ফজরের আযানের পর পর সুফিয়া ঘুম থেকে উঠে খাবার রান্নার কাজে লেগে যায়। কারণ সকাল সাতটার মধ্যেই তাকে আবার মেম সাহেবের বাসায় পৌঁছে কাজ শুরু করতে হবে। তাই ছয়টা কি সাড়ে ছটার মধ্যে তাকে তার ছেলে সমীরের জন্য সকালের নাস্তা ও দুপুরের ভাতের ব্যবস্থা করে যেতে হয়। তার ছেলে স্কুলে পড়ে এবং বিকেলে একটা ওয়ার্কশপে কাজ করে।
খুদের ভাত আর চ্যাপা শুটকির ভর্তা দুপুরের জন্য ডাল আর ডিম ভাজি করে রাখে ছেলের জন্য।
সুফিয়া তড়িঘড়ি করে তৈরী হয়ে বাসা থেকে বের হতে যাবে অমনি ছেলে সমীর চোখ খুলে বলল, বাইরে তো বৃষ্টি হচ্ছে মনে হয়।
-বাবা আজ তোর জন্য শুটকির ভর্তা আর বউরা ভাত রেধেছি। শুনে সমীর খুশি হয়। প্রতিদিন পান্তা ভাত খেতে ভালো লাগে না । আজ মেঘের দিন গরম খুদের ভাত আর ভর্তা খেতে পাবে তাই তার চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক।
সুফিয়াকে বাধ্য হয়ে কাজে যেতে হয়। মা ছেলের ঘর ভাড়া আর খাওয়ার খরচ জোগাতে হয়।
তার স্বামী আলী মিঞা ড্রাইভিং কাজ করতো । একদিন ভোর রাতে একজন প্যাসেঞ্জারকে বিমানবন্দরে নামিয়ে দিতে গিয়ে সে আর ফিরে আসেনি। আলি কি লাপাত্তা, নাকি পলাতক, নাকি মারা গেছে কিছুই জানে না তার স্ত্রী।
অপেক্ষায় থেকে থেকে শেষ পর্যন্ত কাজে নেমে গেছে সুফিয়া। কারণ সঞ্চিত অর্থ ফুরিয়ে যেতে সময় লাগেনি। মানুষ মুখে শান্তনা দেয় কিন্তু টাকা দিয়ে কেউ সাহায্য করে না। আবার সুফিয়া যখন নিদারুন অর্থাভাবে বুয়ার কাজ নিল তখন মানুষ এটা সেটা বলা শুরু করল। তবে মানুষের কথায়তো আর পেট ভরবে না, কাজ করে নিজের অন্ন সংস্থান নিজেকেই করতে হবে।
খুদের ভাতকে বউয়া ভাতও বলে। খুদের ভাত আর চ্যাপা শুটকি ভর্তা মেম সাহেবের জন্য নিয়ে গেল সুফিয়া।
-উফ, সুফিয়া তুমি এসেছ। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। যা বৃষ্টি শুরু হয়েছে আমি তো ভেবেছি তুমি আসতেই পারবে না। বাপ বেটা ঘুমাচ্ছে তুমি ওদের জন্য রুটি আর ডিম ওমলেট করে ফেলো। আমার কলেযে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আমার আর আজকে নাস্তা করা হবে না।
সুফিয়া বলে, ম্যাডাম আপনার জন্য বউয়া ভাত আর শুটকির ভর্তা আনছিলাম একটু যদি খাইতেন।
টেবিলের উপর কাচের প্লেটে বউয়া আর চ্যাপা শুটকি ভর্তা দেখে মোহনা বললো, আরে তুমি এগুলো কোথায় পেলে। সেই কবে গ্রামে থাকতে ছোটবেলায় খেয়েছি।
ম্যাডাম আমিও গ্রামের বাড়িতে গেছিলাম তখন ধানের সিজন ছিল তাই দশ কেজি খুদের চাল কিনে নিয়েছি। বর্ষাকালে যখন বৃষ্টি পড়ে তখন ডিম ভাজা আর এই শুটকি ভর্তা দিয়া খুদের ভাত দারুন মজা লাগে খাইতে। ভাবলাম আপনার পছন্দ হইতে পারে। তাই নিয়ে আইলাম।
মোহনা বেশ মজা করে খুদের ভাত খেলো। তারপর দুপুরে কি কি রান্না হবে সব বুঝিয়ে দিয়ে সে কলেজে চলে গেল। কলেজের সেমিস্টার পরীক্ষা শুরু হয়েছে যথাসময়ে যেতে না পারলে সমস্যা হবে। কলেজে মোহনা বাংলা মিস নামেই পরিচিত।
সমীর নাস্তা খেয়ে স্কুলে চলে গেল তাকে আবার বিকেলে গ্যারেজে কাজ করতে হবে। দুপুরে বাসায় ফিরে একটু জড়িয়ে ভাত খেয়ে সে চলে যায় গ্যারেজে। গ্যারেজের মালিক মোখলেছ বেশ বদ স্বভাবের মানুষ। মানুষের সুবিধা অসুবিধা বুঝেনা। বৃষ্টির দিনে একটু দেরি হলে সে রে রে করে ওঠে। বলে নবাবের পুত এত দেরি করে আসলি কেন ?
