পদরেখা

উপলব্ধি (এপ্রিল ২০২২)

মোঃ মাইদুল সরকার
মোট ভোট ১৪ প্রাপ্ত পয়েন্ট ৪.৯
  • ৫৫
আসন্ন সন্ধ্যা। ক্লান্ত পাখিরা নীড়ে ফিরতে শুরু করেছে ।আকাশে একটু একটু করে আবিরের রঙ দেখা যাচ্ছে ।মৃদু মন্দ বসন্তের বাতাস বয়ে যাচ্ছে- দু’ একটা পাতাও ঝরছে সেই বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে । বাহিরের প্রকৃতিতে সুন্দর শান্তির শ্বাস প্রশাস যেন বয়ে যাচ্ছে কিন্তু দক্ষিণের জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মালিহা শারমিনের প্রকৃতির এই সব রূপ সৌন্দর্য উপভোগ করার মত মন মানসিকতা নেই। সে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে, তাঁর দৃষ্টিতে শুধু শূন্যতা খেলা করছে। ছল ছল চোখে সে কান পেতে শুধু শুনছে তার মায়ের বকুনি।

পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল বিকেলে শারমিনকে ।সেজেগুজে প্রতিবারের মতোই সে গিয়েছিলো পাত্রপক্ষের সামনে। প্রতিবারের মতোই তাকে যা যা জিজ্ঞেস করে সুন্দর করে উত্তর দিয়েছিল এবং পাত্রপক্ষের তাকে পছন্দ হয়ে গিয়েছিল ।সবই ঠিক ছিলো কিন্তু মালিহা শারমিনের একটা সমস্যা আছে সেই সমস্যার কথা সে পাত্রপক্ষের কাছে গোপন রাখতে চায় না। তাই বার বার যত বিয়ে কাজই আসুক, সবাই তাকে পছন্দ করলেও শেষ পর্যন্ত তাঁর সেই শারীরিক সমস্যার কথা শুনলে কেউ এগিয়ে আসে না বরং পিছু হটে। তাই শারমিনের মা ঝুমা বেগম মেয়েকে পই পই করে বলে দিয়েছে এবার তোমার সমস্যাটা যদি পাত্রপক্ষের কারো চোখে ধরা পড়ে তবেই তুমি তা খুলে বলবে, অন্যথায় কিছুতেই মুখ খুলবেনা ।যদি খোলো তাহলে তোমার একদিন কি আমার একদিন।

ঝুমা সাজিয়ে গুজিয়ে মেয়েকে বলল, ‘ দিনের পর দিন পাত্রপক্ষকে দেখানো,খাওয়ানো, আপ্যায়ন, ঝামেলা, টেনশন আমি আর নিতে পারিনা। কবে যে তোমার একটা গতি হবে এক আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না । দোহাই তোমার আবার তুমি পাগলামি কোরো না। নিজের ভালো পাগলও বুঝে কেন তুমি সেই গোপন কথাটা বলে দিয়ে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছো। আর আর কোন ভুল চাইনা। এবার বিয়ে চাই তোমার বিয়ে।’

শারমিন ম্লান হেসে বলল,‘ আমিও চাই আমার বিয়ে হয়ে যাক আর তুমি মুক্তি পাও। কিন্তু কোন ছল ছাতুরি করে নয়। যেন তেন ভাবে বিয়েতো করাই যায় কিন্তু পরে যদি আমার এই শারীরিক সমস্যার জন্য বিদায় করে দেয় সে ভার কি তুমি বইতে পারবে মা। পারবেনা। তালাক প্রাপ্ত মেয়েকে আবার বিয়ে দেওয়া অন্ধকার রাত কে দিনে পরিণত করার মতই কঠিন। তাই যারা আমার সমস্যার কথা শুনে রাজি হবে তাদের বাড়ির বউ হবো আমি।’

ঝুমা ধমকে উঠে বললেন, ‘থাম তুই। তোর লেকচার আমি কম শুনিনাই। যা বলেছি তাই করবি। গোপন ব্যাপার গোপন থাকবে মুখ খুলবিনা।’

