রাত প্রায় এগারোটা। জয়চন্দ্রের চোখ দুটো জ্বলছিল কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে। এক্সেল শিটের সংখ্যাগুলো আর পাওয়ারপয়েন্টের স্লাইডগুলো তার কাছে অর্থহীন মনে হচ্ছিল। এয়ার কন্ডিশনারের একটানা শব্দে অফিসটা যেন এক হিমশীতল কবরখানা। ঢাকার অন্যতম বড় একটি বহুজাতিক কোম্পানির সিনিয়র মার্কেটিং ম্যানেজার জয়। আকর্ষণীয় বেতন, কোম্পানির গাড়ি, আর সমাজের চোখে ঈর্ষণীয় এক জীবন। কিন্তু কাঁচের দেয়ালের ওপারে জয়চন্দ্রের ভেতরটা ছিল একদম ফাঁপা।
গত পাঁচ বছর ধরে সে এই যান্ত্রিক জীবনের চাকা ঘুরিয়ে চলেছে। প্রতিটি দিন শুরু হয় ট্র্যাফিক জ্যাম ঠেলে অফিসে পৌঁছানোর মাধ্যমে আর শেষ হয় মধ্যরাতে ক্লান্ত শরীরটাকে বিছানায় ফেলে দিয়ে। এর মাঝে হারিয়ে গেছে শখ, হারিয়ে গেছে সম্পর্কগুলো। মায়ের ফোনটাও প্রায়ই ধরা হয় না মিটিংয়ের অজুহাতে। বন্ধুদের আড্ডা এখন অতীত। তার পৃথিবীটা হয়ে গিয়েছিল ডেডলাইন, টার্গেট আর প্রেজেন্টেশনের এক চক্রব্যূহ।
সেদিন রাতে একটা নতুন ক্যাম্পেইনের ফাইনাল স্লাইড বানাতে গিয়ে জয়চন্দ্রের হঠাৎ সবকিছু অসহ্য মনে হলো। সে চেয়ারটা পেছনে ঠেলে দিয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। নিচে তাকিয়ে দেখল, নিয়ন আলোয় ভেসে যাওয়া ব্যস্ত শহর। কিন্তু এই শহরের কোলাহলের সাথে নিজের কোনো সংযোগ খুঁজে পেল না সে। জানালার কাঁচে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে চমকে উঠল জয়। এক ক্লান্ত, অপরিচিত মুখ। এই চেহারাটা তার নয়। সে তো এমন হতে চায়নি।
হঠাৎ তার মনে পড়ল বাবার কিনে দেওয়া পুরোনো ইয়াসিকা ক্যামেরাটার কথা। ধুলো পড়া সেই ক্যামেরাটা আলমারির এক কোণায় পড়ে আছে। ফটোগ্রাফি ছিল তার প্যাশন। মানুষের মুখ, প্রকৃতির রং, জীবনের ছোট ছোট মুহূর্তগুলো ক্যামেরাবন্দী করতে তার ভালো লাগত। কবে শেষ সে ক্যামেরাটা হাতে নিয়েছে, মনে করতে পারল না জয়।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে নিজের ডেস্কে ফিরে এলো। এক্সেল শিট বা পাওয়ারপয়েন্ট নয়, সে খুলল একটা নতুন ওয়ার্ড ডকুমেন্ট। সাবজেক্ট লাইনে লিখল: "Resignation Letter"।
এক মুহূর্তের জন্য হাতটা কাঁপল। ভয় হলো। এই নিশ্চিত জীবন, এই সামাজিক মর্যাদা ছেড়ে দেওয়ার ভয়। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হলো, যে জীবনে নিজের অস্তিত্বই নেই, সেই জীবনের নিরাপত্তা দিয়ে কী হবে? সে লিখতে শুরু করল। প্রতিটি শব্দ যেন তার বুকের উপর থেকে এক বিশাল পাথর সরিয়ে দিচ্ছিল। কোনো অভিযোগ নয়, কোনো ক্ষোভ নয়, শুধু নিজের পথ খুঁজে নেওয়ার একটা আকুতি ছিল সেই চিঠিতে।
