বিয়ের পর শামীমা অনেক সুখী হয়েছিল। কুমিল্লার ছেলে আসাদকে বিয়ে করে যে সংসার সে পেতেছিল সেখানটায় ছিল না কোনো মূল্যহীনতা কিংবা দারিদ্রের ছোঁয়া।
ইঞ্জিনিয়ার আসাদ ইট, কাঠ, কংক্রিট নিয়ে কাজ করলেও তার মনটা ছিল মানবিক এবং রোমান্টিক।
সে নিজে যেমন ভালোবাসতে জানতো তেমনি তাকে ভালবাসার মায়া জালাতে জড়াতে জানতো। আর এই গুণটাই তাদের সংসারে সুখী হওয়ার মূল মন্ত্র ছিল।
নদীর ধারার মতন সময়ে বয়ে চলে নিরন্তর তেমনি দেখতে দেখতে শামীমা আর আসরের বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যে দুই সন্তান আসে নতুন অতিথি হয়ে। পার্থিব জীবনের অন্যতম শোভা হচ্ছে সন্তান প্রাপ্তি। দুটি পত্র সন্তানের নাম রাখা হয় অনিকেত ও অনন্ত আদর।
যদিও একটি মেয়ে সন্তানের বড় সখ ছিল কিন্তু সৃষ্টিকর্তা সেইসাধ অপূর্ণ রেখে দিলেন। কারণ মানুষ এক জীবনে সব পেয়ে গেলে অপূর্ণতা বলে কিছু থাকবেনা, অভাববোধ বুঝবেনা।
ছেলেরা বড় হতে লাগলো । মা বাবার ব্যস্ততা বাড়তে লাগলো। কিন্তু কথায় আছেনা সুখ কারো চির দিন রয়না। তারপর মধ্য বয়সে একদিন হঠাৎ শামীমার ক্যান্সার ধরা পড়ল।
এই মরণঘাতী ক্যান্সার কেড়ে নিয়েছিল তার শাশুড়ির প্রাণ। অনেক টাকা ঢেলেও ফিরানো যায়নী শাশুড়িকে, শেষ পর্যন্ত সে বলেছিল তার পিছে যেন আর টাকা খরচ করা না হয়। কারণ ততদিনে তিনি বুঝে গেছেন মৃত্যুই তার এক মাত্র মুক্তি। অবশেষে একদিন জ্বালা যন্ত্রনা থেকে তার আত্মা মুক্তি নিয়ে মুক্ত বিহঙ্গের মত চলে গেছে অনন্তের ওপারে।
তাই ক্যান্সার ধরার পর থেকে ভয় আর আতঙ্ক সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে চলল শামীমাকে। কি শারীরিক, কি মানসিক সব ভাবেই যেন ভেঙ্গে পড়ল শামীমা।
স্বামী সন্তান যতই অভয় দিক না কেন, সে জানে সে আর বেশিদিন বেঁচে থাকবে না। উন্নত চিকিৎসার জন্য ইন্ডিয়া যাওয়া আসা হয়ে গেল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তবুও যেন অজানা একটা ভয় পিছু ছাড়েনা। সেই ভয় যেন একটা অবয়ব হয়ে সয়নে স্বপনে আঘাত হানতে থাকে ।
ছেলেদের আন্তরিকতা, স্বামীর ভালোবাসা আর ডাক্তারদের নিরলস চেষ্টায় শামীমা অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠলো।
একদিন রাতে স্বামীকে বলল, ছেলেরা এখনো লেখাপড়া শেষ করে নাই হঠাৎ একদিন যদি আমি দুম করে মরে যাই, না থাকি সংসারে তাহলে এলোমেলো হয়ে যাবে আমার এ সাজানো সুখের নীর। বড় ছেলেটাকে বিয়ে করালে অন্তত বউ ঘরে উঠবে, অত্যন্ত পুত্রবধুর মুখটাতো দেখে যেতে পারবো।
অনিকেত মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে কিন্তু তার মা-কে নিয়ে বাবার সাথে ইন্ডিয়া দৌড়াদৌড়ি করাতে তার আর মাস্টার্স করা হলো না। এক বছর গ্যাপ দেওয়াতে তার ছোট ভাই ও এবার মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে । দুই ভাই একসাথে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। অনিকেত পার্ট টাইম একটা চাকরীও করে কিন্তু তার বাবা চায়না সে পড়াশোনা শেষ না করে চাকরী বাকরী করুক।
আসাদ সাহেব সবই বুঝেন। তবুও স্ত্রী হালকা হওয়ার জন্য হেসে বললেন তোমার এত ভয় কিসের ? তুমি সুস্থ হও তারপর দেখে শুনে ছেলেকে বিয়ে করাবে। ততদিনে অনিকেত লেখাপড়া শেষ করে কিছু একটা করবে।
শামীমা একদিন ছেলেকে পড়ন্ত বিকেলে বলল, বাবা হয়তো তোর বউকে আমি দেখে যেতে পারবো না। আমি সেই ভাগ্য নিয়ে আসিনি তা না হলে এত তাড়াতাড়ি কেন ক্যানসারে আক্রান্ত হবো। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছা গ্রাম থেকে একটা লাল টুকটুকে মেয়ে তোর বউ করে নিয়ে আসি। যে সংসারকে দেখে রাখতে পারবে, ঘুচিয়ে রাখতে পারবে।
