হলদে পরী

বৃষ্টি ও বিরহ (আগষ্ট ২০২১)

Badruzzaman Khukon
  • 0
  • ৭৪
এক।

কিছুদিন পর আমার বিয়ে। এটা আমার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না। এই অবিশ্বাসের বেশ কিছু কারন আছে। সবাই বলে বিয়ের আগে থেকে সবার মন প্রফুল্ল থাকে। আর এই সময় সব কিছুতেই ভাগ্য খুলে যায়। আমার ক্ষেত্রে হয়েছে একটু ব্যাতিক্রম। বিয়ের কথা সব পাকাপাকি হবার পর থেকে রাতের বেলা ঘুম কম হচ্ছে। এমন নয় মেয়ে পছন্দ হয়নি। ইরা, মানে যার সাথে বিয়ে হবার কথা সে অসম্ভব সুন্দরী একটি মেয়ে। প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ার মত। তবে আমি প্রেমে পড়িনি। সত্যি বলতে কি খুব চেষ্টা করেও পারিনি। উল্টো ইনসোমনিয়া রোগীর সব লক্ষন দেখা দিয়েছে। আর গত কয়েকদিন ধরে আরো একটা সমস্যা দেখা যাচ্ছে। তাহল হঠাৎ করে দরকারি জিনিস ভুলে যাওয়া। যেমন গতকাল ঘড়িতে এলারম দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। আর আজ সকাল বেলা ইউনিভার্সিটিতে আসার সময় তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে মোবাইল ফেলে এসেছি বাসায়। শুধু তাইনা। সকালের রেশ বিকেল পযন্ত বয়ে এসেছে। বিকেল বেলায় ইউনিভার্সিটি ল্যাব থেকে বের হবার পর অল্পের জন্য বাস হারিয়েছি। এজন্যই সবাই বলে ভোরের সূর্য দেখেই বলে দেয়া যায় দিন কেমন যাবে। পরবর্তী বাসের জন্য অপেক্ষায় না থেকে হেঁটেই জনজু রেলস্টেশনে্র দিকে রওনা দিলাম। অনেকদিন পর হাঁটতে ভালই লাগছে। মনে হচ্ছে এত বছরের পরিচিত জনজু শহরকে নতুন করে দেখছি। এটি দক্ষিণ কোরিয়ার অন্যতম প্রাচীন শহর হলেও সবকিছুই খুব ঘোচানো। রাস্তার দুপাশে সারিসারি জিঙ্গো ট্রির হলুদ হয়ে যাওয়া পাতা দেখে মনে হচ্ছে প্রতিটি গাছে হলদে আগুন লেগেছে। চারপাশে ভাল করে তাকালেই বুঝা যায়, এখন সেপ্টেম্বর মাস। শরৎ শুরু হয়েছে। এসময় সব গাছের পাতা হলুদ আর ম্যাপল পাতা রক্তিম হয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে দেখছি চারদিকের এই হলদে পরীর রুপ। রাস্তা ছাড়িয়ে শহরের যতদূরে চোখ যায় চারপাশে বিশাল সব পাহাড়। দেখতে দেখতেই চলে আসলাম রেলষ্টেশনে। খুব একটা সময় লাগেনি। সর্বোচ্চ পনের থেকে বিশ মিনিট হবে। স্টেশনে আসার পর বুঝলাম ভিড় কি জিনিস। কোন লম্বা ছুটির দিন ছাড়া সচরাচর এরকম ভিড় হয়না। ট্রেনের টিকেট কাটার পর আন্ডারগ্রাউন্ড হয়ে যখন প্লাটফর্মের দিকে যাব, এমন সময় পিছন থেকে পরিচিত কন্ঠের ডাক। অনেকটা কলকাতার বাঙ্গালী বন্ধু অনিলের মত। পিছনে তাকিয়ে দেখলাম হ্যাঁ অনিলই। তবে ওর অধীর আগ্রহ ভাব দেখে বুঝতে পারলাম সম্ভবত এই ট্রেনটাও মিস হতে চলেছে। ওর একটা বিশাল গুণ আছে। এটা ভাল না খারাপ তা বলতে পারছিনা। ওর সময় জ্ঞান খুব কম। যতবার ও কোন জুরুরি কথা বলতে এসেছে তা কোনদিন ঘন্টাখানেকের আগে শেষ হয়নি। ভীষণ মিশুক আর আড্ডাবাজ ছেলে। তবে সবকিছুই খুব আগ্রহ সহকারে করে।
