নতুন শাড়ি

মা আমার মা (মে ২০২১)

মোঃ মাইদুল সরকার
  • 0
  • ২৯
ঢাকায় ঠেলা গাড়ি চালানোর কাজ জুটিয়ে নিয়েছিল লোকটি। মেঘনা থানার সেননগরে ছিল তার পরিবার। বছরে কয়েকবার বাড়ি আসতো। ঈদ পারবনে বউ ছেলে-মেয়ে নতুন কাপড় পেতো। সাদা-সিদা লোকটির নাম ছিল জালালউদ্দিন কিন্তু লোকে ডাকতো জালাদ্দি নামে।

একবার গ্রামের বাড়ি এসে সে তার পরিবারকেও ঢাকায় নিয়ে গেলো। তার আপন ভাইরাতো বটেই পড়শিদেরও চোখ টাটাতে লাগলো। ‘ঠেলা গাড়ি চালিয়ে পরিবার ঢাকায় রাখন সোজা কতা না, মনে হয় লগে অন্য কামও করে তাই কামাই বাড়নে বউ বেডি লইয়া গেছে লগে’। এরকম কত কত কথা যে বলতে লাগলো মানুষজন তার ইয়ত্ত্বা নেই।

অনেক দিন পর জালালউদ্দিন ফিরে এলো তার পরিবার সমেত। ততদিনে ছেলে মেয়ে হয়েছে দ্বিগুন। পূর্বে সখিনা আর শাহআলমের সাথে পরিচয় থাকলেও এবার নতুন করে শারমিন ও কবিরের সাথেও পরিচিত হলাম। জালালউদ্দিনের আর কখনো ঢাকা যাওয়া হয়নি, হবে কি করে সে যে গ্রামে এসেছিল লাশ হয়ে।

স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুও পর সেই যে কপাল পুড়লো সখিনার মার তারপর ভাগ্যের ফেরে কি করে নিঃস্ব আর একলা হয়েগেলো এই নারী সেই গল্পই আজ তুলে ধরবো পাঠকের সামানে।

স্বামীর ভিটায় চার ছেলে মেয়ে নিয়ে শুরু হলো নতুন করে জীবন যুদ্ধ। অভাবের ভয়ঙ্কর হানায় কিশোরী সখিনা আর তার ভাই শাহআলকেও গতর খাটানোর কাজে নেমে পড়তে হলো। সখিনা ধান বানা, চাল ঝাড়া আর অবস্থা সম্পন্ন গৃহস্তের গৃহিনীদের হাতের কাজ করে দিতো বিনিময়ে কেউ চাল, ক্ষুদ, ভাত কিংবা তড়িতড়কারি ওর হাতে তুলে দিতো। খুশি হয়ে তাই বাড়ি নিয়ে এসে মায়ের হাতে তুলে দিতো। অসহায় মা মেয়ের এই সামান্য অর্জনই অসামান্য মনে করতেন। শাহ আলম বদলী দেওয়া শুরু করলো। মাঠে রুদ্র তাপে কাজ করতে করতে তার কাচা হলুদ গায়ের রং তামাটে হতে লাগলো। মা ছেলের এহেন পরিশ্রমের কাজ দেখে গোপনে চোখের জল মুছতেন। কত কস্বপ্ন ছিল ছেলেকে পড়াশোনা করাবেন। তার স্বপ্ন স্বামীর কাফনের সাদা কাপড়ের মতই সাদা হতে লাগলো। সখিনার মা মাটি কাটার কাজ নিল। যখন মাটি কাটর কাজ না থাকতো তখন মানুষের মচির খেতে পাকা মরিচ তুলে দেওয়ার কাজ করতো। এক বস্তা মরিচ উঠালে সারাদিন শেষে সন্ধ্যায় গৃহস্তের উঠানে ঢেলে তা দশটি ভাগে ভাগ কওে এক ভাগ নিজে নতো আর নয় ভাগ গৃহস্তকে দিতো এভাবে সারাদিনে যত মরিচ উঠাতো তার অল্পই নিজের হতো। রোদের তাপ যেন আগুনের হলাকা, ঘাম আর মলিন চেহারা নিয়ে এভাবেই গাঁয়ের অন্য গরীব মহিলাদের সাথে কাজ করে যেত। এভাবে যত মরিচ জমতো তা রোদে শুকিয়ে বর্ষা কালে দাম বাড়লে বিক্রি করে সংসার চালাতো।

