প্রতিদিন সকালবেলা রাহাত অফিসে বেরিয়ে যায় আর ফিরে আসে একেবারে সন্ধ্যায়। সারাদিন আর বাপ-মেয়ের দেখা হয় না ঠিকই কিন্তু রাতের খাওয়া হয় দু'জনের এক টেবিলে বসে, তারপর কিছুক্ষণের আড্ডা। তাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা এই দু'জনই। ছোট কিন্তু বাপ আর মেয়ের যেন এক অনাবিল শান্তির সংসার। আজ রাতের খাবার খেয়ে ঐশী তার বাবাকে জিজ্ঞেস করল, বাবা কাল তোমার কোন প্রোগ্রাম আছে?
রাহাত কিছুটা অবাক হলো, সে কীরে? আমার আবার প্রোগ্রাম কী? সকালে অফিস, অফিস শেষে বাসা এই তো আমার সারাজীবনের প্রোগাম।
বাবা এর বাইরে কি মানুষের কোন কাজ থাকতে পারে না?
হুঁম তা পারে কিন্তু সাধারণত আমার কোন প্রোগ্রাম থাকে না।
ঐশী কিছুটা আবদারের সুরে বলল, বাবা কাল চলো না একটু আমার সাথে!
কোথায়?
আগে বলো, যাবে?
আচ্ছা তুই বল আমি কখনো তোর কোন কথা না করেছি কিন্তু আগে বলি তো কোথায় যাবি?
টি.এস.সি'তে।
রাহাত আরো অবাক হলো, সে ঐশীর মুখের দিকে তাকিয়ে অনুমান করার চেষ্টা করল কিন্তু বুঝতে পারলো না, কেন বল্তো?
বাবা কাল ভ্যালেণ্টাইনস্ ডে, টি.এস.সি'তে অনুষ্ঠান আছে।
তো এই ভ্যালেণ্টাইন্স ডে'র অনুষ্ঠানে কি আমি যাব?
হাঁ যা।
আচ্ছা দেখি।
ঐশী তার বাবার চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে চুলে আঙ্গুল এলিয়ে দিতে দিতে বলল, বাবা প্লিজ, না করো না কিন্তু।
আচ্ছা ঠিক আছে যাব।
থ্যাংক ইউ বাবা।
ঐশী তার রুমে চলে গেল, রাহাত তার রুমে এসে বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই। দীর্ঘ জীবনের আনন্দ-বেদনার স্মৃতিগুলো যেন তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। রাহাত তখন দিনাজপুর সরকারী কলেজের ছাত্র, কলেজের একটা অনুষ্ঠানে রাহাত সুকান্ত ভট্টাচার্যের ছাড়পত্র কবিতাটা আবৃত্তি করে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে আর সে কারণেই এক কবিতা আবৃত্তির মধ্যে দিয়েই সবাই তাকে এক নামে চিনতো। কয়েকদিন পরই রাহাতের সঙ্গে পরিচয় হলো ফারজানার, ফারজানা তার চেয়ে এক বছরের জুনিয়র কিন্তু কবিতার প্রতি ফারজানারও বিশেষ অনুরাগ থাকায় দু'জনের মধ্যে প্রথমে একটা সুন্দর, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠল। তাদের সম্পর্কটা বন্ধুত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে ভালো হতো, কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত তা গড়ালো প্রেম অবধি, হৃদয় পর্যন্ত।
দিনে দিনে রাহাত আর ঐশী রঙ্গিন স্বপ্ন দেখতে শুরু করল, ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতে শুরু করল কিন্তু ঐশী আর রাহাতের সম্পর্কটা ঐশীর বাবার কানে পৌঁছাতেই ঐশীর লেখাপড়ার ইতি ঘটল, তার চলাফেরা সীমাবদ্ধ হলো বিশাল উঁচু ইট, বালু, সিমেন্ট দিয়ে তৈরি সীমানা প্রাচীর আর অপ্রতিরোধ্য প্রাচুর্যের দেয়ালের মধ্যে।