মাথায় রাগ উঠে গেলে তুমি থেকে তুই-তে নামতে একটু দেরি করেননা ঝুমা বেগম।মেয়েকে পাত্রপক্ষের সামনে ঠেলে দিয়ে আড়াল থেকে সবই শুনছিলেন ঝুমা বেগম। ছেলের পক্ষ যখন মেয়ের রূপ গুণ সৌন্দর্য দেখে বিমোহিত এবং সম্বন্ধ পাকা করার জন্য মনস্থির করেছে তখনই শারমিন আণবিক বোমা ফাটানোর মত কান্ড করে বসলো ।



সে বলল- আসলে আপনারা আমাকে দেখছেন ঠিকই, আমিও আপনাদের দেখছি তাও ঠিক আছে। আমার সবকিছু আপনাদের পছন্দ হয়েছে ।আমারও আপনাদের ভাল লেগেছে কিন্তু আমার একটা শারীরিক সমস্যা রয়েছে সেটা জানার পর আপনাদের এই ভালোলাগা থাকবে কিনা আমি জানিনা। কিন্তু আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করি সেই তথ্যটা না জানানো মানে ভবিষ্যতে সংকট সৃষ্টি করা আমার একটা পা নেই।

শারমিনের এমন কথায় যেন মর্মাহত হলেন পাত্রপক্ষের লোকজন। কয়েকজন তো শারমিনের পায়ের দিক থেকে নজর সরাচ্ছেননা। সে লক্ষ্য করে শারমিন বলল, আমার পা টা স্বাভাবিক ছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যায় আমি আর আমার বান্ধবী নিপার। বান্ধবী কে বাঁচাতে গিয়ে আমার পাটা হারাতে হয়েছে চিরদিনের জন্য। একটা কৃত্রিম পা এমন ভাবে লাগানো হয়েছে কাছ থেকে ভালো করে না দেখলে বুঝাই যায়না যে আমি এই কৃত্রিম পা টা ছাড়া চলতে পারিনা।

ব্যাস শারমিনের মুখে এতটুকু শোনার পর আকাশের কালো মেঘ যেন জমেছে আগত অতিথিদের মুখে ।সবার মুখ থমথমে। এদিকে আড়ালে ঝুমা বেগম মেয়েকে শাপ-শাপান্ত করছেন অনুচ্চস্বরে ।মেহমানরা যখন চলে গেল তখন ঝুমা বেগম রাগে-ক্ষোভে পাগল প্রায় মেয়েকে পারেন তো তুলো ধুনো করেন। সেই থেকে তিনি বকে চলেছেন।

আলো ল্যাংড়ী তোর যে একটা পা নাই সেই কথা কিছু দুনিয়ার বেবাক মাইনষেরে হোনান লাগবো।

তোর কি কোন লাজ শরম নাই। নিজের এমন সর্বনাশের কথা কি মানষে এমন কইরা বিয়ার আসরে কয়।

ভাত খাইয়া বড় হসনাই, নাকি ফেন খাইয়া বড় হইসস। শেষ কালে আমি কি কন্যা দায় গ্রস্থ মাতা হইয়া সমাজের চোখে খাটো হইয়া থাকমু সেইডাই কি তুই চাস?

আহ এর চেয়ে খোদায় আমারে মরন করেনা ক্যান। আর কত নাটক দেখমু। আমি মরলেই হতভাগীর হাড় জুড়াবে।

এক নাগাড়ে মেয়েকে এভাবে বাক্যবান করেই চলেছেন ঝুমা বেগম। থেকে থেকে কপাল থাপড়াচ্ছেন। এমন ইঞ্জিনিয়ার জামাই হাতছাড়া হল সেই শোকে তিনি উন্মাদ।

একঘেয়ে বিদঘুটে বকা শুনে শারমিনের বিতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। না নিজেকে বুঝাতে পারছে না মাকে বুঝাতে পারছে।


রাত প্রায় দশটা বাজে। মেয়েকে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ডাকলেন কিন্তু শারমিন খেতে গেলনা। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে তিনি আবার শুরু করলেন-

এমন বোকা মাইয়া আমি আমার বাপের জন্মে আর দেখি নাই। নিজেই নিজের ভবিষ্যৎ অন্ধকার কইরা রাখছে। কবে বুঝবে আর নিজের ভালো। পাগলেও নিজের ভাল বুঝে।

