আগুন-পানি

ভয় (সেপ্টেম্বর ২০২১)

মোঃ মাইদুল সরকার
  • 0
  • ২০
রাত হলেই ভয় লাগে সোহানের। ভয়তো লাগবেই-যদি মরে যাওয়া ভাই রাতে ডাকতে আসে, নিয়ে যেতে চায় সাথে করে তবে কার না ভয় লাগবে। যে ভয় পাবেনা সে প্রাচীন রোমের গ্লাডিয়টদের মতই সাহসী। সোহানেরা ছয় ভাই। পর পর দুই ভাই মারা গেছে। তৃতীয় জনের ডাক কখন আসে সেই আতঙ্কে ভাইদের ঘুম হারাম।
সবার আগে মারা গেল চার নম্বর ভাইটা। সবে মাত্র বিয়ে করে সংসার গুছাচ্ছিলো। একটা পুত্র সন্তান ঘর আলো করে এসেছে। সংসারের মায়া কিংবা ভালোবাসায় পুরোপুরি জড়াবার আগেই হুট করে একদিন জ্বর এলো, এক সপ্তাহ পরে পুরো শরীর হলুদ হয়ে গেলো। হাসপাতালে যখন নেওয়া হলো ততক্ষনে সব আশা শেষ। ডাক্তার জানালেন শরীরের ভিতরের সমস্ত গুরুত্বপর্ন অঙ্গ ডেমেজ হয়ে গেছে। অপারেশন করাও রিক্স। সকাল হতেই পৃতিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেলো-সুমন।
সুমনের এমন আকস্মিক মৃত্যুতে সবাই বজ্রাহত। বাবার কবরে ছেলে যায়েদ গিয়ে যখন বলে-বাবা তুমি কথা বলনা কেন, আমার সাথে রাগ করেছো…….তখন কান্নায় চোখের অশ্রু সংবরন করতে পারেনা আশে পাশের মানুষজন। এতিম যায়েদ প্রায়ই তার বাবা সুমনের কবরে চলে যায় একা একা। কবস্থানটা বেশি দূরে নয় বাড়ি লাগোয়া হওয়ায় যায়েদের মায়ের ছেলেকে নিয়ে দু:শ্চিন্তা এখন কিছুটা কমেছে।
দ্বিতীয় ভাই তানভীর এর জন্য কনে দেখা হচ্ছে। সেও বিয়ে করে নতুন সংসার শুরু করার স্বপ্নে বিভোর। কিন্তু নিয়তি যে সাজিয়ে রেখেছে ভিন্নতর আয়োজন সেটা খন্ডাবার সাধ্য মানুষের নেই।
বলা নেই, কওয়া নেই শরতের এক বিকালে উঠানে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেলো তানভীর। যারা কাছাকাছি ছিল তারা দ্রুত তাকে উঠিয়ে মাথায় পানি ডালতে থাকে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সে মরন ঘুমে ঢলে পড়ে। তানভীরের এহেন মৃত্যু সোহানের মনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। চোখের জলে ভাইকে কবর তলে শুয়ায়ে বুকে কষ্টের পাথর চেপে রাখে।
সুমনের বউ ও বাচ্চার ভার কে নিবে এই প্রশ্নে পরিবারের সদস্যরা দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেলো। এক পক্ষ চাইলো সোহানের সাথে সুমনের বউকে বিয়ে দিয়ে যায়েদকে পিতৃহারা হওয়া থেকে বাঁচাতে আর অন্য পক্ষ চাইলো সোহান নতুন বিয়ে করে বউ আনুক, সুখী হউক। এক পক্ষ বলল-ভাবী বর পাবে আর জায়েদ পাবে বাবা কিন্তু অন্য পক্ষ বলল-সোহানের জীবনটা মাটি মাটি হোক আমরা চাইনা। সে নতুন বিয়ে করুক এটাই ভালো হবে।
এভাবে কেটে গেলো অনেক দিন। সোহানের মৃগী ব্যামো রয়েছে। আগুন- পানি থেকে তাকে সব সময় সাবধান থাকতে হয়। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ খেতে হয় সারা বছর। তার এক মন বলল-ভাবীকে বিয়ে করে ভাতিজাকে পিতৃস্নেহে ভরিয়ে দিতে আবার অন্য মন বলল-নতুন বিয়ে করে সংসার শুরু করতে। অনেক দিন ধরেই এই দোটানায় পড়ে তার মন বুঝে উঠতে পারলোনা কোনটা করলে তার জন্য ভালো।