কয়েকদিনের মধ্যে ঐশীর বিয়ে হলো, কথাটা কানে আসতেই রাহাতের হৃদয় চুরমার হয়ে গেল, জীবনের স্বাভাবিক গতিও হঠাৎ করে স্তব্ধ হলো। তারপর প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে হৃদয়ের লাল দাগ আগুনের লেলিহান শিখার মতো কালো হয়ে, গভীর হয়ে জ্বলতে লাগল।
রাহাতের পড়ালেখার পর্ব শেষ হলো, জীবিকার সন্ধানে ছুটল ঢাকায়, চাকরিও জুটল একটা বেসরকারি কোম্পানিতে। পরিশ্রম, মেধা, সততার কারণে সে অল্প দিনে কোম্পানির একজন কর্ণধারে হয়ে উঠল বটে কিন্তু ততদিনে বয়স অতিক্রম করল চল্লিশের কোঠা। একসময়ের আবেগপ্রবণ সবুজ হৃদয়টা তামাটে হয়ে গেছে, তাই আবেগের বশে নয় নিতান্তই সামাজিকতা রক্ষার জন্য বিয়ের পিঁড়িতে বসার আয়োজন শুরু হলো।
মেয়েটির নাম তিন্নি, সংস্কৃতি মনা মেয়ে, কবিতা আবৃত্তি, নাচ-গান এমনকি একটু-আধটু মঞ্চ নাটক করারও অভ্যাস আছে। সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রতি অনুরাগ থাকায় রাহাত মনে মনে খুশিই হলো। উচ্চ শিক্ষা অর্জন এবং উচ্চ শিক্ষিত মেয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্রের অভাবে মেয়ের বয়সটা গেছে বেড়ে, তা নিয়ে রাহাতের কোন অনীহা নেই, নিজেই যখন বিয়ের বয়স অনেক আগেই অতিক্রম করেছে তখন স্ত্রীর বয়সের সমালোচনা করা অর্থহীন।
শুভবিবাহ সম্পন্ন হলো। সংসার নামক তরীর পালে সবেমাত্র বাতাস লাগতে শুরু করেছে ঠিক তখনই তিন্নি আবার অতীত জীবনের মতো লাগামহীন স্রোতে গা ভাসিয়ে দিল। রাহাত প্রথম প্রথম বুঝতে পারেনি, ধীরে ধীরে সেও টের পেল তিন্নি বয় ফ্রেন্ডদের সঙ্গে ক্লাবে যাওয়া, গভীর রাতে ড্রিংক করে বাসায় ফেরা।
ততদিনে তাদের কোল জুড়ে ফুটফুটে সুন্দর একটা বাচ্চা এসেছে, রাহাত তিন্নিকে নিজের জন্য না হোক অন্তত তাদের সম্পর্কের বন্ধন ঐশীর মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে সংসারের প্রতি মনোযোগী হওয়ার জন্য চেষ্টা করল কিন্তু তার ভালোবাসা, ঐশীর অধিকারকে অপমান করে সে একদিন তার এক বয় ফ্রেন্ডের হাত ধরে কানাডায় পাড়ি জমালো। তখন থেকে রাহাত ঐশীকে বাবা-মা'র আদর দিয়ে মানুষ করেছে। ঐশী এখন ঢাকা ভার্সিটিতে অনার্স পড়ছে কিন্তু সে যেন একেবারে অন্যরকম, মায়ের মতো একটি আচরণও তার মধ্যে নেই। ঐশী খুবই নিরিবিলি এবং সাধারন জীবন-যাপন করে, বাবার কষ্ট বোঝে, তার জন্য বাবার নিজেকে উৎসর্গ করাকে সে শ্রদ্ধার চোখে দেখে, এমনি নানান কথা ভাবতে ভাবতে রাহাতের চোখ থেকে কয়েকফোঁটা পানি বালিশে গড়িয়ে পড়ল। সে কাত ফিরে দু'চোখ বন্ধ করে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করল।
নিত্য দিনের মতো সকালবেলা নাস্তা তৈরি করে ঐশী বাবাকে ডাকতে গেল। কিন্তু এ কি? সকাল আটটা বাজে, বাবার দরজা বন্ধ দেখে ঐশী অনেক ডাকাডাকির পর বাবা দরজা খুলল, কী রে মা?
