আহত পাখির কান্না

দাসত্ব (এপ্রিল ২০২৫)

মোঃ মাইদুল সরকার
  • 0
  • ১১
গাছের ডালে ডালে ধোকা ধোকা অন্ধকার। রাত নেমেছে। সওদাগর বাড়িতে সন্ধ্যাবতি দেওয়া হয়েছে আরও আগে। ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ যেন পাগল করে দিচ্ছে চারপাশ। ছাতিম ফুলকে স্থানীয় ভাষায় বলে যাইতুন ফুল।

ছেলেমেয়েরা গৃহ শিক্ষকের কাছে পড়তে বসেছে এমন সময় হঠাৎ কান্নার আওয়াজ শোনা গেল।


বাড়ির কাজের ছেলেটাকে মারা হচ্ছে। তাকে বারবার ভাজা মাছ চুরি করে খেয়েছে কিনা প্রশ্ন করা হচ্ছে। সে অস্বীকার করছে।

গৃহ শিক্ষক শরিফ সাহেব সতর্ক বার্তা দিয়ে তার এক ছাত্রকে বাবার কাছে খবর পাঠালো ছেলেটাকে না মারার জন্য। কারণ তিনি সন্ধ্যায় দেখেছেন একটি বিড়াল মাছ নিয়ে ঝোপের মধ্য লুকিয়ে খাচ্ছিল। এছাড়াও নিরপরাধ কাউকে মারধর করা ওনার পছন্দ না। শরীফ সাহেব পরউপকারী ও প্রতবাদী মানুষ।


ভাজা মাছ শরীফ সাহেবের বেশ পছন্দ। তাই বাড়ির লোকজন ভাজা মাছ না পেয়ে কাজের ছেলেটার উপর চুরির অপবাদ দিয়ে মারধর করছে।

ছাত্র ফিরে এসো বলল,ঔষধে কাজ হয়েছে।

মারধর এবং কান্না বন্ধ হয়ে গেল। সত্যি ঔষধে কাজ হয়েছে। মানে শরীফ সাহেবের কথা পালন করা হয়েছে।

এশার নামাজের আজান হলো ।একটু পরেই সব ছাত্র ছাত্রীকে পড়ানো শেষ করে একটা আধ পড়া উপন্যাস নিয়ে বসলেন গৃহশিক্ষক।

বাড়ির সবাই খাওয়া-দাওয়া শেষ করে হাতের কাজ গুছিয়ে শুয়ে পড়বে। নয়টা দশটা নাবাজতেই এই এলাকা এখন মধ্যে রাত।

টেবিলে খবর দেওয়া আছে কিন্তু তিনি এখনও খাননি। শরীফ সাহেব পড়েই চলেছেন, বেশ মজে গেছেন উপন্যাসের মধ্যে। হঠাৎ বাহিরের শব্দ হওয়ায় তার মনযোগ বিঘ্নিত হরো। তিনি জানেন কাজের ছেলেটাকে আজ কোন খাবার দেওয়া হবে না শাস্তি হিসেবে ছেলেটা হয়তো না খেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণা নিয়ে রাতটা পার করবে।

তাই তিনি অপেক্ষা করছেন সবাই ঘুমিয়ে গেলে নিজের খাবারটা ছেলেটাকে দিয়ে দেবেন।

ছেলেটার নাম সেলিম ।বেশ ভালো ছেলে কাজকর্মে দক্ষ। এর আগে বেশ কয়েকবার ছেলেটার সাথে কথা হয়েছে, কাজের হুকুম দিলে সাথে সাথে পালন করে, মুখের হাসিটাও সুন্দর। পিতৃ-পাতৃহীন অনাথ শিশু বয়স প্রায় দশ বছর হবে।

ভাঙা কাছারি ঘরে ছেলেটা থাকে। রাত নটা দিকে সেলিমের ঘরে গিয়ে তাকে ডেকে তুললেন শরীফ সাহেব। ছেলেটি যে শিক্ষককে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল।

