বাংলার চেতনা তার ভাষায়, বারো মাসের তেরো পার্বনে আর বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে…তবে আজ আমরা তো দু’চার পাতা ইংরেজী পড়েছি আর কোট প্যান্ট টাই পরে বেশ সাহেব ও সেজে বসে আছি তাই সেই চেতনাকে যে আমরা শুধু ভূলতে বসেছি তাই নয় নিজেদের মধ্যেই জাত আর ধর্মভেদের গন্ডিতে এমনভাবে আটকা পড়ে গিয়েছি আর তার ফলে এমন এক বিবাদ বিড়ম্বনা আর বৈষম্যের ও সৃষ্টি করে বসে আছি যে বাংলার সেই সার্বভৌমিক চেতনা আর ফিরে আসবার কোন পথ মনে হয় খোলা নেই।
আর এইটাই তো ইংরেজ বণিকের জাত আসলে চেয়েছিল যখন বাধ্য হয়ে তাদের এই দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়। এমন বিভেদের বীজ তারা পুঁতে দিয়ে গিয়েছে যাবার সময়ে যে আর যেন কোনদিনই ভবিষ্যতে বাঙালির সমাজে চৈতন্যোদয় হ’তে না পারে কেননা তারা এই দেশে এসে যদি কোন জাতকে একটু আধটু ভয় পেয়েছিলো তো সে হয়তো এই এক বাঙালী জাতকে…তাদের বুদ্ধিকে ..তাদের নেতাজিকে….গান্ধিজী বা নেহরুজিকে মনে হয় কোনকালেই নয়।
এই কথাগুলো কিন্তু আমার নয় …কথাগুলো বলেছিলেন আমার এক প্রোফেসার বন্ধু। তিনি একজন বিদ্বান মানুষ ছিলেন আর তাই তিনি যখন বলেছিলেন তখন কথাগুলো ঠিক বলেই মনে হয় আমার।
তবে এখন সে সব পুরণো কথা যাক। আমি বরং আজকের গল্পটিই বলি যেটির জন্যে এতো ভনিতা করা ।
গৌরবকে নিয়ে সে’দিন রাতে আমি ডিনার করতে বসেছিলুম আমাদের ডিজনীল্যান্ডের কার্টুনের ছবিওয়ালা সানমাইকা লাগানো চকচকে সিক্সসীটার ডাইনিং টেবিলটি বেশ করে সাজিয়ে নিয়ে…
গৌরব ছেলেটার পরিচয় মনে হয় এখন আর আমাকে নতুন করে দিতে হবে না কেননা ইতিমধ্যেই তাকে অনেকেই আমার চেয়ে বেশীই বেশ করে চিনে গেছে আর তারা ফোন করে প্রায়ই আমার কাছে গৌরবের বিষয়ে অনেক কিছুই জানতে ও চায়… বিশেষ করে আমার অফিসের বস তো বটেই…
তখন যদি ও বর্ষা কেটে গিয়ে শরৎকাল এসে গেছে তবু ও দেখি যে মাঝে মাঝে বেশ বৃষ্টি হয়েই চলেছে যা আমার একটু ও পছন্দ নয় কেননা জোর বৃষ্টি পড়তে থাকলে তখন যাতায়াতের সমস্যা তো হয়েই থাকে আর তার চেয়ে ও বড়ো মুশ্কিল আমার এই হয় যে গৌরবের দামী ড্রেসগুলো কাচলে তখন আর শুকোতেই চায় না মোটে…
আর আজকাল আমি যে রোজ গৌরবকে শুধু ঘরোয়া ও স্কুল ড্রেস পরাই তাই তো নয়… সে ছাড়া ও আমি নিয়মিত ভাবে তাকে কখনো ঠিক বনেদী ঘরের ইংরেজ ছেলেদের মতন করে দামী পোষাক পরিয়ে রাখি বিশেষকরে রবিবার বা কোন ছুটির দিন হ’লেই…ইএই যেমন সকালে মর্ণিংস্যুট… তারপরে লাঞ্চ… ইভনিং…. ডিনার আর নাইট স্যুট ও পরিয়ে রাখি আর কখনো তাকে স্পোর্টিং ও ট্র্যাক স্যুটে স্পোর্ট্সবয় সাজাই আর কখনো খাঁটি বাঙালির পোষাক পরাই আবার কখনো তাকে একটা পাঠান ছেলে সাজিয়ে ও রাখি আর তাই সব মিলিয়ে দিনে প্রায় পাঁচ কি ছয় বার করে আমাকে তার ড্রেস মানে সাজ আর সজ্জা মানে অলঙ্কার যাকে বলে ছেলের সব নানা ধরণের আবরণ ও আভরণই বসে বসে চেঞ্জ করতে হয় আমার ছেলেটাকে বিশেষ করে ইংরেজ ছেলেদের মতন সবসময় ঝকঝকে স্মার্ট ও এভারফ্রেস করে রাখতে …তাই গৌরবের দামী স্যুট ছাড়াও অনেক রকমের সব পোষাক জামা কাপড় আর অন্তর্বাস সবই আমাকে রোজ কাচতে ও শুকোতে হয়…
অবশ্য গত ঘোর বর্ষার সময় আমি গৌরবের পরামর্শ মতন একটা হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার করে আর শেষে সফ্ট আয়রণ করে নিয়ে সব ড্রেস শুকিয়ে নিয়ে সেই সমস্যা মিটেয়েছিলুম …
তবে সে’দিন তখন ঠিক যে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়া শুরু হ’লো তা নয় তবে আমাদের ফোনটা বেজে উঠলো ঝনঝনিয়ে…
‘এই মরেছে…এই সময়ে আবার কে ফোন করছে রে বাবা…উঃ…ভালো জ্বালাতন যা হোক…এতো রাতে ও দেখি যে আমাদের ডিনারে পড়ছে বাধা….নাঃ….এ তো দেখি মহা মুশ্কিল…’
