এক পা দু’পা করে সামনে হাটছে রাহেলা। মন্থর গতি, চোখ আটকে আছে একটি ফলকের দিকে। ফলকের লেখাটি বার বার পড়ছে সে। তার সাথে তার ছেলে ছিল। ছেলে এখন বাইরে গেছে। ছেলে যাওয়ার পর তার চোখ পড়লো ঐ ফলকের দিকে। ফলকের লেখা পড়ে সে স্তব্ধ হয়ে গেলো। সে এমন স্তব্ধ আরো একবার হয়েছিল। যে সময় তার স্বামীর মৃত্যু হয়েছিল। আজ বড়ই মনে পড়ছে তার প্রিয় স্বামীর কথা, যে চৌদ্দ বছর পূর্বে তাকে ছেড়ে চলে গেলো। সে সময় একা হয়ে পড়েছিল সে। এখন একেবারেই একা হয়ে গেলো।
সে কোলাহলে মুখরিত এক পরিবারে ছিল। কত আনন্দ ছিল সে সময়ে। তার শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ, দেবর তার মা-বাবা, ভাই-বোন, সবাই মিলে এক পরিবার। কত যে সুখ। তার কোন কিছু চাওয়ার ছিলো না। পাওয়ার আনন্দে সে বিভোর থাকতো প্রতিমুহুর্ত। চারদিকের লোকগুলো তাকে খুশি করতে মরিয়া। এ সকল অনন্দের মাঝে আরেক দাপ খুশির জোয়ার বাড়িয়ে কোলে এলো দুলাল। আদরের দুলাল। পরিবারের সবার মধ্যমণি আগত দুলাল। ধীরে ধীরে দুলাল বড় হচ্ছে। তাদের পরিবারের অটুট বন্ধন ও সুখের পায়রা আরো যেন বেড়ে যাচ্ছে। ফেনী নদীর পাশে, মহুরী চরে তার বাড়ি। শহরের পর গ্রাম। গ্রামের পর গ্রাম এরপর নদী। নদীর পর চর। রাস্তাঘাটতো নেই। আইল ধরে হাঁটতে হয়। বাজার অনেক দূরে সোনাগাজী শহর বা বারইয়ারহাট। পাঁচ মাইল হেঁটে তবে কোন গাড়ি পাওয়া যায়। তার বাপের বাড়ি শহরতলী সিলোনিয়া বাজারের পাশে। ফেনী কলেজে পড়াকালিন মাজেদের সাথে পরিচয়। এরপর পারিবারিকভাবে বিয়ে। বিয়ের পর এ চরেই তার কেটে গেলো কয়েকটি বছর।
এখন তার চিন্তা দুলাল কে নিয়ে। তাকে কিভাবে পড়া লেখা করাবে? এ গ্রামেতো কোন ভাল প্রতিষ্ঠান নেই। তাই সে মনে মনে স্থির করেছে স্বামীর সাথে ঢাকা থাকবে। ছেলেকে মানুষ করবে। একদিন স্বামীকে তা বলল। মাজেদ রাজি। তবে বাড়ির কেউ রাজি না। শেষ পর্যন্ত রাহেলা ঢাকায় এলো। ঢাকায় এসে ধানমন্ডি কলাবাগান লেকের পাশে তিন তলায় তিন রুমের একটি ফ্ল্যাটে উঠে। মাজেদ সোনালী ব্যংকে দু’বছর হলো চাকরি করছে। এখন মতিঝিল শাখায় কর্মরত। দুলালকে ইংলিশ মিডিয়াম একটি স্কুলে ভর্তি করালো। সে নিজেই স্কুলে দিয়ে যায় ও নিয়ে আসে। ছেলে তার মেধাবী। কৃতিত্বের সাথে পঞ্চম শ্রেণী উত্তীর্ণ হলো। ষষ্ঠ শ্রেণীতেও উত্তীর্ণ হলো। সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করিয়ে বাসায় আসার পথে মাজেদ এক্সিডেন্ট করে। ছেলে যদিও প্রাণে বেচে যায়। তবে তার স্বামী কোমায় চলে যায়। ঢাকা মেডিকেলে বিশ দিনের মাথায় মাজেদ না ফেরার দেশে চলে যায়। কোমা থেকে আর ফেরে আসে না।