- ও তুমি তো আবার স্কুল চোদাও, পড়ালেখা কইরা কত বাল ছিড়বা। আমার এনে মরতে আহস কেন। যেখানে অফিসারের মত যাইতে পারবি -আইতে পারবি, কাম করতে পারবি সেইখানে যা। দেরি হইলে কামে আহনের দরকার নাই। আরেকদিন দেরি কইরা আবি লাত্থি দিয়া বাইর কইরা দিমু।
সমীর চুপ করে এসব কথা শুনে। কারণ সে এগুলো শুনতে শুনতে অভ্যস্ত। গ্যারেজের মোটরসাইকেল সারাইয়ের কাজটা সে ভালোই রপ্ত করে ফেলেছে। তাই তার মালিক মোখলেস মুখে যাই বলুক না কেন মাসে সে ঠিকমতো তার বেতন টা দিয়ে দেয় ।আবার মাঝে মাঝে মায়া করে ওকে এটা সেটা খাওয়ায়।
বলে আহারে তোর বাপ থাইকাও নাই। তুই অভাগা নাইলে আমার মতন পাপী মানুষের কাছে কাম করতে আহন লাগে তোর। বাপের কাছে যে কিছু আবদার করবি সেই কপাল তোর নাই।
-ঠিকমত লেখাপড়া কইরা চাকরি বাকরি করতি রাজার হলে দিন কাটাইতি। তা না ঠুস করে তোর বাপ হইল উধাও। যাক কপালে থাকলে কি আর করবি ? কষ্ট কইরা যা। কষ্ট করলে একদিন সুখের দেখা পাবি।
পুরি সিঙ্গারা খা। কমকাজ সারা জীবনই থাকবো। টাইম মতো খাইয়া লইতে হইবো। আজকে মেঘের দিন চা কফি খাইলে মন্দ হয় না। যা আলকেসের দোকান থেকে সবার জন্য দুধ চা নিয়ে আয়। তখন সবাই চা খেয়ে চাঙ্গা হয়।
আবার কোন কোন দিন চানাচুর দিয়ে মুড়ি মাখা খায় সবাই কাজ রেখে। তখন সবার মনে হয় আসলে এই গ্যারেজটা মন্দ নয়। মোখলেস ভাইকেও তখন সবার ভালো মানুষ মনে হয়।
সমীরের বাপ রফিক মিয়া সেদিন তার মাইক্রো নিয়ে মালিবাগ মোড়ে প্যাসেঞ্জারের জন্য অপেক্ষা করেছিল। দুজন লোক বিমানবন্দরে যাওয়ার জন্য রফিকের সাথে দরকষাকষি করে গাড়িতে উঠে পড়ে।
গাড়ি থেকে নামার সময় চশমাওয়ালা লোকটি বলে আগামীকাল ভোরে ফজরের আযানের আগে তুমি মালিবাগ মোড়ে থেকো আমি বিমানবন্দরে যাব। আমার গাড়ী লাগবে।
রফিক বলে এত ভোরে আমি আইতে পারুমনা।
রফিকের কথা শুনে লোকটি বলে আরে মিয়া টাকা বাড়াইয়া দিমু। কোন চিন্তা করো না। রফিক এবার রাজি না হয়ে পারেনা।
রফিক রাতে খেয়ে দেয়ে সুফিয়ার সাথে খোশগল্প করে। কথায় কথায় জানায় ফজরের আগে তাকে বের হতে হবে। একজন প্যাসেঞ্জার নিয়ে ঢাকা বিমানবন্দর যাবে।
সুফিয়া বলে। এতো ভোরে যাওন লাগবো ! তয় সবাধানে যাইয়ো।
মানুষ যতই সাবধানে থাকুক সে তার নিয়তিকে এড়াতে পারেনা। কখনো কখনো ঘটনার পরম্পরা এমনভাবে সাজানো থাকে মনে হয় মানুষ কেবল অভিনয় করছে। তাকে নিয়ন্ত্রন করছে অন্য কেউ।