তাতে করেও অজগরের মত হা কওে থাকা অভাবের খাই মিটতো না। কখনো মানুষের খেতের শাক কিংবা সব্জি চেয়ে চিন্তে একমুঠো দুমুঠো উঠিয়ে এনে রান্না চড়াতেন। সবচেয়ে কষ্ট হতো বর্ষা কালে। মাঠ-ঘাট পানিতে ডুবে একাকার । কোন কাজ নেই কোথাও। পান্তা ভাত জুটাতেও ঘাম ছুটতো। তখন শাহ আলম নৌকা নিয়ে মানুষ পারাপারের কাজ করতো। দাউদকান্দি থেকে ট্রলাওে আগত মানুষেরা বাজারে নামলে নৌকায় চরে যে যার গ্রামে যেতো। অনেক মাঝির সাথে প্রতিযোগিতা করে যাত্রী উঠাতে হতো। তারপর কখনো লগি, কখনো বৈঠা বেয়ে চলে যেত দূর দূরান্তের গ্রামে।

সখিনা যে বাড়িতে কাজ করে সেবার কাঁচা আমের ভর্তা খাবে বলে খান বাড়ির আশরাফ খানের বউ সখিনাবে বলল, ‘গাছ থেকে গোটা কতক আম পাড়তো সখিনা’। কাঁচা আমে ছেয়ে আছে গাছ। ভর্তা খাবার লোভে আনাড়ি সখিনা কোমড়ে ওড়না প্যাচিয়ে আল্লাহর নাম নিড়ে দুরু দুরু বক্ষে কোনমতে গাছে চড়ে আম পেড়ে নীচে ছুঁড়ে ফেলতে লাগলো আর আশরাফ খানের বউ তা ঝুড়িতে কুড়িয়ে রাখছে। সখিনা সাবধানে গাছ থেকে নামতে থাকে কিন্তু মাঝ পথে হাত ফসকে যায়। কিন্তু ভাগ্য ভাল যে শেষ পর্যন্ত মাটিতে পতনের আগেই অন্য একটা ডাল ধরতে সক্ষম হয়।
সখিনার চিৎকারে খান বাড়ির বউ উপওে তাকিয়ে সখিনার ঝুলে থাকা দেখে ভয় পায়। যদি সখিনা পড়ে গিয়ে হাত-পা ভেঙ্গে বসতো তবে দোষতো তার উপরেও বর্তাত। আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ায় দুজনেই সৃষ্টি কর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ জানায়।

দুপুরের তপ্ত রোদে যখন পোড়া লঙ্কা দিয়ে আমের ভার্তা খায় তখন সখিনা কিংবা খান বাড়ির বউ কিছুক্ষণ আগের দুর্ঘটনার কথা বেমালুম ভুলে যায়।
সখিনাও ঘটনাটা চেপে যায় কারণ তার মা জানতে পারলে তাকে উত্তম মধ্যম দিবে। সেদিনের পর থেকে সখিনা আর গাছে চড়েনা।

বছর ঘুরে যখন ঈদ আসতো আর গ্রামে সব ছেলে পুলেরা নতুন নতুন কাপড়-চোপড় পড়ে ঘুরে বেড়াতো তখন সখিনাদের পুরাতন জামা-কাপড় ধুয়ে ঈদের দিনে পড়তে হতো। তাদের মা কারো বাড়ি থেকে অনেক বলে কয়ে একটা নারিকেল এনে দুধ ছাড়াই চিনি দিয়ে সেমাই রান্না করতো। সেই সেমাই খেয়েই তারা খুশি হতো। খেলতে চলে যেত সমবয়সীদেও সাথে। তাদের বাবা বেচে থাকার সময়টা স্মৃতিতে ফিরে আসতো। তখন পূর্বেও স্বচ্ছলতা আর বর্তমান দৈন্য দশা, অবহেলা আর লাঞ্চনা-গঞ্চনায় চোখের বাধা না মেনে অশ্রু গড়িয়ে পড়তো বাবা হারা এই হতভাগা ভাই-বোনগুলোর। সে অশ্রু দেখার মত মানুষ ছিলনা। কেবল সৃষ্টিকর্তাই দেখতেন তার সৃষ্টির কষ্ট।

সুদিনে সবাই পাশে থাকলেও দুর্দিনে কাছের লোকেরাই মুখ ফিরিয়ে নেয় সখিনার চাচারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, মামারা কদাচিৎ সাহায্য করলেও তা একেবারেই অপ্রতুল। তাছাড়া তাদের নিজেদেরও অবস্থাও বলার মত ভাল নয়।