তাকে কেউ আদর করে খেতে ঠাকছে এটা সে এই বাড়িতে কাজে ঢুকার পর কল্পনাও করতে পারেনি। সে যে দাসত্বের শিকলে বন্দী হয়ে গেছে সেই বোধটুকুও তার নেই।

প্রথমে খাবার খায়িয়ে পরে বিস্তারিত সব জেনে শরিফ সাহেব বললেন, তা তুমি এখানে পড়ে আছো কেন ? অন্য কোথাও চলে যেতে পারো না ।

সেলিম বলল, আর কোথাও দেওয়ার মত জায়গা নেই ? আপন বলতে কেউ নেই দুনিয়ায়।

বাবা মায়ের মৃত্যুর পর এক আত্মীয় তাকে এই বাড়িতে রেখে গেছেন। সারাদিন কাজ করবে বিনিময়ে দুবেলা খাবে। সেই থেকে তার দাসত্ব জীবন শুরু। বাবা মায়ের মুখর ছবিটাও সে ভুলে গেছে। ডুকরে কেঁদে উঠল অবুঝ বালক।

শরীফ সাহেব তাকে আদর করে বুকে টেনে নিয়ে শান্তনা দিলেন। একদিন তোমাকে আমি এই কঠোর কঠিন জীবন থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করে দিব।

সেলিম যেন অসীম জলরাশির মধ্যে একটু ঠাঁই পেল দু’দন্ড জিরাবার।


এই বাড়িরর গৃহকর্তা বেশ জাদরেল লোক। তাকে সবাই ভয় পায় ।তার যেমন নাম ডাক আছে তেমনি আছে পেশি শক্তি। কাজের লোকদেরকে তিনি কখনো ছাড় দেননা। সামান্য ভুল হলেই মারধর করেন, খেতে দেন না। এমনি বেতনও কেটে রাখেন।

সেলিম এর কাছ থেকে শরিফ সাহেব তার আগের জীবনের ঘটনা জানলেন। বেশ সাদা মাটা জীবন ছিল। বাবা মা কৃষক ছিল, তারা সফল ফলাতো আর তাই দিয়ে সারা বছর চলতো। কিন্তু হঠাৎ অজানা এক রোগে গ্রামের অধিকাংম মানুষ মারা পড়ল । সেলিমে মা বাবা সেই দলে যোগ দিয়ে তাকে চির এতিম করে চলে গেলো।

শরীফ সাহেব ভেবে পাননা, মানুষের এমন দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে জমশেদ সওদাগর কি করে পারলেন একটা অবুঝ শিশুকে তার দাস বানিয়ে ফেলতে ? বিবেক কি একটু বাধা দেয়না। নাকি বিবেকেরও মৃত্যু হয়েছে !

শরীফ সাহেব মনে মনে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন, যেদিন তিনি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন সেদিন সেলিমের দাসত্ব জীবনের অবসান ঘটাবেন।

দেখতে দেখতে সময় চলে যায় । ছেলেমেয়েরা নতুন ক্লাসে উঠে শরীফ সাহেবের কৃপায় সবাই ভালো রেজাল্ট করে। তাকে নতুন পোশাক দেওয়া হয় আরো ভালো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু তবুও যেন জমশেদের উপর খুশি হতে পারেননা গৃহশিক্ষক।

জেলা শহরে ভালো চাকরির জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন শরীফ সাহেব। সেখানে থাকেন তার কাছের বন্ধু অনিকেত।

অনিকেত শহরের নাম করা পাইলট স্কুলে ইংরেজীর শিক্ষক। বন্ধু শরীফকেও সে স্কুলের চাকরিতে ঢোকানোর আপ্রান চেষ্টা করছে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক আজমীর সাহেব তার লতা পাতা সম্পর্কের আত্মীয়। তাই স্কুলে অনিকের প্রভাব বেশ ভালো।

এদিকে জমশেদ তার এক মেয়েকে শরিফ সাহেবের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। কিন্তু শরীফ সাহেব মোটেও রাজি নন তিনি চান না এমন পরিবারের সাথে তো আত্মীয়তা হোক।