মা তুমি অত টেনশন করো না তো । তুমি আগে সুস্থ হও । এই তো একটা বছর তারপর সব হবে। তুমি নিজের হাতে ছেলের বৌকে বরন করবে।
কিন্তু মানুষের পরিকল্পনা এক আর আল্লাহর পরিকল্পনা আরেক। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী এবং তার পরিকল্পনাই সর্বশ্রেষ্ঠ।
বাহিরে তুমুল জোছনা । বারান্দায় সপরিবারে আড্ডা দিয়ে ছেলেরা গেল খাবার গরম করতে আর আসাদ সাহেব গেলেন ঘুমানোর আয়োজন করতে বিছানা ঠিকঠাক করতে।
শামীমা চোখ বন্ধ করে ভাবছিল আর বেশি দিন এভাবে পরিবারের সঙ্গ পাবেনা। বড় অসময়ে তাকে মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে শরীরের খাঁচা ছেড়ে চলে যেতে হবে। কিন্তু শামীমা আর ভাববারও অবকাশ পেলনা। হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে সে ঢলে পড়ল বিছানায়। পৃথিবীর কোথাও কোন কিছু থেমে নেই কিন্তু থেমে গেল শামীমার হৃদপিন্ড, থেমে গেল তার প্রাণ।
খাবার টেবিলে সবাই উপস্থিত কিন্তু শামীমা নেই। অনিকেত তার মাকে ডাকতে গিয়ে দেখল তার মা বিছানায় শুয়ে আছে । যতই ডাকে কোন নড়াচড়া নেই, উঠবার লক্ষণ নেই।অগত্যা অনিকেত গায়ে হাত দিয়ে দেখলো বরফের মত ঠান্ডা শরীর। যখন সে বুঝতে পারলো মাতো আর নেই , মাতো মরে গেছে অমনি সে চিৎকার করে উঠলো।
আসাদ আর অনন্ত আদর দৌড়ে এসে দেখলো একটা মৃত দেহ পড়ে আছে খাটে। তাদের সর্বনাশ যা হবার তা হয়ে গেছে।
কাউকে কিছু না বলে মৃত্যু দূতের সাথে সাক্ষাৎ করে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল শামীমা। পৃথিবীর সমস্ত কষ্ট, যন্ত্রনার উর্দ্ধে চলে গেল সে।
আসাদ সাহেব এটা মেনে নিতে পারলেন না। তিনি যেন সবার মাঝে থেকেও একা হয়ে গেলেন বড় একা।
নিজস্ব বাড়ি গাড়ি আছে আসাদ সাহেবের কিন্তু এখন সুখ নেই, স্বস্তি নেই। রান্নাবান্নার জন্য বুয়ার রাখা হয়েছে কিন্তু ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া হয় না। প্রায় বছর গড়িয়ে গেল এভাবেতো একটা সংসার চলেনা।
অনেক ভেবেচিন্তে বড় ছেলেকে বিয়ের জন্য প্রস্তুত হতে বললেন। মা নেইতো কি হয়েছে এখন তিনি বাবা ও মায়ের দায়িত্ব একসাথে পালন করবেন।
অনেক খোঁজাখুঁজি পর গ্রাম থেকে একটি মেয়ে পছন্দ করা হলো। দীর্ঘ পনের বছর পর গ্রামে গেল অনিকেত। তাকে অনেকেই চিনতে পারলোনা।
চাচিরা তাকে মেহেদী পড়াচ্ছে কিন্তু তার মন পড়ে আছে অন্যখানে যেখানে মায়ের স্পর্শ পাওয়ার জন্য মন কাঙ্গাল।
কিন্তু মাতো আকাশের ওপারে চলে গেছে, সকল ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। চাইলে তো আর মায়ে স্পর্শ পাওয়া যায় না ।তাই একটা কষ্ট, একটা ব্যথা মনের ভিতরে গোপন করে বিয়ের আসরে বসলো অনিকেত।
ছোট ভাই আদরের মনেও তেমন আনন্দ নেই, বাবাও হয়তো মায়ের কথাই ভাবছে। অনেক শখ ছিল মায়ের পুত্রবধু দেখার কিন্তু সেই ভাগ্য নিয়ে তিনি আসেননি তাই আজকে এই আনন্দঘন মুহূর্তে মায়ের কথা মনে পড়ে চোখের পানি জমে উঠে অনিকেতের।
আমরা সবাই একদিন মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে যাব তবু মানব মনের যে স্বাভাবিক আশা-আকাঙ্ক্ষা থাকে তা যদি পূরণ না হয় তাহলে মৃত্যুতে মুক্তি নিয়েও যেন লাভ নেই।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
ক্যান্সারে আক্রান্ত একজন নারীর জীবন সমাপ্তির গল্প তুলে ধরা হয়েছে।
২৪ আগষ্ট - ২০২০
গল্প/কবিতা:
৯৮ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।