আরও অনেক বছর পর গ্রামে বিদ্যুৎ এলো। প্রতিটি ঘর জ্বলে উঠলো কেবল অন্ধকাওে থেকে গেল সখিনাদের ঘর। বিদ্যুৎ বিল দিতে পারবে না বলে কেউ মৃত জালালউদ্দিনের নাম এন্ট্রি করলোনা, মিটার বরাদ্দ হলোনা। গ্রাম যখন বিদ্যুতের আলোয় ঝলমল করছে তখন হ্যারিকেনের আলোই সখিনার মার ভরশা। শাহআলম অবশ্য দৌড়-ঝাপ করলো। নেতা গোছের মানুষের হাতে পায়ে ধরলো কিন্তু টাকার জোড় আর মামার জোড় না থাকায় প্রাপ্তি ফল শুণ্য।

সখিনা এখন যুবতী। তার বিয়ের জন্য মা অস্থির। অবশেষে নিজের বাপের গ্রামের এক পোলার সাথে বিয়ে হয়ে গেল সখিনার। সখিনার মন্দ কপাল। বেশিদিন স্বামীর ঘর করতে পারলোনা। যৌতুক দিতে পারেনি বলে শারীরিক ও মানুষিক নির্যাতন সইতে হলো। মেয়েটা যখন পোয়াতি তখন মা তাকে একেবারে নিজের কাছে নিয়ে এলো।
‘অভাব হোক আর যা হোক মেয়েতো চোখের সামনে থাকলো। যা জুটে তাই খাওয়াবো মেয়েকে তবু অন্যেও ঘওে লাথি-উস্ট্রার মধ্যে রাখবোনা’। এ কথা বেশ দম্ভের সাথে বলে মেয়েকে আর কখনো অত্যাচারিত হবার জন্য শ্বশুরবাড়ি যেতে দেয়নি।

গরীবের অভাবে খাবার জোটেনা, অসুখে চিকিৎসা পায়না। সখিনা একটা ফুটফুটে পুত্র সন্তান জন্ম দিয়ে চিরতরে অভাব অনটন থেকে পালিয়ে গেলো, যেখানে গেলে কেউ আর কোনদিন ফিরে আসেনা।

কিশোরি সারমিন এখন ছোট ভাই কবির আর ভাগনে সামিরকে দেখে রাখে। কবির জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী। তার পা দুটো অত্যন্ত সরু। ডাক্তার দেখিয়েও কোন লাভ হয়নি। অনেক চেষ্টা তদবির করে এখন সে লাঠিতে ভর দিয়ে হাটতে পারে। সন্তান হাটতে পারছে এটাই খুশির বন্যা এনে দেয় মায়ের মনে।

শাহ আলম লুকিয়ে টাকা জমিয়েছে। মোটে ছয়শত টাকা। একটা পাঁচশত টাকার নোট সাথে একটা একশত টাকার নোট। তার অনেক দিনের স্বপ্ন মাকে একটা নতুন শাড়ি কিনে দেবে। সারা বছর মায়ের গায়ে ছেড়া কাপড়। একটা নতুন কাপড়ে মাকে কতটা সুন্দর আর উজ্জ্বল দেখাবে সেটা কল্পনা করে সে এক প্রকার আনন্দ পায়।


সেদিন রাতে খাওয়ার পর মা-ছেলেতে অনেক কথা বলাবলি হলো। ঘরে একটা মাত্র চকি। চকিতে মা শোয় আর তারা ভাই বোনরা মাটিতে বিছানা করে ঘুমায়। শারমিন, কবির আর সমির ঘুমিয়ে গেছে। এক কোনে একটা কুপি জ্বলছে টিমটিম করে মনে হয় কেরোসিন কমে এসেছে। সংগোপনে টাকাটা বের করে মায়ের হাতে তুলে দেয় শাহআলম।

-মা তোমার লাইগা আমি টাকা জমাইছি। একটা নতুন শাড়ি কিনমু। তুমি পইরা বেড়াইতে যাইবা, তোমারে দেখতেও সুন্দর লাগবো।

-সত্যি বাজান তুই আমার শাড়ি কিননের লাইগা টাকা জমাইছছ ! তোরওতো নতুন একটা শার্ট নাই, লুঙ্গি নাই। তুই আগে কিন বাজান আমি না হয় আর ক’দিন পরেই কিনমু।