রাতে মা-মেয়ের কারোই খাওয়া হলোনা। প্রতিবারই মায়ের বকুনি শেষ হলে শারমিনের চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় জল ঝরতো কিন্তু এখন এসব বকুনি গা সওয়া গেছে। এখন আর চোখ থেকে পানি ঝরে না। শোকের নদীতে একদিন যেমন চর জাগে তেমনি একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি বুকের ভেতরটা শক্ত মাটির মতো হয়ে যাচ্ছে তাই কষ্টকে আর কষ্ট মনে হয়না।

জীবনের জটিলতায় দুঃখ-কষ্ট এখন আর আগের মতো শারমিনকে কাবু করতে পারে না। সে চোখ বন্ধ করে আছে কিন্তু ঘুম আসছেনা। বন্ধ চোখের সামনে যেন স্মৃতির অতল তল থেকে ভেসে উঠেছে এক্সিডেন্টের সেদিনের টুকরু টুকরু কতগুলো ছবি।

সবেমাত্র ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছে শারমিন। দাউদকান্দির মোশারফ হোসেন ডিগ্রি কলেজে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক পার হয়ে তবেই কলেজে যেতে হয় শারমিনকে। বান্ধবীকে নিয়ে সম্প্রতি কলেজে ঠিকমত পৌঁছে যেত সে। তারপর ক্লাস, গল্প ,আড্ডা আর নতুন স্বপ্নে বিভোর ছিলো শারমিন।

কত স্বপ্নের আনাগোনা দেখা দিয়েছিল জীবনে সেই সময়টাতে কিন্তু সবই হঠাৎ যেন থমকে গেল তার বাম পা টা হারিয়ে। সেদিন সকালে তাড়াহুড়ো করে ক্লাস ধরবে বলে রিক্সা থেকে নেমে যখন বিশ্ব রোড পার হচ্ছিল ঠিক তখনই চট্টগ্রামগামী একটি ট্রাক এসে আজরাইলের মত হানা দেয়।

সাথে থাকা বান্ধবী নিপা কিছুই টের পাইনি সে মোবাইলে কাকে যেন ম্যাসেজ পাঠাচ্ছিল কিন্তু শারমিন যখন দেখলো তাদের উপরে এসে পড়েছে একটা ট্রাক ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। সে নিপাকে ধাক্কা দিয়ে নিজে সরে যাওয়ার আগেই ট্রাকের সাথে ধাক্কা খেয়ে সামনে রাস্তা থেকে ছিটকে পড়ে গেল। ড়গাতে গড়াতে তার শরীরটা পাশের ডোবায় গিয়ে স্তির হলো । যেখানে আগাছায় জঙ্গলের মত হয়ে আছে জায়গাটা।

নিপা রাস্তা থেকে উঠে দেখে শারমিন অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে আর তার রক্তে ভিজে গেছে সেই ডোবার শুকনো মাটি, খড়কুটো,লতাপাতা।

নিপা চিৎকার করলে আশপাশের লোকজন এসে দ্রুত শারমিনকে তুলে নিয়ে গেল হাসপাতালে তারপর জ্ঞান ফেরার পর শারমিন দেখলো তার বা পায়ের হাঁটুর নিচের অংশটুকু আর নেই। সে বিশ্বাসই করতে পারল না সে পঙ্গু হয়ে গেছে। হাসিখুশি একটা মানুষের জীবনে একটি দুর্ঘটনা নিয়ে এলো যেন সারা জীবনের কান্না।

সেই থেকে দুর্ভাগ্য তার পিছু ছাড়ছে না। নিপার পরিবার যখন জানতে পেরেছে শারমিন নিজের জীবনের পরোয়া না করে তাদের মেয়েকে বাঁচিয়েছেন তখন নিপার বড় ভাইয়ের সাথে বছর দুয়েক পরে যখন শারমিন সুস্থ হবে তখন বিয়ে হবে এরকম কথা পাকাপাকি করে রাখলো দুই পরিবারের মুরুব্বিরা।
কিন্তু বছর ঘুরে নিপা যখন সুস্থ্য হয়ে উঠেছে আর নিপার ভাই পরাগের সাথে তার কথা বার্তা ভালোবাসা পর্যায়ে পৌছেছে ঠিক তখনই দাবানলের মত একটা দুঃসংবাদ আসে শারমিনের জীবনকে নতুন করে পুড়িয়ে খাগ করতে।

