হেমন্তের এক সোনালী সন্ধ্যায় পারুল যখন নতুন বউ হয়ে পরের বাড়ি গেল। তখন তার মা তাকে পই পই করে বুঝিয়ে দিয়েছে সাত চরেও রা করবি না। তুই রা করতে গেলেই সবাই বুঝে যাবে-‘তুই কতটা ঝগরী মেয়ে’। এমনিতেই গ্রামে পারুলের নামে বদনাম আছে-তের ঝগরী বলে। এখন বিয়ের পর যদি শ্বশুড়বাড়িতে লোকজন এই ঝগড়াটে স্বভাবের জন্য গাল মন্দ করে বা অশান্তি করে তবে তারা আর মুখ দেখাতে পারবেনা, সেই ভয় থেকেই পারুর বাপ-মা মেয়েকে এমন মগজ ধোলাই দিলেন।
কথায় আছে না ঢেকী স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। পারুলের দশা হয়েছে সেরকম যতই মগজ ধোলাই দেওয়া হোক তাতে কাজ হবেনা, ঝগড়া যে ওর রক্তে মিশে গেছে। বিয়ের পর প্রথম দিকে খুব কম কথা বলতো পারুল তার শ্বশুরালয়ে। সবাই খুশী নতুন বই এর কথা-বার্তা, কাজ-কর্মে। একদিন পাশের বাড়ির এক মহিলার সাথে পারুলের শ্বাশুড়ীর ঝগড়া বেধে যায়। তার শ্বাশুরী কিছুতেই সেই মহিলার সাথে পেরে উঠছিলনা দেখে পারুলের মুখ দিয়ে গালির ফুলকী বেড়িয়ে আসছিল। পারু তৎক্ষনাত গোসলখানায় গিয়ে মাথায় পানি ঢেকে নিজের মাথা ঠান্ডা করে ঠায় দাড়িয়ে রইল। অনেকক্ষন পরে যখন সে সতেজ ও ঠান্ডা একটা ভাব নিয়ে বেরিয়ে আসল ততক্ষণে ঝগড়া মাটি মাটি হয়ে গেছে।
রাতে খাবার পরিবেশনের সময় পারুলের শ্বাশুড়ী বলল-‘জান বউ, ওই মেয়েলোকটি অনেক বদ। তার সাথে ভাল ব্যবহারে কাজ হয় না। দু’কথা শুনাতে গেলে উল্টো নুন, মরিচ দিয়ে ডলা দেয় আমাদেরই’।
পারুল বলল-‘মা-আপনি আর ওনার সাথে কথা বলতে যাবেন না। এড়িয়ে চলবেন ওই মহিলাকে’। আর মনে মনে বলল-আর ক’টা দিন যাক, কিছুটা পুরান হই এর পর বুঝাবো কে কাকে নুন-মরিচ দেয়।
নাগো বউ যতই এড়াই ততই যেন বেড়ায়ে ধরে। জবাব না দিয়াও পারিনা। কবে যে এই অশান্তি শেষ হবে, আর পারিনা। মন মেজাজ ভাল না। খেতে ইচ্ছে করছেনা। তোমরা খেয়ে নাও বলে-উঠে যাচ্ছিলেন মনোয়ারা বেগম। তখনই পারু বলল-‘মা আপনার জন্য মাছের ভর্তা করেছি, ক’টা ভাত খেয়ে যান’।
মনোয়ারা বেগম খুশী হলেন বউ এর কথা শুনে । মাছের ভর্তা তার অনেক পছন্দের একটি খাবার। শুধু ভর্তা দিয়েই ভাত খেয়ে রুমে চলে গেলন। মাছ, ডাল, শুটকি ছুয়েও দেখলেন না। পারুল সকলের খাওয়া হয়ে গেলে রুমে গিয়ে স্বামীর সাথে আজকের ঘটে যাওয়া ঝগড়ার যে বর্ণনা দিল তা শুনে পারুলের স্বামী হাবিব অবাক হয়ে গেল।
হাবিব বলল- ‘তুমি কি দাড়িয়ে থেকে সব দেখেছ আর মুখস্ত করেছ’ ? পারুল বলল- ‘মুখস্ত করতে হবে কেন, মেয়ে মানুষের মনে এমনেই ঝগড়া-ঝাগড়ির কথা মনে থাকে। তুমি আবার আমাকে ঝগড়াটে ভেব না’।
না তা ভাবতে যাব কেন, তুমি হচ্ছ লক্ষী একটা মেয়ে এই বলে হাবিব যেই না পারুল কে ছুঁতে গেল এমনি সে চট করে সরে গেল। রুমের দড়জা বন্ধ করে বলল-‘তোমার কি চোখ নাই, খোলা দরজা দেইখাও কেমনে আমারে ধরতে আইছ! কেউ দেখলে কি বলবো।
হাবিব- কে কি বলবে ?
