১.
বাসার অদূরে রাস্তার পাশেই বিশাল এক শিমুল গাছ। ফুল ফুটে আছে থরে-বিথরে। সকাল থেকেই বাসার বাহিরে যাওয়ার কয়েক দফা চেষ্টা করে এগারোটা বাজার পরই কেবল বের হতে পারলো মুন্না। একটু আগে টুপ করে ঝরে পড়া দুটি রক্ত লাল শিমুল ফুল হাতে নিয়ে বেশ খুশি মনে মাঠের দিকে ফিরছে কিশোর মুন্না। ফুলের ভেতর থাকা কেশর বের করে আংটার মত একটার সাথে আরেকটা ধরে দুইহাতে দুদিকে টানছে –এ খেলাটা তার বেশ পছন্দ। যে কোন একটার কেশর ছিড়ে যাবে আর অন্য পক্ষ জিতে যাবে।
মাঠে কেউ নেই। খেলার সাথি না পেয়ে বাসার দিকে ফিরে যাচ্ছে সে। ঠিক বাসায় যাবেনা বাসার আশে পাশে ঘুর ঘুর করবে যদি সঙ্গী সাথী জুটে যায় তবে খেলায় মগ্ন হবে। ঘিয়া রঙের দালানটার কাছে আসতে খপ করে তার একটা হাত টেনে ধরে তিন তলার বাহাদুর ভাই। কলেজে পড়া যুবক বাহাদুর ভাইকে তার ভালও লাগে আবার মাঝে মাঝে ভয়ও লাগে। ইতিমধ্যেই মুন্না জেনেছে যে-‘বাহাদুর কলেজে যায় ওখান থেকে মাঝে মাঝে খারাপ জায়গায় যায়’। খারাপ জায়গাটার নাম যে- পতিতালয় সেটা অবশ্য মুন্নার এখনো জানা হয়নি। বাহাদুর যতই গোপনে পাপের কাজটা করুকনা কেন, পাপ কখনো গোপন থাকেনা। কেমন করে যেন মানুষ জেনে গেছে এই পাপ কর্মটি আর বাহাদুরের খারাপ জায়গায় যাওয়া ও খারাপ কাজ করাটা দাবানলের মত মুন্নাদের কিশোর গ্রুপেও ছড়িয়ে গেছে। এটা নিয়ে কত রকম গাল গল্প যে তারা করে তার হিসেব রাখাটা বোধ হয় বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়।
বাহাদুরের সাথে চারতলার মীনা আপুর প্রেম। মীনা ও সীমা দুই বোন। দুজন যমজ হলেও অন্য যমজদের মত তাদের চেহারা হুবহু এক নয়, চেহারায় কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। মীনাকে লেখা বাহাদুরের অনেক প্রেম পত্র মুন্না পৌছে দিয়েছে গোপনে। বলা যায় তাদের দুজনের পত্র বাহকের কাজটা মুন্নাই করে। বিনিময়ে দুপক্ষই তাকে উপঢৌকন দেয়-চকলেট, বিস্কুট, কলম আরও অনেক কিছু।
বাহাদুরের এমন চরিত্রহীনতার খবর চাউর হওয়ার পর থেকেই মু্ন্না তাকে ঘৃনা করতে শুরু করে এবং এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। কিন্তু বাহাদুর বড় শেয়ানা মুন্নাকে ঠিকই বাগে পেয়ে যায়। যেমন আজও পেল। বাহাদুর মুন্নাকে হাত চেপে ধরে বাসায় তার রুমে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
কি ব্যাপার শালার পো? আজকাল তোমার আর দেখা পাওয়া যায় না ক্যান! কোনখানে টই টই কইরা বেড়াও। মীনা যে চিঠির উত্তর দিছে সেইটা আমারে না দিয়া তুমি উড়ুক্কু পাখির মত উড়তাছ, খাড়াও মজা দেখাইতাছি। কথা শেষ করে বাহাদুর মুন্নার শার্টে ও প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে তার কাঙ্খিত চিঠিটা খুঁজছে। কোথাও না পেয়ে মুন্নাকে নাজেহাল করার জন্য প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে গোপন জায়গায় চেপে ধরল।
মুন্না চিৎকার করে বলছে- ‘ছাড়েন আমারে। আমি কিন্তু জোড়ে চিল্লায়া খালাম্মারে কইয়া দিমু’। খালাম্মা বলে চিৎকার করতেই ওর মুখে হাত দিয়ে চেপে আওয়াজ বন্ধ করে দিল বাহাদুর। আজকের মধ্যেই চিঠি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে মুন্নাকে ছেড়ে দিল বেপরোয়া যুবক।
এরপর থেকে বাহাদুরের ছায়া দেখলেই মুন্নার মুখের অভিব্যক্তি বদলে যেত এবং মুখোমুখো না হওয়ার অজুহাত সৃষ্টি করতো। বাহাদুর সাইকেল নিয়ে রাস্তায় নেমেছে মুন্না তাকে দেখতে পেয়ে পাশের দোকানে কিছু কেনার অভিনয় করে সরে যায়। মুন্না ছাদে ছুটাছুটি করছে বাহাদুরের কাশ বা পায়ের আওয়াজ পেয়ে দড়িতে শুকাতে দেওয়া জামা কাপড় নিয়ে সিড়ির দিকে ছুটে গেল। বাহাদুর কলেজে যাবে আর মুন্না স্কুলে এক সাথে এক পথে যাতে যেতে না হয় তাই পাশের বাসার বন্ধুকে ডাকছে দ্রুত চলে আসতে, যতক্ষন বাহাদুর চলে না যায় ততক্ষন তার ডাকাডাকি শেষ হয়না।
২.