রাহেলার জীবনে নেমে এলো এক দুর্যোগ। সাইক্লোন বা সিডরও বলা যায়। যার তীব্রতায় রাহেলা বেগম স্তব্ধ। এতদিনে বাড়ির সাথে অনেক দূরত্বে এসে দাঁড়িয়েছে তারা। এক প্রকার যোগযোগ নেই বললেই চলে। সে কি করবে? কিছুই তার মাথায় ধরছে না। ছেলের ভবিষ্যত। তার নিজের জীবন। তবে তাকে হারমানলে হবে না। এগিয়ে যেতে হবে। সে পথ খুজতে লাগলো। অয়ের পথ। বেচে থাকার পথ। এগিয়ে যাওয়ার পথ। তার স্বামীর কিছূ টাকা ছিল সে টাকাকে পুঁজি করে সে কাজে নেমে গেলো। সেলাই মেশিন ক্রয় করলো। সেলাই কাজ শিখে তা করা শুরু করলো। নিউ মার্কেট, গাউছিয়া সহ বিভিন্ন মার্কেট থেকে কাজ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। সেই সকাল থেকে তার কাজ শুরু। ঘর গোছানোতো আছেই। কাপড় নিয়ে আসা। সেলাই করা। ফুলের কাজ করা। তারপর তা কয়েক মাইল হেঁটে হেঁটে দোকানে ও মার্কেটে দেয়া। আবার টাকা সংগ্রহ করে বিকালে বাসায় ফিরে আসে ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে। এমনি শত কষ্টের ভেতর ছেলের সকল চাওয়া পূর্ণ করে চলেছে। ছেলের প্রাইভেট খরচ। স্কুল খরচ। যাতায়াত ও টিফিন খরচ সব সুন্দর ভাবেই মিটাচ্ছে। রাহেলাকে যদি এখন তার পূর্বের পরিচিত কেউ দেখে চিনতেই পারবে না। আগের সেই সুন্দর দেহ, চেহারা কিছুই তার বাকি নেই। রোদ ও রাত-দিন খাটুনি তার সব নিয়ে গেছে। তবুও তার আশা যদি তার ছেলেকে বড় মানুষ করা যায়। ছেলেকে কোন দিন এতটুকু কষ্টও বুঝতে দেয়নি। এমনি করে মেট্রিক, থেকে শুরু করে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার বানানো পর্যন্ত সে কাজ করেছে।
এখন তার আদরের দুলাল উত্তরা বড় ফার্মে চাকরি পেয়েছে। তাড়া না করে বিয়ে করেছে বড় লোকের মেয়ে দেখে। দেখতে দেখতে কতবছর সে পার করে দিলো। এখন তার কয়েকটি বছর সুখেই যাচ্ছে। যেন সে হারানো সুখ আবার ফিরে ফেল। তার সকল কষ্ট যেন শেষ হলো। কাজ করা বন্ধ করে দিলো। তার গতর ও চেহারায় কিছু পরিবর্তন এলো। শরীরে আগের চেয়ে অনেক শক্তি অনুভব করতে লাগলো। যেন সে ফিরে যাচ্ছে তার যৌবনে। সে অনেক সময় অদৃশ্য স্বামীকে লক্ষ্য করে বলে, দেখ দেখ তোমার ছেলেকে আমি আজ কোথায় এনে দাড় করিয়েছি।
অনেক দিন পর নতুন শাড়ি পেল। মৃত্যু পর্যন্ত সুখেই কাটাবে। দুলালের গাড়ি হয়েছে। উত্তরায় বাড়ি হয়েছে। একটি নাতীও এলো। তার আর কী চাই?
