সিদ্ধান্ত

পদত্যাগ (জুলাই ২০২৫)

মোঃ মাইদুল সরকার
  • 0
  • 0
মহিম সাহেব বয়স পঞ্চান্নর কোঠায়। তিনি এক সরকারি প্রতিষ্ঠানে যুগ্ম সচিব পদে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন। তাঁর চোখে সবসময় একটা স্থির দৃষ্টি, যেন কোথাও হারিয়ে যাওয়া কিছু খুঁজে ফিরছেন। তাঁকে যারা কাছ থেকে চেনেন, তারা বলেন, "মহিম সাহেব মানুষটা খুব আদর্শবাদী।"
অফিসে তার চমৎকার সুনাম। উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তার ওপর ভরসা করতেন, আর অধস্তনরা তাকেই অনুসরণ করত। তবে এই রকম একজন মানুষ হঠাৎ করে পদত্যাগপত্র জমা দিবেন, তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।


বছরের শুরুতে এক বড় প্রকল্পের দায়িত্ব পান মহিম সাহেব। সরকারি খাতে বড় অঙ্কের বাজেট, রাজনীতিকদের হস্তক্ষেপ, মিডিয়ার নজর — সব মিলিয়ে চাপের মধ্যে কাজ করতে হতো তাকে। কিন্তু সমস্যা তখনই শুরু হলো, যখন প্রকল্পের কিছু অর্থায়ন নিয়ে অসঙ্গতি দেখতে পেলেন তিনি। বারবার বলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং রাজনীতিকদের পক্ষ থেকে মিলল না সমর্থন। বরং তাকে “চুপচাপ ফাইল পাশ করানোর” জন্য চাপ দেয়া শুরু হলো।
প্রথমে তিনি প্রতিবাদ করলেন অভ্যন্তরীণভাবে। তারপর লিখিতভাবে আপত্তি তুললেন। একসময় বোঝা গেল, এই কাজ চালিয়ে যেতে হলে তাকে আপস করতে হবে — নইলে “পদে থাকা মুশকিল”।
এদিকে বাসায়ও চাপের শেষ নেই। বড় ছেলে ইমতিয়াজ বিদেশে পিএইচডি করছে, প্রচুর খরচ। ছোট মেয়ে ইরা ঢাকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, সেই খরচও কম না। স্ত্রীর হৃৎপিণ্ডে সমস্যা — গত ছয় মাসে দুইবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
স্ত্রী শারমিন বারবার বলতেন,
“দেখো মহিম, এই বয়সে চাকরি ছাড়লে আমাদের কী হবে? তোমার তো পেনশনও পুরোপুরি শুরু হয়নি। এখন যদি কিছু হয়ে যায়, আমরা দাঁড়াব কোথায়?”
মহিম সাহেব জানতেন স্ত্রী ঠিকই বলছেন। তবুও, নিজের বিবেকের কাছে পরাজিত হতে চাইছিলেন না।
মহল্লার লোকজনও কম কথা বলত না।
“এমন চাকরি কেউ ছাড়ে?”
“সবাই যখন সুযোগ নিচ্ছে, উনি এমন সাধু সেজেছেন কেন?”
“যার পরিবারে সমস্যা নেই, সেই এমন নীতির কথা বলতে পারে।”
বন্ধুরাও বারবার বোঝাতে আসত,
“দেখ ভাই, সময় এখন এমন না যে তুমি আদর্শ নিয়ে বাঁচতে পারবে। সব সামলেই বাঁচতে হয়। এখন না বুঝলে পরে আফসোস করবি।”
মহিম শুধু মুচকি হাসতেন। কিছু বলতেন না। তার ভেতরে যেন একটা যুদ্ধ চলছিল—বাইরের জগৎ বনাম তার নিজের বিবেক।
যুদ্ধে তিনি বিবেকের কাছে হেরে যাননি-
অবশেষে একদিন সকালে অফিসে ঢুকে চুপচাপ নিজের ডেস্কে বসলেন। ডেস্কে পড়ে থাকা নোটিশগুলো দেখলেন। একটার ওপর লেখা — “ফাইল অনুমোদনের নির্দেশ”। তার নিচে একজন প্রভাবশালী নেতার হস্তাক্ষর।
একবার কাঁপা হাতে কলম তুলে নিলেন, তারপর রেখে দিলেন। তারপর একটা নতুন কাগজ বের করে লিখতে শুরু করলেন: “পদত্যাগপত্র”।
চার লাইনের ছোট চিঠি।

