পৃষ্ঠা নাম্বার চারশত তিন

বাবা (জুন ২০২৩)

মোঃ মাইদুল সরকার
মোট ভোট ১৬ প্রাপ্ত পয়েন্ট ৪.৫
  • ১৪
  • 0
  • ৭৫
মিতুকে ছুটাছুটি করতে হচ্ছে বেশ ক’দিন যাবত। হাসপাতাল টু বাসা, বাসা টু হাসপাতাল। তার উপর আছে মেয়েকে স্কুলে দেওয়া ও স্কুল থেকে নিয়ে আসে। রান্না বান্নাসহ সংসারের হাজারটা কাজ মিতুকে একাই সামলাতে হয়।

সারাদিন এত ধকল যায় যে, নিজের শরীরের প্রতি নজর দেওয়ার সময় নেই। মিতুর বাবার অবস্থা ভালো না। ঢাকায় এনে নিজের বাসায় রেখে বাবার চিকিৎসা করাচ্ছে মিতু। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর বাবা গ্রামেই থাকেন। কিন্তু তার বাবা আজগর সাহেবের পিত্তথলিতে পাথর ধরা পড়েছে।

আজগর সাহেব অবশ্য গ্রাম থেকে শহরে আসতে চাননি। তিনি চেয়েছেন যা হবার তা হবে। শেষ বয়সে আর এসব অপারেশন করে নিজের শরীরকে কাঁটা ছেড়া করবেন না।

কিন্তু মিতু নাছোড়বান্দা সে তার বাবাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করিয়েছে যে, এখন তো আর আগের যুগ নেই। এখন কত জটিল জটিল অপারেশন করা হয় আর এটা তো সামান্য পিত্ত থলির পাথর। ফুটা অপারেশন করে সহজেই পাথর বের করে ফেলা যায়।

আগামীকাল বাবার অপারেশন। সে মনে মনে মানত করেছে যদি অপারেশন সাকসেসফুল হয় তাহলে সে এতিমখানার একদিন সবাইকে বিরিয়ানি খাওয়াবে।

সন্ধ্যায় বাবাকে দেখে এসে মেয়ের জন্য নাস্তা বানানোর পর এক কাপ চা খেয়ে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে শুয়ে থাকলো । শরীরের ক্লান্ত ঘর চলে গেলে সে বাবার ব্যাগটাকে আবার গুছাতে শুরু করল। বাবার লুঙ্গি, গামছা আরও যা যা লাগে তা হাসপতালাতে দিয়ে আসতে হবে।

বাবার ব্যাগে সবসময় একটা দুইটা বই থাকে, ডায়েরী থাকে, কলম থাকে জামা কাপড়ের সাথে।

কি মনে করে ডাইরিটা খুলে চোখ বুলাতে থাকলো মিতু। বাবার হাতের লেখা কি সুন্দর ! এখনও যেন ম্লান হয়নি। হঠাৎ চারশত তিন নাম্বার পৃষ্ঠায় চোখ আটকে গেল মিতুর।

চৌত্রিশ বছর আগের এই দিনে বাবা লিখে রেখেছেন ঘটনাটি -

আজকে মনটা ভালো নেই। একমাত্র মেয়েটার গল ব্লাডার স্টোন ধরা পড়েছে। এত অল্প বয়সে মেয়েটার পিত্তে পাথর ধরা পরল সেটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।

মিতুর মা মনোয়ারা কেঁদে কেঁদে একাকার। কেন আমার বাচ্চার এমন কঠিন রোগ হলো। একটার পর একটা রোগ লেগেই থাকে, হয় ঠান্ডা, নয়তো জ্বর, নয়তো পেট ব্যথা আর এখন তো বড় অসুখ ধরা পড়েছে।

আল্লাহ এখন আমি কি করবো, কোথায় যাব। আমি আর সয্য করতে পারিনা।

স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজের গলাটাই কেমন অদ্ভুত কণ্ঠ শোনাচ্ছে। মনে হচ্ছে যে এখনই বুঝি কান্না বেরিয়ে আসবে। মেয়েটা যদি বাবা-মা দুজনকে কাঁদতে দেখে তাহলে সে ঘাবড়ে যাবে।

তাই স্ত্রী অভয় দিয়ে বলি-আরে এত টেনশন এর কি আছে, কান্নার কি আছে ? আল্লাহর পক্ষ থেকে রোগ এসেছে আল্লাহই নিরাময় করবেন। দেখিনা ডাক্তাররা কি বলে ? যদি ঔষধের মাধ্যমে না সারে তাহলে অপারেশন করাবো। তুমি এত ভেঙ্গে পড়না।

