বাহিরে মৃদু মন্দ বাতাস বইছে। দু-একটা গাছের হলুদ পাতা ঝরে পড়ছে । দূর থেকে দেখে মনে হবে অপরাহ্ণের এই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে আছেন বুঝি ময়না বিবি।
কিন্তু না তিনি সে দিকে তাকিয়ে তা উপভোগ কিংবা দেখার মত অবস্থায় নেই। তার সুখের সংসারে দুখের আগুন এসে হানা দিয়েছে। সে আগুন কিভাবে নিভাবেন সেই ভাবনায় ময়না অস্থির।
ময়না বিবির স্বামী এক্সিডেন্ট করে দুই হাত হারিয়েছে তার এখন চাকরি নেই। পাঁচটি ছেলেমেয়ে নিয়ে ময়না বিবি যেন অকুল পাথরে পড়েছেন। বাধ্য হয়ে তিনি একটি সেলাই মেশিন কিনেছেন কিন্তু মানুষের জামা কাপড় সেলাই করে যা আয় হয় তা দিয়ে তো আর সাত জন মানুষের সংসার চলে না। আর চলে না বলেই এককালে শখ করে যেসব জিনিস কিনেছিলেন একটা একটা করে তা বিক্রি করে ক্ষুধার জ্বালা মিটানোর জন্য অন্ন সংস্থানে তা ব্যয় করেছেন।
গতকাল ডাইনিং টেবিল টা বিক্রি করে দিয়েছেন । তা দেখে ছেলে মেয়েগুলো বলছিল,মা ডাইনিং টেবিলটা না থাকলে আমরা কোথায় বসে খাব ?
ময়না বিবি বলেছিল, কেন মাদুর বিছিয়ে ফ্লোরে বসে খাব। আগে তো খেয়ে বেঁচে থাকতে হবে তারপর সময় ভালো হলে আবার সবকিছু কিনা যাবে। শখ আহ্লাদ পূরণ করা যাবে।
অভাবের সংসারে শখের সমস্ত জিনিস বিসর্জন দিয়েও ক্ষুধার দৈত্যকে হার মানানো যায় না। যে সন্তানদের তিনি প্রানসম ভালোবাসতেন, তাদের মুখে খাবার তুলে দিতে না পেরে এক প্রকার অবহেলায় অনাদরে দিন যাচ্ছে যাত্রার বাচ্চাগুলোর। একমাত্র মেয়ে রুবি সে পরে ক্লাস ফাইভে । আর তার ছোট চার ভাই। কেউ পরে থ্রিতে, কেউ পরে টুয়ে, আরেকজন এখনো ক্লাসে ভর্তি হয়নি আর সবার ছোটটা মায়ের কোলের শিশু।
আত্মীয়স্বজনরা যেন অভাবের দিনে পর হয়ে যায়। দেখেও না দেখার ভান করে। সবাই করুণা করে, কেউ তেমন সহযোগিতা করে না।
ময়না আর সোহেলের এই দুর্দিনে কিছু মানুষ তাদের সন্তানদের দত্তক নিতে হাজির হয়। প্রথম প্রথম তাদেরকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেও ইদানিং ময়না বিবির মাথায় দত্তক ভাবনাটাই বারবার চক্কর খাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত বাচ্চাদের কি দত্তক দিয়ে দিতে হবে। একজন দুজনকে দিলেও বোঝা কিছু কমে। স্বামীকে বলবো বলবো করেও সে বলতে পারছিল না কিন্তু একদিন রাতে সে বলেই ফেললো। না বলে তার আর উপায় ছিলনা।
স্বামী সোহেল চৌধুরী রক্ত চক্ষু ধারণ করে বলল, তুমি কেমন মা, অভাবের কারণে বাচ্চাদের তুমি দত্তক দিয়ে দিতে চাও। তুমি কি তাদের ছাড়া থাকতে পারবে না আমি পারবো।
স্বামীর কথা শুনে ময়না বিবি অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলেন আর বললেন আমি কি সাধে বলছি । আমি গত তিন রাত ধরে আমি কিছুই খাই না, ঘরে খাওয়ার মত তেমন কিছু থাকেনা। এভাবে আর কতদিন ? এভাবে না খেয়ে খেয়ে বাচ্চাগুলো মারা যাক সেটাই বা কি করে মেনে নেব। বল তুমি বল ?
