শোকাতর জননী

মা (মে ২০২২)

মোঃ মাইদুল সরকার
  • ২৩০
জলিল সাহেব আর মেহেরুন নেছার সংসারে চার ছেলে মেয়ে। খোলাহাটি ক্যান্টনমেন্টের কোয়াটারে দিব্যি চলে যাচ্ছে সুখের দিনগুলো। ছেলে মেয়েরা স্কুলে পড়ে। বাবা তাদের আর্মি অফিসার। বাবাকে ভীষন ভয় পায় ওরা। সেই তুলনায় মা তাদের হাতের কাছে জলের মত যখন ইচ্ছে তখন ছোঁয় যায়। চাওয়া-পাওয়া আর যত আবদার সব মায়ের কাছে জানান দেয় ভাই-বোনেরা।

সেদিন সন্ধ্যায় ছেলে মেয়েরা পড়তে পসেছে, স্বামী ডিউটিতে। মেহেরুন নেছা ওয়ারড্রব এর ভিতর অনেক জামা-কাপড়ের মধ্যে ছোট্ট একটি প্যান্ট খোঁজে বের করলেন। এ যে তার পরম যতনে রাখা এক রতন। এ যে তার মৃত প্রথম পুত্রের একমাত্র স্মৃতি। এই এক টুকরো কাপড় তার সুখে-দুঃখের অনন্য অনুভূতি।

পুত্র বেঁচে নেই। কিন্তু তার আদরের সন্তানের শরীরের ঘ্রাণ লেগে আছে এই জাম রঙের প্যান্ট এর মধ্যে। ছল ছল চোখে টল টল নোনা জল নিয়ে প্যান্টটিতে হাত বুলিয়ে পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে ধরলেন মেহেরুন নেছা। শেষমেষ চোখের জল বাধা না মেনে গড়িয়ে পড়ল বর্ষার বানের মত প্রথম সন্তানকে স্মরণ করে।


নৃদুল মাকে খুঁজতে খুঁজতে দরজার কাছে এসে অবাক হয়ে দেখলো- তার মা ছোট্ট একটি কাপড় হাতে নিয়ে কাঁদছে। এত ছোট প্যান্ট, কার এটা? মনে প্রশ্ন জাগতেই সে মাকে বলল, মা এটা কার প্যান্ট?

___ তোমার বড় ভাই এর।

___ ভাইয়ের প্যান্ট। কোন দিন বলনিতো ভাইয়ার প্যান্ট স্মৃতি হিসেবে রয়েছে।

___ বলে লাভ কি । কেবল কষ্ট বাড়ানো। স্মৃতির অতল তল থেকে দুঃখ নামের ফুল ছিড়ে আনা।

নৃদুল অবাক হলো এই ভেবে যে, মা ভাইয়ার সেই পেন্টি আগলে রেখেছেন বছরের পর বছর। তারা ভাই বোনেরা তা কখনো দেখেওনি, বুঝতেও পারেনি।

নৃদুল তার বোনকে রাতের বেলায় ঘুমাতে যাবার আগে বলল, ভাই মারা গেছে যখন তখন আমরা অবুঝ । তাই তার কোনো স্মৃতি আমাদের মনের মধ্যে নেই। ঝাপসা কুয়াশার মতন কেবল ভাসা ভাসা মৃত্যুদিনের কিছু ঘটনা মনে পড়ে আমার। কান্না কাটির আর অনেক মানুষের আনাগোনা সারা বাড়িময়। আমরা জমজ দুই ভাই বোন সেদিন মায়ের সান্নিধ্য পাইনি কারণ মা তখন কাঁদতে কাঁদতে পাগলের মত হয়ে গেছেন চিরতরে পুত্র হারানোর কষ্টে।

নৃদুলের কথা শুনে জুলি বলল, আমার তো স্মৃতি বলতে কিছুই নেই, কিছুই মনে পড়েনা। ইস ভাইয়া যদি বেঁচে থাকতো আজ কত বড় হতো! আমাদের কত আদর করতো।

___ ভাইকে আমি আরেকবার দেখেছিলাম কিন্তু সেটা কি স্বপ্ন নাকি সত্যি নাকি কল্পনা আজও বুঝে উঠতে পারিনি।

এই কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে ‍জুলি বলল, কবে কোথায় কখন দেখেছিলি ?

