১৯৮৭ সালের ১৬ অক্টোবরের কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার নিদারাবাদের শশাঙ্ক দেবনাথকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যান পাশের গ্রামের পূর্ব পরিচিত তাজুল ইসলাম।
পার্শ্ববর্তী পাঁচগাঁও গ্রামের তাজুল ইসলাম কসাই তাজু নামে এলাকায় পরিচিত। কোন কোন কসাই গরু, ছাগল কাটতে কাটতে একদিন মানুষ কাটাও শুরু করে। কসাইয়ের কাছে মানুষকে তখন গরু, ছাগল মনে হয়।
শশাঙ্কের অভাবের সংসার। পাঁচ ছেলে মেয়ে। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বাকি চার ছেলে মেয়ে নিয়ে হিমসিম খেতে হয় সংসার চালাতে। তার উপর স্ত্রী সন্তানসম্ভবা।
তার মানে আরও একজন অতিথি আসছে সংসারে। শশাঙ্ক ভেবে কুল কিনারা পায়না। ভিটে ছাড়াও অল্প কিছু জমি জমা আছে। চাষ বাস করে আর মুড়ির মোয়া বিক্রি করে দিন কাল কোন মতে চলে যাচ্ছে।
চতুর তাজু কসাই ইদানিং শশাঙ্কের সাথে বেশ ভাব জমাচ্ছে। শশাঙ্ক লোকটি নিরীহ গোছের। সে ভেবে পায়না মুসলিম তাজু কসাই কেন তার মত এক হিন্দু দরিদ্র মানুষের সাথে এত খাতির রাখছে।
তাজু শুধু শশাঙ্কের সাথে নয় তার পুরো পরিবারের সবার মন জয় করে নিয়েছে। সে যখনই শশাঙ্কের বাড়ি যায় বাচ্চাদের জন্য জুস, চিপস, বিস্কুট নিয়ে আসে। এভাবে ভাল একটা সম্পর্ক গড়ে তোলে শশাঙ্ক পরিবারের সঙ্গে। একপর্যায়ে শশাঙ্কের স্ত্রী বিরজা বালা তাজুল ইসলামকে ধর্মবাবা বলে ডাকতে শুরু করেন। এভাবে চালাক তাজু সবার আস্থা অর্জন করে নেমে পড়ে তার গোপন মিশনে। কথায় কথায় সম্পত্তির অনেক খুঁটিনাটি জেনে যায় তাজু কসাই।
প্রথমে সে ভুয়া দলিল তৈরি করে তাজুল সম্পত্তি আয়ত্তে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সফল হয়না।
শশাঙ্কের সম্পত্তির ওপর লোভ ছিল কসাই তাজুল ইসলামের। কিন্তু কোন মতেই যখন সম্পত্তি গ্রাস করতে পারছেনা তখন সে একদিন ভোরে লোক মারফত শশাঙ্ককে ডেকে নিয়ে যায়।
সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে গুড় নিয়ে ফিরে আসার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হন মুড়ির মোয়া বিক্রেতা শশাঙ্ক দেবনাথ। এরপর দিন যায়, মাস যায়, বছর ঘুরে। ফেরেন না শশাঙ্ক।
শশাঙ্কর স্ত্রী বিরজা বালা যাওয়ার সময় স্বামীকে বলেছিল-
-ওগো তুমি কোথায় যাচ্ছ এত ভোরে। আমার মনটা কেমন জানি করছে। না গেলে হয়না।
-আরে পাগলী। গরীবের কি ঘরে বইয়া থাকলে দিন যাইব। কাম-জাইজ করতে হইবনা। মোয়া বানানোর গুড় শেষ। গুড় আনতে যাই। তুমি কোন চিন্তা কইরনা। যামু আর কাম সাইরা আইয়া পড়মু।
কিন্তু দীর্ঘ দুই বছর চলে গেলেও শশাঙ্কর আর বাড়ি ফেরা হয়নি । হয়নি তার অনাগত সন্তানের মুখ দেখা। এ জীবনে আর কখনো শশাঙ্ক ফিরবেনা।
পরিকল্পনা-মাফিক অপহরণের পর হত্যা করে শশাঙ্কর লাশ গুম করে ফেলা হয়। কেউ জানেনা শশাঙ্কর কি হয়েছে।
এদেক এলাকায় কানা ঘুষা শুরু হয় শশাঙ্ক নাকি তার সমস্ত জমি জমা তাজুর কাছে বিক্রি করে চুপিসারে ভারত চলে গেছে। এবং সে নাকি তার পরিবারকেও ভারত নিয়ে যাবে ! এসব কথা তাজু ও তার লোকেরাই এলাকায় ছড়াতে থাকে।