আমাকে দেখেই অধীরভাবে হাত দিয়ে ইশারায় থামতে বলল।
তারপর খুব আগ্রহ করে তার একটা জরুরি কথা বলতে এল। যেন এটা আমাকে বলতে না পারলে সমস্যাটা কোন ভাবেই সমাধান হবেনা। ওর এই আগ্রহটাকে আমি কোন সময় অগ্রাহ্য করতে পারিনা। জগতে একদল কিছু মানুষ আছে যারা সামান্য পাওয়াতেই খুব তুষ্ট থাকে, অনিল হল ওই বিরলতর শ্রেণির একজন।
- রাফি তোমাকে খুব করে খুজেছি। চল কোন ক্যাফেতে গিয়ে বসি। হাপাতে হাপাতে অনিল বলল।
স্টেশন থেকে বের হয়ে এসে অল্প দূরের পিজ্জা স্কুলে বসলাম। মন ভাল অথবা খারাপ এর কোন একটা হলেই এই পিজ্জা স্কুল নামের দোকানটিতে টু মারা রীতিমত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অনিলকে নিয়েও অনেকবার এসেছি এখানে। নিচুক একটু আড্ডাবাজী করে সময় কাটানোর আশায়। কিন্তু আজকে অনিলকে মনে হচ্ছে কোন কিছু নিয়ে সে বেশ উদ্বিগ্ন। সাধারনত ওর বেশিরভাগ সমস্যাই থাকে তার মেয়ে বন্ধু সংক্লান্ত। তবে এই প্রথম মনে হচ্ছে আসলেই কোন সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কথা বলতে চায়। ব্যাপারটা কিছুটা হালকা করার জন্য মুচকি হেসে জিজ্ঞাস করলাম,
- আবার কি হল, তোমার শ্রীলংকান বান্ধবীকে অন্যকারো হাত থেকে উদ্ধার করতে হবে?
অনিল এবার কিছুটা আশাহত হল, সম্ভবত আমি তার কথার গুরুত্বটা বুঝতে পারিনি। সে আমার কথাটাকে পাত্তা না দিয়েই আবার বলল,
- তোমার ল্যাবমেট মেয়েটার কথা মনে আছে, যে সুন্দর করে কিছু বাংলা বলত।
আমি বুঝতে পেরেও না বুঝার ভান করে বললাম,
-কে বলত? ঠিক মনে পড়ছে না।
অনিল আমার কথা শোনে একটু অবিশ্বাসের চোখে তাকাল।
-ওই যে মেয়েটা, তোমার হলদে পরী। একবার আমাদের পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে হলুদ শাড়ি পড়ে এসেছিল! পরীর মত সুন্দর লাগছিল সেদিন ওকে। তাই আমরা সবাই ওর নাম দিয়েছিলাম হলদে পরী!
-কে, লরিয়ান! অবাক হয়ে আমি জিজ্ঞাস করলাম।
- হা, ও থ্যাংকস গিভিং ডে’র ছুটিতে দেশে এসেছিল। তোমাকে না পেয়ে আমার ডিপার্টমেন্টে এসেছিল।
আমার সারা শরীর বেয়ে ঘাম ছুটে এক মুহূর্তের জন্য সময় থেমে গেল। আমি অনেকদিন ইকসান-জনজুর বাইরে যাইনা। কিন্তূ এবার থ্যাংকস গিভিং ডে’র ছুটির সাথে সাপ্তাহিক শনি, রবিবার হওয়াতে সিউলে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে সবাই মিলে জেজু আইল্যান্ড। তুমুল হইহুল্লোড় করে একটা সপ্তাহ কাটিয়ে জনজু তে যখন ফিরলাম, তখন কাজের চাপে অন্যকোথাও তাকানোর সময় ছিলনা।
-ও এসেছিল?