রাতে একলা ঘুমাতে গেলেই সে তার পরপারে চলে যাওয়া দুইভেইকে দেখে। তারা আসে সোহানকে নিয়ে যেতে। তারা হাতছানি দেয়, তারা উকি দেয়, তারা হাসে……….. আর সোহান চিৎকার করে ঘুম থেকে উঠে যায়। একটা ভয় তাকে তারা করে ফেরে-এই বুঝি মৃত্যুদূত এসে গেলো। এই বুঝি তার প্রানপাখি খাচা ছেড়ে উড়ে গেলো।

শীতকাল দেখতে দেখতেই চলে এলো। গরুর জন্য ঘাস কাটা বা কচুরী ভেঙ্গে আনার কাজটা ছোট ভাই নুরুল হকই করে। আজ সকালে নুরুল হক বাাজারে গিয়েছে কিন্তু ফিরতে বেশ বিলম্ব হচ্ছে। এদিকে গোয়াল ঘরে গরু গুলো খাদ্যের জন্য অস্থির। অগত্যা টুকরী আর কাস্তে নিয়ে সোহানই বেড়িয়ে গেলো কচুরী ভাংতে। যাবার সময় শুধু মাকে বলে গেলো- মা আমি বিলে যাচ্ছি।

নুরুল হক বাড়ি ফিরে নাস্তা খেতে খেতে বেলা চড়ে গেলো কিন্তু তখনও সোহান ফিরেনি। মা বলল- সোহানের এত দেড়ি কেন হচ্ছে, আমার মনটা জানি কেমন করছে ? নুরুল,তুই একটু তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখতো ও কিরছে, আসছেনা কেন ?
মাকে অভয় দিয়ে নুরুল হক বাড়ির পূর্বদিকে রওনা হলো বিলে যাবে বলে। বিলে তেমন পানি নেই। নীচু জমিতে অল্প পানি আটকে যে কচুরী পানা ছিল সেগুলো এখন বেশ বড় হেয়েছে। সেই বড় বড় কচুরী পানাই গরুর উৎকৃষ্ট খাদ্য। আর সেগুলো সংগ্রহ করার জন্যই সোহান এসেছে।
নুরুল হক চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দূর থেকে কিন্তু কোথাও তার ভাইকে দেখতে পায়না। তার বুকটা ধক করে উঠে। সে দৌড়ে এদিকে সেদিক খুঁজতে থাকে তার ভাইকে। মাথার উপর সূর্য গনগনে রোদের আচে সে ভিজে যায় ঘামে। বাদিকের দুটো ক্ষেত পরেই কিছু কচুরি দৃষ্টিগত হয়। কাদা পানিতে কি যেন পড়ে রয়েছে। অজানা ভয়ে তার শরীর কেপে উঠে। সে এস্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে যা দেখে তাতে তার শরীর বরফের মত জমে যায়। আমার ভাই মইরা গেছে গো বলে সে গগন বিদারী চিৎকার করতে থাকে। তার চিৎকার শুনে দূরের চাষারা এগিয়ে আসে।
কচুরি ভাংতে ভাংতে সোহানের ঠান্ডা লাগতে শুরু করে, কাদা পানিতে দাড়িয়ে কাজ করতে করতেই হঠাৎ তার ব্যামো উঠে। সে ডাঙ্গায় শুকনা জায়গায় যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে কিন্তু কাদায় তার পা আটকে যাওয়ায় সে পা টেনে বের করতে করতেই শরীরে কাপনী উঠে। আর কাপনী উঠার পর পর সে কাদা জলে পড়ে যায়। সে খানে সে গড়াগড়ি খেতে থাকে। ক্রমশ তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। সে কাদা জলে স্বাস নেওয়ার জন্য তরপাতে থাকে। কচুরী পানার শিকরের ভিতরে চলে যায় তার মাথা তারপর নিস্তেজ হয়ে আসে শরীর। যে মৃত্যু ভয় থেকে বাঁচার জন্য সে সবসময় আগুন –পানি থেকে দূরে থাকতো সেই মৃত্যুই তাকে এই বিলের মধ্যে গ্রাস করে।