রফিক নির্ধারিত সময়ে মালিবাগ মোড়ে উপস্থিত হয়। সে লোকটিও আসে একটু পরেই কিন্তু তার সাথে আছে আরো একটি লোক। সেই লোকের মুখে মাক্স পড়া তাই চেহারা ভাল করে বুঝা যায় না।
ভোরের ঢাকা শহর একদম নীরব। শুধু দু একটা যানবাহন দেখা যায়। রাত শেষে ক্লান্ত নগরী যেন ঘুমাচ্ছে। রফিক এর গাড়ি বাতাস কেটে সাই সাই করে যেন উড়ে যাচ্ছে ফাকা রাজপথে।
রফিক হঠাৎ খেয়াল করলো তার গাড়িতে বসা লোক দুটি প্রচন্ড তর্কে লিপ্ত হয়েছে। সে ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা করলো। গাড়ি তখন কুড়িল বিশ্বরোড ক্রস করছে। হঠাৎ আলী মিয়া দেখতে পেলো মাক্স ভরা লোকটির হাতে ছুরি সে অন্য লোকটিকে ছুড়ি দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করছে।
রফিক মিয়া দ্রুত ব্রেক কষল। তখন সে শুনতে পেলো, আমি মরে যাবো তবুও তোকে এই কাজ করতে দেবনা। রফিক নেমে গিয়ে মাইক্রোর দরজা খুলতেই তার রক্ত হিম হয়ে গেল। মাক্স পড়া আততীয় ছুরি বসিয়ে দিয়েছে ভদ্রলোকটির বুকে।
লোকটি বুক চেপে রেখেছে হাত দিয়ে। রক্ত গল গল করে ঝড়ছে । দ্রুত ভিজে যাচ্ছে শার্ট ও শরীর।
আততায়ী হতভম্ব রফিক মিয়াকে ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দৌড় দিলে। রফিক নিজেকে সামলে নিয়ে ভদ্র লোকের বুক থেকে ছুড়ি বের করে সে আততায়ীর পিছনে নিল।
পুলিশের টহল গাড়ী অদূরে ছিল। সেটা হঠাৎ থামলো। রক্তমাখা ছুড়ি হাতে একজন লোককে দৌড়াতে দেখে তাকে ধরার জন্য টহল পুলিশ ছুটল।
রফিক জানতনা আততায়ীর ইশারায় আরেকটি মাইক্রো রফিকের গাড়িকে ফলো করছিল। হঠাৎ সে মাইক্রোটা ঝড়ের গতিতে এসে থামলো এবং আততায়ীকে নিয়ে উধাও হয়ে গেল।
রফিকের দৌড় থেমে গেল। সে ব্যর্থ হলো। আর এদিকে পুলিশ এসে তাকে ধরে ফেলল। সে যতই বলছে খুনী পালিয়েছে তাকে ধরতে হবে, পুলিশ বলে আরে ব্যাটা তুইতো খুনী তোর হাতে রক্তাক্ত ছুরি।
রফিক বলে আমার গাড়ির প্যাসেঞ্জারকে ছুরি মেরে ঐ লোকটি পালিয়েছে। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখলো লোকটি মরে পড়ে আছে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি রক্তকে আরও ছড়িয়ে দিয়েছে। কেউ জানলনা মাদক বিরোধী একজন সফল মানুষ মারা গেল। রফিককে আটক করে জেলে দেওয়া হলো।
মোহনার স্বামী মিলন সাহেব একজন ব্যবসায়ী। নিউ মার্কেটে তার দুটি দোকান রয়েছে। তিনি ছেলেকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে নিজের দোকানের সামনে এসে কলেজ পড়ুয়া একজোড়া তরুন তরুনীকে চুম্বনরত অবস্থায় দেখে লজ্জায় পড়লেন।