তার চেয়ে রুবি আর ফারহানকে দিয়ে দিলে বাকি তিনজন কে নিয়ে আমরা না হয় কোন মতে দিন কাটালাম। যদি সংসারে সুখে ফিরে তবে তখন রুবি আর ফারহানকেও নিয়ে এলাম।
দুদিন পর স্বামী-স্ত্রী এটাই ঠিক করলেন যে, মেয়ে রুবিকে এবং সবচেয়ে বড় ছেলে ফারহানকে তারা দত্তক দিয়ে দেবে।
রুবিকে নেওয়ার জন্য একটি নিঃসন্তান দম্পত্তি আসলেন এবং সুন্দর সুন্দর কথা বলে রুবিকে তাদের সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য রুবির বাবা-মাকে রাজি করিয়ে ফেললেন। পর্দার আড়াল থেকে রুবি সবই শুনেছে । যেইমাত্র সেই দম্পত্তি বেরিয়ে গেল, অমনি সে মায়ের সামনে এসে হাজির হলো।
-মাগো আমরা কি তোমার অবহেলার পাত্র হয়ে গেলাম। সাব্বির, সেলিম, মাহমুদের যদি এই সংসারে জায়গ হয়, আমার আর ফারহানের কেন জায়গা হবে না মা ! আমরা কি অন্যায় করেছি, কি অপরাধ করেছি। কেন আমাদের তাড়িয়ে দিচ্ছ ?
মেয়ের কথায় ময়না বিবি মেয়েকে সান্তনা দেয় । কিন্তু সান্তনায় চোখের জল বাধ মানে না। সান্তনার ক্ষুধার জ্বালাও মিটেনা।
- তুমি যত কিছুই বলো না কেন আমি কিন্তু কোথাও যাবো না।
রুবি চোখ মুছতে মুছতে নিজের রুমে চলে যায়। ছোট অবুঝ ভাইগুলো বুঝতে পারেনা তাদের বোনের কান্নার মানে। তাড়া জানতে চায় রুবি কেন কাঁদছে। রুবি চোখ মুছে বলে এমন কাঁদছি, ব্যাথা পেয়েছি।
সেলিম বলে কোথায় ব্যাথা পেয়েছ আপু, দেখাওনা। রুবি বলে মনের ব্যাথা কি দেখানো যায় রে ভাই। বলেই আবারও অশ্রুতে তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। সে ছোট ভাইগুলোকে বুখে জড়িয়ে ধরে। নিজের অসহায় ভাগ্যোর কথা ভেবে ফুপিয়ে কাঁদে।
কিন্তু সপ্তাহখানেক পরে সেই দম্পতি এসে হাজির । আজ তারা রুবিকে নিয়ে যাবে। ময়না বিবি জোর করেই তার কন্যার জামা কাপড় ব্যাগে ভরে এক প্রকার টেনে হেচড়ে রুবিকে সেই দম্পতির হতে তুলে দিলেন।
যাওয়ার সময় রুবি তার মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে বলতে থাকে, মাগো আমাকে যেতে দিও না । আমি তোমার সব কাজ করে দেবো। আমি আমার ভাইদের দেখাশোনা করব। দরকার হয়না না খেয়ে থাকবো। তবুও আমাকে যেতে দিও না মা । আমি তোমাদের ছাড়া থাকতে পারবো না।
আমি আমার আদরের ছোট ভাইগুলো ছাড়া কি করে থাকবো। আহা! কি ভয়ানক সেই দৃশ্য, ভাবলেই বুকটা কেমন করে উঠে। চোট ভাইগুলোও বোনের জন্য কেঁদে চলেছে। আপু যেওনা, যেওনা বলে মাতম করছে।
এদিকে নিঃসন্তান সেই দম্পতি রুবির মাথায় হাত রেখে বললো, কোন ভয় নেই, কোন চিন্তা নেই। তুমি অনেক ভালো থাকবে আমাদের ওখানে। প্রতিদিন ভালো ভালো খাবার খেতে পাবে। প্রতি মাসে নতুন জামা কাপড় পাবে, লেখাপড়া করতে পারবে আর সপ্তাহে একবার বাবা-মার কাছে দেখা করতে আসতে পারবে।
কিন্তু এক মাস চলে যায় তারা রুবিকে বাবা-মার কাছে আসতে দেয় না। তেমন ভালো খেতেও দেয় না । যদিও পড়ালেখার সুযোগ দিয়েছে কিন্তু সংসারের সমস্ত কাজই করিয়ে নিচ্ছি রুবিকে দিয়ে ।
এদিকে অনাদর অবহেলায় দিন যায় রুবির। তার মন ছটফট করে বাড়ি ফিরে যেতে চায়। কিন্তু সে কিছু বলতেও পারেনা আবার সইতে পারেনা। এই সংকট কবে কাটবে কে জানে ?