একদিন কাকডাকা ভোরে খবর আসে নিপার ভাই ঢাকা থেকে দাউদকান্দি আসার সময় মদনপুরে রোড এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে।

নিপার ভাই পরাগের এই আকস্মিক মৃত্যুর জন্য পরোক্ষভাবে আশেপাশের সবাই শারমিনকে দোষারোপ করতে থাকে। এই মেয়েটা নিজের পা হারিয়ে শুধু বসে নেই সে তার বান্ধবীর ভাইকেও খেয়ে ফেলল। কি জানি বাপু যে ছেলে এই মেয়ের বর হবে তার কপালে মনে হয় এমন দুঃখই থাকবে।

তবে কি এ জীবনে শারমিনের বিয়ে হবেনা। না সে আর ভাবতে পারেনা। আজ যেন শারমিনকে স্মৃতিতে পেয়েছে। নিপার কথা মনে পড়ল। কেমন আছে ও? অনেক দিন যোগাযোগ নেই। নিশ্চয় স্বামী সন্তান নিয়ে দিব্যি সংসার করছে।

নিপা যখন একান্তে শারমিনের সাথে কথা বলছিল যে, ভালোই হলো তুই আমার ভাবি হবি। একদিকে আমরা বান্ধবী অপরদিকে ভাবি আর ননদ। দারুন হবে আমাদের সম্পর্কটা কী বলিস ? শারমিন অনেকক্ষণ ধরে ইতস্তত করছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলল, ‘তোরা কি আমাকে করুণা কোরছিস কিন্তু আমি তো কারো করুণার পাত্র হয়ে থাকতে চাই না। আমি লেখাপড়া চালিয়ে সাবলম্বী হতে চাই।’

শারমিনের কথা শুনে নিপা বলল, ‘তুই এটা ভাবছিস কেন ? আমরা জেনে শুনেইতো আমাদের বাড়ির বউ করছি তোকে আর তুই আমার যে উপকার করেছিস জীবন দিলেও কি আমি সে ঋণের দায় শোধ করতে পারবো। পারবনা। তাই আমাকে একটু তোর পাশে থাকার সুযোগ দে।’


না সে সুযোগ আর আসলনা। নিপার ভাবী হওয়া হলনা শারমিনের । দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফিরল শারমিন। ফ্যানটা একটু কমিয়ে দেওয়া দরকার, কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করছেনা। শুয়ে দেয়ালের দিকে চোখ যেতেই কবিতা আবৃত্তিতে পাওয়া মেডেলটা জ্বল জ্বল করে উঠল। সেই সাথে বাবার কত কথা মনে পড়ে গেল শারমিনের ।

এই দুঃসময়ে বাবা নামের বট বৃক্ষটা যদি ছায় হয়ে পাশে থাকতো তাহলে হয়তো শারমিনের কবেই বিয়ে শাদী হয়ে যেত ।সে এখন ব্যস্ত থাকতো সংসার, স্বামী, সন্তান নিয়ে।

মেয়ের পায়ের চিকিৎসার জন্য সমস্ত সঞ্চয় শেষ করেছেন আসগর সাহেব। টাকা খরচ করতে কারপন্য করেননি। লোকে বলাবলি করতো-পঙ্গু মেয়ের পিছে এত টাকা খরচ করে কি লাভ হবে ? লোকের কথায় কান দেননি । বলেছেন মেয়ে আমার সুস্থ্য থাকলে আমিও সুস্থ্য থাকবো।
শিল্পকলায় শারমিনের একটা প্রোগ্রাম ছিল কবিতা আবৃত্তির বাবাকে নিয়ে যথাসময়ে সেই প্রোগ্রামে উপস্থিত হয়ে যখন মঞ্চ থেকে তার নাম ঘোষণা করল সে বাবাকে কদমবুজি করে মঞ্চে উঠে শুরু করল তার স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি -

চল আকাঙ্খার নদীতে নাইতে নামি
চোখ বন্ধ করে কিছু একটা চাও
যা অনেক দামি।
বোকা মেয়ে-স্বর্ণালংকার,সিল্কের শাড়ি, সাদা বাড়ি
সমস্ত শখের জিনিস ফেলে
তুমি আমাকেই মনে মনে চাইছো!
জানিনা প্রেমের কোন গান হৃদয়ে ধরেছো।
আমারও কত চাওয়া ছিল যা হারিয়ে গেছে কালের স্রোতে;
হাহাকার আর আর্তনাদে
এ জীবনে কেউ বলেনি-
চোখ বন্ধ করে কিছু একটা চাও!
যা অনেক দামি,
কখনো রোদের রেখা কেউ মুছে দেয়নি রুমালে
এ কথা নির্ভয়ে বলতে পারি আমি।
.............................................................

কবিতা তখনও পুরো শেষ হয়নি। স্টেজের পিছনে আগুন লেগে যাওয়ায় আমন্ত্রিত অতিথিদের হৈ-হল্লা, চিৎকার-চেঁচামেচি আর হুড়োহুড়িতে শারমিন এদিক ওদিক তাকিয়ে ঘটনাটা বোঝার চেষ্টা করলো কিন্তু ততক্ষণে আগুনের লেলিহান শিখা পৌঁছে গেছে স্টেজে। জীবন বাঁচাতে যে যার মতো করে দিগ্বিদিক ছুটতে লাগল। মূহুর্তেই আনন্দময় পরিবেশ ছেয়ে গেলে বিসাদে।

শারমিনের বাবা আজগর সাহেব জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মেয়েকে বাঁচাতে চলে এসেছিলেন স্টেজের কাছে কিন্তু তিনি মেয়েকে খুঁজে পেলেন না বরং অত্যধিক উত্তেজনায় তার হার্টবিট এতটাই বেড়ে গেল যে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন মাটিতে পরে যখন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তখন ডাক্তার আজগর সাহেবকে মৃত ঘোষণা করেন ।মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেই পরপারে পাড়ি জমালেন। মৃত্যু মুছে দিল প্রানের স্পন্ধন।

পরিস্থিতি বিচারে বাবার এহেন পরিণতিতে শারমিন যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। কথা ছিল একসাথে বাবা মেয়ে হাসিমুখে বাসায় ফিরবে কিন্তু তা আর হলো না ।বাসায় ফিরলেন ঠিকই আজগর সাহেব তবে জীবিত নয় লাশ হয়ে।

সেদিন শারমিনের মা স্বামী হারা হয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন। আর বারবার বলছিলেন আমি মানা করেছিলাম এসব উৎসব, কবিতা আবৃতি অনুষ্ঠানে যাওয়া দরকার নেই।

আমার কথা না শুনে কন্যার কথায় আহলাদে আটকানো হয় মৃত্যুর পথে পা বাড়িয়েছে গো মানুষটা। আমি এখন কি করবো, কাকে নিয়ে থাকবো, কাকে নিয়ে বাঁচবো ?

আমার যে সব শেষ হয়ে গেল। মা মেয়ের আহাজারীতে বাতাস ভারী হয়ে এসেছিল। আর এদিকে পড়শীরা শান্তনা দিতে এসে বলাবলি করছিল- কি অলুক্ষণে মেয়ে নিজের বাবাকেও খেয়ে ফেলল ।
ডাইনী একটা। ছোট কালে ভাইকে নিয়ে গোসল করতে গিয়ে ভাইকে মেরে নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়েছে। আর আজ বাবাকে শেষ করেছে। কবে জানি আবার মাকেও শেষ করে দেয়।

আরেকজন ফোরন কাটে- ওর সাথে যাওয়াতেই তো আজ এই পরিণতি ।আহা বেজারা সহজ সরল আজগর সাহেবের জন্য মায়া লাগে। বেঁচে থেকে বেচারী শান্তি পেলনা।

বাবাকে হারিয়ে শারমিন এমনিতেই পাগলপারা তারপর মায়ের আহাজারি আর প্রতিবেশীদের এমন হৃদয় ভাঙ্গা কথায় জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ জন্ম নিয়েছিল ।মানুষ কিভাবে এত সহজে আরেক জনকে অভিযুক্ত করতে পারে। বিশেষ করে মৃত্যুর ব্যাপারে, সে কথা কিছুতেই ভেবে উঠতে পারেনা শারমিন।