ভাইয়ের লাশ পাজাকোলে করে শুকনা যায়গায় নিয়ে হাত দিয়ে কানে, চোখে, মুখে যেখানে কাদা লেগে আছে তা পরিষ্কার করতে থাকে নুরুল হক। আর বলতে থাকে-ভাইরে কেন তুমি কচুরী ভাংতে আইলা। কেন তুমি আমার লাইগা দেরি করলা না। বাজার থাইকা ক্যান আমি দেরি কইরা ফিরলাম। আমি এখন কই পামু আমার ভাইরে। ভাই…ও ভাই কথা ক ভাই।
নুরুল হকের আহাজারীতে বিলের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। সমবেত জনতা শোকাহত নুরুল হককে আর তার সদ্য মরে যাওয়া ভাইকে তাদের বাড়িতে নিয়ে আসে। দাবানলের মত মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে আর মানুষের ভীর বাড়তে থাকে নুরুল হকদের উঠানে।
ছয় ভাই থেকে তিন ভাই চলে গেলো মাত্র ছয় মাসের মধ্যে। বাকি তিন ভাই যেন জীবন সম্পর্কে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠলো। আর তাদের মা তিন পুত্রকে হারিয়ে নির্বাক। শুরু বলে আগুন আর পানি আমার পুতের শত্রু। সেই শত্রুই আমার পুতের মৃত্যু ডাইকা আনছেগো। সেই শত্রুই আমার পুতেরে কইরা নিলোগো। পুত্রে শোকে শোকাতর জননীর বিলাপ যেন কিছুতেই শেষ হয়না।

খোদা তুমি আমারে না নিয়া আমার জুয়ান পোলগো একেক কইরা নিতাছো এইডা তোমার কেমন বিচার। খোদা তুমি আমারে নিয়া যাও আমার পুতেগো রক্ষা করো। আমি মা হইয়া আর দেখতে পারিনা সন্তানের মৃত্যু। আমি আর সয্য করতে পারিনা……..
মৃত্যুকে ভয় পায় সবাই। মৃত্যু কেড়ে নেয় জীবন নেমে আসে শোক। শোকের নদীতে এক সময় চড় জাগে। শোক সইবার ক্ষমতা বাড়ে। তবুও মৃত্যুর মিছিল বন্ধ হয়না। সেই মিছিলে যোগ দেয় অগনিত প্রাণ। এমনি করেই চিরন্তন চলতে থাকে পৃথিবীতে মানুষের আসা-যাওয়া।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
doel paki nice.
ভালো লাগেনি ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১
ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১
Dipok Kumar Bhadra সুন্দর লিখেছেন।
ভালো লাগেনি ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১
ধন্যবাদ, ভালো থাকুন প্রিয়।
ভালো লাগেনি ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১
ইব্রাহিম ইসলাম ইমন Very Interesting drama.
ভালো লাগেনি ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১
ধন্যবাদ আপনাকে।
ভালো লাগেনি ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২১
ফয়জুল মহী শব্দ বর্ণ ও চয়নে স্বকীয়তা আছে।
ভালো লাগেনি ১ সেপ্টেম্বর, ২০২১
ধন্যবাদ পাশে থাকার জন্য।
ভালো লাগেনি ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

পর পর কয়েকটি ধারাবাহিক মৃত্যু একটি পরিবারে যে প্রভাব ফেলে তাই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে গল্পে।

২৪ আগষ্ট - ২০২০ গল্প/কবিতা: ৯৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