বাধ্য হয়ে আমি উঠতে যাচ্ছি ..তাই দেখে গৌরব হাত নেড়ে বারণ করলো আমাকে…আর আমি ওঠবার আগেই ব্রাউন ভেলভেটের নরম গদি মোড়া ডাইনিং চেয়ার ছেড়ে আমার দশ বছরের ঝকঝকে ফর্সা আর ডীপ ক্রিম কালারের ডিনার স্যুট আর গলায় গোল্ডেন বোয়ের সাথে ইংরেজদের রয়্যাল ফ্যামিলীর প্রিন্সদের মতন একটা আসল মুক্তোর লকেট লাগানো সোনার চকচকে ডাইনিং নেকলেস পরে থাকা অতিসুন্দর ও স্মার্ট ছেলে গৌরব তখনি লাফিয়ে উঠে বললো-‘থাক বাপী…তুমি বসো …আমি দেখছি …’
এই বলে একটা ঝকমকে বিদ্যুতের আলোর ঝলকের মতন গৌরব ছেলেটা ছুটে গেলো আর ফোনটা বাঁ হাতে তুলে নিয়ে বললো-
‘হ্যালো…কে বলছেন? না …আমি তো গৌরব কিশলয় কুমার বলছি … আপনি কে বলছেন আংকেল? …’
‘ওঃ… আচ্ছা ..শিওর আংকেল……হোল্ড অন ফর জাস্ট এ মিনিট প্লীজ…’
এই বলে গৌরব ফোনের তারের একস্ট্রা কয়েলটা খুলতে খুলতে পুরো ফোন সেটটাকে আমার কাছে তুলে নিয়ে এসে ফোনটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলো…
কি ছেলে বলো তো? …তার মতে না কি খেতে বসে উঠতে নেই…তাই…
‘হ্যালো……হাউ ডু ইয়ু ডু? …একটু দরকারী আই মিন আর্জেন্ট কথা বলতে চাই আমি…’
‘ও… শিওর স্যার……’
‘অ্যাঁ…সে কি? তা এই ব্যাপারে আমি কি করতে পারি স্যার? আপনি না হয় পুলিশে …’
‘ও আচ্ছা …কিন্তু আমি গিয়ে কি করবো স্যার যখন পুলিশ….? না… না… পূজোর ছুটিতে হ’লে সে তো হ’তে পারে স্যার কেননা আমার পূজো নিয়ে তেমন কোন মাথাব্যথা আই মিন সিলি ফিলিসং নেই অন্য সব বাঙালিদের মতন আর …হ্যাঁ স্যার…তবে সে তো হয় মোটে তিনদিনের ছুটি স্যার… তাইতে কি হবে?’
‘..ও হ্যাঁ স্যার.. ওই স্পেশাল ক্যাজুয়াল লিভটা ও যদি পাওয়া যায়… আচ্ছা… হ্যাঁ… স্যার… তবে আর আপনি চিন্তা করবেন না স্যার…আমি যেতে পারবো…ও কে স্যার…গুডনাইট…’
‘এই নাও গৌরব…এখন রাখো এই আধুনিক দূরভাষ যন্ত্রটিকে দূর করে ফেলে যথাস্থানে কেননা এর কৃপায় এখন হ’য়ে গেলো আমাদের কম্ম কাবার… ও গৌরব… এখন এসো …তুমি এসে বসে আগে দু’টো যা হয় খেয়ে তো নাও তার পরে সব কথা আমাদের আলোচনা করতে হবে… তবে কেন যে আমার কপালেই সব সময় এমন সব দুষ্টগ্রহ নাচে তা কে জানে বাবা … ওঃ…’
তা আমার চটপটে ছেলে দেখি যে চট করে আমার আগেই খেয়ে দেয়ে নিয়ে উঠে পড়লো আর নিজের ডিনার স্যুটটা ছেড়ে ফেলে আমার খাওয়া শেষ হ’তে সে তখন ডিশ ও ডাইনিং টেবিল ক্লিনিংয়ের কাজে লেগে ও পড়লো…
আসলে আমি ডিনারের আগে ডাইনিং টেবিল সাজিয়ে ছিলাম তো…তাই এই কাজ গুলো এখন সব সে করবে…
সে যে এখন বেশ বড় হয়ে গেছে তাই আমাকে ছেলেটা দেখাতে চায় আর কি…
আমি তার কান্ড দেখে মনে মনে হাসলুম…
’হুঁ… ভারী তো ক্লাশ ফাইভে পড়া একটা ১৩০সেন্টিমিটারের কচি বাচ্ছা ছেলে …যার ওজন বড়জোর হবে ২১ কেজি আর সে নাকি আবার বড়ো ও হ’য়ে গেছে ….এইটুকু একটা ছেলে দিয়ে তো দেখি যে আমার কোন কাজই ঠিকমতন হয় না…হয় তো খালি অকাজ …তা সেই কথাটি এখন কে বোঝায় এই ছেলেটিকে?’
কি আর করা?…
তবে এখন তো গৌরব ছেলেটা একটু হ’লে ও বড়ো হয়েছে.. আগে তো সে একেবারেই একটা কচকচে কচি বাচ্ছা ছেলে ছিলো… আর তখন তাকে ধরে একটু মনের সুখে আদর করতে ও আমার বেশ ভয় করতো… যদি লেগে টেগে যায় তখন তো আবার কান্না শুরু করে দেবে আর তখন তো আমি গেছি… ওরে বাপ রে…
এখন আর আমার অবশ্য সেই ভয়টা নেই তাই যখন তখন আমি আমার প্রিন্স সাজানো চকচকে ঝকঝকে ছেলেটাকে ধরে বেশ করে আদর টাদর করতে পারি ইচ্ছেমতন তা ঠিক তবে একদিনেই তো আর একটা ছেলে বড়ো হয়ে যাবে না তা সে যতোই সুন্দর বুদ্ধিমান আর স্মার্ট হোক না কেন…প্রকৃতির নিয়ম মতন সে তো একটু সময় লাগবেই….