- হ্যাঁ, সে তোমার জন্য একটা প্যাকিং করা গিফট রেখে গিয়েছে। এই বলে ব্যাগ থেকে একটা গোলাপি কালার এর ছোট প্যাকেট হাতে দিল।
ধন্যবাদ দিয়ে প্যাকেটটি হাতে নিয়ে বুঝতে পারলাম ইতিমধ্য খোলা হয়েছে এটা। আমি কিছু বলার আগেই অনিল আবার বলল,
-তোমাকে অনেকবার ফোনে না পেয়ে আমি নিজেই খুলে দেখেছি কোন জরুরী কিছু আছে কিনা।
ওর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ওর কাঁধে অল্প চাপড় দিয়ে আড়ষ্ট ভাবে বললাম,
-‘নো প্রব্লেম। আসলে আজকে সকালে ভুল করে মোবাইল বাসায় রেখে চলে এসেছি।‘
আমার কথা কে তেমন একটা পাত্তা দিল বলে মনে হলনা। খুব মমতা নিয়ে শান্তনার সাথে অনিল আবার বলল,
- ‘জানোই তো, আমরা বাঙালি কমিউনিটির সবাই তোমার আর লরিয়ানের রিলেশনটা নিয়ে খুব আশাবাদী ছিলাম।‘
-‘ও আচ্ছা।‘ আমার এই দুটো শব্দের চেয়ে বেশি কিছুর বলার শক্তি ছিলনা। আমার জবাবে অনিলের তেমন কোন ভাবান্তর হয়নি।
-‘তুমি একটু বসো, আমি দশ মিনিটের ভিতর আসছি।‘
এই বলে বের হয়ে গেল। ও বের হয়ে যাবার পর লরিয়ানের দেয়া প্যাকেটি খুললাম। একটি চিরকুট। তাতে সুন্দর গোটা গোটা অক্ষরে লিখা,
‘সকাল এগারটায় সিউল টাওয়ারের সামনে অপেক্ষায় থাকব’
তারমানে লিখা সময় অনুসারে দিনটি আগামীকাল।
অনেকদিন পর ওর কথা ভেবে সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কতদিন পর আবার সে এসেছে! প্রায় পাঁচ বছর!
আমি যখন লাইফ সায়েন্স ডিপার্টমেন্টে পোস্ট গ্রাজুয়েশনে প্রফেসর কিম এর ল্যাবরেটরিতে আসি তখন লরিয়ান আসে একই সেমিস্টার এ। যদিও ওর ইচ্ছে ছিল এমএস শেষ করে ইউএসএ গিয়ে পিএচডি করার। কিন্তু আমার আগ্রহেই মাস্টার্স শেষ করে পিএইচডি শুরু করে আমার সাথেই। ততদিনে আমাদের পরিচয়টা সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল অনেকদুর। আমার প্রথম প্রেম, প্রথম পাহাড়ে ট্রেকিং, প্রথম তুষারপাত দেখা। আমার এরকম আরো অনেক কিছুই ছিল প্রথম ওর সাথে। আমার এখনো মনে পড়ে সেইদিন গুলোর কথা। একটা লম্বা ছুটি পেলেই ছুটে যেতাম পাহাড়ে থেকে পাহাড়ে। রক ট্রেকিং খুব প্রিয় ছিল ওর।
একবার সেমিস্টার শেষে চার সপ্তাহের ছুটিতে বাংলাদেশে এসেছিলাম। এই কয়দিন ওর সাথে কোন রকম যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়নি। ফিরতি বেলায় ঢাকায় এয়ারপোর্টে ওকে মেসেজ পাঠালাম। কিন্তু কোন জবাব পাইনি। এমনকি কোরিয়াতে আসার সাথে সাথেই ওকে ফোনে চেষ্টা করলাম। কিন্তু ফোন বন্ধ। একটা অজানা আতঙ্কে আসার পর পরদিন ল্যাবে এসে যখন ইমেইল চেক করলাম। তখন মাথা খারাপ হবার মত অবস্থা। আমি দেশে যাবার পর একটি ইমেইল পাঠিয়েছিল। একটিতে লিখা ছিল সে ফেব্রুয়ারির দশ তারিখে ইউএসএ চলে যাচ্ছে। এই স্প্রিং সেমিস্টার থেকে ইয়েল ইউনিভারসিতে পিএচডি শুরু করবে। ক্যালেন্ডারের পাতায় চোখ বুলিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম আমি কোরিয়াতে ফেরার আরো এক সপ্তাহ আগেই সে চলে গিয়েছে। কিন্তু একটা হিসাব কোন ভাবেই মেলাতে পারলাম না। ও চলে যাবার আগে একবারের জন্যও আমাকে বুঝতে দেয়নি! একটা তীব্র অভিমানে সেদিন ওর কোন ইমেইলের জবাব দিতে পারিনি। অনেকদিন পর অবশ্য আমি শুভকামনা জানিয়ে একটা ইমেইল পাঠিয়েছিলাম। আর ছোট্ট করে জানতে চেয়েছিলাম, কিভাবে এরকম একটা সিদ্ধান্ত একা একাই নিতে পেরেছিল। সেদিনের পর থেকে আজ পযন্ত কোন ফিরতি জবাব আসেনি। এইতো শেষ।
এতগুলো বছর পর লরিয়ান আবার এসেছে ছোট একটা চিরকুট নিয়ে!
