বারান্দায় অলস বসে আছে সাহারা । বাহিরে কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। বিকালের মরা রোদও শেষ আলো ছড়িয়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। একটু পর সূর্য ডুবে যাবে। সমগ্র চরাচর জুড়ে নেমে আসবে সন্ধ্যার অন্ধকার। সন্ধ্যার আজান পড়বে তবুও উঠতে ইচ্ছে করছে না। উঠেই বা কি করবে। কাজ কাম কিছুই ভাল লাগেনা। ভাবনার সবটুকু দখল নিয়েছে আদিল।
সাহারা আদিল দম্পত্তির এক ছেলে, এক মেয়ে। লামিয়া ও লাবিব। দুজনের নাম ‘ল’ বর্ণ দিয়ে মিলিয়ে রাখা হয়েছে। ‘ল’ বর্ণ দিয়ে ছেলে মেয়ের নাম রাখার কারণ ‘ল’ বর্ণের অনেক শব্দ আদিলের পছন্দ ছিল। যেমন- লাভ, লাল গোলাপ, লাকি, লৌহ, লীলা, লাভার, লাল টুকটুকে বউ, লাল রক্তসহ আরও অনেক কিছু। বলা চলে সুখের সংসার ছিল তাদের। সংসার এখনো আছে কিন্তু সাহারা যাকে নিয়ে সংসার করবে সেই মানুষটাই নেই। এখনও একান্নবতী পরিবারে তাদের বসবাস। আদিলের আরো দুই ভাই রয়েছে। তাদের ছেলে মেয়ে ও আদিলের মা সবাই একসাথেই থাকে।
কথায় বলে না, ‘মানুষের সুখ বেশিদিন থাকে না।’ সাহারার ক্ষেত্রে হয়েছে তাই। রাতে স্বামী- স্ত্রী গল্প করতে করতে ঘুমিয়েছে। কত কথা বলেছে, কত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করেছে। ছেলেকে বানাবে আর্মি অফিসার আর মেয়েকে বানাবে ডাক্তার । তাদেরকে ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়েছে। তো সেদিন ভোরে যখন সাহারা ফজর নামাজ পড়তে উঠল আদিলকেও ডাক দিল কিন্তু আদিল অন্যান্য দিনের মতো সারা দেয়নি। ঘুমের মধ্যেই আদিল এর হৃদ ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে তার জন্য পৃথিবীর সমস্ত কাজ। বন্ধ হয়ে গেছে চিন্তা ভাবনার অধিকার। বন্ধ হয়ে গেছে তার নিঃশ্বাস নেওয়া, বন্ধ হয়ে গেছে তার কথা বলা, বন্ধ হয়ে গেছে তার স্বপ্ন দেখা।
বার বার ডাকার পরেও আদিল যখন জেগে উঠলো না তখন সাহারা হাত দিয়ে স্বামীকে নাড়তে গিয়ে দেখে সে বরফের মত ঠান্ডা হয়ে আছে। অবিশ্বাস্য এক দৃশ্যের অবতারনা হলো। যখন সে বুঝলো চিরদিনের জন্য স্বামী বঞ্চিতা হয়েছে তখন তার চিৎকারে অন্য সবাই জড়ো হলো ঘরে। লাশের পাশে সেই যে চোখের জল গড়াতে লাগলো এখনো তা বন্ধ হয়নি।
শীতের শেষ বিকেলে বসে সে তার নিয়তির কথাই ভাবছিল- স্বামীহারা সংসারে দুটি সন্তান নিয়ে সে এখন কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না।
শোকের বহতা নদীতে ভেসে চললেই সব বন্ধ থাকবে না। ক্ষুধা নিবারনে খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। ছেলে মেয়ের লেখাপড়ার খরচসহ হাজারো চাহিদা মেটাতে হবে। কোথা থেকে কিভাবে মিটাবে সেটাই এখন সাহারার সবচেয়ে বড় চিন্তা।