আমি তখন আমার ডবলবেডের নরম গদীপাতা খাট থেকে রঙচঙে বেডকভারটা তুলে রেখে বিছানায় একটা কাচা সাদা বেডশীট পেতে নিলুম আর বালিসগুলোর কভার বদলে ঠিক করে নিয়ে ঘরে হিট নাইটস্প্রেকরে নিলুম আর দু’টো গুডনাইট মেশিন অন করে দিয়ে শয়নের উদ্যোগে লেগে পড়লুম….গৌরবের বেডরুমে অবশ্য আধুনিক ডিজাইনের একটা ফোল্ডিং মশারী ও লাগানো আছে।
গৌরব আধঘন্টা পরে কিচেনের সব কাজ শেষ করে নিজের হাত পা তোয়ালে দিয়ে মুছে বেডরুমে ফিরে এলো তবে বেশ সলজ্জ ভঙ্গিতে নিজের সুন্দর মুখটা একটু নীচু করে নিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে একটু হেসে দিলো যার কারণ বুঝতে আমার অসুবিধা ছিলো না…সে হ’লো তখন ছেলের পরে থাকা আধ ভিজে পোষাকগুলো……
আমি কিছু বলবার আগেই গৌরব এক এক করে তার পরে থাকা মেরুন রঙের চকচকে সিল্কের শার্ট ও সুপার ফাইন ভেলভেট কাপড়ের তৈরী সাদা শর্টটাকে খুলে ফেললো আর আলনায় ঝুলিয়ে রেখে দিয়ে এসে নিজের অতি সুন্দর মুখটাকে বেশ কাঁচুমাচু করে আমার কাছে এসে দাঁড়ালো…
বর্ষাকালে ছেলের সাথে বসে ইনডোর খেলা করবার সময় আমি এইসব নানারকমের বিচিত্র মুখ ভঙ্গিমাগুলো গৌরবকে দেখিয়েছিলুম আর ছেলে সে’গুলো সব দিব্যিকরে দেখি একবার দেখেই শিখে ও নিয়েছে আর সেইসব মুদ্রাগুলো তার পদ্ম ফুলের মতন সুন্দর আর দুষ্টুমির হাসি মাখা ফর্সা মিষ্টি মনোহারী মুখে এমন অপরূপ দেখায় যে এই মুখভঙ্গিমাগুলো দেখলেই তাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে আমার…
আমি আর তখন ছেলেটাকে তার রঙিন আলোর ঝালর আর রোটেটিং কালার এলইডি রুফ প্রোজেক্টার দিয়ে সাজানো গোছানো শোবার ঘরে নিয়ে গেলুম না। তার বদলে নিজের বিছানাতেই গৌরবকে টেনে তুলে নিলুম দুইহাতে চেপে ধরে আর বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেই ঝপ করে শুয়ে ও পড়লুম…
তখনই আমার নাকে গৌরবের সান্ধ্যকালীন অন্তর্বাসের মিষ্টি চন্দনের সুগন্ধ এসে লাগলো…
ঘড়িতে তখন রাত এগারোটা বেজে গেছে …
বেশ সুন্দর একটা চকচকে কচি কলাপাতা রঙের পাতলা স্লিভলেস গেঞ্জী আর একটা ছোট গাঢ় নীল রঙের নরম জাঙ্গিয়া পরেছিলো তখন আমার ঝকঝকে ফর্সা রূপবান নরম নরম ছেলে গৌরব…… এটা ছেলের ঘরে পরে থাকবার ছোট অন্তর্বাস আর কি…
তবে বাইরে ছেলেটাকে নিয়ে কোথাও যেতে হ’লে তখন আমি তাকে ম্যাচোর দামী মোটা ফুল স্লিভ সাদা গেঞ্জী আর এই ছোট ভি শেপের জাঙিয়ার বদলে জকির ইয়ু শেপের বড়ো জাঙিয়া পরিয়ে দিই বইকি…
আসলে আমাদের মানে বিশেষ করে গৌরবের সুন্দরী অল্পবয়সী মায়ের তার ছেলের সম্বন্ধে কনসেপ্টটাই একটু অন্যরকমের ছিলো যে…
এই যেমন ধরা যাক যদি আমাদের এই বাড়িটা একটা ফুলের সাজানো বাগান হয় তবে গৌরবকে হ’তে হ’বে একটা গোলাপ ফুল… অথবা বাড়িটা যদি স্বর্গ হয় তো গৌরবকে একটা দেববালক হয়ে থাকতে হ’বে আর বাড়িটা যদি পরীলোক হয়ে যায় তখন গৌরবকে হ’তে হ’বে একটা ছেলে পরী অথবা বাড়িটাকে কখনো একটা মরুভূমি ও মনে করা যেতেই পারে কিন্তু গৌরব তখন হয়ে উঠবে একটা সুন্দর ছায়াঘেরা মরুদ্যান বা ওয়েসিস….
আসলে এইগুলো সব সাংঘাতিক কল্পনার বিলাস ছাড়া আর কিছু নয়…উঃ…উঃ…
গৌরব নিজের দু’টো নরম চকচকে বাহু দিয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বললো-‘নাও বাপী… এইবার তুমি তোমার ছেলেকে এখন সব ব্যাপারটা খুলে বলতে পারো…’
আমি গৌরবের দু’টো ফর্সা মসৃণ আর মাখনের মতন নরম গালে আর লাল ঠোঁট দু’টোতে অভ্যাস মতন চুমু খেতে শুরু করলুম আর গৌরব বেশ লজ্জা পেয়ে মুখটা লাল করে বললো-‘এই যাঃ..বাপী..এখনই নয়..ও সব একটু পরে..আগে সব কথা বলো তো দেখি তুমি আমাকে….
আমি মুখ ভার করে ঠোঁট উল্টে একটা বিশেষ মুখভঙ্গিমা করে শুধু বললুম-‘বলছি আমার প্রিন্স….তবে বললুম একটাই কথা…’রায় বাহাদূরগঞ্জ ওরফে রায়গঞ্জ…বলো তো দেখি যে তুমি কি বুঝতে পারলে?…’’
আমার সেই লাস্যময় মুখ দেখে আর এই কথা শুনে গৌরব খিল খিল করে হেসে উঠে বললো-‘ও বাপী… তোমার কথা আমি ঠিক বুঝেছি… তবে সে তো এই ইয়ু.পিতে নয় বলে মনে হয়… ‘
‘না…বঙ্গদেশে…’
‘ওরে বাবা…তা তোমার ওই অবাঙালী বস আংকেলের হঠাৎ এই বঙ্গ চেতনা জাগলো কেন মানে তিনি আমাদের দরিদ্র বাংলাকে নিয়ে পড়লেন কেন আর যেতেই বা বলছেন কেন তোমাকে?’
‘জরুরী দরকার আছে…’
‘তবে নিশ্চয়ই ওনার কোন জাত ভাই বা আত্মীয় স্বজন কেউ আছেন সে’খানে …’
‘হুঁ…সে তো থাকতেই হবে….’