স্বামীর আশার পথ চেয়ে তাজুল ইসলামসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা করেন বিরজাবালা।
মামলার রায় ঘোষণার দিন ঘনিয়ে আসতে থাকে। তাজুল আর তার সহযোগী বাদশাসহ সবার অপরাধই প্রমাণ হতে থাকে আদালতে। নিশ্চিত বিচারের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কায় ক্ষুব্ধ হয় তাজুল। শশাঙ্কের পরিবারের সবাইকে খুনের পরিকল্পনা আঁটে।
১৯৮৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাত। ঘুমিয়ে আছে মানুষজন,ঘুমিয়ে আছে নিদারাবাদ গ্রাম। শুধু জেগে আছে কসাই তাজুলের নেতৃত্বে একদল দুর্বৃত্ত। গভীর রাতে ত্রিশ থেকে চল্লিশ জনের ওই দুর্বৃত্তের দল হামলা চালায় শশাঙ্কের পরিবারের ওপর।
জানালার লোহার রড ভেঙে ঘর ঢুকে দুর্বৃত্তরা তাদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে। তারা অপহরণ করে নিয়ে যায় শশাঙ্কের স্ত্রী বিরজাবালাসহ তার পাঁচ সন্তানকে। বাঁচার জন্য তারা গগনবিদারী চিৎকার শুরু করে। তাদের চিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলেও সংঘবদ্ধ দলের সামনে দাঁড়াতে সাহস পায়নি আমজনতা।
গ্রামবাসীর সামনে দিয়েই অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয় । বড় একটি নৌকায় তুলে নেওয়া হয় তাদের। নৌকা চলল ধুপজুরি বিলে।
বিরজাবালা বুঝে গেল তাদের সাথে কি ঘটতে যাচ্ছে। সে কাকতি মিনতি করে বলল-
-তোকে ধর্মের বাপ ডেকেছি। তুই যদি মানুষ হয়ে থাকিস তবে আমাকে খুন করে পানিতে ফেলে দে তবুও আমার সন্তানদের ছেড়ে দে। দরকার হয় ওরা এদেশ ছেড়ে চলে যাবে তবুও ওদের বাঁচতে দে।
-হ্যা। কি বললি তুই বাঁচতে দিব। যাতে করে আমাকে ফাসিতে ঝুলাতে পারে। হা হা হা........ আজ তোরা কেই বাঁচবিনা। দুই বছর আগে শশঙ্ক যেখানে গেছে আজ তোরাও সেখানে যাবি।
-তাজু, তুই মনে করিসনা আমাদের মেরে পার পেয়ে যাবি। আমার আর আমার সন্তানের অতৃপ্ত আত্মা তোদের পিছু ছাড়বেনা। আমাদের এই কান্না নিদারাবাদের কান্না হয়ে ফিরে আসবে বারে বারে।
-বেশি কথা কইসনা মাতারী। মরার আগে তোর ভগবানের নাম নে।
বিরজা বালা অগ্নি চোখে তাকিয়ে থাকে তাজুর দিকে তারপর আকাশের দিকে মুখ তুলে কি যেন বলতে থাকে বিড় বিড় করে। তারপর রাতের অন্ধকারে বিল থেকে অস্থিত্বের শেষ চিৎকার ভেসে আসে। থমকে যায় বিলের বাতাস অসহায়ের আর্তনাদে।
নৌকার ওপরই তাদের ছয়জনকে কুপিয়ে হত্যার পর টুকরা টুকরা করে ড্রামে ভরে ফেলে দেয়া হয় বিলের পানিতে।
ধুপাজুড়ি বিল দিয়ে নৌকায় করে প্রতিদিনই বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা ছিল ওই গ্রামের শিক্ষক আবুল মোবারক।
একদিন তিনি স্বপ্ন দেখেন ধুপাজুড়ি বিলের মধ্যে খানে তার নৌকা আটকে গেছে আর ছয়টা নৌকা তার নৌকাকে ঘিরে রেখেছে। কিন্তু সেই ছয় নৌকায় কোন মানুষ নেই। মানুষের পরিবর্তে প্রতিটি নৌকায় একটি করে কাটা মাথা রয়েছে। মাথাগুলো এক সাথে বলে উঠে- মাষ্টার মশাই আমরা বিচার চাই, আমরা কি এই দেশের নাগরীকত্ব অর্জন করি নাই। তাইলে স্বাধীনদেশে ক্যান আমাগো একসাথে খুন হইতে হইল।
বিচার চাই , বিচার চাই , বিচার চাই ? আবুল মোবারকের ঘুম ভেঙ্গে গেল। তিনি খুব ভয় পেলেন। এ কি দেখলেন তিনি ? এই স্বপ্নের অর্থ কি ?