মানুষ কেন উপলব্ধি করতে পারে না মৃত্যু একমাত্র সৃষ্টিকর্তা হাতে নিয়ন্ত্রিত হয় তবুও কেন মিছে মিছি একে অপরকে দোষারোপ করে। নাকি অপরকে কষ্ট দেওয়ার নামই সুখ। না এটাকে সুখ বলা যায়না। এটা হচ্ছে সুখ নামের অসুখ।

দুঃখের দিন কারো চিরকাল থাকে না সময়ের চাকা ঘুরে ঠিকই সুখের দেখা মিলে।

সপ্তাহখানেক পরের ঘটনা-

উত্তরা দশ নম্বর সেক্টরের একটি নামকরা স্কুলের শিক্ষিকা পদে চাকরি হয়েছে। সে খুব খুশি, যাক ভালোই হলো শিশুদের নিয়ে কাটবে তার সারা বেলা।


ভালোই হলো চাকরিটা পেয়ে তার নামের পাশে বোঝা হয়ে থাকা ল্যা্ংড়ী নামের উপাধি এবার হয়তো ঘুচবে। যোগদানের পর থেকেই শারমিন বেশ ভালোভাবেই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে । স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকা, ছাত্র-ছাত্রী এবং অভিবাবকদের মন জয় করে নিয়েছে সে অল্প দিনের মধ্যেই। জীবনে এমন সুখের অনুভূতি তার কাছে নতুন। এখন জীবনকে আর বোঝা মনে হয়না। মনে হয় বেঁচে থাকা অপার আনন্দের।

বেশ কিছুদিন পর নিজে গুছিয়ে উঠে মাকেও নিয়ে এসেছে ঢাকায়। দু রুমের বাসায় ভালই চলে যাচ্ছে মা-মেয়ের দিনকাল।

একদিন ক্লাস রুম থেকে বেরিয়ে ওয়াশরুমে যাওয়ার পথে দুটি বাচ্চা মেয়ের কথপোকথন শুনতে পেল শারমিন। তারা বলাবলি করছে- শারমিন ম্যাম একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে মনে হয় পায়ে কোন সমস্যা আছে। মনে হয় ছোটকালে ল্যাংড়ী ছিল। ম্যাডাম বেশ ভালো, অনেক সুন্দর করে কথা বলেন এবং পড়ান।

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বেসিনের আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে বেশ অবাক হলো সে। প্রসংশার রেশ চলে গেছে কিন্তু রয়ে গেছে নিন্দার দংশন। ল্যাংড়ী শব্দটা যেন তাকে চারপাশ থেকে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি হয়ে উপহাস করছে। চোখেমুখে ঠান্ডা পানি দিয়ে মনের উত্তেজিত ভাব দমন করতে চেষ্টা করছিল। সে বুঝতে পারলো এই শব্দ টা হয়তো তার জীবন থেকে আর কখনো মুছে যাবে না এটার সাথে আপস করেই তোকে বাঁচতে হবে।

রবীন্দ্র সরণিতে জরুরী একটা কাজে এসেছিল শারমিন। সেখান থেকে বেরিয়ে সে বাসায় ফেরার পথে দেখল একটা বাচ্চা মেয়ে লাঠিতে ভর করে রাস্তার সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলো- তে গোলাপ ফুল বিক্রির চেষ্টা করছে ।কেউ নিচ্ছে কেউ নিচ্ছে না ।অনেকেই ফিরিয়ে দিচ্ছে কিন্তু মেয়েটি ঘুরে-ফিরে এক গাড়ি থেকে আরেক গাড়িতে বিক্রির আশায় ফেরি করে চলছে তার ফুল।

কাছে গিয়ে মেয়েটিকে ডেকে বলল- খুকি তোমার নাম কি ?