‘তা আছেন সে তো ভালো কথা বাপী তবে যতো দূর আমি জানি কোন রেল স্টেশন তো নেই ওই জায়গাতে আর বেশ ইন্টিরিয়র কান্ট্রিসাইড হ’তে পারে জায়গাটা…মনে হয় কর্ড লাইন হয়ে যেতে হবে…’
‘হুঁ…তবে তোমার ওই সব গালভরা ইংরিজী নামগুলো রাখো তো দেখি নর্দমাতে ফেলে…আমি ইংরেজদের পরিচ্ছন্নতা ..সুবিধাজনক সাজ পোষাক …সময়ানুবর্তিতা… ড্রেসকোড ..হার্ড ওয়ার্ক আর অনেষ্টির গুণগুলো পছন্দ করে নিয়েছি ঠিকই বটে তবে তাদের ওইসব গালভরা কথাবার্তা মোটেই আমার পছন্দ নয়… হুঁ… বলে কিনা ইন্টিরিয়ার কান্ট্রিসাইড.. ..ছাই সাইড… সোজা বাংলায় তাকেই বলা হয়… অজ গ্রাম…’
‘হিঃ…হিঃ…হিঃ…অজগ্রাম আবার কি বাপী?…’
‘সেটি তুমি সে’খানে একবার গেলেই শুধু হাড়ে হাড়ে কেন বলা যায় মজ্জায় মজ্জায় এমন কি বত্রিশটি পাঁজরে ও ঠিক টেরটি পেয়ে যাবে…হ্যাঁ না তো..কেননা সে’খানে কোন আধুনিক সুখ সুবিধার উপকরণের বালাই নেই আর তিন চারটে গ্রাম মিলিয়ে হয়তো একটা পোস্টঅফিস আর পুলিশ স্টেশান আছে মনে হয়…সেই মশাগ্রাম ছাড়িয়ে যেতে হবে… রেল স্টেশন তো দূর হয়তো বাসস্টেশন ও মিলবে না….ওঃ…যতো সব আপদ এসে জোটো দেখি এই আমার পোড়া বরাতেই…..’
‘আচ্ছা বাপী…সেই গ্রামে কি কোন কেউকেটা… মানে গন্যমান্য লোক আছেন?’
‘তা সে তো একজন আছেনই…’
‘তিনি কে?’
‘তাঁর নাম রায় বাহাদূর রঞ্জিৎ সিংহ… আমাদের বসের ঘনিষ্ট বন্ধু…তাই মনে হয় অবাঙালী তবে বাংলায় এসে বঙ্গচেতনা জাগৃত হতেই পারে আর তাই হয়তো তিনি বাঙালী সেজে বসে আছেন… তবে বিরাট ধনী… আগেকার দিনের জমীদারের পরিবার…হয়তো রায়গঞ্জ গ্রামের পত্তনীদার ও …আমি ওই সব পাড়া গাঁ জায়গা ভালোই চিনি…ওখানে সব কিছুই হ’তে পারে…’
‘তার মানে কি বাপী? কি হ’তে পারে?’
‘মানে আবার কি? ঘটন ও অঘটন সব কিছুই …গাঁইয়াদের সব কারবার আলাদা হয় তো তাই আর কি…আর আমরা শহুরে শিক্ষিত নিধিরাম সর্দার তাদের কাছে…’
‘তার মানে বাপী?…’
‘এই যেমন মনে করো চুরী চামারী এমন কি ডাকাতী থেকে শুরু করে কাউকে গুম বা খুন করা ও খুব সহজ কাজ ওইসব জায়গায় আর…’
‘আর কি বাপী?’
‘যতো সব গ্রাম্য কুসংস্কারের ব্যাপার ও থাকতেই পারে…’
‘যথা…’
‘আরে বুঝলে না? যাকে আমরা বলি ব্ল্যাক ম্যাজিক…সেই সব তুকতাক গুণজ্ঞান তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপ এমন কি হয়তো গ্রামের শ্মশানে ভূতপ্রেতও পিশাচ নিয়ে সাধনা অবধি করা হতেই পারে… …এই বিজ্ঞানের যুগে ও মন্ত্র তন্ত্র হোম যজ্ঞ বলি…সব সব চলে আর পুলিশের কোন ফাঁড়ি ও আশেপাশে কয়েক মাইলের মধ্যে পুলিশের ফাঁড়ি না থাকলে পাহারার ব্যবস্থা যে রামভরোসায় চলবে সে আর বেশী কথা কি গৌরব?…সুতরাং তুমি বুঝতেই পারছো যে আইন বা নিয়ম কানুনের অবস্থা কি হ’তে পারে সেখানে…জোর যার মুল্লুক তার অবস্থা হওয়া মোটেই বিচিত্র ব্যাপার নয় ওই সব জায়গায়…হুঁ…যত্তোসব…’’
‘তা সে তো বেশ বোঝাই যাচ্ছে বাপী তবে তো আমাদের সে’খানে না গেলেই হয়…’
‘তা তো হয়ই… আমি ও তো তাই বললুম কিন্তু ঝামেলাটাকে আমি এখন কাটাই কি করে বলো তো?… বসের বন্ধু বা জাতভাই বলে কথা আর তাঁর প্রয়োজন মানেই বসের প্রয়োজন… এইজন্যেই বলে পরের চাকরীর না কাঁথায় আগুন …বার কয়েক বেশ ভালোমতন জব্দ হ’য়ে এখন আমাদের খাঁটি রামগরুড়ের ছানা এই বসটি হয়তো মনে করেন যে গৌরব যেখানে… মুশ্কিল আসান সব সেখানে… আর সেইসাথে একজন বড়ো হেভিওয়েট মিনিস্টারের রিকমেন্ডেশন ও আছে এর পেছনে… সুতরাং….’
‘ওঃ… তবে তো মহা মুশ্কিল বাপী…নাঃ সত্যিই ভারী জ্বালাতন হ’লো দেখছি…’
‘তবে আর আমি বলছিটা কি এতোক্ষণ ধরে তোমাকে গৌরব? রায় বাহাদূরের অনেক সব জ্ঞাতি গোষ্ঠি নিয়ে বিশাল এক যৌথ পরিবার আর তাঁর বাড়িতে প্রতিবছর এখনও ধুমধাম করে দোল থুড়ি হোলী আর দুর্গোৎসব মানে যাকে বলে নবরাত্রের পূজো তাই হয়… পয়সা থাকলে যা হয় আর কি? তবে এইবার তিনি দিল্লীর ওপর মহলের কাছে না কি আর্জি জানিয়েছেন যে তাঁর পুলিশ প্রোটেকশান ও চাই…’
‘তা কেন বাপী?’
‘তাঁর সব সচল দেবোত্তর সম্পত্তি অপহৃত হতে পারে বলে ভয় তাঁর …তাঁর সাথে একজন জ্ঞাতি এই নিয়ে কিছু বচসা ও করেছেন দিন কয়েক আগে আর তাই তিনি এখন নিরাপত্তা চাইছেন…. তাঁর এক ছেলে এখন এম পি আর তিনি নিজে ও আগে একজন মিনিষ্টার ছিলেন সেন্টারে…… সুতরাং এখন বুঝতেই পারছো গৌরব যে কি কান্ড সব….’