হাসপাতাল থেকে বাসায় এসে মেয়েকে জড়িয়ে মনোয়ারা বেগম আরেকবার কেটে উঠলেন। মেয়ে মিতুকে খাওয়ানোর সময় কেঁদে ওঠেন, ঘুম পাড়ানোর সময় কেঁদে ওঠেন। নামাজ পড়ার সময় কেঁদে ওঠেন । মোটকথা শয়নে স্বপনে যখনই তার মনে পড়ে মেয়ের পিত্ত থলিতে পাথর তখনই তিনি কেঁদে ওঠে।

পাঁচ বছরের মিতু বাবাকে বলে, মা এত কাঁদে কেন ? যখই দেখি শুধু কান্না করে।

মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে বলি, মায়ের মন ভালো নেই তাই কাঁদে। মেয়ের নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকালে আমারও চোখে পানি চলে আসে । সেদিন মিতু খেলা করছিল খেলনা নিয়ে।তার মা পাশের রুমে নামাজ পড়ছিল। সে নামাজ শেষে দোয়া করছে আর কান্না করছে খোদার দরবারে। আল্লাহ তুমি আমার মেয়েকে ভাল করে দাও। আমার মেয়েকে ছাড়া আমি বাঁচবো না।

কোন ফাকে আমার চোখে যে পানি জমেছে টের পাইনি মেয়ে হঠাৎ তাকিয়ে থেকে বলে, বাবা তোমার চোখেও পানি !

আমি অন্য দিকে মুখ সরেয়ে বলি, আমি চোখ কচলিয়েছি তো তাই পানি জমেছে। মনে হয় চোখে কিছু একটা পড়েছে।

মেয়েকে কি করে বলি, ওরে এই পানি তো তোর জন্য, এই কান্না তো তোর জন্য। তোর কিছু হয়ে গেলে কি করে থাকবো রে মা। কি করে নিজেকে বুঝ দেবো।

অনেকে অনেক পরামর্শ দিল। ঢাকায় বড় ডাক্তারের কাছে নেওয়ার আগে হোমিও ওষুধ খাওয়ানো শুরু করলাম।
অনেকের নাকি হোমিও ওষুধে সেরে যায়। যেহেতু প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়েছে হয়তো সেরে যেতে পারে।
মেয়ে ওষুধ খেতে চায় না ঝাঁজ লাগে কিন্তু তবুও তিন বেলা তাকে ওষুধ খাওয়ানো হচ্ছে।

এক মাস পর আবার আল্ট্রা করা হলো কিন্তু রিপোর্ট ভাল আসেনি। তেমন কোন উন্নতি হয়নি ।আগের মতই রয়েছে গলব্লাডার স্টোনটা।

মনে যতটুকু আশা বেধেছিল তাও আবার হতাশায় নিভে গেল ।আবার অস্থিরতা দেখা দিল মেয়েকে কোথায় নিব, কি করব।

সবার পরামর্শ আর ধৈর্য ধরে তিন মাস হোমিও খাওয়ানোর পর আল্ট্রা করে দেখা গেল পাথরটা গলে গেছে। মেয়ের রোগ মুক্তি হয়েছে এর চেয়ে জীবনে বড় আর কোন চাওয়া নেই। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।


ডায়রী পাতা থেকে চোখ ফিরায় মিতু। বাহিরে তুমুল অন্ধকার । কখন রাত্রি হয়ে গেছে সেট টের পায়নি। মিতুর চোখে পানি চলে আসে। এক সময় বাবা মেয়ের জন্য কেঁদেছে এখন মেয়ে বাবার জন্য কাঁদে। মিতুর বাবার মত ডাইরি লেখা অভ্যাস মিতুও পেয়েছে। সে ও নিয়মিত ডায়রী লিখে।

মিতু ভালভাবে খেয়াল করল আজকে তার ডায়েরির লেখার পৃষ্ঠা নাম্বার চারশত তিন। কি কাকতালীয় ব্যাপার। বাব আর মেয়ে একই পাতায় একই কাহিনী লিখে রাখছে। সময় বুঝি এমনই কিছু কিছু ব্যাপার ফিরেয়ে দেয় অগোচরে।

