একজন রকেট জলিল

স্বাধীনতা (মার্চ ২০২২)

মোঃ মাইদুল সরকার
  • ৯৭
যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার শিমুলিয়া ইউনিয়নের সবুজে ছাওয়া মনোরম একটি গ্রাম। গ্রামটির নাম পাল্লা। সৌন্দর্যে যেন সে সবসময় প্রকৃতির সাথে পাল্লা দিয়ে যাচ্ছে, এখানেই গ্রামটির নামের স্বার্থকতা।

এক জোড়া ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী পাল্লা গ্রামের মোড়ল পাড়ার বড় জাম গাছের ডালে বসে গল্প করছে। নিশি রাত হু হু হাওয়া বইছে । সমগ্র ধরণী যেন হালকা চাঁদের আলো আর আবছা অন্ধকারে ছেঁয়ে আছে। গাছের ছায়া আর রাতের মায়া মিলে মিশে একাকার, কোথাও কোনো শব্দ নেই যেন অপার্থীব এক পৃথিবী।

বেঙ্গমী ব্যাঙ্গমার আরো কাছে এসে নিবিড় হয়ে বলল, জানো এ বাড়িতে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হবে ভোররতে। মুয়াজ্জিনের কন্ঠে যখন সুললিত আযানের ধ্বনি ভেসে উঠবে আকাশে বাতাসে তার কিছুক্ষণ পরই একটি মানব শিশু আত্ম চিৎকার করে জানান দিবে সে পৃথিবীতে এসেছে।

ব্যাঙ্গমা-আমিও তা জানি এবং ছেলেটির নাম রাখা হবে আব্দুল জলিল। ছেলেটি হবে অসীম সাহসী, নির্ভীক, অকুতোভয়, দেশ প্রেমিক ও যোদ্ধা।

বেঙ্গমী- এই পরাধীন দেশে একদিন যখন স্বাধীনতার ডাক আসবে, যুদ্ধ বেধে যাবে, মানুষ যখন স্বাধীনতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে জীবন বাজি রেখে তখন এই ছেলেটিও টগবগে যৌবন নিয়ে একটি মুক্ত লাল সবুজের পতাকার জন্য যুদ্ধে যাবে।

ব্যাঙ্গমা-যুদ্ধে সে দেশ স্বাধীনে বিরাট ভূমিকা রাখবে এবং তার অসামান্য নৈপুণ্যর জন্য রকেট জলিল নামের খ্যাতি অর্জন করবে।

বেঙ্গমী- বাংলার মাটিতে এমন হাজারো সাহসী সৈনিকের জন্ম হয়েছে এবং জন্ম হবে যারা দেশের স্বাধীনতা এনে দেবে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে।

এভাবে কথায় কথায় রাত ফুরিয়ে গেল ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী উড়ে চলে গেল অন্য কোনোখানে, অন্য কোন গাছের ডালে তাদের সুখের সংসারের খোঁজে।


নানা ঘাত প্রতিঘাতে ঘটনার বাতাবরণে সময় গড়িয়ে চললো । সময়ের সীমানা ভেঙ্গে ইতিহাসের মহা সড়গে যোগ হল কত ঘটনার। বাহান্ন, উনসত্তুর, একাত্তর ; কত সুখ, দুঃখ, পাওয়া-না পাওয়ার হিসেব বিলীন হয়ে গেল সময়ের স্রোতে।



আব্দুল জলিলের জন্মের প্রায় ছয় যুগ পরে শীতের এক রাত সেই ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী আবার এসেছে পাল্লা গ্রামে। মোড়ল পাড়ার পারিবারিক করস্থানের কাঠাল গাছের ডালে বসে তারা কথা বলছে-


ব্যাঙ্গমা-তোমার কি মনে আছে বহুযুগ আগে আমরা এক রাতে এই গ্রামে গল্প করছিলাম। তখন জলিল নামের ছেলেটির জন্ম হয়।

বেঙ্গমী- হ্যাগো মনে আছে। দেখ নিয়তির কি অদ্ভুত খেলা আজ আমরা আবার সেই সাহসী ছেলেটির কবরের উপর বসে আছি। সেই ছেলেটি জন্ম নিল, যুদ্ধ করল, ইতিহাস হলো আবার মরেও গেলো।

ব্যাঙ্গমা- ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয় ইপিআরের রাজশাহী অঞ্চলে কর্মরত সিপাহি আব্দুল জলিল। রক্ত যেন টগবগ করছে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য তাইতো ২৮ মার্চ আব্দুল জলিলসহ চার জন চারটি রাইফেল নিয়ে রাজশাহী থেকে প্রথমে যশোর, এরপর একই দিনে বেনাপোল ক্যাম্পে গিয়ে যোগ দেয়। রাতেই তাদের যশোরের চাঁচড়া ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর পরতো আব্দুল জলিল সরাসরি অংশ নেন মুক্তি যুদ্ধে।