তিনি জোড়ে কাশি দিয়ে জানান দিলেন এখানে তার উপস্থিতি। চুম্বনের সাধ থেকে কিঞ্চিৎ বঞ্চিত সেই যুগল মিলন সাহেবকে দেখে সরে পড়ল।
দোকানে বসে মিলন সাহেব ভাবতে লাগলেন কি দিন কাল পড়েছে। ছেলে মেয়েদের লজ্জা সরমের বালাই নেই। প্রাকশ্যে চুম্মা চাট্টি দিচ্ছে। বন্দ দোকানের সামনে দিন দুপুরে কেউ এই কাজ করতে পারে! তার চোখে সেই চুমোর দৃশ্যটি আবার ভেসে উঠল। আজাইরা ভাবনা ঝেড়ে ফেলে তিনি তার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
কলেজে আজ মোহনা ছাত্র ছাত্রীদের রচনা লিখতে দিয়েছেন বর্ষার দিন নিয়ে। একেক জনের শিরোনাম হবে একেক রকম। যার রচনা ভাল হবে সে প্রাইজ পাবে। সবাই বেশ মন দিয়ে লেখা শুরু করল। সময় দেয়া হলে এক ঘন্টা। রচনা লেকা খাতাগুলো তিনি বাসায় নিয়ে এলেন। রাতে একে একে অনেকগুলো খাতা দেখলেন।
ঢাকার আকাশে বৃষ্টি নেমেছে। মোহনা জানালা খুলে দিলেন। হাওয়া আসছে ঠান্ডা হাওয়া। তিনি এবার যে খাতাটা দেখছেন সেটার মালিক জোভান। জোভান এর কোকড়া চুল, চোখে চশমা আর তার স্টাইল দেখে মনে হয় সে একজন নামী দামী লেখক। মোহনা অবশ্য রসিকতা করে বলে লেখকের ছায়া।
বেশ আগ্রহ নিয়ে মোহনা মেডাম জোভানে খাতা খুললেন। ছেলেটি রচনার নাম দিয়েছে ‘বর্ষা মঙ্গল’। মোহনা পড়তে পড়তে বুঝতে পারলেন এই বর্ষা মঙ্গল এর চরিত্রগুলো আসলে সে নিজে ও তার আসে পাশের সবাই।
এখানে সুফিয়া তার ছেলে সমীর আছে। আছে মোকলেছের মত বকবক করা গ্যারেজ মালিক। রফিক মিয়ার মত ড্রাইভার। আছে মুখোশ পড়া মাদক চোরাকারবারী। মোহনার মত এক শিক্ষিকা ও মিলনের মত একজন ব্যবসায়ীর চরিত্র। তাদের দৈনন্দিন জীবনের কাহিনী উপজ্জীব্য করেই রচনা এগিয়ে চলেছে এবং এক সময় সমাপ্ত ঘটেছে।
মোহনা যখন জোভানের খাতা রেখে ঘুমাতে যাবে তখন বেশ গভীর রাত। জানালাটা বন্দ করে দিল। বাহিরে তখনও বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টি যেন বর্ষা মঙ্গলের বৃষ্টি।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
বর্ষা মঙ্গল গল্পে আমাদের সমাজের মানুষের নানন দিক তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে মেঘ বাদলের দিনের ছোট ছোট ঘটনা ফুটিয়ে তোলার চেষ্ট করা হয়েছে।
২৪ আগষ্ট - ২০২০
গল্প/কবিতা:
৯৮ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।