“আমি মহিম চৌধুরী, যুগ্ম সচিব, নিজ ইচ্ছায় ব্যক্তিগত ও নৈতিক কারণে এই পদ থেকে অব্যাহতি চাই। আমি এই চিঠির মাধ্যমে তা দাখিল করছি। আগামী এক মাসের মধ্যে দায়িত্ব হস্তান্তর করব।”
দুপুরে চিঠিটি জমা দিয়ে যখন বেরিয়ে আসছিলেন, তখন সহকর্মীরা হতবাক চোখে তাকিয়েছিল। কেউ সাহস করেও কিছু বলল না।

সেদিন সন্ধ্যাবেলায় শারমিনকে বললেন,
“আমি পদত্যাগ করেছি।”
শারমিন স্তব্ধ হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,
“তোমার মত মানুষ এটাই করত। তবুও ভয় লাগছে। এখন আমাদের কী হবে মহিম?”
মহিম সাহেব ধীরে ধীরে বললেন,
“হয়ত কষ্ট হবে। হয়ত অনিশ্চয়তা বাড়বে। কিন্তু প্রতিদিন আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে ঘৃণা করতে হবে না।”
ইমতিয়াজ ভিডিও কলে জানল খবরটা। প্রথমে সে বিরক্ত হলো,
“বাবা! তুমি একটু ধৈর্য ধরতে পারতে না? এত বছর চাকরি করেছো, আরও এক-দু’বছর করে নিলে কি হতো?”
ইরা অবশ্য বাবার হাত ধরে বলেছিল,
“তুমি আমাদের জন্য যা করেছো, তার চেয়ে বড় কাজ এটা। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করনি। আমি গর্বিত তোমার জন্য বাবা।”

অবসরজীবনে প্রবেশ মানে শুধুই বিশ্রাম নয় — অন্তত মহিম সাহেবের জন্য তা ছিল না। প্রথমদিকে সময় কাটাতেন বই পড়ে, পত্রিকা লিখে। ধীরে ধীরে স্থানীয় একটি স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা ও সিভিক শিক্ষা পড়াতে শুরু করলেন। কেউ বেতন দেয় না, তবুও প্রতিদিন সময়মতো হাজির হন।
একদিন ইরার বন্ধুদের একজন এসে বলল,
“ইরার বাবা? উনি না সেই অফিসার, যিনি চাপে থেকেও দুর্নীতিতে রাজি হননি?”
গল্প ছড়াতে লাগল। ছোটদের মাঝে তিনি হয়ে উঠলেন এক অনুপ্রেরণা।
যেখানে সমাজে সবাই টিকে থাকার জন্য অন্যায় মেনে নেয়, সেখানে মহিম সাহেব হয়ে উঠলেন ব্যতিক্রম।
ছয় মাস পরে, একদিন হঠাৎ ডাক এল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। একটা নতুন কমিটি গঠন করা হচ্ছে — "সুশাসন ও প্রশাসনিক নৈতিকতা কমিশন"। তার উপদেষ্টা হিসেবে মহিম সাহেবের নাম প্রস্তাবিত।
বস্তুত, তার পদত্যাগ অনেকের চোখ খুলে দিয়েছিল। উপর মহলেও তাকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল।
তিনি প্রথমে রাজি হননি। বলেছিলেন,

“আমি আর কোনো পদ চাই না। শুধু ন্যায়ের পথে থাকতে চাই।”
কিন্তু শেষমেশ, দেশের জন্য কাজ করার সুযোগ বলে তিনি প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন।
এবার তিনি আর কারো চাপে নয়, নিজের বিবেকের নির্দেশেই কাজ করবেন।

মহিম সাহেব দেখিয়ে দিলেন, একটি নিরীহ চাকুরিজীবীর নৈতিক সংগ্রামের গল্প নয় শুধু, এটি প্রতিটি নীতিবান মানুষের প্রতিচ্ছবি। সমাজের চাপ, পরিবারের অসহায়তা, আত্মার টানাপোড়েন — সবকিছুকে জয় করে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, সত্যিকারের শক্তি আসে নিজের ভেতর থেকে।
অনেকে বলেন-

“ আদর্শে পেট চলে না।”

কিন্তু মহিম সাহেব প্রমাণ করেছেন — “পেট চলে যায়, যদি আত্মা বাঁচে।”
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

একটি সঠিক সিন্ধান্ত নিজের জন্য ও দেশের জন্য এবং জাতী ও সমাজের জন্য বেশ উপকারী।

২৪ আগষ্ট - ২০২০ গল্প/কবিতা: ১১০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "পরগাছা”
কবিতার বিষয় "পরগাছা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ জুলাই,২০২৫