একদিন বিকালে স্কুল থেকে ফেরার পথে বিলের পানিতে দুর্গন্ধযুক্ত তেল ভাসতে দেখেন মোবারক সাহেব। তিনি নৌকার গতিপথটা একটু ঘুরিয়ে নেন। হঠাৎ নৌকার তলদেশে কী একটা আটকে যাওয়ায় ঢুলে ওঠে তার নৌকা! এবার মাঝির বৈঠায় খটখট শব্দ! সন্দেহ হয় শিক্ষক আবুল মোবারকের।
তার নির্দেশমতো মাঝি বৈঠা দিয়ে পানির নিচে খোঁচাখুঁচি করতেই ভেসে ওঠে ড্রাম! তিনি ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের খবর দিলেন। ড্রাম খুলতেই স্তব্ধ সবাই। তিন তিনটি লাশ! সন্ধান চলে আরও। মিলেও যায় আরেকটি ড্রাম। সেটার ভিতরে টুকরো টুকরো করে রাখা আরও তিনজনের লাশ!
লাশ ছয়টি শনাক্ত হলো। এরা আর কেউ নন, নিদারাবাদ গ্রামের নিরীহ শশাঙ্ক দেবনাথের স্ত্রী ও পাঁচ অবুঝ সন্তানের লাশ এগুলো। শশাঙ্কের স্ত্রী বিরজা বালা, মেয়ে নিয়তি বালা , প্রণতি বালা , ছেলে সুভাস দেবনাথ , সুপ্রসন্ন দেবনাথ সুমন ও দুই বছরের সুজন।
লাশে দ্রুত পচন ধরাতে ঘাতকরা ড্রামের ভিতর চুন দিয়ে রাখে। বিল থেকে ছয়জনের লাশ উদ্ধারের পর এই খবর ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের গ্রামে। হাজার হাজার মানুষ মর্মান্তিক সে ঘটনা জানতে ও লাশ দেখতে ঘটনাস্থলে ভিড় জমায়।
কেবল বড় মেয়ে সুনিতী শ্বশুরবাড়ি থাকায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান ।পরিবারের সবাইকে হারিয়ে নির্বাক হয়ে যায় সুনিতী।
হত্যাকাণ্ডের হোতা তাজুল ইসলামের বোনজামাই হাবিবুর রহমান একটি নৌকা নিয়ে লাশ দেখতে এলে এলাকাবাসী তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। কথাবার্তায় সন্দেহ হলে তাকে পুলিশে দেওয়া হয়। তার স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে আসামি করা হয় তাজুল ইসলাম, হাবিবুর রহমান, এনু মিয়া, ফিরোজ মিয়া, হাবিব মিয়া, আবুল হোসেন, জজ মিয়া, বাদশা মিয়া, মো. কাজল, ফারুক মিয়া, আবুল কাশেমকে। এ ঘটনায় ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন সদস্য বাদী হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থানায় মামলা করেন। পুলিশ এ ঘটনায় ৩৮ জনকে দায়ী করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেয়।
পলাতক তাজু কসাই এর শান্তি নেই। সে রাতে ঘুমাতে পারেনা। ঘুমের মধ্যে বিরজা বালা আর তার পাঁচ সন্তান হানা দেয়। মাঝে মাঝে হানা দেয় শশাঙ্ক। ওদের বিদঘুটে চেহারা দেখলেই তাজু কেপে উঠে। ঘুম ছুটে যায়। রাতভর জেগে থাকে। তাজু নিজেকে পাল্টে ফেলেছে। সে বড় দাড়ি রেখেছে, চুল বাবড়ি করেছে। সবসময় বড় আলখাল্লা পড়ে থাকে। তাকে দেখে বুঝার উপায় নেই যে সে খুনী তাজুল।
কিন্তু একজন খুনি কখনো তার চোখ পাল্টে ফেলতে পারেনা। পারেনা তার চাহনী পরিবর্তন করতে আর পারেনা বলেই সে ধরা পরে পুলিশের হাতে।
১৯৯৩ সালের ১১ আগস্ট রাত ২টা এক মিনিটে কুমিল্লা কারাগারে কসাই তাজুল আর বাদশার ফাঁসি কার্যকর হয়। তাজুলের ফাঁসিতে মৃত্যু হওয়ার পর সেই নিরপরাধ ছয়টি আত্মা যেন শান্তি অর্জন করে।
সেদিনের সেই নির্মমতায়, নৃশংসতায় এখনো রাতের বাতাসে নিরবে কাঁদে নিদারাবাদ।
(গল্পটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত ।)
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার নিদারাবাদের শশাঙ্ক দেবনাথ ও তার স্ত্রীসহ পাঁচ সন্তানের হত্যাকান্ড নিয়ে গল্পটি লিখিত।
২৪ আগষ্ট - ২০২০
গল্প/কবিতা:
৯৮ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