আমার বেশিক্ষন একা একা চিন্তা করতে হলনা। দুই মগ কফি হাতে নিয়ে অনিল আবার হাজির। একটা মগ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল-
-কাল তাহলে সিউল যাচ্ছ?
-এখনো ঠিক বুঝতে পারছিনা।
আমি জবাব দিলাম। যা ওকে এক মুহূর্ত ওকে বাকরোদ্ধ করে দিল। ও কোন ভাবেই বিশ্বাস করতে পারছে না।
-হে ম্যান, স্টিল আর ইউ থিঙ্কিং? প্লিজ টেক এ কংক্রিট ডিশিসন। দিস ইজ ইউর লাস্ট চান্স।
অনিল যখন সিরিয়াস মুডে থাকে তখন ও বাংলা ভুলে যায়। আমি হ্যা বা না কিছুই বললাম না। আমার বরং কফির মগটা হাতে নিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগছে। চোখের সামনের বিশাল জিঙ্গো ট্রি থেকে হলুদ পাতা ঝরে পড়ছে তো পড়ছেই। যতদূর চোখ যায় সব হলুদ আবরনে ঢেকে গিয়েছে।
আমার কল্পনার রেশ টানতে হল অনিলের কথায়।
-রাফি, ইউ মাস্ট গো দেয়ার। অলরেডি আই হ্যাভ বট ইউর টিকেট।
এই বলে কেটি এক্সপ্রেসের একটি টিকেট ধরিয়ে দিল।
-সত্যিই বলছ যাবার জন্য, তাহলে?
-হ্যাঁ আমি বলছি তুমি যাবে।
-কিন্তু ও লিখেছে সিউল টাওয়ারের সামনে অপেক্ষা করবে। এর বেশি কিছু না।
এবার অনিল কিছুটা নাছোরবান্দার মত আমাকে বলল,
-আমি ওর মিনতি ভরা দুটো চোখ পড়তে পেরেছিলাম। লরিয়ান তোমার লাইফে ফিরে আসতে চায়। বিশ্বাস করো, প্লিজ।
অনিলের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার আগে একবার আকাশের দিকে তাকালাম। যেকোন মুহূর্তে বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে। দেরী না করে আবার ষ্টেশনের দিকে পা বাড়ালাম।
প্ল্যাটফর্মে বসে ভাবছি আগামীকাল দিনটির কথা। কল্পনার চোখে ভাসছে সিউল টাওয়ারের নিচে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে লরিয়ান। ওর রিনিঝিনি হাসির শব্দ পযন্ত কানে এসে ধরা দিচ্ছে এই মুহূর্তে! কতদিন পর আবার দেখা দুজনার!
আবার অন্য একটি চিন্তা মাথায় আসার সাথে সাথে সব এলোমেলো হয়ে গেল। ইতিমধ্য বাংলাদেশে বিয়ের জন্য সব পাকাপাকি হয়ে গিয়েছে! এখন কি আর ফেরার পথ আছে? বিয়ের কথা পাকা হবার পর থেকে নিয়মিত ইরার সাথে কথা হয়। এই কয়েকমাসে আমার ভিতর বিশেষ কোন অনুভূতির ব্যাপার বুঝা না গেলেও ইরাকে দেখে অনেক কিছু বুঝা যায়। ও প্রেমে পড়েছে! অনেকটা লরিয়ানের প্রতি আমার যে অনুভূতি ছিল ঠিক একই অনুভূতি আমার প্রতি ওর। বেশ স্পষ্ট করেই বুঝা যায়।
ট্রেনের আগমনি ঘোষনায় আমার সম্ভিত ফিরল। ট্রেনে উঠার সাথে সাথেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। লরিয়ানের দেয়া চিরকূটটি আবার হাতে নিলাম। এক লাইনের লিখাটি আর পড়তে পারলাম না। একটা তীব্র অভিমানে চোখ ঝাপসা হয়ে এল। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখছি বাইরে বৃষ্টি এখন মুষলধারে রূপ নিয়েছে। শরৎকালের ঝুম বৃষ্টি। যেন হলদে পরীর চোখে জল।
