প্রিয়তমাসু

শূন্যতা (অক্টোবর ২০২০)

Badruzzaman Khukon
মোট ভোট প্রাপ্ত পয়েন্ট ৫.২২
  • ৭১
এক।
সিঙ্গাপুর এয়ারের বিমানটি মায়ানমারের উপর দিয়ে বাংলাদেশের আকাশ সীমায় প্রবেশের কয়েক মুহূর্ত পরেই পাইলট জরুরী ঘোষণায় সবাইকে সিট বেল্ট পড়তে বলল। আমি সামনের মনিটরে দেখছিলাম বিমান বেশ নিচুতে নেমে এসেছে। এক লাফে উনচল্লিশ হাজার ফিট থেকে বাইশ হাজার ফিটে। ভেবেছিলাম হয়ত বিমানটি অবতরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমার ভুল ভাঙল একটু পর। যত নিচে নামছি মনে হচ্ছিল ততই গাঢ় মেঘের ভিতর ঢুকে যাচ্ছি। ভয়ে সিটকিয়ে যাবার মত এয়ার টার্বুলেন্স আর সাথে বিজলীর চমক। বুঝতে পেরেছিলাম ঢাকায় বৃষ্টি সাথে করেই নিয়ে এসেছি।
এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সিতে উঠার আগেও বৃষ্টি শুরু হয়নি। তবে একটা ভ্যাপসা গরমের সাথে আকাশটাও খুব অন্ধকার। অনেকদিন এই আবহাওয়ার সাথে আমি পরিচিত না। গ্রাজুয়েশন শেষ করেই চলে গিয়েছিলাম উচ্চ শিক্ষার্থে দেশের বাহিরে। আর ফিরে আসা হয়নি। অনেক বছর পর এবার এসেছি একটা সায়েনটিফিক কনফারেন্সে। আয়োজক কমিটির প্রধান খুব কাছের বন্ধু। আমার অবশ্য অন্য একটা লোভও ছিল। অনেকবছর হয়ে গেল টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শোনিনা। এই জুলাই মাসে বাংলাদেশে টানা বৃষ্টি হয়। কিছুদিন আগে দক্ষিন কোরিয়ার ইকসান স্টেশন থেকে মোহেঙ্গা এক্সপ্রেসে সিউলে যাচ্ছিলাম। বৃষ্টি শুরু হয়েছিল তখন। কিছু বৃষ্টির ঝাপটা ট্রেনের জানালায় এসে দুরের সব কিছু ঝাপসা করে দিচ্ছিল। যদিও কোরিয়ার বৃষ্টি আমাদের দেশের মত না। তবে পুরানো স্মৃতি মনে করিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল। আমাদের দেশে বৃষ্টি মনে প্রেম বোধ জাগিয়ে তুলে। আর কোরিয়ায় এর মানে হল সব কিছু ধুসর অন্ধকার হয়ে থাকা। আর হেড লাইট জ্বালিয়ে একরাশ জল ছিটিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে চলা গাড়ির সারি। তবে ওখানে শীতকালের বৃষ্টি আনন্দময়। তখন প্রচন্ড ঠাণ্ডায় পানির ফোটা তুষারে পরিনত হয়। চারপাশে যতদুর চোখ যায়, রাস্তা, মাঠঘাট, গাছপালা, আকাশ সব সাদা তুষারের চাদরে ঢেকে যায়। শৈল্পিক ভঙ্গিমায় শ্বেত শুভ্র তুষারপাত অন্যরকম এক জগতের আবেশ তৈরি করে । ধূমায়িত কফির কাপে চুমুক দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে তখন।
মহাখালি বাস টার্মিনালে আসতে না আসতেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি থেকে ভারি বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। আকাশের অবস্থা খারাপ এই জন্যেই কিনা টার্মিনালে প্রচণ্ড ভিড়। সবার ভিতর একটা তাড়াহুড়া ভাব। ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। লোকেলোকারন্য অবস্থা তার উপর অনেকদিন পর দেশে এসেছি। কপাল নেহাত খারাপ বলব না, ঢাকা থেকে সিলেটগামী এনা পরিবহনের টিকেট পাওয়া গেল। অবশ্য আরো তিন ঘন্টা পর।
‘এই যে বাঁধন ভাইয়া শোনছেন?