___তখন সবে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়ি তুই আর আমি। একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি মা ঘরে নেই । আমি গোসল করার জন্য মাকে খুঁজছি খুঁজতে পুকুর পারে চলে গেলাম। পুকুরপাড়ের একপাশে কবরস্থান, সেই কবরস্থানে বড় একটি তেতুল গাছ। সেই তেঁতুল গাছের দিকে নজর যেতেই দেখি আমার ভাই সেখানে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। তেঁতুল খাচ্ছে, কাঁধে তার একটি গামছা।

আমি ভাইকে দেখে খুব খুশি হলাম । বললাম, ভাইয়া তুমি ওইখানে কি করছো।

ভাইয়া বলল, গোসল করার জন্য এসেছি, মায়ের জন্য অপেক্ষা করছি।

নেমে আসো গাছ থেকে আমিও গোসল করবো। তুমি কি গোসল করবে আমার সাথে ? একটু পর মা আসবে, মা আসলে তখন গোসল করবো। কত দিন মায়ের হাতে গোসল করিনা।

তারপর তুই কি করলি? জুলির চোখে বিষ্ময়!

___হন্তদন্ত হয়ে মাকে খুঁজতে আবার বাড়িতে আসলাম এবং সহজে পেয়েও গেলাম। তারপর মা-কে টানতে টানতে নিয়ে গেলাম সেই পুকুর পাড়ের কবরস্থানে, যেখানে ভাই বসেছিল। সেই তেঁতুল গাছের দিকে তাকিয়ে বললাম- মা, ভাইয়া এখানে বসে ছিল তোমার অপেক্ষায়। গোসল করতে এসেছিল। কত দিন তোমার হাতে নাকি গোসল করেনা!

কিন্তু ততক্ষণে সেখানে কিছুই নেই। তেঁতুলের ডাল বাতাসে দুলছে। মা একবার সেই গাছের দিকে একবার আমার দিকে তাকিয়ে ঘটনাটা বুঝার চেষ্টা করছে।
তারপর হঠাৎ এক অজানা ভয় ও আতঙ্কে মায়ের মুখ রক্ত শূণ্য হয়ে গেল। ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠল মায়ের শরীর সাথে আমারও। মা বুকে থুতু দিয়ে আমাকে নিয়ে দ্রুত ঘরে চলে আসলো। আমাকে বুকে জড়িয়ে অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে বললো, এই কথা যেন আমি কাউকে না বলি।

আমার চোখে আজও ভাসে লাল গামছা কাঁধে ঝুলিয়ে ভাইয়া বসে আছে গাছের ডালে উদাস দুপুরে। রোদ্র ঝলমল করছে তার সোনাবরন অঙ্গে।

___ জানসি নৃদুল আমি না মাঝে মাঝে মাকে খুব গোপনে কাঁদতে দেখি। কিন্তু বুঝতাম না কেন কাঁদে। আজ বুঝলাম। ভাইয়ার কথা স্মৃতিতে ভেসে উঠলে মা কাঁদে।

___গত সপ্তাহে তুই যখন শিউলীদের বাসায় গিয়েছিলি। তখন পাশের বাসার আন্টি এসেছিল। বিকেল বেলায় আমার ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। আন্টির সাথে মায়ের কথোপকথোন আমি শুনতে পেয়েছি।

জুলি নীচু গলায় বলল, কি বলেছেরে মা আন্টিকে ?

___ ছেলে আমার মারা গেল ওষুধ পেল না। গ্রামের বাড়িতে সেবার প্রচুর আম ধরেছিল। বৈশাখী ঝড়ে আমার বড় ভাই গ্রামের আরো অন্য সব ছেলে মেয়ের সাথে বৃষ্টিতে ভিজে আম করিয়েছিল। এমনকি রাতের বেলায়ও খালে নেমে আম কুড়িয়েছে।

পরের দিন থেকেই তার জ্বর । সেই জ্বর যে কাল জ্বর হয়ে ভাইয়ের জীবনে আসবে মা ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেননি । জ্বর ঠান্ডায় ভাই যখন কাতর এবং খাবার যখন খাচ্ছিল না তখন মা তাকে আম কুড়ানোর জন্য বকাবকি করছিলেন।