মনে হচ্ছে বুকের ভিতর বয়ে যাওয়া তুমুল ঝড়ো হাওয়ার সাথে এর একটা অদ্ভুদ ঐক্যতান রয়েছে। এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য আমার সাবকনসিয়াস মন বলছে গান শোনার দরকার। কিন্তু উপায় নেই। তাই মনে মনে মাথার ভিতর চালু করে দিলাম পল কিম এর গান,
‘আই ফাউন্ড এ পারফেক্ট লাভ,
দ্যাট আই হ্যাভ ওয়েটিং ফর এ লং টাইম’
ট্রেন প্রায় ইকসান স্টেশনে এসে পৌঁছেছে।
ইকসান রেলস্টেশনে নামতেই মোস্তাফিজ ভাইয়ের সাথে দেখা। অনেকদিন ধরেই কোরিয়াতে আছেন। এখানেই বিয়ে করেছেন। নামের ভিতর একটু কোরিয়ান ফ্লেভার আনার জন্য শেষে যোগ করেছেন কিম। এখন কেউ বলে কিম মোস্তাফিজ আবার কেউ কেউ ডাকে মোস্তাফিজ কিম বলে। শোনতে হাস্যকর হলেও এসবে উনার অবশ্য কোন আপত্তি নেই। উদাসীন, খামখেয়ালি কিন্তু সদালাপী মানুষ। মোস্তাফিজ ভাইয়ের ডাকে স্টেশনে কোলাহল ছাপিয়ে বাস্তবতায় ফিরে আসলাম,
-রাফি, সোজা বাসায় যাবে নাকি অন্যকোথাও?
ভিড় ঠেলে সামনে এসে জিজ্ঞাস করলেন।
-না, বাসায় যাব। আপনি কি করেন এখানে?
-তোমার ভাবীকে পৌছে দিতে এসেছিলাম। ও বুসান যাবে।
আমি হাসলাম। বুসানে উনার শ্বশুর শাশুড়ি থাকেন। আগে সবসময় দেখতাম বিভিন্ন ছুটিতে উনাদের একসাথে বুসান যেতে।
-ভাবি, একা! আপনি সাথে গেলেন না?
মোস্তাফিজ ভাই হাসলেন। কি বুঝে হেসেছেন ঠিক বুঝা গেলনা। হয়ত ধরতে পেরেছেন এটা বাঙ্গালীর চিরাচরিত রসিকতা।
তবে বললেন,
-তুমি একটু অপেক্ষা কর। অনেকদিন দেখা হয়না। তোমাকে বাসার সামনে নামিয়ে দিব। যেতে যেতে কথা বলা যাবে।
মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে দিলাম। বেশিক্ষন সময় নিলেন না। দশ মিনিটের মাথায় এসে উপস্থিত। এসেই তাড়া দিলেন গাড়িতে উঠার জন্য। আমিও কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে উঠলাম। মোস্তাফিজ ভাই কথা বলা শুরু করেছেন। দেশ-রাজনীতি কোন কিছুই বাদ পড়ছেনা। আমি শুনছি তবে না শোনার মত করে। আমার চোখে এখন ভাসছে হলদে পরীর সাথে কাটানো প্রথম প্রেমের সেই তুমুল দিনগুলো। কিছুতেই সরাতে পারছিনা। শুধু এটা বুঝতে পারছি গাড়ি কখনো সিগন্যাল এ থামছে আবার কখনো বাড়ছে গতি।
বাসার কাছেই একটা সুপার শপের সামনে এসে বিদায় নিলাম। তবে কয়েক সেকেন্ডের ভিতর পিছন থেকে ডাক-
‘রাফি, তুমি ভুল করে সিউল যাবার টিকেট ফেলে গিয়েছ।
আমি হাসলাম। আসলেই কি ভুল করে না ইচ্ছাকৃত ভাবেই ফেলে এসেছি বুঝতে দিলাম না। চোখের তীব্র অভিমানের দৃষ্টিকে আড়াল করার জন্য ঘাড় না ঘুড়িয়েই জবাব দিলাম,
-কাল সিউল যাবার প্ল্যান ছিল। কিন্তু ল্যাবে একটা কাজ থাকায় যেতে পারব না। যদি কারো দরকার হয় দিয়ে দিবেন।
-ও আচ্ছা। ঠিক আছে তাহলে।
ট্রাফিকের সবুজ বাতি জ্বলে উঠেছে। মোস্তাফিজ ভাই আর কথা না বাড়িয়ে মুহূর্তেই অনেক গাড়ির স্রোতে হারিয়ে গেলেন।