পারু-বলবো বউয়ের লাজ-লজ্জা নাই। দোষ না করেও দোষী হয়ে যাব সকলের চোখে। পুরুষ মানুষেরে কেউ দোষ দেয়। সব দোষ মাইয়া মানুষের।
হাবিব-কেন দোষ দেবে ?
পারু- ইস্ কচি খোকা। কিচ্ছু বোঝেনা।
পারু কথা বলার ফাঁকে হঠাৎ ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিল তার স্বামীকে। তারপর হাবিবের পাশে বশে তার ছোট বেলার একটা ঘটনা বলতে শুরু করলো। হাবিব এসব বেশ উপভোগ করে। মনে করে পারুর কাছ থেকে কিশোরীর চপলতা এখনো মিলিয়ে যায়নি।
পারু- শোন । এদিকে দেখ। জানালায় কি দেখ ? ঐখানে কোন ফুলপরী নেই যে ওদিকে চেয়ে থাকতে হবে। না কি আমারে দেখতে ভাল লাগেনা।
একটু কেশে নিয়ে গলা পরিষ্কার করে পারু বলতে শুরু করে- আমি তখন ফাইভে পড়ি। গ্রামের ছেলে মেয়েরা কারণে অকারণে আমার সাথে ঝগড়া লাগে। একদিন স্কুল থেকে ফিরার পথে তাসলিমা বলল-‘পারু, তোর লজ্জা নাই। তুই আজও পড়া শিখে আসিসনি। তোর জন্য ক্লাসে হাসাহাসি হয়, মুখ দেখাতে পারিনা’। তাসলিমার কাথা শুনে আমি রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বললাম-‘দেখি তোর মুখটা দেখি, বলেই ঠাস ঠাস করে দুটো চড় মেরে দিলাম’। আর বললাম-যা এবার তোর এই মুখটা সবাইকে দেখা।
তাসলিমা চড় খেয়ে হতভম্ব হয়ে গেল। তারপর নিজেকে সামলিয়ে আমার দিকে তেড়ে এলো। আমি এমনি বাঘিনীর মত ওর উপর ঝাপিয়ে পড়লাম। ওর চুলের গোছা ধরে মাটিতে ফেলে দিলাম। শুরু হলো দু’জনের মধ্যে তুমুল ধস্তাধস্তি। এমন সময় পাশের বাড়ির বড় আপু এদিক দিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছিলেন। আমাদের এ অবস্থা দেখে টেনে তুলে মাঝ খানে দাড়িয়ে বললেন-‘এই তোরা কি লজ্জার মাথা খেয়েছিস। এই রাস্তার উপর মেয়ে মানুষ এমন করে ঝগড়া করে, মারামারি করে। যা শিগগির বাড়ি যা নয়তো তোদের বাবার কাছে নালিশ দেব’। আপুর কথায় আমরা একে অন্যকে চোখে রাঙিয়ে অদৃশ্য ভাষায় হুমকি দিয়ে চলে যাই।
ঘটানার বর্ণনা দিয়ে পারু হেসে বলল-‘আমি আসলে ঝগড়া লাগলে কাউকে ছাড় দেই না’।
হাবিব বলল-বাহ! চমৎকার। তুমিতো দেখি ঝগড়ার প্রতিযোগীতায় মেডেল পাবে। তা আমার সাথে কবে হচ্ছে তোমার ঝগড়া! পারু লজ্জা পেয়ে বলল-যা! স্বামীর সাথে ঝগড়া করতে নেই।
