অনেক দিন হলো ঢাকার অভিজাত এলাকায় মুনিয়ারা ফ্ল্যাটে উঠেছে। অয়ন-মুনিয়া দু’জন মিলেই সাজিয়েছে সংসার। দখিনের বারান্দায় অয়ন হুট-হাট গেলেও মুনিয়া তেমন একটা যায় না। অথচ মুনিয়ারই বেশি থাকার কথা ছিল সেখানে। গরমের দিনে একটু বাতাসের ভাজে দাড়াবে বই হাতে, বৃষ্টির সন্ধ্যায় চা-কফি খেতে খেতে তর্কে মেতে উঠবে কিংবা শীতের বিকেলে মিহি কুয়াশায় ভিজবে। রাগ বা অভিমান হলে চুপটি করে দাড়িয়ে থাকবে যতক্ষণ না তাঁর হাত ধরে মান ভাঙ্গাতে কেউ না আসে। আরও কত কত স্বপ্ন ছিল সেগুলো মনে হলে কেবলই দীর্ঘশ্বাস বাড়ে।
কী রঙিন দিন-ই না ছিল তিন বন্ধুর, অয়ন-মুনিয়া-মারুফের। বন্ধুত্ব কাকে বলে ওদের দেখে অনেকে উদাহরন দিত। একই ক্লাস, একই বিশ্ববিদ্যালয়, একই বিষয়ে পড়তো ওরা। কথা ছিল সারা জীবন বন্ধু হয়ে থাকবে তারা। কিন্তু তা আর হল কই? একটা সময় মুনিয়া মারুফের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। অয়নও ভালোবাসে মুনিয়াকে। মারুফ দু’জনকেই চায়। কাউকে হারাতে চায় না। সে কৌশলে মুনিয়ার সাথে দূরত্ব বাড়াতে চায় কিন্তু বাস্তবে তা হয় না।
ভালোবাসা এমনই এক ব্যাধি যা এক মনেতে স্থির থাকে না। প্রকাশ না করা পর্যন্ত জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মনের ভিতরটা খাগ করে দেয়। মারুফের মন পাওয়ার জন্য কি না করেছে মুনিয়া ! তবুও সুদর্শন ছেলেটি তাকে পাত্তা দেয় না। বন্ধুত্বে কোন অবহেলা নেই, প্রেমের জ্বালে সে আটকাবে না। অন্য কারো সাথেও সম্পর্ক নেই তাহলে এই উপেক্ষার কারণ কি ? অয়ন-কে বলেছিল কেন মারুফ বন্ধু থেকে প্রেমিক হতে পারে না? অয়ন বলেছিল- সে জানে না। অয়ন মুনিয়ার জন্য পাগলপ্রায় একথা মুনিয়ার অজানা নয়। অয়ন তো মারুফ থেকে কম সুন্দর নয় বরং শরীরের গঠন আরও ভাল। তবুও মুনিয়া মরিচার পিছনেই ছুটে মরে দিন রাত। দেখে দেখে আহত হয় অয়ন।
সুন্দর দিনগুলো কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে গেল। বিষাদে ভরে থাকে মন। না পাওয়ার বেদনায় আশাহত হয় দু’জন আর অন্যজন নিয়তির কাছে সপে দেয় নিজেকে।
মুনিয়ার পরিবার বিয়ের জন্য চাপ দেয় তাকে। চাকরী পেয়ে অয়ন প্রস্তাব পাঠায়। মুনিয়া রেগে আগুন। কিছুতেই সে বিয়ে করবে না এখন। বিয়ে না করার কারণ জানতে চায় বাপ-মা ? সঠিক কোন কারণও বলে না মুনিয়া শুধু জেদ ধরে থাকে। এদিকে মারুফ লা-পাত্তা। কি করবে মুনিয়া ? যে মানুষটা তাকে চায় সেই অয়নকেই বেছে নেবে না নতুন কাউকে সপে দিবে নিজের এই হাহাকারময় জীবন ?