আদিল মরেছে মাসখানেক হলো এর মধ্যেই বাড়ির অন্য সদস্যদের আচার-আচরণ পাল্টে গেছে। আগে যেখানে লামিয়ে ও লাবিবকে তার চাচারা আদর করে এটা সেটা দিত এখন তাদেরকে দেখলেই একটা বিরূপ ভাব দেখায়। যেন ভাই বোন দুটি গলার কাঁটা।
সবার ভাবখানা এরকম তোমার যেহেতু স্বামী নেই ,তুমি হয় ছেলেমেয়ে নিয়ে গিয়ে বাপের বাড়িতে থাকো না হয় সংসারে খেটে মরো।
সেদিন লাবিব বলছিল তার চাচাতো ভাই হাবিবের সাথে সে মাঠে খেলা করছিল তখন তার চাচা নাজির চৌধুরী অফিস থেকে ফিরছিল। হাবিব চকলেটের বায়না করলে তাকে চকলেট কিনে দিলেও পাশে থাকা লাবিবকে কিছুই কিনে দেয়নি।
উল্টো হাবিব যখন লাবিবকে চকলেট কিনে দেওয়ার কথা তার বাবাকে বলে তখন নাজির চৌধুরী চোখ রাঙিয়ে ছেলেকে শাসন করে। বলে- নিজে খেতে পায় না পড়শিকে ডাকে।
সন্ধ্যায় ছেলে মন খারাপ করে বলল, মা জান চাচ্চু না হাবিবকে চকলেট কিনে দিয়েছে আমি হাবিবের সাথে ছিলাম আমাকে কিছুই কিনে দেয়নি।
-তুমি কি কিছু চেয়েছো ?
-না মা কিছু চাইনি।
-মন খারাপ করনা। আমি কিনে দেব। কখনো কারো কাছে কিছু চাবেনা।
লামিয়া বারান্দায় গাছের টবে পানি ঢালছিল সে মা ছেলের কাথা শুনে কাজ বন্ধ রেখে সেও এসে যোগ দিল।
-মা, পরশু দিন দুপুরে তুমি বাসার বাহিরে ছিলে। লাউ শাক, চিংড়ি ভুনা আর ডাল রান্না হয়েছে। দুপুরে সবাই সব তরকারি দিয়ে ভাত খেলেও আমাকে চিংড়ি ভুনা দেয়নি। আমি চাচির কাছে চেয়েছিলাম, উনি বলেছে শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আমি পরে চুপি চুপি রান্না ঘরে ঢুকে দেখেছি আরও তিন/চারটা চিংড়ি রয়েছে।
-দাদিকে বলতে ।
-দাদিকে বললে কি হবে মা, তিনিওতো তাদের দলে। বাবা মরে যাওয়ার পর সবাই কেমন যেন হয়ে গেছে। আমাদের ঠিকমত আদর করেনা, খেতে দেয়না।
বাবার কথা মনে হতেই লামিয়া কাঁদতে লাগলো।
সাহারা ছেলে ও মেয়েকে বুকে টেনে আদর করতে লাগলেন। শান্তনা দিয়ে বললেন সংসার এমনই বাবা না থাকলে ছেলে মেয়েদের কদর থাকেনা। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমরা ঠিক মত লেখা পড়া করো। বাবার স্বপ্নকে সত্যি করো তাহলে আর কোন দুঃখ থাকবেনা।
সাহারা বেগম বুঝতে পারলেন তাকে কিছু একটা করতে হবে হয় চাকরি নয়তো ব্যবসা। শুধু গৃহিনী হয়ে তিনি এ সংসারে টিকতে পারবেন না। তার উপরে আছে মা হওয়ার দায়। এখন ছেলে মেয়ের কথায় মুখ খুললে হয়তো বলে দিবে-তোমাদের না পোষালে আলাদা খাও, আলাদা থাকো। তার চয়ে টিকে থাকার জন্য কিছুদিন মাটি কামড়ে থাকাই ভালো।
সাহারাকে এখন মায়ের পাশাপাশি বাবার ভূমিকাও পালন করতে হবে। সাহারা বাবার বাড়ি কিছুদিন থেকে এসেছে সেখানেও সে দেখেছে ভাই-ভাবী, বাবা-মা সবার চোখে একটা ভয়। যদি সাহারা ছেলে মেয়ে নিয়ে পাকাপাকি চলে আসে ! কিংবা সে যদি থাকতে চায় তখন কি হবে ?