হাবিব আর পারু শুয়ে পড়েছে লাইট নিভিয়ে। হাবিব পারুর হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলতে লাগলো-‘তুমি যে একটা ঝগড়ী মেয়ে সেটা বিয়ে ঠিক হওয়ার আগেই জানতে পেরেছি। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর তোমাদের গ্রাম থেকে আমাদের এই পৌড়সভার বাড়িতে দুইজন লোক এসেছিল। তারা ইনিয়ে বিনিয়ে বলেছে তুমি নাকি গ্রামের সেরা ঝগড়ী। আমরা যদি ভাল চাই তাহলে যেন এই বিয়ে না করি। ওদেরকে নাস্তা পানি দিয়ে আপ্যায়ন করে বিদায় দিয়েছিলাম এবং আমরা আমাদের সিদ্ধান্তে অনড় ছিলাম’।
কথা শুনে পারু ফোসতে লাগলো। সেই অজানা লোক দুটোকে অভিশাপ দিতে দিতে কখন ঘুমিয়ে গেল সে আর তা বলতে পারবেনা। এমন খোশ গল্প, খুনশুটি, মান-অভিমান নিয়ে দিন কেটে যেতে লাগলো।
বিয়ের পর বেশ ক’বার পারু ওদের বাড়ি গিয়েছে। গ্রামের সবাই ওকে দেখে ধরে নিয়েছে পারুর পরিবর্তন হয়েছে। মা-বাবাও খুশী । এখন পর্যন্ত কোন অভিযোগ আসেনি। মেয়ে তাদের সুন্দর করে স্বামী সংসার সামলাচ্ছে।
সেদিন বিকালে পারু আর তার শ্বাশুড়ি বাগানে ফুল গাছে পানি দিচ্ছে। হাবিব অফিস থেকে তখনও ফিরেনি। পাশের বাসার সেই মহিলা কিছু একটা খেয়ে উচ্ছিষ্ট বাগানে ফেলে দিল। শ্বাশুড়ি না দেখলেও পারু দেখল এবং সাথে সাথে বলে উঠল-‘আন্টি আপনে এখানে কেন ময়লা ফেললেন ? আপনার বাড়িতে কি ডাষ্টবিন নেই’। পারুর কথা শেষ হতেই শ্বাশুড়ি দেখেন তাদের বাগানে কি সব পরে আছে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে ? তিনি পাশের বাসার দোতালায় তাকিয়ে দেখলেন সেই মহিলা বাড়ান্দায় দাড়িয়ে কোমড়ে শাড়ি পেছিয়ে ঝগড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আলো নবাবজাদী, তোগো বাগানটাইতো ডাস্টবিন। বউ, শ্বাশুড়ী একজোট হয়ে আইছে আমার লগে কাইজ্জা করতে। বৃদ্ধা আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন-আমি তোগো ডরাইলো।
শ্বাশুড়ির নীরবতা দেখে পারু বলল- ‘এমন বুড়ি ইন্দরতো আর দেখি নাই, আজাইরা থাইকা গোলার ধান খাইয়া গা করে লছ্ লছ’্। শ্বাশুড়ি পারুকে থামতে বলছে না দেেখ আরও দ্বিগুন উৎসাহে কদর্য ভাষায় গালি দিতে লাগলো।
