হামিদা বানু বসে আছে উঠানে ।ঘটনার আকস্মিকতায় সে নির্বাক। মানুষটা রাত্রে কত কথা কইল ।শেষ রাত্রে ঘুম থাইকা উইঠা হঠাৎ কইতাছে বুক টা ব্যথা করতেছে। মনে হইতেছে কি যেন খামচে ধরছে বুকের ভিতর। কে যেন আমার হৃদপিণ্ডটারে ছিড়া ফেলতাছে। তারপর পানি চাইল । পানি আনতে হামিদা বানু ঘরের বাইরে কল তলায় গেল।
টিউবওয়েল চেপে জগ ভর্তি পানি নিয়ে ঘরে এসে দেখে স্বামী তার মাটির মেঝেত উপুড় হয়ে পড়ে আছে।
কি হইছে রহিম এর বাপ কইয়া স্বামীরে ধরে দেখে সে মরে গেছে। তার জোয়ান স্বামীর দেহে প্রান নাই।
তারপর আল্লাহ গো আমার কি সর্বনাশ হইল বলে, চিৎকার দিয়ে কাঁদার পর সেই যে নির্বাক হয়ে গেল এখন বেলা মাথার উপরে উঠে গেলেও আর কোন কথা বলেনি হামিদা বানু।
উঠোন ভর্তি লোকজন। সবাই কথা বলছে রহিমের বাপের অকাল মৃত্যু নিয়ে। আহারে বাচ্চা দুইটা এতিম হইয়া গেল, ভরা যৌবনের বউটার গতি হইবো কি? আল্লা তুমি এইডা ক্যামন কাম করলা?
হামিদা বানু মনের ভিতর কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে বাইরে থেকে কেউ তা টের পাচ্ছে না। একেতো স্বামী হারানোর শোক তার উপর সংসারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি না থাকায় ছেলে মেয়ে সহ সামনের দিনগুলো কিভাবে কাটবে সেই আসন্ন বিপদের কথা ভেবে তার চোখ বেয়ে নতুন করে জলের ধারা গড়িয়ে যাচ্ছে।
সব ভাবনা ছাপিয়ে হামিদা বানুর চোখের সামনে যেন বহু বছর আগে ঘটে যাওয়া একটি ছবি ভেসে উঠলো ।
অনেক বছর আগে ঠিক এমনই এক সকালে হামিদা বানুর মা রহিমা বানু তার স্বামীকে হারিয়ে উঠানে স্বামীর মরদেহের সামনে আহাজারি করছিলেন। হামিদা বানুরা তিনবোন মায়ের পিছনে বসে কাঁদছিল। কারন ততক্ষনে তারা বুঝতে পেরে গেছে বাবা নামের বট বৃক্ষে ছায়া তাদের মাথার উপর থেকে সরে গেছে। কঠিন পৃথিবী তাদের জন্য আরো বেশী কঠিন হয়ে উঠবে। অভাব অনটন আর মানুষের অবহেলা পরবর্তীতে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল তারা। বাবা না থাকলে পৃথিবীতে টিকে থাকা মুশকিল। বাবা না থাকলে এ সমাজের মানুষেরা সহজে কাউকে মূল্য দিতে চায় না।
বাবা মারা যাওয়ার পর পড়শীরা একদিন খাবার দিয়েছিলো তারপর দুদিন রহিমা বানুর চুলায় আগুন জলেনি। ক্ষুধা তৃষ্ণা কাতর হামিদা বানুরা বাড়ির কাছে জঙ্গলে গিয়ে গাছের পাকা ফল পেড়ে খেয়ে আর জল খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছিল টানা দুটি দিন। ক্ষুধার জ্বালা বড় জ্বালা সেই দিনই হামিদা বানু বুঝে গিয়েছিল।
সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি কি হবে হামিদা বানুর দুটি সন্তানের জীবনেও! ক্ষুধার জ্বালা তার সন্তানেরাও কি ছুটে বেড়াবে এদিক-ওদিক।
ছেলে রহিমের ডাকে বাস্তবে ফিরল হামিদা বানু। রহিম মাকে বলে, মা বাবারে সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখছে ক্যান ? বাবা আজকে ঘুম থেকে উঠে না ক্যান, কথা কয়না কেন? বাবায় কামে যাইব না ?