বাস্তবতা বড় কঠিন। মারুফের কোন খোঁজ নেই, যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে মানুষটা। যে নেই তার জন্য পড়ে থাকার কোন মানে নেই বরং যে তাকে ভালোবেসে তৃষ্ণিত হয়ে আছে জনম ভর তাকেই জোছনার মায়ার মত ভালোবেসে, সুখ-আনন্দে ভরে তুলুক জীবন। কিন্তু চাইলেই কি সব পাওয়া যায় জীবনে?
অপেক্ষার কষ্ট পৃথিবীতে সব চেয়ে নির্মম। এই নির্মম ব্যাথা নিয়ে দিনের পর দিন পার করছে মুনিয়া। অপেক্ষা করতে করতে সে এখন ক্লান্ত মরুর পথিক। তবুও যাকে ভালোবাসে সে নেই আকাশের কোথাও, নেই তার ফেরার আগমনী বার্তা, নেই কোন চিহ্ন যা আকড়ে ধরে মুনিয়া থাকতে পারে। ধূসর পান্ডুলিপির মত ধূলো জমে কেবল মনের ভিতরে আর স্মৃতিগুলো আরও বেশি ম্লান হতে থাকে। তারপর একদিন বাবা-মা আর অয়নের দেখানো পথেই হেটে যায় সে।
অগ্রাহায়ণের এক সোনাঝড়া রোদের দিনে বর সেজে এল অয়ন। কি সুন্দরই না লাগছে তাকে, কই আগেতো তাকে এত ভাল লাগেনি। লাগবে কি করে সে কি ভালোবেসে সুনজরে চেয়েছে অয়নের দিকে। কেবলই মিছে মিছে মারুফকে না পাওয়ার যন্ত্রণায় নিজেকে কষ্ট দিয়েছে। আসলেই কি কষ্ট নাকি অন্য কিছু? যা আর সারা জীবনে ভুলা যায় না। মর্মের এই যাতনা কাউকে বলা যায়না, কাউকে দেখানো যায়না। কেবল একা পুড়তে হয়, একা জ্বলতে হয়।
বিয়ের পর ভালই যাচ্ছে দিন কাল নতুন দম্পত্তির। কিন্তু মনের কোন গহীন কোনে যে মারুফ আজও রয়ে গেল তা বুঝতে পারেনা মুনিয়া। এত চেষ্টা করার পরও কিছুতেই মারুফ নামের ছায়াটা মন থেকে মুছে ফেলা যায়নি। বন্ধু হয়ে, প্রেমিক হয়ে, কুহক হয়ে, স্বপ্ন হয়ে, মায়া হয়ে, ছায়া হয়ে সে ফিরে আসে । বার বার ফিরে আসে। ভিন্ন ভিন্ন রূপে । আর এলোমেলো করে দেয় মুনিয়ার জগৎ সংসার।
ইদানিং কোন কিছু নিয়ে ঝগড়া হলেই মারুফকে নিয়ে টানাটানি করে অয়ন। খোটা দেয়। বলে-ঘর করো একজনের মন দিয়ে রেখেছ আরেকজনকে। আরও বলে-তোমার কায়া এখানে কিন্তু ছায়া ঘুরছে মারুফের পিছে পিছে। এভাবে কি সংসার হয় নাকি সুখি হওয়া যায় ? সত্যিইতো অয়নের মাঝে সেতো বার বার মারুফকেই চায়। মারুফের যে রং পছন্দ সে রঙের পোশাকই অয়নের জন্য বেছে বেছে কিনে নিয়ে আসে । খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে সবকিছুতেই অয়নকে বাধ্য করে মারুফ হতে। অয়ন কি এতই বোকা। কিচ্ছু বুঝে না সে ? সবই বোঝে। এত দিন কিছু বলে নাই ভেবেছে সময় গেলে আপনি ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু দিন যায়, মাস যায় মুনিয়ার ধ্যান-জ্ঞান মারুফ থেকে সরে না।
একদিনতো রাগের মাথায় বলেই ফেলেছে-তোমাকে ভালোবাসার মত ক্ষমতা মারুফের নেই। সে কোন নারীর প্রতি টান অনুভব করে না।