আজ প্রথম দুলালের গাড়িতে উঠল সে। গাড়িতে উঠার পর সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে গেলো। খুব ভাল লাগছে। কি এক অজানা ঘ্রাণে মৌহিত হলো। গাড়ি চলছে সেই সব পথে যে পথে সে হেঁটে হেঁটে এক সময় কাপড় আনতো, আবার তীব্র রোদে হেঁটে কাপড় দিতো, টাকা সংগ্রহ করতো। পাশেই তার ছেলে, ছেলেকে বলছে বাবা এ রাস্তাগুলোতেইতো মা-ছেলে এক সময় হেঁটে হেঁটে গিয়েছি। ঐ দেখ নিউ মার্কেট, কত যে হেঁটেছি এ পথে। দোকানে দোকানে। রাহেলার চোখ ভিজে গেলো। অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। আনন্দের অশ্রু। গাড়ি চলছে। এক সময় গাড়ি থামলো। সে গাড়ি থেকে নামলো সাথে তার ছেলে। তার ছেলে দুলাল বলল, মা আমি আসছি। জায়গাটি সুন্দর এখানে থাকো। মা বলল আচ্ছা। সাবধানে যাবে ও আসবে। তাড়াতাড়ি আসবে। আমি অপেক্ষায় আছি।
দুলাল গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলো। মনে হয় কোন কাজে গেছে। ফিরে আসবে। একটি লোকের সাথে কি যেন বলল তার দুলাল। রাহেলা বসে আছে। দু’টি মেয়ে আসলো। বলল আমাদের সাথে চলুন। রাহেলা বলল চল, দুলাল আসা পর্যন্ত একটু ঘুরে দেখি। জায়গাটি সত্যিই সুন্দর। একটি লম্বা বড় ঘর। তার সামনে মাঠ। মাঠে লাগানো হয়েছে ফুল গাছ। গাছে গাছে বিভিন্ন ফুল ফুটে আছে। ফুল হাসছে। নাকে ঘ্রাণও লাগছে। কোন ফুলের ঘ্রাণ সে ঠিক করতে পারছে না। কামিনি না গন্ধরাজ।
তার ডান পাশের লম্বা ও ফর্সা মেয়েটি প্রশ্ন করলো? আপনার ছেলের বুঝি অনেক টাকা? হ্যাঁ আমার ছেলের অনেক টাকা সে বলল। তার শ্বশুরেরও অনেক টাকা। বাম পাশের মেয়েটি বলল ও আচ্ছা? কথা বলতে বলতে তারা হাঁটছে। কিছু সামনে অগ্রসর হতেই তার চোখ পড়লো ঐ ফলকের উপর। সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। বার বার ফলকের লেখাটি পড়তে লাগলো। আবার পড়তে লাগলো। স্তব্ধ সে পুরাপুরিই স্তব্ধ। নির্বাক, নিশ্চল, বিমুঢ় হয়ে পড়তে লাগলো। শুধু পড়তেই লাগলো। বৃদ্ধাশ্রম। বৃদ্ধাশ্রম। বৃদ্ধাশ্রম। মেয়ে দু’টি বলতে লাগলো হাঁটুন? হাঁটছেন না কেন? সামনে চলুন। সামনের ঘরেই আপনার থাকার রুম। জানালার পাশে। জানালা দিয়ে পিছনে অনেক ফুল বাগান আছে তা দেখতে পারবেন। চলুন। তার কোন রা নেই।
হঠাৎ তার স্বামীর যেন আওয়াজ শুনতে পেল। তার স্বামী যেন তাকে ডাকছে। না সে আর শুনতে পাচ্ছে না। সে পড়ছে তো পড়ছে বৃদ্ধাশ্রম। বৃদ্ধাশ্রম। বৃদ্ধাশ্রম। তার মাথা ঘুরছে, ঘুরতে ঘুরতে দেখতে পাচ্ছে, তার শৈশব, বিবাহের আগের ও পরের জীবন, ঢাকার দীর্ঘ সুখ দুখের স্মৃতির পাতা। এক সময় তার মাথাঘুরা বন্ধ হলো। অতীত স্মৃতি দেখা বন্ধ হলো, ফলকে লেখা বৃদ্ধাশ্রম পড়াও বন্ধ হলো। মেয়ে দু’টি দেখতে পাচ্ছে তাদের মধ্যখানে থাকা মহিলাটি ধীরে ধীরে নেতিয়ে যাচ্ছে। বসে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে পুরো শরীর মটিতে এলিয়ে দিলো।
১৯ জানুয়ারী - ২০২১
গল্প/কবিতা:
১ টি
সমন্বিত স্কোর
৪.১
বিচারক স্কোরঃ ২.৭ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ১.৪ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