বেঙ্গমী-বাড়িতে স্ত্রী সন্তানকে রেখে দেশ মাতাকে রক্ষা করার জন্য বেড়িয়ে পড়ে যুবক জলিল। যাওয়ার আগে স্ত্রী হালিমাকে বলে গিয়েছিল, ‘‘ভয় পেয়না, কান্না করোনা। দেশ বাঁচলে সন্তান বাঁচবে। তোমাদেরকে আল্লার কাছে আমানত রেখে গেলাম। ছেলেকে আগলে রেখো। যদি বেঁচে থাকি দেখা হবে।’’


ব্যাঙ্গমা-একাত্তরের জুলাই মাসে ঝিকরগাছার গঙ্গাধরপুর-দোসতিনায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয় আব্দুল জলিল। গুলিটি বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচে বিদ্ধ হয়। সেদিনের যুদ্ধে জলিলের সামনে টিকতে পারেনি পাকসেনারা। কয়েকজন শত্রুকে মৃত্যুর মুখে একাই পাঠিয়ে দেয় জলিল ও তার সহযোদ্ধারা। ভারতের বনগাঁ হাসপাতাল থেকে গুলি বের করে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় নৌপথে চলে আসে দেশে। যুদ্ধ যার রক্তে মিশে গেছে সে কি একটি বুলেটের ব্যাথায় পড়ে থাকতে পারে।
বেঙ্গমী-ঝিকরগাছার বনমান্দার এলাকায় দ্বীপের মতো একটা আস্তানা ছিল রাধানগর ক্যাম্প। চারপাশে পানি, নৌকায় যাতায়াত করতে হতো। এখানে নিয়মিত অনেক অপারেশনে জলিল সরাসরি অংশ নেয়। জলিল যেন মৃত্যু দূত হয়ে দেখা দেয় পাকীদের সামনে।

বেঙ্গমা-একাত্তরের বর্ষাকাল দোসতিনার প্রাইমারি স্কুলের মাঠে ক্যাম্প করেছে পাকিস্তানিরা। ছুটিপুরে তাদের হেডকোয়ার্টার্স। টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছে। মাথায় টোকা, হাতে কাস্তে নিয়ে বের হলেন জলিল। হঠাৎ হাজির পাকিস্তানি সেনারা। জিজ্ঞেস করে, ‘মুক্তি হ্যায়?’ জলিল চুপ। সেনারা তাকে আটক করে নিয়ে যেতে থাকে দোসতিনার মধ্য দিয়ে। বেশ বিচলিত হন তিনি। কালেমা পড়তে থাকেন; ভাবেন, রাজাকাররা যদি দেখিয়ে দেয়, তবে আজই তার শেষ দিন।
বেঙ্গমী- রকেট জলিলের মাথায় একটা গুলির বাক্স দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেনারা। কিছুদূর যাওয়ার পর কাদামাটিতে ইচ্ছা করেই পড়ে যায় জলিল । সে ভেবেছিল, যদি অসুস্থ মনে করে ছেড়ে দেয় সেনারা। কিন্তু পাকী সেনারা তার চালাকি বুঝতে পেরে, উল্টো লাথি মেরে জোর করে উঠিয়ে আবারও মাথায় বাক্সটি তুলে দেয়। এভাবে পৌঁছে যায় দোসতিনার মোমিন মাস্টারের কাঁঠালবাগানে। সেখানে দুজন সেনা গাঁতি দিয়ে বাংকার খুঁড়তে বলে । জলিল বাংকার খুঁড়তে লাগলো হঠাৎ দেখে, পাকসেনারা গাছের শেকড়ের ওপরে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে দুজন দুই দিকে মুখ করে বসে আছে। সুযোগ বুঝে আস্তে আস্তে তাদের কাছে গিয়ে গাঁতি দিয়ে একজনের মাথা বরাবর কোপ দেয়। দুই ভাগ হয়ে যায় মুহূর্তেই সেই সৈনিকের মাথা। শব্দ শুনে অন্যজন সামনে ফিরতেই হতভম্ব হয়ে যায়। সৈনিকটি হাতিয়ার হাতে নেওয়ার আগেই গাতির কোপে কুপোকাত ।

বেঙ্গমা- দুই সৈনিকের দুটি চাইনিজ রাইফেল নিয়ে জলিল দৌড় শুরু করে। সে কি দৌড়। সাধ্য কি তাকে কেউ আটকায়। পরদিন সেই জায়গায় আবারও ১২টি মাইন স্থাপন করা হয়। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পাক সেনারা সেখানে থামে। মাইন বিস্ফোরন ঘটিয়ে এবং ফায়ারিং করে মুক্তিযোদ্ধারা অধিকাংশ দখলদারদের মেরে ফেলে বাকিরা ভয়ে পালিয়ে যায়।