বাবা তাকে নিয়ে লিখেছে এত বছর আগে সেটা ছিল চারশত তিন নাম্বার পৃষ্ঠা। আজ এতটা বছর পর সে বাবাকে নিয়ে লিখছে সেটাও চারশত তিন নাম্বার পৃষ্ঠা।

মিতুর স্বামী হাবিব অফিস থেকে ফিরে বলল, কি ব্যাপার এত চাপের মধ্যে থেকেও তুমি ডাইরি লিখতে বসলে। অন্য সময় রিলাক্সে লিখতে পারতে।

মিতুর মুখ থেকে কোন কথা বা প্রতিউত্তর না শুনে সে মিতুর কাছে এসে বসলো। স্ত্রীর চোখে পানি দেখে সে ব্যাপারটা বুঝতে পারল যে নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে।

মিতু বাবার ডায়েরির কথা খুলে বলল হাবিব কে।

হাবিব বলল, এটাই নিয়তির খেলা । একসময় বাবা সন্তানের জন্য নিজের সবটুকু উজার করে বাঁচিয়ে তোলে আবার বাবা যখন শেষ বয়সে অসহায় হয়ে যায় তখন সন্তান বাবার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়।

আজগর সাহেবের অপারেশন সাকসেসফুল হল। মিতু তাকে জিজ্ঞেস করল বাবা তুমি কি খাবে? তিনি সানন্দে বলে উঠলেন গ্রিল আর বাটার নান।

মেয়েকে অবাক হতে দেখে আজ আজগর সাহেব ভালোভাবে চারপাশ দেখে বুঝতে পারলেন তিনি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন। তখন তার মনে হল যে উনি অপারেশনের রোগী তাকে এই মুহূর্তে এই খাবার দেওয়া হবে না । তাই তিনি চুপ করে থেকে বললেন লিকুইড জাতীয় কিছু।

নাতনি মেহরিমা বলে উঠলো নানা ভাইয়া তোমাকে কি আইসক্রিম দেবো, নাকি চকলেট দেবো।

আজকের সাহেব বললেন, তোমার যা খুশি দাও আমার খেতে না নেই। আজগর সাহেব আবার খুনসুটিতে মেতে উঠলেন। দেখে কে বলবে তার অপারেশন হয়েছে।

আজগর সাহেব বাসায় ফিরলেন। আনন্দে ভরে উঠলো একটি পরিবার। মিতু ফিরে পেলেন বাবাকে। এভাবেই বারবার ফিরে আসুক বাবা নামের বট বৃক্ষের ছায়া সন্তানের উপর।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ মোখলেছুর রহমান অনেক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা
ধন্যবাদ ভাই। ভাল থাকবেন।
মোঃ নুরেআলম সিদ্দিকী অনেক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা দাদাভাই
ধন্যবাদ। ভাল থাকুন সুস্থ্য থাকুন।
Jamal Uddin Ahmed অনেক অভিনন্দন।
ধন্যবাদ। শুভকামনা নিরন্তর।
ফয়জুল মহী সত্য সুন্দর ও সতেজ অনুভব! দারুণ সাহিত্য চিত্র তুলে ধরেছেন এই ধারা যেনো অব্যাহত থাকে অবিরত ।
পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ ভাইজান।
বিষণ্ন সুমন গল্পের বাবারা সবসময়ই ফিরে আসে। ফিরেনা শুধু বাস্তবের বাবারা। অনেক সুন্দর গল্প ভাই। মনটা আর্ত হয়ে উঠলো।
doel paki প্রতি মাসে আপনার গল্প কবিতা পড়ি, ভাললাগে।
mdmasum mia আমার বাবা নেই তাই বাবাকে মিস করি। গল্পের মত যদি বাবা ফিরে আসতো কত ভাল হতো।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

একজন বাবা তার অসুস্থ মেয়েকে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করে তুলেন এবং এই ঘটনা ডায়রীতে লিখে রাখেন। সেই বাবা যখন বৃদ্ধকালে অসুস্থ হন তখন মেয়ে বাবাকে সুস্থ্ করে তুলতে সব দায়িত্ব নিজের কাধে তুলে নেয়। মেয়েও বাবার মত ডায়রীতে এই ঘটনা লিখে রাখে । দুজনের ডায়রীর পৃষ্ঠা নাম্বার চারশত তিন ।

২৪ আগষ্ট - ২০২০ গল্প/কবিতা: ৯৮ টি

সমন্বিত স্কোর

৪.৫

বিচারক স্কোরঃ ২.১ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ২.৪ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