কথাটা শুনে ভীষণ চমকে যায় মুনিয়া। তবে কি সে.....না না একথা সে ভাবতেই পারে না। এত সুন্দর একটা ছেলে এমন করে নিজেকে শেষ করে দিবে। ভাবনার চাবুক যেন প্রহার করেই চলে অহর্নিশ মুনিয়ার পিঠে। মুনিয়া ক্ষত বিক্ষত হয়, রক্তাক্ত হয়। কথাটা শুনে কান মাথা গরম হয়ে গেল তার। খাওয়া-দাওয়া হলোনা, রাতে ভাল ঘুমও হলো না।
হয়তো অয়ন তাকে জব্দ করার জন্য বলেছে এসব কথা। কই এর আগে কখনোতো অয়ন এসব বিষয় নিয়ে বলেনি যখন তারা কেবলই একে অন্যের বন্ধু। কেউতো কখনো বলেনি মারুফ সম্পর্কে এমন কথা, তার নিজের চোখেওতো ধারা পড়েনি এমন কিছু। সন্দেহের তীর একবার বিদ্দ হলে সেটা থেকে মুক্তি পাওয়া মুশকিল। কে জানে কার মনে কি আছে ওপরওয়ালাই ভাল জানেন।
মুনিয়ার মনে পড়ে গেল সেদিনের মারুফের বলা কথাটা- জানিস আমি না অন্য রকম। মুনিয়া হেসে জানতে চেয়েছিল কি রকম। মারুফ আর উত্তর দেয়নি। বলেছিল-জানলে আমার সাথে আর তোদের সম্পর্ক থাকবে না। আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাবে এবং আমি আর কোন দিন তোদের মুখ দেখাতে পারবনা।
টাকা-পয়শা, শাড়ী-গহনা, নিজস্ব ফ্ল্যাট, আড্ডা, ঘুরে বেড়ানো সবই আছে, সবই হচ্ছে তবুও যেন ঠিক সুখী হতে পারেনা মুনিয়া। সুখের মুখোশ পরে আছে যেন সবাই ভাবে সুখেই আছে সে। আসলে গভীর গোপন সুখ নামের অসুখে ভুগছে।
অয়ন তাকে বুঝতে পারে বলে রক্ষা। অন্য কোন পুরুষ হলেতো সম্পর্কের মানে খুঁজতে গিয়ে প্রশ্নের বানে জর্জরিত করত তাকে। বদনাম ছড়াতেও দ্বিধা করত না। বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়াও আজগুবী কিছু নয়। তবুও কোথায় যে স্বচ্ছ কাচের একটা অদৃশ্য বাধা যার বলয় কিছুতেই ভাঙতে পাড়ছে না মুনিয়া।
সে দিন শপিং করে ফিরছিল মুনিয়া। মনটা ফুরফুরেই ছিল। লেকের ধারে আসতেই চোখ গেল পাশের রাস্তায়। রাস্তার মোড়ে দাড়িয়ে আছে দুই তরুণ। পিছন থেকে একজনকে মারুফ বলে ভ্রম হলো। মনটা লাফিয়ে উঠলো। তবে কি সে এ শহরের ঘাপটি মেরে আছে। আত্মগোপন করে আছে আশে পাশে কোথাও। আর তারা বৃথাই খুঁজে মরছে।
পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল মুনিয়া। রক্ত চলাচল যেন বেড়ে দ্বিগুন হেয়ে গেছে। হৃদপিন্ড যেন খাঁচা ছেড়ে বের হয়ে যাবে। হঠাৎ ছন্দপতন। সেই তরুন কথা শেষ করে ঘুরতেই মুনিয়ার আশা ভঙ্গ হলো। এ যে অন্য কেউ, মারুফ নয়। হতাশা আর আক্ষেপ যেন এসে খামছে ধরলো তাকে। কোনরকমে বাসায় ফিরে এলো। সারাটা বিকেলই মনটা ভার হয়ে ছিল, চোখে জল ছিল।
অয়নের সাথে ঝগড়া হলেই গভীর রাতে এই দক্ষিণ বারান্দায় চুপি চুপি এসে দাড়ায় মুনিয়া। আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। এলমেলো ভাবনার জগতে হঠাৎই মারুফ আসে-
-কী ভুলে গেলে আমাকে ?