ঐশী বাবার চোখ-মুখ দেখে চমকে উঠল, কী হয়েছে বাবা? তোমার চেহারা এমন কেন?
কই কিছু হয়নি তো।
কিছু হয়নি মানে? তুমি সারারাত ঘুমাওনি মনে হচ্ছে।
না, কিছু হয়নি, তোমরা মেয়েরা সবসময় শুধু মুখ শুকনো দেখো, বলে রাহাত একটা শুষ্ক হাসি হাসল।
আচ্ছা ঠিক আছে তাড়াতাড়ি হাত মুখ-ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে আসো।
আচ্ছা আসছি।
নাস্তার টেবিলে রাহাত টি.এস.সি যেতে মৃদু আপত্তি করল, আচ্ছা ঐশী আমার না গেলে হয় না?
ঐশী শাসনের সুরে বলল, বাবা, আর না বলবে না, অফিসের অজুহাত দেখাবে না, অফিসে ফোন করে বলে দাও তুমি আজ আসছ না।
আচ্ছা ঠিক আছে।
গাড়ি শাহবাগ মোড়ে আসতেই টি.এস.সি থেকে কবিতা আবৃত্তির ধ্বনি কানে ভেসে এলো। তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, মধ্যবয়সী পুরুষ-মহিলা, সব বয়সের প্রেমিক-প্রেমিকারাও আজকের মেলায় অংশগ্রহণ করেছে। কেউ ফুচকা খাচ্ছে, কেউ চানাচুর, চটপটি, ঝালমুড়ি নিয়ে ব্যস্ত। কেউবা পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে বিগত দিনের স্মৃতিগুলো আবার উপভোগ করছে। আবার কোথাও দুয়েকজন খাপছাড়া মানুষ যে নেই এমন নয়, কোথাও কোথাও দু'একজন মধ্যবয়সী মানুষও চোখে পড়ল। কেউবা নিঃসঙ্গ হয়ে দূর থেকে দাঁড়িয়ে কবিতা আবৃত্তি শুনছে। কারো চোখে-মুখে হতাশা আর সীমাহীন বেদনা ও ক্লান্তির ছাপ। রাহাত মনে মনে ভাবছে এখানে যেমন পরষ্পরকে কাছে পাওয়া জুটি আছে তেমনি তার মতো ব্যর্থ প্রেমিকও আছে। টি.এস.সি দিয়ে রাহাত ঐশীর হাত ধরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢুকল। তার হৃদয়ে যেন অনেক বছর আগের ফারজানার স্মৃতিগুলো ভেসে উঠল। রাহাতের চোখের কোণা পানিতে ভরে গেল। ঐশীর হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে রাহাতের চোখে পড়ল আগত এক রমণীর মুখচ্ছবি, সেই-ই পথচলা। রাহাত চোখ থেকে চশমা খুলে পরিস্কার করল, তার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা তপ্ত পানি গড়িয়ে পড়ল। টি.এস.সি থেকে তখন ভেসে আসছে জীবনানন্দ দাশের কবিতা-
তোমাকে দেখার মতো চোখ নেই-তবু,
গভীর বিস্ময়ে আমি টের পাই-তুমি
আজো এই পৃথিবীতে রয়ে গেছ।
কোথাও সান্ত্বনা নেই পৃথিবীতে আজ
বহুদিন থেকে শান্তি নেই।