‘ফলে একজন সরকারী ডিটেকটিভ অফিসারকে দিল্লী থেকে পাঠানো হচ্ছে আর কয়েকজন বিশেষ আর্মড পুলিশ ও থাকবে গেট ও পূজো প্যান্ডেলের পাহারায়….
‘তবে তো তিন প্রোটেকশান ও পেয়েই যাচ্ছেন বাপী …তাহ’লে আর আমাদের যাবার কি দরকার আছে বলো বাপী?’
‘বস আর রায়বাহাদূর সাহেব এই দু’জনেই চাইছেন তাই…কেননা তাঁর এই জ্ঞাতিভাইটি আসলে একটি অতি ধুরন্ধর জীব…ওপরে অতি ভালোমানুষ সেজে বসে থাকেন….এই আর কি’
‘বুঝেছি বাপী…তাই এই ষড়যন্ত্রির কবলে পড়তে আমাদের ঠেলে দেওয়ার ইচ্ছে…বেশ কান্ড যা হোক বাপী ...তা এই দেবোত্তর অচল সম্পত্তিটা কি জিনিষ সেটা একটু তুমি এখন আমাকে বুঝিয়ে বলো না..’
‘’হুঁ…এটা মনে হয় নেটের গুগল সার্চ ইঞ্জিনের বাবা কেন তার ঠাকুর্দা ও বলতে পারবে না …তাই তুমি জানো না…’
‘ওঃ বাপী…তুমি ও না…খালি ঠাট্টা করে…’
‘আচ্ছা… বলছি শোন আমার রূপকুমার পুত্ররত্ন… এর মানে হ’লো যে কোন বনেদী পরিবারের একজন করে যে কুলদেব বা দেবী থাকেন তাঁর নামে উৎসর্গীকৃত বা আইনানুসারে সমর্পিত এমন সব সম্পত্তি আমাদের বাংলাতে থাকে যা স্থাবর বা অস্থাবর মানে অচল বা সচল দু’টোই হ’তে পারে তবে সচল সম্পত্তি হ’লো এই যেমন ধরো… টাকা পয়সা… সোনা দানা.. হীরে মাণিক… সোনার অলঙ্কার …এই সব আর অচল সম্পত্তি হয় জায়গা জমী ক্ষেত খামার বাড়ী ঘর মন্দির যার মালিক সেই কুলদেব বা দেবীই হয়ে থাকেন বলে এই সব সম্পত্তি অন্য কোন লোক বা সরকার ও নিতে বা হস্তান্তরিত করতে পারে না…’
‘ওঃ… এইবারে আমি সব বুঝেতে পেরেছি বাপী …এককথায় ঠাকুরের ধন সম্পত্তি …এই তো? তবে সমস্যাটা মনে হয় এই সব নিয়েই তৈরী হয়েছে…’
’সে তো হ’তেই পারে গৌরব…তাই হয়তো সেই ভয়েতেই চাওয়া হয়েছে প্রোটেকশন…’
‘তবে এখন শুধু সেই শয়তানির মানে চুরী ডাকাতী বা অপহরণের মূল পদ্ধতিটা জানতে পারলেই তো মিটে গেল সব সমস্যা …মোটে এইটুকু তো কাজ বাপী…মনে হয় বেশ সহজ ব্যাপারই হবে…হিঃ হিঃ হিঃ হিঃ…’
‘সেটা আর এই ঘরে বসে কি করে জানা যাবে বলো গৌরব যথা স্থানে না গেলে? আর বেশী সহজ কাজই অনেক সময় বেশী গোলমেলে ও হয় যে…’
‘সে যা হয় তাই হোক…আগে রেলের টিকিট তো তুমি হাতে পেয়ে নাও বাপী… এখন ও দিন পনেরোর ও বেশী সময় হাতে আছে… আমি আমাদের লাগেজ ও সব দরকারী জিনিষপত্র গুছিয়ে নেব ঠিক তবে এই সুযোগে মনে হয় যে আমাদের পূজোর সময় বেড়ানোর মজাটা বেশ ভালোই হবে …কু… ঝিক ঝিক… করে রেলগাড়িতে চড়ে…কি মজা… কি..মজা… হিঃ… হিঃ… হিঃ ..হিঃ… ‘
‘হুঁ…তা রেলগাড়ী পাগল কচি ছেলের কাছে এটা বেশ একটা মজা তো হ’তেই পারে তবে আমার জন্যে যে এটা একটা সাজা… তা ঠিক কেননা আমি মোটেই ভ্রমণ রসিক বাঙালী নই রে ভাই… তাই বাঙালির এই ভ্রমণ চেতনা থুড়ি সংস্কৃতি আমার মাথায় উঠে বসে থাকলেই আমার বেশ ভালো লাগে…’
‘ওঃ…বাপী…তুমি ও না বাপী… সব কাজকেই সাজা বলে ভাবো কেন বলো তো?’
‘তবে কাজের মজা না কি সাজার মজা কি ভাববো?…হুঁ…কেন যে ভাবি তা সময় এলেই ঠিক টেরটি পেয়ে যাবে তুমি…’
‘তা সে আমি যখন যা পাই পাবো …এখন তুমি একটু ঘুম করো তো বাপী ভালো ছেলের মতন…আমি না হয় ঘুমকে ডাকছি…আয় ঘুম আয় ঘুম রায়গঞ্জ দিয়ে বলে… হিঃ… হিঃ… হিঃ…হিঃ… ‘
‘তবে রে দুষ্টু পাজী ছেলে …’
বলেই আমি বেশ রাগ করে একটা নীল সিল্কের চাদর পায়ের কাছ থেকে টেনে নিয়ে গৌরব ছেলেটার গায়ে চাপা দিলুম… কি আর করি? জল ঘেঁটে এসে তখন গৌরবের হাত পা’গুলো সব যে বেশ ঠান্ডা কন কন করছে…আর রাতে এখন তো দেখি যে বেশ একটু ঠান্ডামতন ভাব ও লাগছে… ’
অতঃপর দিন কয়েক কেটে গেছে…
শেষে দেখি যে ট্রেনের দু’টো টিকিট এলো আইআরসিটিসির ওয়েবসাইট থেকে আমার ই-মেলে আর আমার অ্যাকাউন্টে এলো পাঁচ হাজার টাকা রাস্তার খরচ খরচা বাবদ….
