিয়ে ব্যথায় লাগাবার ভোলিনির মলম স্প্রে ওষুধ সব নিয়ে এসে তোমার পিঠ আর কোমরে লাগিয়ে দিই আর তুমি একটা পেন কিলার ও খেয়ে নাও দেখি আগে বাপী…আমি জল ও নিয়ে আসছি… ‘
‘তা দাও… ওঃ …উঠতেই যে পারছি না…. আমার লাগেজের কম্বিনেশন লক খুলে তোমার অন্যড্রেস সব কি করে যে এখন আমি বের করে আনি বলো তো গৌরব…’
‘আরে থাক না এখন বাপী…তুমি আগে এখন একটু ভালো হয়ে নাও তো …. আমার ড্রেস তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না বাপী……সে সব তুমি আমাকে পরে পরালে ও কোন ক্ষতি নেই…. তবে এখন বলো তো বাপী যে আমার কি হয়েছিলো এমন যে আমাকে বাঁচাতে গিয়ে তোমাকে আছাড় খেতে হয়েছে আর আমার নতুন পোষাক সব এইভাবে ছিঁড়ে ফর্দাফাঁই হয়ে গিয়েছে …’
গৌরব ভোলিনি স্প্রে করতে আমার ব্যথা একটু কম হ’লো আর আমি ছেলেটাকে কাছে টেনে এনে চাদর দিয়ে জড়িয়ে রেখে সব কথা বলতে বসলুম…
গৌরব সব শুনে বললো-‘বাপী আজ এমন কিছু একটা এসেছিলো যাকে আমি ঠিকমতন বুঝতেই পারিনি আর তাই তাকে আটকে দিতে ও পারি নি…বাপী কাল রাতে আর এখানে থাকাটা কিছু নয় …আমি বিকেলেই নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের জন্যে ক্যাব বুক করছি অ্যাপে আর স্পাইসজেট বা ইন্ডিগো যে কোন একটা ফ্লাইটে বেনারসের টিকিট কাটতে পারি কি না তা ও আমি দেখছি বাপী … সে এখন যে যা বলে বলুক আমাদের…’
গৌরবের যে কথা সেই কাজ… সে কম্প্যুটার আর অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ সবই চালাতে ওস্তাদ ছেলে তো তাই সে তখনই সেই কাজে লেগে পড়লো…
তাই পরের নবমির রাত আর সে’খানে কাটাতে হ’লো না আমাদের তবে চলে আসবার আগে গৌরব রায়বাহাদূর সাহেবের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে দু’টো ফটো দেখিয়ে জানতে চেয়েছিলো –‘আংকল… এই দু’টো প্রতিমার ফটোতে কি আপনি এখন কোন তফাৎ আই মিন ডিফারেন্স দেখতে পারছেন?’
‘কই না তো… তেমন কিছুই নেই তো…’
‘সে কি আংকল? এতো বড়ো প্রভেদটা আপনি দেখতেই পেলেন না… ওঃ… সরি… ভেরী সরি আংকল… আমাকে ক্ষমা করবেন..আপনি তবে সিংহের মুখটা শুধু দেখুন একবার ভালো করে প্লীজ…’
‘এ এ এ একি? এ যে তোমার দ্বিতীয় ফটোটায় দেখছি বন্ধ…’
‘হ্যাঁ আংকল… খুব অভিনব আইডিয়া ……নবমীর পূজো তো আজ শেষ আর তাই মা দুর্গার অসুরের সাথে যুদ্ধ করা ও শেষ আর তাই সিংহকে ও আর অসুরকে তো কামড়াতে হ’বে না…তাই সে মুখটা নিজের বন্ধ করে নিয়েছে…’
‘কিন্তু মাটির সিংহ…হাউজ দ্যাট পসিবল?’
‘আংকল সরি… ওটা হয়তো ঠিক মাটির তৈরী নয়… কোন হাল্কা ধাতুর তৈরী হ’তেই পারে… ওপরে যদি ও মাটির প্রলেপ আর রং চং করা হয়েছে কিন্তু…’
‘তবে কি মূর্তিগড়া পাল ও আছে এই চক্রান্তের ভেতরে?’
‘হ্যাঁ আংকল… আর এই নিন আর একটা দুর্লভ ফটো … এটা মা দুর্গার কৃপা… এতে আমার কোনই কৃতিত্বই নেই… আজ দুপুরের ভোগের সময় ভেতরে ঢাকা দেওয়া কাপড়ের একটা কোনা একটু সরে গিয়েছিলো এক জায়গাতে আর সেটা আমার চোখে পড়ে যায় দৈবাৎ আর সঙ্গে সঙ্গে …ক্লিক… আংকল কোন মেয়ে অনায়াসে তার প্রাণ দিয়ে দিতে পারে কিন্তু কোনমতেই তার নিজের গয়ণা কাউকে দিতে পারে না আর যখন দুর্গা ঠাকুরকে মা বলা হয় তখন তিনি ও নিশ্চয়ই একজন মেয়ে বইকি…আংকেল…’
‘এ কি? শেষে রক্ষকই ভক্ষক মানে সহকারী পন্ডিতমশাই নিজেই?’
‘হ্যাঁ স্যার… সব আসল গয়ণা তিন দিন ধরে ভোগের সময় গেছে সিংহের পেটে আর মা এখন পরে আছেন সবই নকল গয়ণা …আপনি দশমীর পরে গিয়ে সে’গুলি সব খুলে নিয়ে সিন্দুকে তুলবেন বলে আর তারপরে তো শুধু বিসর্জনের সময়ের অপেক্ষা… তবে মা দুর্গারই তো সিংহ … সে এখন ও বিশ্বাসঘাতক হয়ে উঠতে পারেনি ….সে যে এখন ও অসুর মারতে পারে এটা ওই মানুষরূপী অসুরদের বুঝতে পারা উচিৎ ছিলো …’ আমি শেষে এইবারে বলেই ফেললুম …
‘আমরা এখন তবে যাই আংকেল…নইলে আর বেশী দেরী হ’লে আমাদের ফ্লাইট মিস হয়ে যেতে পারে…’
‘হুম….তোমরা একটু দাঁড়া ও …তোমাদের যাতায়াতের ভাড়াটা আমি দিয়ে দিই আর একটা গাড়ির ব্যবস্থাটি ও করে ফেলি …তোমরা যাও..তারপরে এই সব বদমায়েস পাজী ছুঁচোগুলোকে আমি দেখছি এক এক করে… আমার সাথে বেইমানী… আমার খেয়ে পরে থেকে শেষে আমারই সাথে নেমকহারামী… অ্যাঁ…’
‘পাঁচ লাখ টাকার চেকটা নিয়ে গৌরব সেটা আমার হাতে তুলে দিয়ে বললো-‘প্রণাম আংকেল …বাই বাই …’
আমরা উঠে দাঁড়ালুম…
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
শাহ আজিজ বেশ বড় গল্প , দুবারে পড়েছি । ভাল লেগেছে ।
বিষণ্ন সুমন গল্পটার পৃষ্টাগুলো বোধকরি ঠিকমত বিন্যাস করা হয়নি। তাই পড়তে গিয়ে বিশ্রাম নেবার অবকাশ মেলেনি, যা অনেক পাঠেকেরই বিরক্তির কারণ হতে পারে। আপনার লেখার হাত ভালো। পাঠকপ্রিয় হবেন আশা করছি। শুভ কামনা রইলো।

১২ ফেব্রুয়ারী - ২০২১ গল্প/কবিতা: ৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "নগ্নতা”
কবিতার বিষয় "নগ্নতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ মে,২০২৪