-না মা। এইডা হয় না। তোমার নাম কইড়া টেকা জমাইছি । তোমার শাড়ি কিনমুই কিনমু।
পুত্রের কথায় চোখে আনন্দ অশ্রু দেখা দেয় সখিনার মার। আহ! আমার সখিনাডা মরলো। কোনদিন ভালা একটা কাপড় দিতে পারি নাই মাইয়াডারে। খাওনের কষ্ট পিন্দনের কষ্ট কইরা গেল। খোদা আমার অভাগী মাইয়া এহন তুমার কাছে তুমি তারে দেইখা রাইখো। কথা কটা বলার পর মায়ের চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে মৃত কন্যার শোকে।
মায়ের মুখের এহেন কথায় বোনের জন্য শাহআলমেরও অশ্রুস্বজল হয় দু’চোখ। মনে পড়ে পুরোনো অনেক স্মৃতি। বেদনার ভারে ভারী নি:শ্বাস বয়ে যায় দুটি মানুষের।

কথায় কথায় রাত্রি গভীর হলে মা-ছেলেও ঘুমিয়ে পড়ে নতুন দিনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে। রাত্রি এগিয়ে চলে প্রভাতের দিকে।


শাহআলম দেখলো তার জমানো টাকা দিয়ে মা নতুন শাড়ি না কিনে পায়খানার স্লাব এনেছেন। রাগে-দু:খে তার কান্না এলো। টাকাটা মাকে দেওয়াই ভুল হয়েছে। মা যে নিজের জন্য কিছু করবেনা সেটা সে জানতো। কেবল সংসার সংসার! সে নিজেই শাড়ি কেন যে কিনলনা এ জন্য তার এখন আফসুস হচ্ছে।

ছেলের রাগ আর জিদ দেখে মা বললো- দ্যাখ বাজান। কাপড় পড়ে কিনলেও চলবো। মাইনষের পায়খানায় জাওন লাগে এর চেয়ে শরম আর আছে। তাই তোর আর আমার জমাইন্না টাকা দিয়া নিজেগো পায়খানাটা কইরা লইলাম।

শরমের চেয়ে খাওন-পড়ন বড় না। তুই মন খারাপ করিস না। একদিন সব হইবো। শাহআলম চুপ করে থাকে কিছু বলেনা। হয়তো মায়ের শান্তনায় সেও অদূর ভবিষ্যতের নিজেদের স্বচ্ছলতার ছবিটা দেখতে পায়।

কবির কাজে যাচ্ছে পুকুরপাড় পেড়িয়ে বাগের বড় বড় কড়ই গাছের নিজ দিয়ে সে যখন মাঠে যাচ্ছে তখন
‘তোর ভাই কবিররে বাইত বওইয়া বইয়া বইয়া খাওয়াছ। কোন দিন কোন কামে আইবনা। তার চেয়ে দাউদকান্দি নিয়া ছাইরা দে ভিক্ষা কইরা ট্যাহা কাইমাইয়া তোর হাতে দেউক। তরও ভার কমলো, সংসারেও দুইডা পয়শা আইল’। রফিক জ্ঞান দেওয়ার মত কথাটা বলে দাত কেলিয়ে হাসতে থাকে।
রফিরেক এমন কথায় বেজায় চটে যায় শাহআলাম। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করে বলে-

‘ কোন মতেই আমি এই কাজ করুম না।আমার বাপ নাই। আমি বড় ভাই। সংসার দেখ-ভাল করনের দায়িত্ব এহন আমার। আমার ভাইরে আমি শাসন করমু, সোহাগ করমু । অন্যায় করলে একবার মারুম আরেকবার বুকে জড়াইয়া ধরমু। নিজে যা পারি তাই খামু ওরেও খাওয়ামু। খাওয়ানের ডরে কোন দিন ভিক্ষাত নামাইতামনা ভাইয়েরে’।


‘আর কোন দিন এমন ফাইজামীর কথা কইবিনা আমার লগে রফিক। তয় তর লগে আমার যে বন্ধুর সম্পর্ক সেইডা শেষ হইয়া যাইবো।’
রফিককে অবাক করে দিয়ে হনহনিয়ে চলে যায় শাহআলম। রফিক অবাক হয়ে নিরবে তার পথপানে চেয়ে থেকে বলে-
‘বিনে পয়শায় দুটো ভাল পরামর্শ দিলাম। শালার পুত দেহি উল্টা আমারেই খারাপ ভাবে। দরকার নাই বাপু ভালা কতা কওনের । যার যার ভাল সে সে বুঝুক।’