গৌরব তাই দেখেই টিকিট দু’টো ডাউনলোড করে নিলো আর এ টি এম থেকে টাকাটা ও আমার সঙ্গে গিয়ে তুলে এনে সেই বাংলার পূজোর ছুটির মজার জোগাড়ের জন্যে উঠে পড়ে লেগে পড়লো …গুগল সার্চ করে দেখে দেখে কতো কি যে সব জিনিষ সে কিনে আনলো আর নিজের পিঠের ব্যাগ মানে কি যে ছাই বলে আজকাল… হ্যাঁ…ব্যাকপ্যাকেতে ভরলো তা সেই জানে তবে আমাকে ও গৌরবের জন্যে কেনা পূজোর নতুন সব পোষাকগুলো গুছিয়ে নিয়ে বেশ করে তৈরী হ’তে হলো বইকি…
যথাসময়ে আমাদের যাত্রা শুরু হ’লো…
গৌরবের তো দেখি ট্রেনে চড়বার মজাই আলাদা…
আমরা একটা রিজার্ভ অটো নিয়ে বেনারস ক্যান্ট স্টেশনে পৌঁছে ফ্লুরোসেন্ট কালার চার্ট দেখে ৯ নম্বর প্ল্যাটফর্মে গিয়ে হাজির হলুম আর গৌরব প্ল্যাটফর্মে নেমেই ছুটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নীলরঙের ট্রেনে আমাদের কোচ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো…
ভেতরে স্পঞ্জের লাইনিং দেওয়া দামী ঝকঝকে একটা গোলাপী রঙের বেশ নরম tween boy স্যুট পরা গৌরব দৌড়ে দৌড়ে ফিরে এসে সব ট্রলি ব্যাগ ট্যাগগুলো টেনে নিয়ে গিয়ে ট্রেনের নির্দিষ্ট কামরাতে এক এক করে সব লাগেজ তুলতে আমাকে সাহায্য করলো …সীট নম্বর খুঁজে নিয়ে যথাস্থানে গিয়ে বসবার ব্যবস্থা করে আবার ট্রেনের কোচের বাইরে লাগানো চার্ট দেখে নাম সীট নম্বর সব চেক করে মিলিয়ে নিয়ে নিশ্চিত হয়ে তখন সব লাগেজ সীটের নীচে গুছিয়ে রেখে দিলো আমার পারফেক্সনিস্ট ছেলে আর আবার নীচে নেমে গিয়ে একটা স্টল থেকে কোল্ডড্রিংক মিনারেল ওয়াটার কেক বিস্কুট চিপস চকলেট চানাচুর… যা পাওয়া গেলো সে সব ও কিনে আনলো …
সে কি আনন্দ আর উৎসাহ ছেলের…তার তখন মজা খুব..
ওরে বাবা..এই ছেলের মায়ের মতন দেখি যে ছেলের ও মজার জগৎটাই যেন আলাদা… সঙ্গে দেখি আবার নিজের ডবল লুডোটা ও নিয়ে এসেছে কাল সকালে বসে খেলবে বলে তবে এসী টু টিয়ার কোচ বলে দিনে গরমের কষ্টটা আমাকে তেমন পেতে হবে না… এই যা রক্ষা… কিন্তু রাত ন‘টায় স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে উঠতেই যে আমার কালঘাম ছোটবার অবস্থা হয়ে গেলো তার বেলায় কি?
গৌরবের মজার না নিকুচি কিয়া হ্যায়…যত্তোসব…ওঃ..’
আমি নিজের নিচের বার্থে তখন একটা কম্বল আর বেড সীট পেতে বালিশে হেলান দিয়ে আড় হয়ে বসেছি আরাম করে…
‘এখন এই গাড়িটি ছাড়লেই বাঁচি…
গৌরবকে বললুম- ‘এই ছেলে… এইবার তুমি আমার কাছে এসে জানলার ধারে চুপটি করে বসে পড়ো তো দেখি… আর তোমার কিনে আনা একটা চকলেটই খাও তো বসে…উঃ…আমার কি ছটফটে একটা ছেলে হয়েছে রে বাবা …বুঝতেই তো আমি পারছি না যে এটা একটা ছেলে না চিংড়ি মাছ…অ্যাঁ….’
‘হিঃ…হিঃ…হিঃ…হিঃ….ও বাপী…রেল গাড়ী চলছে …রেল গাড়ী চলছে… ’
আমাদের গাড়ী যথাসময়ে ছাড়লো তো বটে তবে সেই গাড়ী দেখি গুড় গুড় করে চলে বেশ লেট ও করতে লাগলো…
মাঝপথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আর ঢিকঢিকিয়ে চলে গাড়িটা বর্দ্ধমানের পরে কর্ড লাইন ধরে হাওড়ার পথে রওনা হ’লো আর তাই পরের দিন বিকেলে প্রথমেই গিয়ে আমাদের নামতে হ’লো মশাগ্রাম… সে’খানে নেমে বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে একটা প্রাইভেট বাসে উঠে নীলপুর যাত্রা…
সেইখানেই কি রেহাই আছে না কি? বাস বদল করে মানে বাস ছেড়ে ট্রেকারে খানিকপথ যেতে হ’লো আর শেষে মাণিকপুর থেকে সন্ধ্যের আগে একটা অটো নিয়ে যেতে হ’লো সেই ধাধ্ধাড়া রায়গঞ্জ…পথেই রাত নেমে এলো।
এইভাবে সেই গ্রামে গিয়ে পৌঁছতেই তো আমি একেবারে হয়রাণ…
কেননা সেই এবড়ো খেবড়ো গ্রামের পথটির দশা একেই তো মোটে ভালো নয় তার ওপরে একজায়গাতে পথের মাঝখানে একটি বেশ বড়ো সড়ো গর্ত কেউ বা কারা শুধু যে খুঁড়েই রেখেছিলো তাই নয় সে’টিকে এমনভাবে একটি আলকাতরা মাখানো কালো কাপড় দিয়ে বেশ করে ঢেকে ও রাখা হয়েছিলো যে দূর থেকে অটোর হলদেটে হেডলাইটের আলোতে দেখে বুঝতে পারা শুধু যে কঠিন তাই নয় একেবারে যাকে বলে অসম্ভব…
তবে রাখে কৃষ্ণ মারে কে… বলে একটা কথা আছে না বাংলাতে…আমাদের ভাগ্যে ও তাই হ’লো।
আমরা যথাস্থানটিতে গিয়ে হাজির হ’বার খানিক আগেই ঝমঝমিয়ে এমন বৃষ্টি শুরু হ’লো যে আমরা যখন সে’খানে গিয়ে হাজির হ’লুম তখন পথে বেশ জল জমে গেছে।
হঠাৎ জল জমে গিয়ে সেই ভারেতে সব শুদ্ধু সেই কালো কাপড়টা ফচাৎ করে ছিঁড়ে গিয়ে গর্তসই হ’য়ে গেলো আর গর্তের বড়োসড়ো মুখটি খুলে গেলো…তাই দেখেই তখন… ওরে বাবারে একি কান্ড?…এই বলে চালক প্রাণপনে ব্রেক কষে দিলো …ধীরে চলছিলো বলে অটো উল্টে না গিয়ে খানিকটা চাকা ঘষটে এসে চারদিকে জল ছিটিয়ে শেষে অটোটা থেমে গেলো বলে আমাদের সমাধিটা আর হ’য়ে উঠলো না…উঃ..উঃ…আপদ কি গাছে ফলে?