পারুর এমন নতুন ধারার কথা ও গালাগাল শুনে শ্বাশুড়ি চমকে উঠলেন, চমকে গেলেন পাশের বাড়ির সেই মহিলাও। এদিকে পারু শাসিয়ে যাচ্ছে-‘তোর মোডা শইল, হোডা হউক। আরেক দিন যদি দেখি বাগানে ময়লা ফালাইছছ, তাইলে চুল ধইড়া টাইনা আইনা সব ময়লা সাফ করামু। আমারে চিনে না।আঙ্গুল দেখাইয়া কব্জা গিলার দিন শেষ’।
সেই মহিলাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শ্বাশুড়িকে নিয়ে পারু হন হন করে বাসায় ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। বেশ কিছু দিন দুই বাসার সদস্যদের আর ঝগড়া হয়নি।
এখন ঝগড়া হলেই পারুলের শ্বাশুড়ী পারুকেই ময়দানে নামিয়ে দেয়। আর পারুও তার-‘তের ঝগড়ী’ নামের প্রতি সুবিচার করে ঝগড়ায় জয়ী হয়ে ফিরে আসে। এমন করতে করতে পারুর মুখ গেছে আলগা হয়ে। এখন সে তার শ্বাশুড়িকেও ছোট খাটো বিষয় নিয়ে এটা সেটা বলে। ইদানিং হাবিবকেও ছাড়েনা। এই নিয়ে বেশ মনোমালিন্য গেছে স্বামী-স্ত্রীতে। কিন্তু কিছুতেই পারুর মুখ বন্ধ হয়নি।
অবস্থা এমন দাড়িয়েছে পারুই যেন শ্বশুড়ি আর তার শ্বাশুড়ি যেন বউ। সে এখন সুযোগ খুঁজে শ্বশুড়ির দোষ ধরতে তৎপর। একরাতে খাবারের অপচয় নিয়ে কথা উঠতেই পারু তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। শ্বশুড়ির সাথে তর্ক যুদ্ধে লিপ্ত হলো। আমি যা করি সেটাই তো আপনার পছন্দ না-আমি ভাল করলেও দোষ, খারাপ করলেও দোষ এরকম নানা কথা বলে চলেছে পারু। শ্বশুড়ি পারুর সাথে তর্কে না পেরে রণে ভঙ্গ দিয়ে বললেন- ‘আমারই ভুল হয়েছে এমন তের ঝগড়ী বউ ঘরে তুলে’। পারু বলল-‘উচিৎ কথা কইলেই জাত যায়। উচিৎ কথার ভাত নাই’। এর পর থেকে বেশ ক’দিন বউ- শ্বশুড়ির কথা বলা বন্ধ।
হাবিব মা ও বউ কারো কাছেই ভাল থাকতে পারছেনা। মা বলে-বউ এর কথা মত চলে। আর বউ বলে-মার কথা শোনে, মার মত মতো চলে। পরিবারের রোজ রোজ এমন অশান্তি দেখে হাবিবও ভেবে পায়না সে কেমন করে এমন তের ঝগড়ী বউ এর স্বামী হলো। অথচ কত স্বপ্ন ছিল বিয়ে নিয়ে, বৌ নিয়ে। সেসব স্বপ্ন মরিচীকা হয়ে তাকে যেন উপহাস করছে।
এমনি করেই দিন যায়, মাস আসে, বছর ঘুরে সবই পরিবর্তন হয় কিন্তু পারুর যেন কোন পরিবর্তন নেই। কত স্বপ্ন ছিল বৌ নিয়ে, বিয়ে নিয়ে। কিন্তু হাবিবের সেই স্বপ্ন যেন ধীরে ধীরে শূণ্যতায় মোরানো কুয়াশার চাঁদরে ঢেকে গেছে।
২৪ আগষ্ট - ২০২০
গল্প/কবিতা:
৯৮ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