মেয়েটি অদ্ভুত চোখে শারমিনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল- বকুল ।আমার নাম বকুল। আহা! বকুল নামের মেয়েটির কি ভাগ্য ফুল বিক্রি তাকে জীবিকা নির্বাহ করতে হয় ।

বাবা- মা নাম রেখেছে ফুলের নামে কিন্তু জীবন তার কাঁটার আঘাতে জর্জরিত ।শারমিন সবগুলো ফুল কিনে নিয়ে বলল- তুমি কি প্রতিদিন ফুল বিক্রি করো।

-হ ম্যাডাম প্রত্যেক দিন আমার ফুল বেচন লাগে। না বেইচা উপায় কি?ফুল ফেড়ি কইরা যে টাকা পাই সেটা খালার হাতে তুইলা দেই। তাইলে দুই বেলা খাবার জোটে।

- খালার হাতে কেন ? বাবা-মা কোথায় ?

বাবা –মার কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল বকুলের। তার বাবা মা নাই। বাবা কিংবা মা কারো সাথে কোন স্মৃতিও তার মনে পড়েনা। কোথায় কবে কে জন্ম দিয়েছে তাকে জানেনা সে।

-বাপ-মা নাই।


শারমিন বলল- ও ।তাই বুঝি তোমার খুব দুঃখ। তোমার বাবা-মা নেই তাই তোমাকে এত কষ্ট করতে হয়। মন খারাপ করোনা বকুল। কারো কারো জীবনটাই এমন শুধু দু:খ আর দু:খ।

-গরীবের কষ্ট না কইরা উপায় কি ম্যাডাম। আর দু:খের কথা কইয়া কি লাভ। যার তিনকূলে কেউ নাই হেরতো দু:খের কপাল হইবোই।

কথাটা শুনে চোখ ছল ছল করে উঠল মারশিনের। আহা! এতটুকু মেয়ে অথচ কত গভীর তার চিন্তা ভাবনা।

শারমিন উপলব্ধি করতে পারে স্রষ্টা তাকে বকুলের চাইতে ভালো রেখেছেন। ভালো রেখেছেন আরো অনেকের চেয়ে। হয়তো জীবনে একটা অপূর্ণতা আছে কিন্তু প্রতিটা মানুষেরই তো কোন না কোন অভাব কিংবা অপূর্ণতা থাকে। একেবারে কানায় কানায় পরিপূর্ণ নয় কোন মানুষেরই জীবন। বকুলকে অভয় দিয়ে সেদিনের মত সে চলে গেলো বাসায়।

এভাবে মাঝে মাঝে সে বকুলের খোঁজ খবর নিতে আসে এবং তার সম্পর্কে সব জেনেশুনে একদিন বলে-

বকুল তোমার কি ফুল হতে ইচ্ছে করে না?

বকুল অবাক হয়ে বলে- ম্যাডাম মানুষ আবার ফুল হয় ক্যামনে? শারমিন বলে- মানুষের জীবন ফুলের মত হতে পারে আবার কাঁটার মত হতে পারে। তুমি কি থাকবে আমার সাথে আমি তোমাকে ফুলের মতো করে গড়ে তুলবো। লেখাপড়া শিখাবো। নতুন এক জীবনে তুমি পা রাখবে। কোন কষ্ট থাকবেনা আর তোমার।

এমন প্রস্তাব পেয়ে বকুল খুশিতে ডগোমগো কিন্তু হঠাৎই তার মুখটা কালো হয়ে গেল সে বলল- কিন্তু খালাতো আমারে ছাড়তে চাইবো না। তোমার খালার কাছে আমাকে নিয়ে যাবে আমি সব ব্যবস্থা করবো যাতে সে তোমাকে কাটকে না রাখে।

শারমিন একদিন বকুলের খালার কাছে যায়। বস্তিতে থাকে বকুল তার খালার সাথে। বকুলের খালা বলে- আপনে ওরে মানুষ করবেন সেইঠাতো ভালা কথা। আমি ওর আপন খালা না। ওরে পাইছি রাস্তায়। আমি নিজে গরিব মানুষ। পাঁচটা পোলাপান নিয়া আমারই দিন চলেনা তার উপর বকুলরেও ঠাঁই দিছি।

-বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাম করি। একদিন সকালে কামে যাওনের সময় দেহি রাস্তার পাশে কান্তাছে দুধের শিশু। আহারে কোন পাষানে জানি থুইয়া গেছে মাইয়াডারে। কেমন ফুটফুটে চান্দের লাহান মাইয়া। আমি নিয়া আইলাম কোলে কইরা । সেই থাইকা বকুল আমার কাছে আছে।