এই যখন অবস্থা তখন সেই গ্রামেতে থাকতে যে আমাদের কেমন সুবিধা আর মজা হ’বে …সে তো বেশ বোঝাই গেলো…সে আর কহতব্য নয়…না আছে লাইট আর না আছে পাথা…এসী ফ্রিজ কুলার বাথটব ও গীজার…সে সব তো দূর অস্ত…
শুধু দেখা গেলো যে গ্রামে পথের ধারে ল্যাম্প পোস্ট বসানো হয়ে গেছে আর পোস্টের মাথায় তার ও লেগেছে তখন আর শুধু গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান বলে জমীদার বাড়িতে তার টেনে লাইট নিয়ে যাওয়া হয়েছে…
তবে আরো কাজ চলছে একটা ট্রান্সফর্মার বসানোর আর মনে হয় তারপরে এখনি স্টীট লাইট না লাগলে ও আগামী তিন মাসের মধ্যে হয়তো সবঘরেই ইলেক্ট্রিকের আলো এসে যাবে… তবে এখন যে আমাদের এই ঝামেলায় পড়তে হ’লো তার কি?
তবে গৌরব দমে যাবার পাত্রই নয়…
গৌরবকে একটা বিদেশী নাইট ভিজন চশমা ও চোখে পরিয়ে দিয়েছিলুম রাতে....কেননা সারা গ্রাম নিষ্প্রদীপ… শুধু বাবুদের দু’তলা বাড়ির তিন চারটে ঘরে লাইট আর চন্ডী মন্ডপে আলো জ্বলছে পেট্রোম্যাক্সের… সে’খানে নাকি প্রতিমা রঙ ও পালিশ করা আর সাজানো হচ্ছে… রাত বারোটা অবধি কাজ চলবে…
কাল পঞ্চমী… প্রতিমার বিশেষ অলঙ্করণ করা হবে আর ঘট স্থাপন ও করা হবে… তার পরের দিন বোধন হবে…ঠিক বাঙালির পূজো না হ’লে ও বাংলার পূজোতো বটেই আর এই পূজোতে শুধুমাত্র এই গ্রামেরই নয় আশে পাশের দশ বারোটা গ্রামের আপামর সবাই হবে আমন্ত্রিত,, এ’টাই বাংলার পূজোর সংস্কৃতি যাকে বলে…অবারিত দ্বার..তা সে যে কোন জাত বা ধর্মের লোকই হোক না কেন? মা যে সবাকারই মা …আর সে না মানলে তখন তো নিজের মা ও পর হয়ে যায় নিজেদের ঘরেই…অর্থাৎ মানলে গঙ্গা আমার মা..পদ্মা আমার মা হ’তে পারে আর না মানলে …সেই যে একটা হিন্দী গান আছে না? মানো তো মৈ গঙ্গা মা হুঁ.. না মানো তো বহতা পানী… তাই আর কি?…
তবে দেখা গেলো যে সে’খানে আমাদের থাকবার জন্যে ব্যবস্থা জমীদার বাড়ির পাশে আলাদা একটা চারদিকে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা আর লোহার গেট লাগানো একতলা ছোট বাড়িতে করা হয়েছে তবে সেই বাড়িতে ও লন্ঠন আর মোমবাতিই ভরসা….
আমরা অটো নিয়ে কোনমতে সেই বড়ির গেট পেরিয়ে সবে ঢুকতে না ঢুকতেই আবার ঝম ঝম করে বৃষ্টি পড়া শুরু হ’য়ে গেলো…আবছা আলোতে সামনেই মনে হ’লো টালির ছাদওয়ালা একটা লম্বা ঘর আর উঁচু দাওয়া …চারটে সিঁড়ি উঠে তবে উঠতে হয় তবে বড়ো দাওয়াতেও টালির চাল আছে বলে ভিজতে হ’লো না…
ম্যানেজারবাবু আমাদের সঙ্গে ছিলেন…
তিনি দরজা খুলতেই দেখি যে সামনেই বড়ো একটা ঘর আর সামনের দেওয়ালে ঠিক সামনে আছে আর একটা দরজা …সেটা খুললে ও’দিকে ও নাকি একটা বারান্দা আছে …. ঘরে সামনা সামনি চারটে জানলা আছে আর ডানদিকে আর একটা দরজা আছে…
আর আছে একটা বিছানাপাতা বড়ো খাট আর তার পাশে একটা গোল টেবিল …তার ওপরে আছে জলের জাগ তিনটে গ্লাশ ঢাকা সমেত…আর একটা লন্ঠন মোমবাতি দেশলাই ও একটা টর্চ…
একটা কাঠের আলমারী গোটা চার কাঠের চেয়ার আর একটা বড়ো টেবিল যেটা ডাইনিং টেবিলের কাজ করতে পারে… ডানদিকের দরজার পাশে আছে একটা কাঠের আলনা … সেই দিকের দরজাটা খুলতে দেখা গেলো আরো একটা ঘর আর সে’খানে আছে একটা জল ভর্তি বড়ো ড্রাম …দুটো বালতি আর মগ.. এক পাশে একটা চাকাওয়ালা স্টিলের ফ্রেমে বসানো একটা বেসিন … একটা গামছা তোয়ালে রাখবার রেক আর একপাশে নতুন বসানো কমোড …এই হ’লো টয়লেট কাম বাথরুম…
‘স্যার…এই আমাদের কুঁড়েঘর …পূজোর কটা দিন একটু কষ্ট করে থাকতে হ’বে স্যার এখানেই আপনাদের… তবে পূজোর কয়েকদিন মানে কাল পঞ্চমী থেকেই সকলের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা তো বাবুদের বাড়িতেই করা হয়েছে…. তাই বেশী অসুবিধা হয়তো আপনাদের হবে না… আর সকাল ও বিকেলের চা জলখাবার সব ঘরেই পাঠিয়ে দেবো স্যার…’
‘তা বেশ…’
‘আজ রাতের খাবার ও বাবুদের বাড়িতে বলা আছে … আপনারা এখন আগে একটু রেস্ট নিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলে ভালো হয়… ততক্ষণে আমি চা টা পাঠিয়ে দিচ্ছি… রাত সাড়ে দশটার মধ্যে ডিনার এসে যাবে ….তবে আমাকে এখন যেতে অনুমতি দিন স্যার… কি আর বলি? ’
আমাদের জিনিষ পত্র সব সেইঘরে এনে রেখে দিয়ে তপনবাবু মানে ম্যানেজারবাবু বিদায় নিলেন আর আমাদের ঘিরে ধরলো এক দারুণ গ্রাম্য নৈশব্দ আর অন্ধকার….যদি ও দাওয়াতে একটা আর ঘরের ভেতরে একটা লন্ঠন বেশ জোরেই জ্বলছিলো …
‘ও… গৌরব… এই হ’লো আমাদের আপাতত আস্তানা…এখানে লাইট নেই পাখা ও নেই গীজার চুলোয় যাক এমন কি বাথটব ও তো নেই…কি করে থাকবো?’
‘ওঃ… বাপী…শহরে থেকে দেখছি তুমি না এখন একটুতেই বড় বেশী ঘাবড়ে যাও… ওই দেখো না …খাটের মাথার কাছে দেওয়ালের তাকে আছে হাতপাখা আর নীচে আছে একটা স্টোভ আর কিছু বাসনপত্র… একটা বড়ো ডেকচি ও আছে… আমি আছি কি করতে বলো তো বাপী? আমি সকালে স্নানের গরম জল রেডি করে নেবো…’
‘ও রে বাবা… তাই তো… এতোবড়ো একটা ছেলে থাকতে আমার আর ভাবনা কিসের? তবে সে ও কি সহজ কাজ হ’বে না কি? এ আমরা কোথায় এসে পড়লুম রে বাবা?’
‘আঃ বাপী তুমি না বড্ড ছটফটে ছেলে একটা…সহজ কাজ হ’বে না কেন বাপী? তবে….’
‘তবেটা আবার কি গৌরব?’
‘বাপী…আমার মনে হয় এই জায়গাটা তেমন বিশেষ সুবিধের নয় কেননা গ্রামের কোন বাড়িতে এমন পাকা পাঁচিল আর বড়ো গেট… এই সব তো থাকবার কথা নয়… বড়ো জোর গরু ছাগল শেয়াল আটকাতে থাকে বাঁশ ও কঞ্চির বেড়া ও তার একটা আগল…তাই মনে হয় যে আমাদের রাত্রিবাস একটু সাবধান হয়েই করতে হবে বাপী…’
‘তার মানে নিশ্চিন্ত হয়ে একটু ঘুমোতে ও পাবো না…ওঃ কি আপদ রে বাবা…’
‘সে যাক…তুমি না বাপী এখন এক কাজ করো…’
‘কি করবো?’
‘বাথরুমে যেতে হবে তো তাই তার আগে দাওয়া থেকে তুমি আলোটা নিয়ে এসো কেননা বাথরুমে তো আলো নেই… তবে…সবার আগে মেন গেটটা বন্ধ করে দিয়ে এসো বাপী…’
‘যো হুকুম মেরে আকা…’
‘এই মা… ছিঃ… ছিঃ বাপী…ওইভাবে কি বলতে আছে নিজের ছেলেকে কখনো? …ঠাকুর তো পাপ দেবেন আমাকে….তা আগে দেখা যাক জলখাবার কি দেয়… তারপরে রাতের খাবার খেয়ে তখন শুয়ে পড়লেই হবে তবে জেনে নিতে হ’বে যে গেটে তালা দেওয়া হয় কি না রাতে…’
চা দুধ বিস্কুটের দেখা মিললো খানিক পরেই আর রাতে মিললো হাতে গড়া আটার মোটা মোটা রুটি দেশী ঘি দেওয়া অড়হরের ডাল বেগুনের ভর্তা মানে পোড়া আর কি…. সাথে আলুকপির তরকারী চাটনী থুড়ি আমের আচার আর মিহিদানার বড়ো বড়ো গোটা দুই করে লাড্ডু…
মনে হয় এখানে এই সব নিরামিশ আর দেহাতের ভোজনই ভরসা…
সেই খাবার দেখে গৌরব ছেলেটা আমার দিকে চেয়ে মুখে এমন একটা অপরূপ সুন্দর ভঙ্গি করলো আর নিজের পাতলা লাল ঠোঁটদুটো টিপে ভ্রুভঙ্গি করে একটু হাসলো যা দেখেই রাগে আমার সারা গা জ্বলে গেলো কেননা এই সব খাবার যে আমি আজ অবধি সাতজন্মে ও কখনো খেয়েছি বলে মনে পড়লো না…
আমি রাগ করে বলে ফেললুম-‘ আরে ছাতার মাথা… তা তোদের লিট্টিপোড়াটাই বা শুধু বাদ গেলো কেন? আর বিশেষ করে তার জন্যে যখন নুন লঙ্কা দিয়ে মাখা বেগুনের ভর্তা ও রয়েছে… সেইটাই তো আমি বুঝতে পারছি না…’
আর তাই শুনেই গৌরব ও নিজের বিশেষ জলতরঙ্গ সুরে খিল খিল করে হেসে ফেললো…’ও বাপী…সে কাল হয়তো দেবে ঠিক …তুমি বাপী একটু ধৈর্য্য ধরোই না বাপী…’
হিঃ..হিঃ,,,হিঃ হিঃ…করে হেসে ছেলেটা একেবারে কুটিপাটি হয়ে গেলো… আর তাই দেখে রাগে তখন আমার ইচ্ছে করছিলো যে গৌরব যেমন ছোটবেলায় তার আমার ওপরে রাগ হ’লেই আমার সাথে করতো ঠিক সেই মতন করে করে দিই তার একটা নরম হাতে ঘ্যাঁক করে এক কামড় বসিয়ে… যত্তো সব জ্বালাতন আর কি…ওঃ..’
তখন আর ক
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।