মাঠে কাজের ফাঁকে ফাঁকেও রফিকের সেই কথাগুলো বল্লার হুলের মত বিধে যেন মগজে। মানুষ তারে ভাবে কি ? সে কি এতটাই অক্ষম যে তার মা আর ভাই বোনরে পালতে পারবে না। দরকার হয় রক্ত বেইজা সংসার চালামু। তবুও ভিক্ষা নয়।
ঘৃনায় তার মুখ কুচকে যায়। ওয়াক থু। একদলা থুতু সে ফেলে জমিনের সদ্য অঙ্কুরিত ধানের চারার উপর। এই থুতু যেন তার প্রতিবাদ আর মনের কথাগুলো যেন প্রতিবাদ লিপি।

এই প্রতিবাদ যেমন রফিকের বিরুদ্ধে তেমনি ক্ষুধা আর দারিদ্যের বিরুদ্ধে। যেন বা সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে, যেন সমাজের বিরুদ্ধে। তার ঘামে জবে জবে শার্টের হাতা দিয়ে মুখ মুছতে থাকা হাতের রগের রক্ত যেন টগবগ করে, বুকের রক্ত যেন ছিটকে বেড়িয়ে আসতে চায়। রক্তের এই বিদ্রোহ যেন তার অক্ষমতার বিরুদ্ধে আর আকাঙ্খা পূরণের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে।

সহসা নিজেকেই যেন সে বিদ্রুপ করে। আজ তার কি হলো? রক্তে যেন আগুন লেগে গেছে। তাকে একটা কিছু করতেই হবে। এ সমাজ কে সে দেখিয়ে দেবে- সে ফেলনা নয়। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে কঠিন প্রতিজ্ঞা।
দিন শেষ হয়। সন্ধ্যার অন্ধকার নামে চড়াচড়ে। পাখিরা নীড়ে ফিরে। মানুষজন কাজে শেষে অবসর হয়। শুয়ে বসে থেকে সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে। এক সময় মায়ের মুখোমুখি হয় শাহআলম ।

-মা। এমন কইরা গোজামিল দিয়া কদিন আর সংসার চলবো।
-কি করবি বাজান। আমাগো আর কি করনের আছে?
-পড়ার অনেক পোলা বিদেশ গিয়া সুন্দর মেলা টাকা পয়শা কামাইতাছে। আমিও বিদেশ যামু মা। যেমনেই হোক তুমি বন্দবস্ত করো।
-মাথা গরম করিস না পুত। আমাগো কি আর হেই উপায় আছে।

-তুমি বড় মামার লগে আলাপ করো। হের লগে আদম ব্যাপারী সুরুজ মিয়ার ভালা খাতির। যদি কইয়া-বইলা কম টাকায় পাঠাইতে পারে।
-আচ্ছা দেহুমনে। এহন ভাত খাইয়া ঘুমা। রাইত কম হয় নাই। সকালে আবার কামে যাইতে হইবো।

মা তার ভাইকে বলে-ছেলে বিদেশ যেতে চায়। ভাই যেন আকাশ থেকে পড়ে।
-নাজমা। পুতের লগে লগে তুইও পাগল হইছছ। বিদেশের স্বপ্ন দেহছ। এত টাকা মিলাইবি কইথাইকা ?
-ভাইজান। দরকার হয় ভিটা বন্ধক রাখুম। ধার-দেনা কইড়া পাঠুমু। সুদিন আইলে সব দেনা শোধ করমু। ভিটার বন্ধক ছুটাইয়া নিমু।

জমানো টাকা, ভিটা বন্ধক দেয়ার টাকা, মামা-খালুর থেকে ধার করা টাকা মিলিয়ে তিন লক্ষ টাকা নগদ আর দুই লক্ষ টাকা বাকি রেখে তরুন শাহআলম পাড়ি জমাড় প্রবাসে। মালয়শিয়া গিয়ে সে আস্তে আস্তে নিজের একটা ব্যবস্থা করে নেয়। মাকে টাকা পাঠাতে থাকে।
ধীওে ধীওে মানুষের দেনা পাওনা মিটাতে থাকে সখিনার মা। বাপের বাড়ি থাকে সে নাতি আর ছেলে মেয়ে নয়ে। প্রতিমাসে একবার ভিটাটা দেখে আসে। ঘরটা জীর্ন শীর্ণ হয়ে ভেঙ্গে পড়ে আছে। স্তুপ হয়ে পড়ে থাকা ঘরটা একসময় দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যায়। শুধু জেগে থাকে ভিটার মাটি।
এই ভিটায় আবার নতুন ঘর উঠবে, বিদ্যুতের বাতি জ্বলবে। সুখের দিন আসবে। মেয়েকে বিয়ে দিবে। ছেলের বউ ঘরে তুলবে। আরও কত স্বপ্ন আবর্তিত হতে থাকে।