বেঙ্গমী -মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ওই এলাকায় প্রতিনিয়ত যুদ্ধ হয়। মে মাসের দিকে পাকিস্তানি সেনারা ঝিকরগাছা উপজেলার আজমপুর, বোদখানা, দোসহাতিনা ও গঙ্গাধরপুর গ্রামে বিভিন্ন দিন আক্রমণ চালায়। আবদুল জলিল ইপিআর সেনাদের সঙ্গে নিয়ে তখন পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর পাল্টা আক্রমণ চালায়। তাঁদের আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পাকিস্তানি সেনারা পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানি সেনারা জানতে পারে, এসব আক্রমণের নেতৃত্ব দিয়েছে ইপিআরের আবদুল জলিল। তখন তারা লোকজনের সামনে বলে, ‘জলিল জিন নাহি হ্যায়, রকেট হ্যায়।’ সেই থেকে আবদুল জলিল হয়ে যান ‘রকেট জলিল’।
বেঙ্গমা- একাত্তরের রণাঙ্গনে হানাদার বাহিনীর কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন আব্দুল জলিল। একাত্তরে এই বীর সেনানী একই দিনে চার পাঁচ জায়গায় অপারেশনে নেতৃত্ব দিয়েছে। অল্প সময়ে দ্রুত কাজ সম্পন্ন করার কারণে পাকিস্তানি বাহিনী ওই সময় বলতো, ‘রকেট হ্যায়, না কিয়া হ্যায়’।

বেঙ্গমী- মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৬ সালে আব্দুল জলিলকে ‘বীরপ্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। স্বীকৃতি পেয়ে কি যে আনন্দিত ও গর্বিত হয়েছিল জলিল, ওর সেই হাসিমুখ আজও আমার মনে পড়ে।

বেঙ্গমা-২০১৭ সালের শেষ দিকে না ফেরার দেশে চলে যায় বীর মুক্তিযোদ্ধা রকেট জলিল। দেখ কেমন একা কবর তলে ঘুমিয়ে আছে সাহসী ছেলেটি। একদিন যুদ্ধের ময়দান কাপানো মানুষটি আজও নিথর, নিরব হয়ে পড়ে আছে কবেরের অন্ধকারে।
মানুষের দেহের মরন হলেও কর্মের মরন নেই। সে বেঁচে থাকবে ইতিহাসে, মানুষের হৃদয়ে। কিছু কিছু মানুষ জন্মায় ইতিহাস হওয়ার জন্য। জলেলর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।


বেঙ্গমা- ঝিকরগাছার বেনেয়ালী থেকে পাল্লা সড়কটি রকেট জলিলের নামে নামকরণ করা হবে অদূর ভবিষ্যতের কোন একদিন । এই যে জড়াজীর্ণ কবর। এটিও পাকাকরণ করা হবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম জানবে একজন রকেট জলিলের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহসীকতার গল্প।

রাত্রি ফুরিয়ে আসছে। ব্যঙ্গমা ব্যঙ্গমী আবার ডানা মেলে উড়ে চলল অন্য কোন ইতিহাসের খোঁজে, অন্য কোন গল্পের খোঁজে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী অসাধারণ ও অতুলনীয় উপস্থাপন।
বিষণ্ন সুমন বেঙ্গমা-বেঙ্গমীর জবানে রকেট জলিলের গল্পটা বেশ লাগলো। সত্যিই কি ঝিকরগাছার বেনেয়ালী থেকে পাল্লা সড়কটি রকেট জলিলের নামে নামকরণ করা হবে অদূর ভবিষ্যতের কোন একদিন ?
ধন্যবাদ জানবেন ভাই। প্রশংসার জন্য কৃতজ্ঞতা। ঝিকরগাছার বেনেয়ালী থেকে পাল্লা সড়কটি রকেট জলিলের নামে নামকরণ করার জন্য উপজেলা পরিষদসহ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে রেজুলেশন করে পাঠানো হয়েছিল বাস্তবায়ন হয়েছে কিনা জানিনা। এই সড়কটি মুক্তিযোদ্ধা রকেট জলিলের নামে নামকরণ করে সম্মানিত করা উচিৎ। ভালো থাকবেন।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার শিমুলিয়া ইউনিয়নের পাল্লা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জলিলের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান গল্পে তুলে ধরা হয়েছে।

২৪ আগষ্ট - ২০২০ গল্প/কবিতা: ৮৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "নগ্নতা”
কবিতার বিষয় "নগ্নতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ মে,২০২৪