পরদিন সকালে বসের টেবিলে পদত্যাগপত্রটা জমা দেওয়ার মুহূর্তটা ছিল অদ্ভুত রকমের শান্ত। বস অবাক হলেন, বোঝানোর চেষ্টা করলেন, প্রমোশনের লোভ দেখালেন। কিন্তু জয়চন্দ্রের সিদ্ধান্ত ছিল চূড়ান্ত।
অফিস থেকে শেষবারের মতো বেরিয়ে আসার পর তার মনে হলো, সে যেন বহুদিন পর প্রাণভরে শ্বাস নিচ্ছে। বন্ধুরা অবাক হলো, কেউ কেউ বলল 'পাগলামি'। পরিবার দুশ্চিন্তায় পড়ল। কিন্তু জয়চন্দ্র জানত, সে ঠিক কাজটাই করেছে।
তার পরের সকালটা ছিল ভিন্ন। অ্যালার্মের শব্দে নয়, পাখির ডাকে তার ঘুম ভাঙল। সে আলমারি খুলে ধুলো ঝেড়ে বের করল তার পুরোনো ক্যামেরাটা। লেন্সটা মুছে, নতুন ফিল্ম ভরে সে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়।
পুরোনো ঢাকার অলিগলি, সদরঘাটের ব্যস্ততা, টিএসসির চায়ের কাপের আড্ডা—সবকিছুকেই তার নতুন মনে হতে লাগল। সে ছবি তুলতে শুরু করল। রিকশাওয়ালার ঘর্মাক্ত মুখের হাসি, উড়ন্ত পায়রার ঝাপটা, পথশিশুর অবাক চাহনি—প্রতিটি ক্লিক তাকে জীবনের কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছিল।
কয়েক মাস পর জয় তার জমানো টাকা দিয়ে একটা ছোট স্টুডিও খুলল। সাথে শুরু করল একটা ফটোগ্রাফি ব্লগ। তার তোলা ছবিগুলো মানুষের ভালো লাগতে শুরু করল। ধীরে ধীরে পরিচিতি বাড়তে লাগল। এখন আর তার রাত জাগতে হয় না অর্থহীন স্লাইড বানিয়ে, কিন্তু প্রায়ই রাত কেটে যায় পছন্দের কোনো ছবি এডিট করতে করতে। ক্লান্তি আছে, কিন্তু তাতে মিশে আছে গভীর আত্মতৃপ্তি।
জয়চন্দ্র প্রায়ই ভাবে, সেদিনের সেই পদত্যাগপত্রটা আসলে কোনো চাকরির শেষ ছিল না, ওটা ছিল তার নতুন জীবনের নিয়োগপত্র। সে একটা চাকরি থেকে পদত্যাগ করে নিজের জীবনে নিযুক্ত হয়েছিল।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
গল্পের বিষয়বস্তুর সঙ্গে "নতুন জীবনের নিয়োগপত্র" শিরোনামটি অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সংক্ষিপ্ত সামঞ্জস্য বিশ্লেষণ:
গল্পটি একজন সফল কিন্তু মানসিকভাবে ক্লান্ত পেশাজীবী—জয়চন্দ্রকে ঘিরে, যে যান্ত্রিক জীবনের নিষ্ঠুর চক্র থেকে বেরিয়ে এসে নিজের স্বপ্ন ও ভালোবাসার পথ বেছে নেয়। তার পদত্যাগপত্র শুধু একটি চাকরি ছাড়ার ঘোষণা নয়, বরং একটি নতুন, অর্থপূর্ণ জীবনের সূচনা। যেখানে সে জীবনের রঙ, মানুষ, মুহূর্ত ও স্বকীয়তা খুঁজে পায় ফটোগ্রাফির মাধ্যমে।
সারাংশে, এই শিরোনাম প্রতীকীভাবে জীবনের মোড় ঘোরানোর সিদ্ধান্তকে তুলে ধরেছে—যেখানে পদত্যাগ নয়, বরং আত্ম-আবিষ্কারের নিয়োগই মুখ্য।
১৪ ডিসেম্বর - ২০২০
গল্প/কবিতা:
৩ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“ ” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ , থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।
প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী