সোনালীর দেশে

আমার দেশ আমার অহংকার (ডিসেম্বর ২০২০)

Ferdous
  • ৬৮
আমি যে সোনালীর ভাষা বুঝতে পারি, তা কি তোমরা জানো?

আচ্ছা, তার আগে তো জানা দরকার সোনালী টা কে?কোথায় তার বাড়ি?
বলছি সে সব।সোনালী আমার বন্ধু। ছোট্ট একটা পাহাড়ের পাদদেশের নদীতে তার বসবাস।ছোট্ট একটা মাছ।সারা শরীর সোনালী আঁইশে ভরা আর লেজটা লালচে সোনালী রঙের।চোখ দুটো লাল-কালোর মিশ্রণ।মাঝে মাঝে মনে হয়,সে রাগে চোখ রাঙিয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে।ভাইয়া বলে, মাছটার নাম নাকি মহাশোল।কিন্তু আমি নাম দিয়েছি সোনালী।
সোনালী দেখতে কি যে সুন্দর!শুধু কি সুন্দর? ভীষণ দুরন্তপনা স্বভাব তার।কিন্তু সেসব দুরন্তপনা ছিল যখন সে নিজের দেশে ছিল।ওহ্....সোনালীর দেশটা কোথায় এইবার নিশ্চয়ই বুঝে গেছ।
ওর দেশ হলো নদীতে।আঁকাবাঁকা চকমকে রোদমাখা নদী। স্বচ্ছ পানির নদীতে সোনালীর আবাস। নদীর পাথর-নুড়ির ফাঁকে ফাঁকে পেরিফাইটন নামের এক রকমের শ্যাওলা জন্মে। এগুলোই সোনালীর প্রধান খাবার।সে নদীতে সোনালীর কী যে ছোটাছুটি!
দাদু বললেন,'নিজের স্বাধীন দেশ হলো সবচেয়ে খুশির জায়গা।নিজের দেশে নিজের মতো সবাই সবকিছু করতে পারে।কেউ চাইলে গান গাইল আবার কারো ইচ্ছা হলে নাচল।ঠিক তেমনি সোনালী ও গায়ে পানি লাগিয়ে গান গাইত আর নাচত।টেংরা,পুঁটির দলে গাঁ ভাসিয়ে দিত আর নিজেকে রাজা ভাবত আবার মাঝে মাঝে গল্পের আসর জমাত।ইচ্ছে হলে চুপটি করে ঘাপটি মারত কাতলা মাছের ডেরায়।
সমুদ্র থেকে ইলিশ যখন ডিম পারতে আসত,ইলিশের সঙ্গে সঙ্গে সোনালী ও ডিম পাহারা দিত।ইলিশগুলো খুশি হয়ে সোনালীকে আদর করে দিত।নদী জুড়ে সোনালীর ছিল খেলার জায়গা,ঘুরার জায়গা আর বেড়ে ওঠার জায়গা।
কিন্তু সোনালী নদীতে থাকতে পারল কই?
জাল ফেলে,বুদ্ধি খাটিয়ে,নদী থেকে জোর করে জেলেরা বাজারে নিয়ে এল।
বাজারে আসতেই বাবা তাকে বাসায় কিনে নিয়ে আসল।আর ভাইয়া বুদ্ধি খাটিয়ে তাকে আঁটকে রাখে বয়ামে।সেই থেকে সোনালী বয়ামে থাকে। অল্প জায়গায় ঠিকমতো নড়তে পারে না।খেলবে কেমন করে?
দাদু বলে, 'এই মাছটাকে ছেড়ে দেয়।'
ভাইয়া বলে,না না।আমি ও কে খেতে দিই।প্রতিদিন গোসল করিয়ে দিই,থাকতে দিই,আমি আর রাতুল খেলি ওর সাথে।ওর সময় কেটে যায়।ও কে ছেড়ে দিতে হবে কেন?
দাদু বলেন,'নিজের দেশে থাকতে না পারার কষ্ট অনেক।দেখ না, ও কেমন মনমরা হয়ে থাকে।কম নড়াচড়া করে।সে বুঝে গেছে, এখন সে অন্যের অধীনে আছে।দাদু ভাই,মনে রেখ কাউকে জোর করে পোষ মানানো যায় না।'
ভাইয়া শুধু হাসে।কিন্তু সোনালীকে ছাড়ে না।
দুপুরবেলায় সবাই যখন যে যার কাজে ব্যস্ত থাকে তখন আমি সোনালীর কাছে যাই।সোনালীর সাথে কথা বলি।বলে,ভাল্লাগে না কিছু।এখানে একটু সাঁতার কাটতে পারি না,খেলতে পারি না ঘুরতে পারি না,প্রতিদিন একই খাবার একটু মুড়ি আর একটু ভাত আর সাগর থেকে যেসব অতিথিরা আমাদের গ্রামে ডিম দিতে আসত তাদেরকে খুব মনে পড়তেছে।পাথর আর শ্যাওলাকে খুব মিস করতেছি।কতদিন নরম তুলতুলে শ্যাওলার উপর ঘুমায় না!
আমি বলি,ভাইয়া খুব যা-তা।কখন কি যে করে!আমাদের কারো কথা শুনছেন না,সোনালী!তুমি রাগ কর না। বাবা-মা,দাদু,আমি আমরা সবাই ভাইয়াকে এতো করে বুঝাচ্ছি তোমাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য কিন্তু ভাইয়া কিছুতেই রাজী হচ্ছে না।আচ্ছা, আমি কি তোমাকে ছেড়ে দেব?
সোনালী বলে,'না না।আমাকে যেখানে সেখানে ছাড়লে আমি বাঁচব না!আমাকে ছাড়তে হবে আমার দেশে।পানিতে। নদীতে।সাঙ্গুর তীরে।যেখানে স্বাদু পানি আছে।
আমার খুব কষ্ট হয় সোনালীর জন্য। সোনালী চোখের দিকে তাকালে মনে হয় সোনালীর লাল-কালো মিশ্রণের চকচকে চোখগুলো কেমন জানি কালো হয়ে গেছে।মনে হচ্ছে, সে কান্না করছে।ভাইয়াকে এইসব বললে,সে খুব হাসে।আর বলে,মাছ আবার কাঁদে?মাছ আবার কথা বলে?
মাছের আবার স্বাধীনতা,নিজের দেশ?ভাইয়া হাসতে হাসতে চলে যায়।
এর মধ্যে একদিন ভাইয়া তার স্কুলের লিফটে আঁটকে গেল।ওই এলাকায় কি একটা সমস্যার কারণে ওইদিন কারেন্ট আসতে দেড় ঘন্টা লেগে যায়।ভাইয়ার কান্না আর ঘামে পুরো শার্ট ভিজে একাকার।মনে হচ্ছে, এই মাত্র স্নান করে বের হয়েছে।ওইদিন ভাইয়া আর ক্লাস না করে সোজা বাসায় এসে মাকে জড়িয়ে ধরে কি যে কান্না!লিফটে আঁটকে থাকার পর এতো ভয় পেয়েছে সেদিনের পর থেকে যেখানে যায় মাকে সাথে নিয়ে যায়।কয়েকদিন পর ভয়টা একটু কাটতেই সে গেল সোনালীর বয়ামের কাছে আর বয়ামটা হাতে নিয়ে কি যেন ভাবতে লাগল।
আমি বললাম,ভাইয়া এত কি ভাবিস?
ভাইয়া বলল,আমি যেমন লিফটে আঁটকে পড়েছিলাম সেও একটা বয়ামে আঁটকে পড়ছে, তাই না?
: হুম,ওর জন্য আমার খুব কষ্ট হয়।
: আর অনেক ভয়!আটকে পড়লে কেমন লাগে সেটা আমি এখন বুঝি।
দাদু পেছন থেকে এসে বলল,'তাহলে এবার কি করবি দাদু ভাই?'
ভাইয়া বলল,'সোনালীকে এবার তার দেশে পাঠানোর জন্য পাসপোর্ট করব।'
দাদু আর আমি হাসলাম।আর আমাদের হাসিটাকে স্মৃতিময় করার জন্য সোনালী ও যোগ দিল।আমি তা স্পষ্ট দেখলাম।
সময় ঠিক করে পরের দিন দাদু, ভাইয়া,আমি আর সোনালী হাজির হলাম সাঙ্গু নদীর তীরে।দাদু বললেন,'যতই ভালো জায়গায় থাকো,নিজের দেশের মতো আরাম কোথাও নেই।নিজের দেশের মতো খুশি মনে স্বাধীনভাবে পৃথিবীর অন্যকোন দেশে থাকা যায় না।আমরা সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর এতোগুলো আন্দোলন করেছি নিদিষ্ট ভূখণ্ড,মানচিত্র, একটি পতাকার জন্য। আর সাথে নিজের মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্য,স্বাধীনভাবে চলতে পারার জন্য,সবাইকে ভালোবাসতে পারার জন্য প্রভৃতি।দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা সেসব পেয়ে গেছি।দাদু আরো বললেন,
"আমার দেশ ধানের দেশ,
গানের দেশ,
বীরের দেশ,
রূপসী বাংলার দেশ,
মরমী সাধকের দেশ,
তেরশ নদীর দেশ,
আমার দেশ আমার অহংকার। '

আমার দেশ আমার কাছে যেমন প্রিয় ঠিক তেমনি সোনালীর দেশও সোনালীর কাছে প্রিয়। দেখবি ও নিজের দেশে ফিরে গিয়ে সবার সাথে খেলবে,ঘুরবে,গান গাইবে, নাচবে অর্থাৎ যাই খুশি তাই করবে।
এই কথাগুলো শুনার পর ভাইয়ার মন আরও নরম হয়ে গেল।ভাইয়া সোনালীকে পানিতে ছেড়ে দিল।সোনালী লেজটা একটুখানি বাঁকিয়ে পানিতে চট করে ঢুকে গেল।আমাদের মনটা খারাপ হয়ে গেল।আহা রে!কতদিন ছিল আমাদের সাথে।সোনালীর সাথে আমার কতই না ভাব ছিল! কত স্মৃতি আছে!ভাবতেই আমার চোখের কোণে জল চলে এল।ভাইয়া বয়ামের মুখ লাগিয়ে বাসায় ফিরতে যাবে এমন সময় দাদু বলে উঠল,পানির উপর যেখানে আমাদের ছায়া পড়েছে ওইদিকে তাকিয়ে দেখ, সোনালী আবার ফিরে এসেছে।কিন্তু সে এবার একা আসেনি।তার সাথে পাড়ার প্রতিবেশিদের সহ নিয়ে এসেছে।কেউ কাতলা,পুঁটি,ট্যাংরা,মলা ঢ্যালা,পাবদা,তপসে,কেউবা আবার তার জাতের।তারা সবাই মহাশোল কে ফিরে পেয়ে আনন্দে গান শুরু করে দিল-----
"আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী
সাথী মোদের মৎস্যপরী।
কাতলা,পুঁটি,চুনোপুঁটি,ঝুটোপুঁটি
সবার সাথে ভাব করি।।

এইখানে হিংসা বিদ্বেষ কেউ করে না
এইখানে জাতের কথা কেউ বলে না।
নেই কোন দুঃখ আর অপমান,
এইখানে মোরা সবাই সমান।

....ও আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী
সাথী মোদের মৎস্যপরী।

কেউ আবার খুশিতে নাচতেছে।এইসব দৃশ্য দেখে ভাইয়া নীরব কান্না শুরু করে দিল।আমি বললাম, ভাইয়া কান্না করতেছিস কেন?ভাইয়া বলল,না তো! নদীর পানি চোখে এসে পড়েছে।এ কথা শুনার পর সব মাছগুলো খলখলিয়ে হেসে উঠল।মাছদেরকে বিদায় জানিয়ে চলে আসার সময় সোনালী বলে উঠল,হে উপকারী বন্ধু, মাছদের রাজ্যে তোমাকে স্বাগতম।আমাকে দেখতে মন চাইলে তুমি এই জায়গায় চলে এস। এই বলে আমার দিকে চোখ টিপে একটু ইশারা করে আবার নাচে আর গানে মেতে উঠল।সবাই একসাথে মিলে গাইতে লাগল-----

ঈদ এসেছে,ঈদ এসেছে,ঈদ এসেছে।
মৎস্য রাজ্যে ঈদ এসেছে।
হারিয়ে ফেলা বন্ধুটিকে ফিরে ফেলাম গো......
তাই তো মোদের আনন্দের সীমা নাইকো।

ও.....ঈদ এসেছে, ঈদ এসেছে,ঈদ এসেছে.......
‌‌
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Dipok Kumar Bhadra সুন্দর লিখেছেন।
Ferdous আমার লেখা পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ আর শ্রদ্ধা।
ফয়জুল মহী খুব সুন্দর অনুভূতি প্রশংসনীয় লেখা I অসাধারণ লিখেছেন । খুব ভালো লাগলো

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

আমার গল্পের নাম 'সোনালীর দেশে'।নামকরণের স্বার্থকতা গল্পের সবচেয়ে বড় বিষয়।এই গল্পে সোনালী টা হল একটা মাছ।সে বয়ামে থাকার কারণে কতটা কষ্টে আছে তা নিয়ে লেখা।খুব সহজ ভাষায় বলতে গেলে সে যখন তার দেশ অর্থাৎ নদী থেকে যখন আমাদের দেশে অর্থাৎ বয়ামে আটকে ছিল।সে কতটা অসহায় ছিল,পরাধীন ছিল সে বিষয়টা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি।যেমনটা আমরা ছিলাম একাত্তরের আগে।এই বিজয়টা ছিনিয়ে আনার জন্য কতই না ত্যাগ-তিতিক্ষা করেছে বাংলার দামাল ছেলে থেকে কৃষক,মাঝি-মাল্লা পর্যন্ত।যার জন্য আমরা পেয়েছি আলাদা ভূ-খন্ড,একটি মানচিত্র আর একটি পতাকা।আমার দেশের নাম 'বাংলাদেশ' এই একটা শব্দের পরিধি কত বিশাল তা আমরা বায়ান্ন থেকে একাত্তরে বুঝেছি।তাই আপন মনেই লিখে চলি..... 'সাতচল্লিশের ভাবনা একাত্তরের চেতনা মোদের অলংকার, হুংকার দিয়ে বলতে চাই বাংলা আমার অহংকার। ' নিজের দেশে থাকার মত সুখ শান্তি আর কোথাও আছে বলে আমার মনে হয় না।তাই আমি ডিসেম্বর সংখ্যার সাথে একাত্ম হয়ে বলি ....... "আমার দেশ আমার অহংকার। "

১৭ নভেম্বর - ২০২০ গল্প/কবিতা: ২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