ছেলের কথা শুনে হামিদা বানুর শোক যেন আবারো উঠল উঠল।ছেলেকে জড়িয়ে ধরে সে বলতে লাগল, তোর বাবায় মইরা গেছে। আর কোনদিন কথা বলবো না। আর কোন দিন উঠবো না, কামে যাইবনা। তুই এতিম হয়ে গেছোছ বাজান তুই এতিম হয়ে গেছোছ ।
হামিদা বানুর সেই কথাগুলো পড়শীদেরও ছুঁয়ে যায় তাইতো কেউ কেউ হাত দিয়ে চোখের জল মুছে আবার কেউ শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে নিষ্ঠুর মরণের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে। মনে মনে খোদার কাছে আর্জি পেশ করে, তাদের সন্তানদের যেন এমন অকালে পিতৃহারা হতে না হয়।
দেখতে দেখতে কতগুলো বছর কেটে গেল হামিদা বানুর দ্বিতীয় বোন হাসিনা বানুর বিয়ে হয়ে গেল গজারিয়া থানার ভবেরচর গ্রামে।
হাসিনার বানুর দিনগুলো ভালই যাচ্ছিল। দু'বছর পর কোল জুড়ে পুত্র সন্তান আসে। পুত্র পেয়ে হাসিনা বানু আর তার স্বামীর সুখের দিন যেন আরও সুখময় হয়ে উঠল।
কিন্তু সুখ চিরদিন কারো স্থায়ী হয়না। গুনে গুনে সুখের দিন শেষ হয়ে গেল একদিন।
হাসিনা ভানুর স্বামীর চাকরি চলে গেল। সংসার চালাতে সে ধার-দেনা করে একটি মুদি দোকান দিলো। দোকানটি ভালো চললেও নগদ এর চেয়ে বাকিতে বেচাকেনা বেশি হতে লাগলো। দিন যতই যেতে লাগল পাওনাদারের কাছে পাওনা টাকা চেয়ে বারবার খালি হাতে ফিরতে হত হাসিনা বানু স্বামীকে।
দেনার দায়ে জর্জরিত হাসিনার স্বামীর রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেল। চিন্তায় চিন্তায় শরীর শুকিয়ে কাঠ। এক সপ্তাহ জ্বরে ভুগে যখন হাসিনা বানুর স্বামী কাহিল তখন তার দেবর ও ভাসুর মিলে হাসিনা বানু স্বামীকে ঢাকায় হাসপাতালে নিয়ে গেলে। ডাক্তাররা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললেন রোগীর এখন শেষ সময় আপনারা বাড়িতে নিয়ে যান। রোগী যা খেতে চায় তা খাওয়ান।
হাসিনা বানুর স্বামীর ভাইয়েরা তাকে জোর করে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করাতে থাকে কিন্তু ডাক্তাররাও বলে দিয়েছেন রোগীর কিডনি, লিভার, হার্ট সবকিছুতেই মারাত্মক সমস্যা দেখা দিয়েছে। যেকোনো সময় মৃত্যু ঘটে যেতে পারে।
পরের দিন সকালে হাসিনা বানু ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়ে পেলেন স্বামীর লাশ। পুত্র হলো বাবা হারা। হাসিনা হলেন স্বামীহারা। বাবার আদর, স্নেহ, শাসন থেকে বঞ্চিত হয়ে অনাদরে অবহেলায় দিন কাটতে লাগলো হাসিনা বানুর সন্তান জায়েদের।
মেয়েকে সান্তনা দিতে এসে হামিদা বানুর মা রহিমা বানু আক্ষেপ করে বললেন- কি ভাগ্য নিয়ে দুনিয়াতে আইলাম, অকালে জামাইরে হারাইলাম। দুই মাইয়ারে বিয়া দিলাম মাইয়ারাও স্বামীহারা হইলো। মাইয়াগো সন্তান হইল পিতৃহারা । খোদা তুমি এমন কষ্ট আর কোনো নারীর কপালে লেইখনা। এমন নরক যন্ত্রনা আর কাউরে দিওনা।
হামিদা বানু আর হাসিনা বানুর ছোট বোন হোসনা বানু। সে এখন বেশ বড় হয়েছে বাবার মৃত্যুর সময় সে এতটাই ছোট ছিল যে বাবার স্মৃতি তার মনের গহীনে কোথাও জমা নেই। হোসনা বানুর বিয়ে হয়ে গেল পাশের গ্রাম লক্ষ্মীপুরের জামালের সাথে। বিয়ের পর জানা যায় জামালের একটিমাত্র কিডনি আছে। ফল বিক্রেতা জামাল হঠাৎ হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যায়। হাসনা বানু তার মায়ের , তার বোনদের ভাগ্য দেখে নিজের ভাগ্য নিয়ে শংকিত। সে দিন-রাত জামালের সেবা-যত্ন করে ।খোদার কাছে মিনতি করে, খোদা অকালে আমার মায়ের মতো আমার বোনের মতো আমারে স্বামী সুখ থেকে বঞ্চিত করো না।
কিন্তু ভাগ্যের লিখন বদলানো তো মানুষের কর্ম নয়। বছর না ঘুরতেই জামাল এক সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে জ্ঞান হারিয়ে গাড়ি থেকে পড়ে এক্সিডেন্টে মারা যায়। স্বামীর মৃত্যুর খবন শুনে হোসনা বানু যেন পাথর হয়ে যায়।
আকাশের দিকে মুখ তুলে সে বলতে থাকে,অকালে বাবারে হারালাম। যৌবনে স্বামীরে হারালাম। আমি এখন কোথায় যাব, কার কাছে যাবো?
হোসনা বানুর এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই । নিয়তি কাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করায় তা আমরা জানিনা। যিনি জানেন তিনি নিরুত্তর।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
বাবা নামের বট বৃক্ষের ছায়া মাথার উপর থেকে সরে গেলে জীবনের পথ চলা কত কঠিন, কি অসহনীয় বিপদ নেমে আসে একটি সংসারে সেটাই গল্পে তুলে ধরা হয়েছে।
২৪ আগষ্ট - ২০২০
গল্প/কবিতা:
৯৮ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।