-তোমাকে মনে রেখে কি লাভ ! শুধুই স্মৃতির হাহাকার। বেদনার গøানি বাড়ানো।
-তবুওতো ভালোবাসতে।
-হুম তা বাসতাম। লাভ কি হলো তবুও তোমার মন পেলাম না।
-পেলে আরও কষ্ট বেড়ে যেত মুনিয়া ।
-কিন্তু না পাওয়ার আক্ষেপও তো ঘুচলনা।
-তুমি কোথায় মুরুফ?
-এইতো এখন এখানে। আবার অন্য সময় অন্যখানে।
-কেন তুমি আমার হলেনা ?
-হয়তো নিয়তির লিখন ছিলনা তাই আমি তোমার নই, তুমি আমার নও।
-আক্ষেপ এটাই সঠিক কারণটা আজও জানতে পারলামনা, তোমার সমস্যাটি কি ?
উত্তর পাবার আগেই বাহিরে রাস্তায় হঠাৎ মুঠোফোনের আলো জ্বলে উঠলো। কে যেন গাইছে ভরাট কন্ঠে-
ভালোবাসা সীমাহীন, এ জীবন সীমাহীন নয়তো..............
যেটুকু সময় পাব শুধু ভালোবেসে যাব, তা নাহলে মরে যাবো হয়তো...............
সদ্য মুক্তি পাওয়া ফিল্মের এই সুন্দর গানটি গাইছে এক কিশোর আর হেটে যাচ্ছে সিনেমার নায়কের মত স্টাইল করে। হয়তো সেও সদ্য প্রস্ফুটিত কোন এক কিশোরীর প্রেমে পরেছে। হয়তো আগামী ভোরে ফুল নিবেদন করবে তারপর চিরকুট দিবে।
কখন যে ভাবনার জাল থেকে ছিড়ে বেড়িয়ে গেল তার গোপন প্রিয়জন টেরই পেলনা অসুখী তরুণী। তবুও ঠায় দাড়িয়ে আছে বারান্দায়।
অয়ন আচমকা ঘুম থেকে জেগে দেখে মুনিয়া নেই। বারান্দায় গিয়ে ডাকলো- কি হয়েছে ? শরীর ভাল লাগছে না ?
-না ভালই। হঠাই দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গেছেতো তাই একটু এখানে এলাম, রাতের আকাশ দেখছিলাম।
-ঘুমাতে আসো। রাত জাগতে হবে না বলেই মুনিয়ার হাত ধরে বিছানায় নিয়ে এলো। মূহুর্তেই সব রাগ-অভিমান পানি পানি হয়ে গেল। অয়নকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল সে। অয়নটা এত ভাল কেন ? ভাবতেই অজান্তে চোখের কোন বেয়ে দু,ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।
না আর সে মারুফকে ভাববে না। সে দূরের আকাশে নক্ষত্র হয়েই থাক। থাকুক সে মরিচীকা হয়ে, থাকুক সে আলেয়ার আলো হয়ে, থাকুক সে সুদূর বিজণ বনে। তাকে আর ভাববেনা, আনবেনা স্মরণে, মনে ও মণনে।
যাকে নিয়ে দক্ষিণ বারান্দায় বসে স্বেেপ্নর জ্বাল বুনে সময় কাটানোর কথা ছিল সেই যখন নেই তখন অয়নকে নিয়েই সে বারান্দয় সময় কাটাবে। সুখ-দুঃখের কথা কইবে। এত দিনের দুঃখ, কষ্ট মিটাবে। হাওয়া বইছে। অন্ধকারে হাওয়া বয়েই চলছে দক্ষিণ বারান্দায়।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
তিন বন্ধু ও তাদের ভালোবাসা, চাওয়া-পাওয়ার গল্পই হচ্ছে দক্ষিণ বারান্দার পটভূমি।
২৪ আগষ্ট - ২০২০
গল্প/কবিতা:
৯৮ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