কিন্তু নিয়তির খেলা বড় অদ্ভুত। স্বপ্নের নাগাল পাওয়া বড় কঠিন। আবার দু:স্বপ্ন হানা দেয় সখিনার মার বাস্তবাতায়।

শাহআলম টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেয়। ছেলের সাথে কোনরূপ যোগাযোগ করতে পারেনা মা। দিন যায়, মাস যায়, বছর ঘুরে কিন্তু শাহআলমের কোন খোঁজ পায় না তার মা।

নানা চিন্তায়, উৎকন্ঠায় দিন কাটে। অবশেষে একদিন জানতে পারে শাহআলম মালয়েশিয়া থেকে পাড়ি জমিয়েছে সিঙ্গাপুর। তার হাতে নেই পাসপোর্ট। সে আর কোন দিন দেশে ফিরতে পারবেনা।
খবরটা শোনার পর মাথা ঘুড়ে উঠে সখিনার মার। তবে কি ছেলেও একদিন ফিরবে লাশ হয়ে যেমন করে বহুদিন আগে লাশ হয়ে ফিরেছিল তার স্বামী। নয়তি কি তার জন্য এমনই নিঠুর আয়োজন সাজিয়ে রেখেছিল। তপ্ত অশ্রুকনা গড়িয়ে পড়ে হজ্রাবহ সখিনার মার দুচোখ থেকে।
যন্ত্রনায় শান্তনা দেয়ার মানুষ নেই। সংসারের হাল ধরার কেউ নেই। এবার কি তবে সে বানের জলের কচুরিপানার মত ভেসে যাবে ?
ছেলের পাঠানো টাকা দিয়ে নতুন শাড়ি পড়ে যে ভিটায় নতুন ঘর তুলার স্বপ্নর সুতো প্রায় গুটিয়ে আনছিল সেই নাটাই যেন হঠাৎ হাত থেকে ছিটকে পড়ে যায়। ছিড়ে যায় সুতা। পড়ে থাকে বিড়ান ভিটা।
সখিনার মা নি:স্ব হতে থাকে। নাতীকে বড় ভাইয়ের হাতে তুলে দিয়ে কবির আর শারমিনের হাত ধরে বেড়িয়ে পড়ে চেনা পথের অচেনা আলোয়।

তারপর বহু বছর পর জানা যায় শারমিন থাকে যশোরে তার স্বামী সংসার নিয়ে। কবির থাকে মাদ্রাসার এতিম খানায়। সখিনার মার কোথাও জায়গা হয় না। এত বড় পৃথিবীতে সে হারিয় যায় অগনিত মানুষের অগোচরে।

দেশে না ফিরতে পারার যন্ত্রনা, পরিবারের কাছে ফিরতে না পারার তুমুল বেদনা আর মাকে দেয়া প্রতিশ্রুতির কথা মনে হলেই শাআলমে চোখে যেন আজও ভেসে উঠে একটা নতুন লাল শাড়ি। নির্ঘুম রাতে আকাশের হাজার তারার সাথে চোখের জল যেন কথা কয়-বহুদিন আগে শীতের কুয়াশাঘন রাতে যে শাড়ি নিয়ে মা-ছেলে কথা শুরু করেছিল সেই গল্প, বাবা হারানোর গল্প, বোন হারানোর গল্প আরও অনেক গল্প। যে গল্পের সুন্দর সমাপ্তি হলনা আর কোনদিন।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Dipok Kumar Bhadra সুন্দর লিখেছেন।
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
ফয়জুল মহী অসাধারণ লেখায় মুগ্ধতা অশেষ
ধন্যবাদ জানবেন। আপনার জন্য শুভকামনা।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

একজন মা, একটা নতুন শাড়ি আর সংসারের অভাব অনটনের বাস্তব কাহিনি।

২৪ আগষ্ট - ২০২০ গল্প/কবিতা: ৯৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