আমিও বাসার দিকে রওনা দিলাম। এতক্ষনে অবশ্য চারপাশের নানান রঙয়ের চকমকে বৈদ্যুতিক আলো জানান দিয়ে দিল সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। এখান থেকে আমার এপার্টমেন্ট পায়ে হেটে পাঁচ-দশ মিনিটের রাস্তা। তবে এই অতিপরিচিত রাস্তাকে আজ কেমন জানি অচেনা মনে হচ্ছে। আবার আকাশের দিকে তাকালাম। এই মুহূর্তে বৃষ্টি নেই তবে বাতাস বইছে। উত্তরের হিমশিতল ঝিরিঝিরি ঠান্ডা বাতাস। রাস্তার পাশে লাগানো বিশাল মনিটর থেকে আবহাওয়ার ফোরকাস্ট দেখে নিলাম। তাপমাত্রা খূব দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে, শীতের আগমনী বারতা।
দুই।

কয়েকবছর পর সিউলের বুক চিরে বয়ে যাওয়া হান নদীর পাশদিয়ে তীর বেগে ছুটে চলেছে রাফির গাড়ি। যেভাবেই হোক সন্ধ্যার আগেই বাসায় পৌছাতে হবে। আজ ওর বিবাহ বাষিকি। গত পাঁচ বছরের ভিতর আর এমন কখনো হয়নি। সবসময় রুটিন মেনে এই দিনটির পুরোটা সময় বাসায় থেকেছে। আজ ব্যতিক্রম অন্য একটা বিশেষ করনে। অনিল ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছে, ওকে ইনচিয়ন এয়ারপোর্টে বিদায় জানাতে গিয়ে দেরী হয়ে গেল।
একবার আকাশের দিকে তাকাল রাফি। আকাশের লক্ষন খুব ভাল নয়। আবহাওয়া বিভাগ জুরুরি বার্তায় আগেই জানিয়েছে নিতান্তই প্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকে বের না হতে। কিন্তূ সেই নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আজ চলন্ত গাড়িতে উচ্চস্বরে বেজে চলেছে টিনেজার বয়েসের গান, তাংশিনি সারাংহে...
বাসায় ঢুকে দড়জার ওপাশের মেয়েটিকে দেখে খুব অবাক হয়ে গেল রাফি। হাসিমুখে দড়জার ওপাশে হলুদ শাড়ি পড়িহিত ইরা। কতদিন ধরে পাশাপাশি দুজন। তারপরেও যেন কত অচেনা লাগছে। হলুদ শাড়ীতে ইরাকে দেখে এতদিন পর আবার লরিয়ানের কথা মনে পড়ে গেল। অনেক বছর পর বুকের খুব গভীরে একটা তীব্র কষ্টের ঝড়ো বাতাস বয়ে গেল মুহূর্তেই। কিন্তু ইরাকে কিছুই বুঝতে দিল না। কিছু সৃতি সারাজীবন মাথা থেকে ঘুন পোকার মত মনকে ক্ষয় করে যায় খুব গোপনে। কিন্তু যার রেশ বাহির থেকে বুঝার কোন উপায় থাকে না। রাফি অনেক বছর পর খুব উদাসমনে কফির মগ নিয়ে জানালার পাশে বসল। একটু একা সময় কাটাতে ইচ্ছে করছে। তাকিয়ে দেখল বাহিরে আকাশ ঝেপে খুব তুষারপাত শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে পুরো সিউল শহর সাদা চাদরে ঢেকে যাচ্ছে। আর তুলার মত তুষারগুলো যেন প্রজাপতি। পাগলের মত উড়ে বেড়াচ্ছে এদিক সেদিক। অন্যসময় কফির মগে চুমুক দিয়ে জানালা পাশে বসে থাকার চেয়ে সুখকর কিছুই হতে পারত না। কিন্তু আজ বুকের ভিতর লুকিয়ে থাকা একটা তীব্র অভিমান চোখের দৃষ্টিকে তুষারের সাথে মিলিয়ে ঝাপসা করে দিয়েছে। আর, সেই ঝাপসা হয়ে যাওয়া চোখে শুধুই ভাসছে মনের খুব গভীরে লুকিয়ে থাকা হলদে পরী। এতগুলো বছর পর আবার।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী সৃজনশীলতার অনুপম বিকাশ। বেশ লাগলো ।
ধন্যবাদ মহী ভাই। আপনার কথায় উৎসাহ পেলাম।

১৮ জুলাই - ২০২০ গল্প/কবিতা: ৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