রুবি যাওয়ার দু'মাসের মাথায় ফারহান–কে দত্তক নিতে আসলেন আরেক দম্পতি। তাদের একটি মাত্র কন্যা সন্তান রয়েছে কিন্তু তাদের পুত্র সন্তানের অনেক শখ। বিয়ের ষোল বছর পেরিয়ে গেলেও তাদের আর সন্তান না হযওয়ায় তারা ফারহানকে দত্তক নিতে আগ্রহী।
ফারহান তার মাকে ধরে কান্নাকাটি করলো। কারণ নিজের বাবা-মা আর ছোট ভাইদের ছেড়ে সে কোনদিন কোথাও থাকেনি । আজ তাকে চলে যেতে হচ্ছে অচেনা অজানা পরিবারে। সেটা মেনে নিতে পারছে না সে । তাই সে মাকে বলে গেল, মা আমি চাচ্ছি ঠিক আছে কিন্তু আমার ছোট ভাই এগুলো কে তুমি আর অন্য কারো কাছে দত্তক দিওনা। ওরা অনেক ছোট ওরা তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না মা।
ছেলের কথাগুলো যেন কলিজায় গিয়ে আঘাত লাগে ময়না বিবির। ছেলে বিদায় হওয়ার পর নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না । তার চোখ দিয়ে পড়ছে নীরবে এতক্ষণ যে অশ্রু। এখন জোড়ে চিৎকার করে বলছে, এই কি ছিল আমার ভাগ্যে, খোদা এই কি লিখেছিলে আমার ভাগ্যে। ছেলে মেয়ে দিয়ে আবার তা কেড়ে নিচ্ছ।
দুজন সন্তানকে দত্তক দিয়েও শেষ রক্ষা হলো না ময়না বিবির। হুট করে তার স্বামী সোহেল চৌধুরী মারা গেলেন। অসস্ত অক্ষমতা আর লজ্জা থেকে চিরতরে মুক্তি পেল এক ব্যর্থ পিতা।
স্বামীকে কবর দেওয়ার পর ময়না যেন অন্য জগতে হারিয়ে গেলেন। কি করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। বাবাকে শেষ দেখার জন্য ফারহান আর রুবি এসেছিল ।ফারহান বেশ ভালোই আছে কিন্তু রুবি যে ভালো নেই তা তাকে দেখেই বুঝে দিয়েছে ময়না বিবি।
মেয়েকে কাছে এনে আড়ালে বলল, কিরে মা ওরা কি তোকে ঠিকমতো খেতে পড়তে দেয় না। রুবি মাকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে বললো, না মা ওরা আমাকে অনেক আদর করে । অনেক ভালো ভালো খাবার খেতে দেয় কিন্তু জানো তোমাদের ছাড়া, ছোট ভাইদের ছাড়া আমার ওসব ভালো খাবার খেতে মন চায় না । তাই আমি কিছু খেতে পারিনা।
-আরে পাগলি মেয়ে আমার, অভাব কি আমাদের চিরদিন থাকবে। তুই খেয়ে পড়ে ঠিক থাকলে, আমাদের আবার সুখের দিন আসলে তোদের সবাইকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবো। আবার আনন্দের ভরে উঠবে আমাদের সংসার।
রুবি চোখ মুছে। ফিরে যেতে যেতে বলল, হ্যাঁ মা তাই যেন হয় । আবার যেন আমরা ফিরে আসতে পারি । সংসারটি যেন সুখে শান্তিতে ভরে উঠে।