একটি মৃত্যু একটি পরিবারকে কেমন ওজহীন, মূল্যহীন করে দেয় সাহারা তা হারে হারে টের পেল। তাই সে তিন দিনের বেশি বাবার বাড়িতে থাকেনি। কাউকে বুঝতে না দিয়ে মনের ভিতর ক্ষোভ নিয়ে ছেলে মেয়ের হাত ধরে স্বামীর বাসায় চলে এসেছেন।
বেশ ক’দিন চাকরির জন্য ঘুরাঘুরি করে চাকরির বাজারের অবস্থা দেখে ও মন মত চাকরি না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ে। তার পর বান্ধবী শবনমের পরামর্শে নিউ মার্কেটে জুয়েলারি ব্যবসায় শুরু করে দোকান ভাড়া নিয়ে। যেহেতু শবনমের স্বামী মুকুল পাটোয়ারী নিউ মার্কেটে ব্যবসায় করে তাই সাহার দোকান পেতে সমস্যা হয়নি। ব্যবসায়িক কাজে স্বামী মুকুল পাটোয়ারী সাহারাকে অনেক সাহয্য করেন এবং বিভিন্ন বিষয় বুঝিয়ে দেন এতে করে ব্যবসার জগতে সাহারার পথ চলা সুগম হয়।
বিপদের দিনে যে পাশে থাকে সেই প্রকৃত বন্ধু। মাঝ খানে সাহারা শবনমের কোন খোঁজ খবর না নিলেও শবনব ঠিকই সময়মত বান্ধবীর পাশে দাড়িয়েছে।
এত কিছু করেও শ্বশুর বাড়ির লোকদের মন ভার। আড়ালে দেবরের বৌরা বলে-মেয়ে মানুষ কে দিয়ে ব্যবসায় হবে নাকি ? মাঝ খান থেকে নগদ যা ইনভেস্ট করেছে সবই লস হবে।
সাহারা বুঝেনা নগদ ইনভেস্ট নিয়ে ওদের এত মাথা ব্যাথা কেন ? না দেবর, না শ্বাশুড়ী কেউতো একটা টাকাও দেয়নি। উল্টো সাহারা যেন ব্যবসা না করে সেটাই তারা চেয়ে ছিল। নিজের গহনা বিক্রির টাকা আর আদিলের ব্যাংকে থাকা টাকা দিয়েই সে ব্যবসা শুরু করেছে।
প্রথম প্রথম কাস্টমার পেতে ব্যাগ পেলেও ইনাদিনং বেশ বেচা বিক্রি হচ্ছে। বছর না ঘুরতেই দুজন সেলসম্যান নিয়োগ দিয়েছে সাহারা।
ভাল মানের গহনার বেশ চাহিদা রয়েছে বাজারে। নিত্য নতুন ফ্যাশনেবল গহনার কালেশন থাকে তার দোকানে। তাই ‘লামিয়া’স চয়েজ’ নামক দোকানটির গ্রাহক বাড়তে থাকে হু হু করে।
গ্রাহক একদিকে বাড়ে অন্যদিকে সাহারার ভাগ্যের চাকা ঘুরে। ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে বাবার বাড়ি, শ্বশুড় বাড়ির সবার ব্যবহার। সারাহার অবশ্য কে কি করেছে ওসব মনে রাখেনি। কারল সে জানে বিজয়ীর পাশে সবাই থাকে পরাজিত সৈনিকের পাশে কেউ থাকেনা।
সাহারা হার না মানা নারী হয়েছেন বলেই হতে পেরেছেন জয়িতা। এ সমাজে সাহারার মত হাজারো জয়িতার প্রয়োজন।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
সাহারা নামক এক নারী স্বামী হারিয়ে সংসার যুদ্ধে কি করে জয়িতা হতে পেরেছেন গল্পে সেটাই তুলে ধরা হয়েছে।
২৪ আগষ্ট - ২০২০
গল্প/কবিতা:
৯৯ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ জানুয়ারী,২০২৫