যে মেয়িটি শরীফ সাহেব এর সাথে বিয়ে দিতে চান তার নাম শামসুননাহার মিলি।


মিলি বেশ চটপটে মেয়ে। আশির দশকের মেয়ে হয়েও সে বেশ আধুনিকা। সে সেলিমের মাধ্যমে নানান চিরকুল শরিফের নিকট পাঠায়।

শরীফ সাহেব চিরকুট পড়েন আর ছিড়ে ফেলে দেন। তবু মানুষের মন বলে কথা, মিলির হাতের লেখা বেশ মনে ধরে । ধীরে ধীরে তার প্রতি দুর্বল হয় সে।

কিন্তু আরও দুর্বল হওয়ার আগেই বন্ধুর কল্যানে পাইলট স্কুলে চাকরি হয়ে যায় শরীফের। কিন্তু এই খুশির সংবাদটা গৃহশিক্ষক বাড়ির সবার কাছে গোপন রাখলেন।


একদিন কাক ডাকা ভোরে সেলিমকে সাথে নিয়ে শহরের উদ্দেশ্যে চলে যান শরীফ সাহেব। রেখে যান মিলির উদ্দেশ্যে একটি চিরকুট।

মিলি, তুমি নোংড়া এক সরোবরে ফুটে থাকা পদ্ম। যার সৌন্দর্যে মুহিত হওয়া যায়। কিন্তু কাছে গেছে সর্প দংশনে দংশিত হইয়া, বিষের বেদনায় নীল হইয়া সংসারের মায়া ত্যাগ করতে হয়। তুমি ভালো থেকো। বড় ঘর, ভালো বর পেয়ে সুখী হও। ইতি মোতার এককালের শিক্ষক।


পরের দিন ঘটনাটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। সওদাগর শিক্ষক এবং কাজের ছেলেকে হারিয়ে একদিকে যেমন মর্মাহত হলেন অন্যদিকে তাদের খুঁজতে লোক পাঠালেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না ওদেরকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না।




শহরে এসে সেলিমের পড়ালেখার ব্যবস্থা করলেন শরিফ সাহেব। পড়ালেখা না জানলে মানুষকে অন্যের বাড়িতে কাজ নিয়ে দাসত্বের জীবন জাপন করতে হয় দিনে এই ব্যাপারটা ভালোভাবে জেনে গেছে সেলিম। তাই সে মনোযোগী হয়ে খেলাপড়া করতে থাকে।

একটা ছেলের জীবন নষ্ট হোক অবহেলায়, অনাদরে এটা কখনো চাননি শরিফ। তাই দুই বন্ধু মিলে সেলিমের জন্য নতুন এক জীবন উপহার দিলেন।

সেলিম খুব খুশি। তাকে আর মার খেয়ে আহত পাখি হয়ে ডানা ঝাপটাতে হবেনা। লেখাপড়া শিখে কিছু একটা করে খেতে পারবে । অন্যের বোঝা হয়ে থাকতে হবে না আর।


অনেকদিন হয়ে গেল মাকে দেখেনা শরীফ। উত্তরবঙ্গে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য মন আনচান করে। সেলিমকে সাথে নিয়ে গেল তার মাকে দেখবে বলে।

বাড়িতে পৌছতে দুদিন লেগে গেল। শরীফের মা আমেন বেগম সেলিমকে দেখে বলল, আমার নাতিটা যদি বেঁচে থাকতো তাহলে আজ ওর সমানই হইত।

বছর দশেক আগে রোড এক্সিডেন্টে পুত্রবধূ ও নাতিকে হারিয়ে শোকে কাতর আমেনা বেগম। সেলিমের মাঝে তিনি তার নাতিকে খুঁজে পান।

শরীফ বলে, আজ থেকে ও তোমার নাতি আর আমার হারিয় যাওয়া পুত্র আলাদিন।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
doel paki আহত পাখির কান্না শেষ হোক।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

একটি শিশুকে দাসত্বের জীবন থেকে নতুন জীবনে ফিরিয়ে আনার গল্প।

২৪ আগষ্ট - ২০২০ গল্প/কবিতা: ১০৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "সংসার”
কবিতার বিষয় "সংসার”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৫