তিন দিন পরেও জ্বর যখন কম ছিলনা তখন কাজের লোককে দিয়ে ডাক্তার বাড়িতে ওষুধ আনার জন্য পাঠালেন । কিন্তু দুর্ভাগ্য সেই লোক যখন ওষুধ হাতে বাড়ির কাছাকাছি আসলো তখন শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি ও বজ্রপাত। সেই বৃষ্টি থেকে বাঁচতে সে পরিত্যক্ত একটি ঘরে আশ্রয় নিল আর এদিকে আমার ভাইয়ের শুরু হয়েছে মৃত্যু যন্ত্রণা।

মা শিয়রের পাশে বশে ওষুধ আসার অপেক্ষায় ছিল । কিন্তু নিয়তির কি নির্মম পরিহাস ওষুধ মুখে দেওয়ার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ভাইয়া। সেই থেকে যখনই ভাইয়ের কথা মনে পড়ে- মা কেবল কাঁদে আর বলে আমার সন্তান ওষুধের অভাবে মরে গেল, আমি পারলাম না ওর মুখে ওষুধ দিতে, আমি ওকে বাঁচাতে পারলাম না।

নৃদুলের কথা শুনে জুলির মন খারাপ হয়ে গেলো। হারিয়ে যাওয়া ভাইয়ের জন্য তার বুকের ভিতর কেমন তোলপাড় অনুভব করছে।

___জানিস নৃদুল, ভাইয়ার একটি ফটো পাওয়া গেছে কাকার পুরনো এ্যালবামে। সেই ছবির দিকে তাকিয়ে মা অশ্রুসজল হয়ে বলেছিল, সময় আমার ছেলেকে স্থির করে দিয়েছে। তা না হলে ও যদি আজ বেঁচে থাকতো, একটা লাল টুকটুকে বউ ঘরে আসতো আর নায়- নাতকুর নিয়ে আমার সময় কেটে যেত খেলার ছলে।

___আসলেই ভাইয়া থাকলে আজ আমাদের একজন ভাবী থাকতো। ভাবীর সাথে আমাদের দুষ্টু দুষ্টু মিষ্টি কথা ও খুনশুটি চলতো। নাদুস নুদুস একটি অথবা দু’টি ভাইপো বা ভাইঝি থাকতো। ওদের আদর করতাম, কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। ওরা কাঁদলে কান্না ভুলাতাম। ওদের হাসি মুখ দেখার জন্য সদা ব্যস্ত থাকতাম।

___ আল্লাহ কেন আমার ভাইকে এত তাড়াতাড়ি নিয়ে গেল। কেন আমরা ভাইহারা হলাম। ভাইয়ের আদর সোহাগ থেকে বঞ্চিত হলাম।

এভাবে কথায় কথায় ভাইয়ের জন্য যমজ দুই ভাইবোন অশ্রু বিসর্জন দেয়। মন কেমন আকুলি বিকুলি করতে থাকে। একে অপরকে শান্তনা দেয়। থাক কাঁদিস না। মৃত্যুর পর জান্নাতে গেলে ভাইয়ের সাথে আবার দেখা হবে। তখন ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরবো। ভাইয়াও আমাদের বুকে নিয়ে আদর করবে।

পুত্র যখন ফ্রেমে বাধা ছবি মা তখন সারা জীবনভর পুত্র শোক বয়ে বেড়ান গোপনে। গভীর গোপনে।
সময়ের সাথে সাথে ভাই ভুলে যায় বোনকে। বোন মনে রাখে না ভাইকে । বাবাও হয়তো সন্তানের শোক সামলে উঠেন কিন্তু একজন মা কিছুতেই তার সন্তানকে ভুলে যান না। তিনি আমৃত্যু মনে রাখেন সন্তানকে, হোক সে সন্তান মৃত কিংবা জীবিত।

যে মা তার সন্তানকে হারান তিনি আজীবন শোকাতর জননী হয়েই জীবন কাটিয়ে দেন।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

প্রথম সন্তানের মৃত্যুতে একজন মা কিভাবে সারা জীবন তার স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকেন সেই ঘটনাই তুলে ধরা হেয়ছে গল্পে।

২৪ আগষ্ট - ২০২০ গল্প/কবিতা: ৮৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