শীতকাল প্রায় শেষের দিকে এর মধ্যেই একদিন মুন্নার মামা সুজন বেড়াতে এসেছে। মুন্না বেজায় খুশি। মামা তাকে নিয়ে বিকালে ঘুরতে বেরোয়। এটা-সেটা কিনে দেয়। কিন্তু ক’দিন বাদেই তার সব আনন্দ উবে গেল- বাহাদুরের সাথে সেজ মামার মাখামাখি বন্ধুত্ব দেখে।
রাত-বিড়াতে দুজন বাহিরে যাচ্ছে, গল্প করছে, দূরে কোথাও ঘুড়তে যাচ্ছে অথচ মুন্নাকে একবারের জন্যও সাথে যাওয়ার কথা বলছেনা। মন খারাপের দিনগুলো যেন বেশ দীর্ঘ। পরিবারের সবাই মিলে মামার সাথে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্তে খুশির শিহরন বয়ে যায় কিশোর মুন্না ও তার বোন জেবিনের।
পারবর্তীপুর রেলষ্টেশনে পৌছে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে যখন তখনই বাহাদুর এসে হাজির। তার পিঠে ঝুলছে ব্যাগ, মুখে স্মিত হাসি। সেও যাচ্ছে মুন্নার নানির বাড়ি। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে থমথমে মেঘের মতই হল মনের অবস্থা এতক্ষণ আনন্দে ভাসতে থাকা কিশোর ছেলেটির।
রাতে যমুনা নদী ফেরিতে পেরোনের জন্য ট্রেন থেকে নামার হুড়োহুড়িতে ঘুম ভেঙেছে মুন্না ও তার বোনের। নদী পেরিয়ে ওপারে অপেক্ষারত ট্রেনের নির্ধারিত বগিতে উঠার জন্য সবার এক ধরনের অস্থির প্রতিযোগিতা দেখার মতই ব্যাপার বটে। কে কার আগে পৌছবে, বগিতে উঠে আসন গ্রহণ করবে হুইসেল বেজে উঠার আগ পর্যন্ত এবং ট্রেন চলতে শুরু করার আগ পয়ন্ত মানুষের ব্যস্ততা কমেনা।
ভোরে কমালাপুর রেল স্টেশনে সবাই ভ্রমণ ক্লান্তিতে এলিয়ে পরে। প্রাত:রাশ ও নাস্তা সেরে বাসযোগে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার ভবেরচরে নেমে বেবিট্যাস্কিতে রসুলপুর সেখান থেকে হেটে ফুলদি গ্রামে যখন পৌছে ততক্ষনে দুপুরের রোদে আর ক্ষিধায় মলিনতার ছাপ চেহারায় স্পষ্ট হয়ে উঠে।
মেহমান দেখে বাড়িতে হৈ চৈ পড়ে যায়। কেউ হাতমুখ ধোয়ার পানি এনে দেয়, কেউ সাবান-গামছা এনে দেয়। এর মধ্যেই শরবত, পিঠা চলে আসে তারপর দুপুরের খাবার খেয়ে সোজা বিছানায় শুয়ে গড়িয়ে, ঘুমিয়ে শরীরের সতেজতা ফিরে আসে। ভ্রমণের ক্লান্তি ভুলে বেড়ানোর আনন্দ যেন শীতের রাতের লেপের ওমের মত আরাম দেয় দেহ-মনে।
সেজ মামা বাহাদুরকে পুরো গ্রাম ঘুড়িয়ে দেখায় বাদ যায় ফসলের মাঠ, নদী ও বাজার। সেজ খালার সাথেও বাহাদুর ভাব জমাতে চায় চোখ এড়ায় না মুন্নার। সে গোপনে নজরদারি করে চলে বাহাদুরের উপর। প্রতি রাতিই খাবারের পর সবাই মিলে কিছুক্ষণ গল্প, গুজব করা হয়। মুন্না খেয়াল করেছে গত দুদিন ধরে এসময়টাতে সেজ খালা ও বাহাদুর বাংলা ঘরে ফিসফিসিয়ে কথা বলে।
আজ রাতে যখন সবাই গল্প, গুজব করছে তখন বাংলাঘরে কি কথা হচ্ছে দুজনের সেটা শোনার জন্য বিড়াল পায়ে পাশের রুমে ঢুকে কান পাতে মুন্না।
বাহাদুর-তুমি এখনও কাউকে ভালবাসনা এটা আমার বিশ্বাস হয়না।
সুফিয়া-সেটা আপনার ব্যাপার। কিন্তু আমি সত্য বলেছি।
বাহাদুর-তোমার মত কাউকে পেলে আমিও প্রেমে পড়ে যেতাম।
সুফিয়া-তাই নাকি? আপনার মত হ্যান্ডসাম ছেলে প্রেম করেনা এটা বিশ্বস করা আমার পক্ষে কঠিন।
বাহাদুর-মেয়েরা সহজেই মিথ্যা কথা বলে। ওদের ছলা-কলার শেষ নেই।
সুফিয়া-পুরুষেরা শুধু নারীর দেহ নিয়েই পাগল, মনটাকে খুঁজে দেখে না।
বাহাদুর-ছেলেদের শক্তি বেশি তাই শরীরের জন্য পাগল হয়।
সুফিয়া-এতই যখন শক্তি তখন একবার ..........................
কথাবর্তার এ পর্যায়ে আস্তে করে মুন্না সরে যায়। দুজন নারী-পুরুষ যে যৌনতা নিয়ে এতটা খোলামেলা আলাপ করতে পারে নিজের কানে শুনেও তা যেন ঠিক বিশ্বাস হচ্ছেনা তার। লজ্জায় লাল হয়ে গেল তার গাল আর কান। রাতে ঘুমাতে গিয়ে সে ঘুমাতে পারলোনা। বারবার তার চোখে হানা দিল- বাহাদুর ও সুফিয়া খালার ঘনিষ্ট হয়ে বসে কথোপকথনের দৃশ্যটি। তারপর ভাবনার অতলে হারিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে তা সে বলতে পারবেনা।
বাহাদুরের সাথে উত্তর পাড়ার লিজার ঘন ঘন দেখা-সাক্ষাৎ, রঙ্গ-তামাসা মনে খটকা লাগিয়ে দিল মুন্নার। ওপারার আরও কয়েকটি মেয়েও বাহাদুরের প্রতি আগ্রহী। নিছক প্রেম –ভালবাসা নাকি অন্যকিছু সেটা জানার জন্য মুন্না প্রতি রাতেই বাহাদুর যে ঘরে ঘুমায় সেখানে গোয়েন্দাগিরী চালাতে লাগলো।
জ্যোছনা রাত। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে ধরণী। বাহিরে একটু বেড়িয়ে আসার লোভ সে সামলাতে পারছেনা যদিও তার ভয় ভয় করছে। আজকে মুন্নার ঘুমানোর জায়গা হচ্ছে বাহাদুরের সাথে বাংলা ঘরে। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেছে। চুপি চুপি সে দোর খুলে সে বাহিরে এসে উঠানের একপাশে দাড়িয়ে বিমোহিত হয়ে জ্যোছনা রাত উপভোগ করছে। বইয়ে পড়েছে জ্যোছনা রাতের বর্ণনা কিন্তু বাস্তবে জ্যোছনা মানুষের মনের ভিতর এমন তীব্য হাহাকার সৃষ্টি করতে পারে সে এই প্রথম উপলব্দি করলো। গাছের ছায়া পড়ে চাঁদের রূপালী আলোয় যেন এক অপার্থিব আল্পনা আঁকা হয়েছে। গাছের গোড়ায় দাড়িয়ে নিশিলাগা মানুষের মত যে দেখে চলেছে রাতের প্রকৃতির রহস্যময়তা। হঠাৎ ঘরের দিকে নজর যেতেই দেখে কেউ একজন যেন ঘরে ঢুকে পড়েছে। মনের ভুল ভেবে সে এটাকে আর তেমন গুরুত্ব দিলনা।
৩.
চুপি চুপি বাংলা ঘরে ঢুকে ঘুমাতে যেতেই যেন বিষ্ফোরণ ঘটলো। বাহাদুর আর এক নারী শরীরের খেলায় মত্ত। নিজেদের উজাড় করে দেহ সর্বস্ব সুখে খোঁজে যখন তারা ব্যস্ত তখন অনাহুতের মত মুন্নার আগমনে ছিটকে যায় দুটো শরীর দুদিকে। ঘটনার এমন আকষ্মিকতায় মুন্না দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে নতুন ঘরের খোলা জানালা গলিয়ে ঢুকে পড়ে খাটের একপাশে কোনমতে শুয়ে পড়ে হাপাতে থাকে। খাটে কে শুয়ে আছে না আছে তা তার ভাবনায় আসেনা। ভাগ্যিস নতুন ঘরে এখনো জানালায় গ্রিল লাগানো হয়নি নয়তো এত রাতে মুন্না কোথায় যেত ? ভাল বিপদেই পড়তো সে। এই ঘটনার পরবর্তী প্রভাব কি হতে পারে সেই ভাবনায় অবশ হয়ে একসময় ঘুমিয়ে যায় মুন্না।
বাহাদুর যার সাথে রঙ্গ-লীলায় মত্ত হয়েছিল সেই নারী তড়িঘড়ি করে বিদায় নেওয়ার পর ধাতস্থ হয়ে ভাবছিল কি করে এমন দুর্ঘটনা ঘটলো। আসলে দোষ তারই। সে যথেষ্ট কতর্কতা অবলম্বন করেনি। মুন্না যখন কয়েক ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও ঘরে আসেনি তখন সে ধরে নিয়েছে মু্ন্না বড় বা নতুন ঘরেই বুঝি ঘুমেয়েছে। এখন এই পাজি পোলাটা যদি মুখ খুলে তবে তার মান সম্মান বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকবেনা। সে পরিকল্পনা করতে থাকে কি করে সকালে কেউ কিছু জানার আগেই মুন্নাকে একান্তে পাওয়া যায়।
চোখ কান খোলা রেখে সে সকালে মু্ন্নার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। তার জন্য নাস্তা দেওয়া হলে সে জানিয়ে দিল-মুন্নাকে ছাড়া নাস্তা করবেনা। তাই নাস্তা করতে হবে মুখোমুখো হলো দুজন। দুজনের মনেই চলছে টানাপোড়ন। চোখাচোখি হতেই বাহাদুর চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দিল যেন রাতের ঘটনা কাউকে না বলে।
নাস্তা পর্ব শেষ হলে জানা গেল মেঝ মামা ও ছোট মামা নৌকাযোগে ধান ভাঙ্গাতে যাবে বাজারে। বাজার বেশ দূরেই যদিও হেটে যাওয়া যায় তথাপি ধানের বস্তা নিয়ে এতদূর হাটা সম্ভব নয় আর নদী পেরুনোর ঝামেলাও আছে। তাই নৌকাতে যাতায়াতের বন্দবস্ত করা হয়েছে।
বাহাদুর ও মুন্নাও আনন্দের সাথে ধান কি ভাবে ভাঙ্গানো হয় তা দেখার জন্য সাথে যাচ্ছে। বাহাদুর মনে মনে এটাই চাচ্ছিল আজকের দিনটা যেন মুন্না তার চোখছাড়া না হয়। কারণ যে কোন সময় সে হাটে হাড়ি ভেঙ্গে দিতে পারে। রসূলপুর বাজারে পৌছে ধানের বস্তা দোকানের ভিতর রাখা হলো। অনেকেই ধান ভাঙ্গাতে এসেছে তাই সিরিয়ালও আছে। সিরিয়াল আসতে আসতে ঘন্টা খানেক সময় লাগবে। এই সুযোগে মেঝ মামা বাজারটা ঘুরিয়ে দেখালেন। মেঝ ও ছোট মামা যখন ধান ভাঙ্গাতে ব্যস্ত তখন বাহাদুর মুন্নাকে নদীর ধারে নিয়ে গেল। বাহাদুর নদীতে গোসল করবে তাই মুন্নাকেও গোসল করার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলো। নদীর মাঝামাঝি একটা খালি ট্রলার স্থির হয়ে আছে সাতরে সেখানে যাওয়ার জন্য বাহাদুর মুন্নাকে রাজি করালো। যদি মুন্না আগে পৌছতে পারে তবে তাকে পুরস্কার দিবে। মুন্না হাফ প্যান্ট ও বাহাদুর গামছা পড়ে পানিতে ঝাপিয়ে পড়ল।
দু’জন প্রায় একই সময় ট্রলারের কাছে গিয়ে পৌছলে। অনেকদিন পর সাতার কাটার ফলে দ্রুতই মুন্না ক্লান্ত হয়ে গেল সে ভিজা শরীর নিয়ে ট্রলারে উঠে পাটাতনে শুয়ে পড়ল। বাহাদুর আরও কিছুক্ষণ পানিতে সাতরিয়ে, ডুবিয়ে ট্রলারে উঠল। মুন্না চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। মৃদু বাতাস তার ক্লান্তি দূর করে চোখে ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে এলো। বাহাদুর আস্তে আস্তে লুভী বিড়ালের মত এড়িয়ে এল শিকারের কাছে। চারপাশের দিকে একবার চোখ বুলিয়েই ঝাপিয়ে পড়ল মুন্নার উপর।
চোখ খুলে মুন্না বুঝতে পারলো এভাবে শুয়ে থাকাটাই তার ভুল হয়েছে। শিকারীর প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝতে না পারায় কি করে এই বিপদ থেকে মুক্ত হবে ব্রেন সেটা ঠিক করতে পারছেনা। শরীর না মৃত্যু? নাকি দুটোই চায় বাহাদুর, ধস্তাধস্তির মধ্যে সেটা বুঝতে পারছেনা মুন্না। বলবান যুবকের সাথে শক্তিতে কিছুতেই সে পেরে উঠছেনা। যতই সময় যাচ্ছে তার শক্তি ও চিন্তাশক্তি যেন রহিত হয়ে আসছে। মুন্না প্রাণপনে একটু পিছনের দিকে যেতে চাচ্ছে। আরেকটু পিছনের দিকে যেতে পারলেই সে হয়তো এ যাত্রায় বেঁচে যাবে।
গলা চেপে ধরলেও মুন্নার ডান হাতটা খোলা আছে । হাতরাতে হাতরাতে অবশেষে ট্রলার ষ্ট্রার্ট দেওয়ার যন্ত্রটা সে পেয়ে গেল। দেরি না করে ওটা বাহাদুরের কপাল ও মাথা বরাবর চালিয়ে দিল। মূহুতেই থেমে গেল বাহাদুর আর অন্ধকার হয়ে এলো তার চারপাশ। জ্ঞান হারিয়ে ধপাস করে একপাশে পরে যেতেই মুন্না পরিমরি করে জলে ঝাপ দিল।
৪.
অনেকক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরলো বাহাদুরের। সেদিন বাড়ি ফিরে বিকেলেই বাহাদুর বিদায় নিয়ে উত্তর বঙ্গের পথ ধরলো। মুন্না অবশ্য অনেক দেরি করে বাড়ি ফিরেছে। তাকে অবশ্য জেড়ার মুখে পড়তে হয়েছে-সে কোথায় ছিল ? একা একা কোথায় ছিল ? নানি অবশ্য এগিয়ে আসায় আর তেমন ঝামেলা হয়নি। নানি বলেছে- আহা! বেচারি হয়তো ঘুরতে ঘুরতে দূরে কোথাও চলে গিয়েছে, সারাদিনের না খাওয়া আমার নাতীটা না শাষালেই কি নয়। দ্রুতই খাবার খাওয়ার জন্য তাকে নানির পিছে পিছে যেতে হলো।
মুন্না অবশ্য কাউকে কিছু বলেনি- না সেই কাল রাতের ঘনটা না মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসার ঘটনা। আর বলেই বা লাভ কি তার কথা কেউ বিশ্বাস করবেনা কারণ বাহাদুরের মুখের উপর যে মুখোশ পড়ে আছে তা মুন্না ছাড়া কেউ জানেনা।
বাড়ির সবাই একটু অবাক হলো হঠাৎ বাহাদুরের চলে যাওয়া নিয়ে কিন্তু এ নিয়ে আর কেউ কথা বাড়ালোনা। হয়তো বাহাদুরের জরুরী কাজ থাকতে পারে তাই সে চলে যাচ্ছে। বেড়ানোর আনন্দ ছাপিয়ে একটা ভয় সবসময় যেন মুন্নার বুকের গুহায় থাবা উচিয়ে বসে থাকে। তার সব রাগ গিয়ে পড়ল মেঝ মামার উপর । তিনিই তো বাহাদুরকে সাথে করে নিয়ে এসেছেন। তা না হলেতো বাহাদুরের এখানে আসার কোন প্রশ্নই উঠতো না।
মীনার সাথে বাহাদুরের প্রেম গভীর হতে পারেনি। বাহাদুরের নষ্টামী মীনার কানেও গিয়েছে আর মীনার বাবারও তা অজানা নয়। তাই মীনার বাবা তার মেয়েকে সাবধান করে দিয়ে বলেছে- এরকম নষ্ট ছেলের সাথে যদি তুমি যোগাযোগ রাখ বা কোন সম্পর্ক রাখ তবে তোমার প্রতি কঠোর হতে আমার কষ্ট হবে না। এর কিছুদিন পরই বাহাদুরের বাবার বদলীর সুবাদে তারা অন্যত্র চলে গেলে মুন্নার বুকের ভিতর থেকে যেন এক কালো পাথর সরে গেলো। বাহাদুরেরা চলে যাওয়ার পর মীনাও স্বাভাবিকভাবেই মেনে নেয় সবকিছু আর এভাবেই সম্পর্কের ইতি ঘটে।
পাঁচ বছর পরের ঘটনা। মুন্না এখন কলেজে পড়ে। দাউদকান্দির একটি নামকরা কলেজে সে পড়ে। থাকে হোস্টেলে। হোস্টেলে প্রতিদিন দু’টি পত্রিকা রাখা হয়। একটি প্রথম আলো অন্যটি যুগান্তর। সকালে পত্রিকা পড়তে ছেলেদের ভীর লেগে যায়। অনেকে তাই পত্রিকা এক নজর দেখে চলে যায়। দিনগুলো মুন্নার ভালই কাটছে। একদিন বন্দের দিন পত্রিকা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করেছে। আজ ভীর কম। ছেলেরা অনেকেই বাড়ি চলে গেছে বা আত্মীয় স্বজনের বাসায় গিয়েছে বেড়াতে। পত্রিকা পড়তে পড়তে ভিতরের পাতায় একটা খবরে তার চোখ আটকে গেল। বাগেরহাটে এক বখাটে তার বন্ধু-বান্ধবকে নিয়ে রাতের আধারে এক তরুনীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষন করেছে। ধর্ষনের ঘটনা হর হামেশাই পত্রিকায় আসে। কিন্তু আজ পত্রিকায় যে ধর্ষকের নামে প্রতিবেদন এসেছে সে আর কেউ নয় সে যে বাহাদুর।
মহূর্তেই মনে পড়ে গেল সেই কাল রাতের ঘটনা। আবারও বাহাদুরের প্রতি তীব্র ঘৃনায় আর বিতৃষ্ণায় ভরে গেল মন।
মুন্না ডায়রীতে তারিখটা লিখে রাখলো তারিখটা। অনেক ইচ্ছে ছিল মা আর খালাকে জানাবে বাহাদুরের এহেন কীর্র্তি কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেন যেন বলতে পারেনি। বাহাদুরের নামটা উচ্চারিত হলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে সেই জোছনা রাত। যে রাতটা আস্তে আস্তে রূপান্তরিত হয় কালো রাতে।
চিরতরে ভুলতে গিয়েও বারবার ফিরে আসে সেদিনের সেই রাত। জীবন বুঝি এমনই না চাইলেও স্বাক্ষী হতে হয় অনেক ঘটনার।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী
অনবদ্য লিখনী, সাবলীল ভাবে সাজানো লেখাটি ।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
একজন নষ্ট যুবক কি করে একজন কিশোরের জীবনে বিপর্যয় নিয়ে আসে তাই বলা হয়েছে গল্পে।
২৪ আগষ্ট - ২০২০
গল্প/কবিতা:
৯৬ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।