আল্লা আপনার ভালো করুক। একদিন বিকালে বকুল ও তার অন্য ভাই বোন ও তার খালার জন্য অনেক উপহার নিয়ে আসে শারমিন তারপর পাকাপাকিভাবে নিয়ে যায় নিজের কাছে। বিদায় বেলায় বকুল খালাকে জড়িয়ে কান্না করে, অশ্রুসজল চোখে অন্য ভাই বোনরা বিদায় দেয় বকুলকে।

শারমিন নতুন কিছু ড্রেস কিনে দেয় বকুলকে, চুলে নতুন কাটিং দিয়ে বকুলের লুকটাই পাল্টে দেয়। এখন আর কবুলকে ফুল ফেরি করা মেয়ে মনে হয়না। মনে হয় স্কুল পড়ুয়া মেয়ে। শারমিন কিছুদিন শিখিয়ে পড়িয়ে নিজের স্কুলে ভর্তি করে দেয় বকুলকে।


সবাই জানে বকুল শারমিনের মেয়ে কিন্তু স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক রাকিব শারমিনকে বলে তোমার তো বিয়ে হয়নি তাহলে মেয়ে কোত্থেকে এলো?

শারমিন বলে আমি ওকে পেয়েছি। ও এতিম। এই পৃথিবীতে ওর আপন বলে কেউ নেই। ও এখন থেকে আমার মেয়ে হয়ে থাকবে। আমার পরিচয়ে বড় হবে।

শারমিনের উদার মনের পরিচয় পেয়ে রাকিব শারমিনের প্রতি আরও দুর্বল হয়ে পড়ে।

সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে রাকিবের স্ত্রী মারা গিয়েছে গত বছর। একই সাথে সন্তান ও স্ত্রীকে হারিয়ে রাকিব পাথরের মত প্রাণহীন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শারমিনের সান্নিধ্যে এসে সে আস্তে আস্তে যেন আবার নতুন জীবনের খোঁজে পেতে শুরু করেছে।

শারমিনের রাকিবকে ভালো লাগে কিন্তু সে নিজ থেকে মনের কথা কখনো খুলে বলে নি। রাকিব ঠিকই বুঝতে পেরেছে শারমিন তাকে ভালোবাসে। তাই সে একদিন ফাল্গুনের বিকেলে তার ভালোবাসার কথা শারমিনকে জানিয়ে দেয়।

আরও বলে- চলো না আমাদের অপূর্ণতাকে আমরা পূর্ণতা দেই। একটা সংসার বাধি নিজেদের মত করে। একাকীত্বকে নির্বাসনে পাঠাই। আমাদের সে সংসারে বকুল আদরের মেয়ে হয়ে ঘ্রান বিলাক সারাটি জীবন।

শারমিনের দুচোখ বেয়ে অশ্রু নামে আনন্দ অশ্রু। সে নিরবে সম্মতি জানায়। এমন সুখের দিন তার কপালে লিখা ছিল সে যেন বিশ্বাসই করতে পারছেনা।

জীবনের এই খুশির সংবাদটা মাকে দেওয়ার জন্য ধীরে ধীরে ক্যাফে থেকে বাসার ফিরে শারমিন। তার দৃঢ় পদরেখায় স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠে বিজয়ের চিহ্ন। জীবন যুদ্ধে সে হেরে যায়নি। সে যে অপরাজিত সৈনিক।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Jamal Uddin Ahmed অনেক অভিনন্দন। এগিয়ে যান।
ফয়জুল মহী ভীষণ ভালো লাগলো সুন্দর উপস্থাপন
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
doel paki জীবন যুদ্ধের গল্প ভাললাগলো।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

শারমিন নামের এক মেয়ের জীবনের প্রতি ভালোলাগা, মন্দলাগা এবং গভীর উপলব্ধি গল্পে তুলে ধরা হয়েছে।

২৪ আগষ্ট - ২০২০ গল্প/কবিতা: ৯৬ টি

সমন্বিত স্কোর

৪.৯

বিচারক স্কোরঃ ২.১ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ২.৮ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