ময়না বিবির জন্য আরো কঠিন দিন এলো। কিছুতেই কিছু হয় না, না কোথাও কাজ মিলে না কর্জ পাওয়া যায়। মানুষের কাছ থেকে ধার দেনা করেও আর সংসার চলে না। তাই বাধ্য হয়ে পরের দুটি ছেলেকেও তিনি দত্তক দিয়ে দিলেন । শুধু দুধের শিশুটাকে নিজের কাছে রাখলেন।
চারটা চেলে মেয়েকে পরের হাতে তুলে দিয়ে মা কি আর ভাল থাকে। একদিন তিনি চুপি চুপি সেলিমকে দেখতে গেলেন। দেখলেন তার ছোট ছেলেটিকে দিয়ে বাড়ির মহিলা ঘর মোছাচ্ছে আর বলছে পরের বাড়িতে থাকতে গেলে সব কাজ কর্ম করেই থাকতে হয়।
ময়না নীরবে সেখান থেকে ফিরে এলেন। এবার সাব্বির- কে দেখতে গেলেন। দেখলেন সাব্বির টেবিলে পড়ছে কিন্তু তার মুখটা শুকনো নিশ্চয়ই ঠিক মতন খেতে দেয়না তার ছেলেকে। ছেলেকে ডাক দিতে গিয়েও না দেখা করে ফিরে এলেন।
সন্তানদের প্রতি এই অবহেলা দেখে মায়ের মন কেদে ওঠে তিনি বাড়ি ফেরেন কোলের শিশুটাকে নিয়ে। তিনি কোন মতে দিন কাটান আমার আল্লাহকে বলেন, আল্লাহ আমাদের ভাগ্য তুমি পরিবর্তন করে দাও। এই দুঃখ , এই কষ্ট আর সহ্য হয়না। মালিক তুমিতো সবই পার। আমার ছেলে মেয়েগুলোকে আমার বুকে ফিরিয়ে দাও।
ময়না বিবি বুঝলেন এভাবে হবেনা। তার দিন ভাল যাচ্ছে না তার সন্তানদের দিন ভাল যাচ্ছে। পৃথিবীর কোন বাবা মা চায়না তার সন্তান অবহেলায়, অনাদরে বড় হোক। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন গ্রামে যাবেন এবং স্বামীর ভাগের সম্পত্তি বিক্রি করে একটা ছোট ব্যবসায় দিবেন যাতে তার এবং তার সন্তানদের আর মানুষের বাড়িতে পড়ে থাকতে না হয়।
গ্রামে গিয়ে অনেক চড়াই উৎড়াই পেড়িয়ে স্বামীর ভাগের জমি বিক্রি করে বুটিক্স এর কাজ শিখে একটা ব্যবসায় দাড় কড়ালেন। দেখে শুনে আর পরিশ্রম করে ভাল একটা অবস্থায় ব্যবসাটা দাড় করালেন।
দেখতে দেখতে তিনটি বছর কেটে গেলো। তিনি তার সবগুলো সন্তানকে একে একে নিজের কোলে, নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন। সন্তানেরা মাকে পেয়ে , নিজেদের পরিচিত বাড়ি পেয়ে যেমন খুশি হলো তেমনি মায়ের আদর, ভালবসায় বড় হতে লাগলো কারণ তারা অবহেলাকে বড্ড ভয় পায়।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
এক মা তার চার সন্তানকে দত্তক দিয়ে তাদের অবহেলা, অনাদর দেখে অনেক কস্টে ফিরিয়ে আনেন। মা কোন ভাবেই তার সন্তানদের অবহেলা সহ্য করতে পারেননা গল্পে এই ব্যাপারটি তুলে ধরা হয়েছে।
২৪ আগষ্ট - ২০২০
গল্প/কবিতা:
৯৬ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