পাশ থেকে মনে হল আমাকে কেউ কয়েকবার ডাক দিল। পরিচিত কন্ঠের ডাক। তাকিয়ে দেখি মিলি। এতদিন পর দেখা। দেখে চিনতে একটু সময় লাগল। তবে কন্ঠ আগের মতই আছে। কতদিন পর দেখা তা ঠিক মনে করতে পারছিনা। খুব সম্ভবত পনের কি ষোল বছর তো হবেই। এই ক’বছরের ব্যবধানে ওর কত পরিবর্তন। এখন ওর নাকের উপর বসেছে কালো ফ্রেমের মোটা চশমা। চেহারা অনেক খানি বদলে গিয়েছে মাঝখানের সময়ের আবর্তে। এটাই অবশ্য স্বাভাবিক। এতগুলি বছর পর যে চিনতে পেরেছি এটাই তো অনেক বেশি। মিলি যদিও আমার ছোট বেলা থেকেই পরিচিত। ছোট মফস্বল শহরে পাশাপাশি বাসায় থাকতাম। দিনে কতবার দেখা হত হিসেব করে বলা কঠিন। আমাদের এলাকায় সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে ছিল ও। শুধু সুন্দর বললে ভুল হবে। আমাদের যখন প্রেম হয় তখন আমার এইচ এস সি পরীক্ষা সামনে। টিনেজার হিসাবে যা হয়। প্রেমে পড়ার বয়স তাই পড়তেই হবে। আমাদের ক্ষেত্রে ওরকমই ছিল হয়ত।
চারপাশের হাঁকডাকে আমার হুঁশ ফিরল। এই যাহ, ও বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে! তাকিয়ে দেখি রাস্তায় পানি জমা শুরু হয়েছে। মিলিকে দেখে কষ্টই লাগল। বেচারির শাড়ি কাদায় মাখামাখি। কোন রকম ভাবে বাস টার্মিনালের ভিতর ওর জন্য জায়গা ম্যানেজ করা গেল। বৃষ্টির কারনে এত ভিড় বেড়ে গিয়েছে, ঠিক মত পা ফেলার মত অবস্থা এখন আর নেই। ঢাকা শহরে বৃষ্টি আসে ভয়ংকর রূপ নিয়ে। গল্প কবিতায় হয়ত তা উপভোগ্য। বাস্তবে তা নয়। মিলির চেহারায় কি যেন একটা নেই। সম্ভবত আগের চঞ্চচলতা। তার বদলে কেমন জানি একটা মায়া তার স্থান নিয়েছে। খোলা বইয়ের মত। ঠিক চোখে পড়ে ফেলা যায়। কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল মহাদেব সাহার কবিতাকে নিজের মত করে বানিয়ে বলি, এক কোটি বছর পর তোমার সাথে দেখা।
কিছুটা সময় লাগল ধাতস্ত হতে। মিলিও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ফেলেছে। বিপদের সময় আমাকে দেখে ভুলেই গিয়েছিল আজ এত বছর পর আমার নাম ধরে ডেকেছে।
‘তুমি কেমন আছ? ঢাকায় কি করছ? তুমি না ময়মনসিংহে থাক?
আমার এতগুলো প্রশ্ন শোনে ও একটা লাজুক হাসি দিল। এত বছর পর ওর সেই হাসির কথা মনে পড়ে গেল। কলেজে ছিলাম সময় আমরা একসাথে অংক প্রাইভেট পড়তে যেতাম জব্বার স্যারের কাছে। কি একটা কৌতুক বলেছিলাম। আর ওর কি হাসি। জব্বার স্যার রাগান্বিত ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। যেন আমিই সব কিছুর মূল। ওদিকে মিলির হাসি বন্ধ হবার কোন লক্ষন নেই। মিলি অতি ভালো ছাত্রী হবার কারনে সেদিন পার পেয়ে গেলেও আমার বাসায় নালিশ এল। এই রকম হেনেস্থা করার কারনে কি রাগটাই না হয়েছিল ওর উপর সেদিন। অনেকদিন আর একসাথে জব্বার স্যারের বাসার আশে পাশেও যাইনি।
‘বাধন ভাই, আমাকে একটা বাসের টিকেট কেটে দিতে পারবেন? ঢাকায় এসেছিলাম কলেজের একটা কাজে। কাউন্টারের ভিড়ের যে অবস্থা।‘
অনেক কষ্টে বাসের টিকেট নিয়ে এসে মিলির হাতে দিলাম। ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও টিকেটের টাকা নিতেই হল। এ নিয়ে কোন সিন ক্রিয়েট হোক এই ইচ্ছা ছিলনা।
আরো দুটো বাসের পর মিলির বাস। তারমানে আরো দুঘণ্টা দেরী। ওকে দেখে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। আমার মনে একটা অপরাধবোধ কাজ করলেও ইচ্ছা করেই কাজটি করেছি। কতদিন পর ওর সাথে দেখা। আবার চোখের পলকে হারিয়ে ফেলে অনুশোচনায় ভুগতে ইচ্ছে হলনা।
‘কোথায় যাচ্ছেন আপনি?
‘সিলেট। একটা কনফারেন্সে যোগ দেবার জন্য এসেছি।‘
খানিক সময় আমরা দুজনেই নিঃচুপ। আমিই শুরু করলাম আবার-
‘এই বৃষ্টিতে কতক্ষন দাঁড়িয়ে থাকবে। চল, চা খাবে।‘
আমার ভিতর আর জড়তা ছিলনা। হয়ত অধিকার নিয়ে চায়ের আবদারটা বুঝতে পেরেছিল। না বুঝার কিছু ছিলনা অবশ্য। এমনিতেই মেয়েরা এসব অধিকারের ব্যাপারটা অল্পতেই ধরতে পারে। এমনকি ওরা কারোর চোখের দিকে না তাকিয়েই বলে দিতে পারে অনেক কিছু! মিলি একান্ত বাধ্য মেয়ের মত আমার পিছন পিছন আসছে। আমাদের প্রেমের প্রথম দিনগুলিতে চায়ের দোকানের আসে পাশেও যাইনি। একবার ওদের বাসায় গিয়েছিলাম। ও আমার জন্য চা বানিয়ে এনেছিল। মুখে দিয়ে মনে হল চা না খাওয়াই হয়ত ভালো ছিল। বেচারী চিনি এত বেশি দিয়েছিল যে এটা একপ্রকার শরবত হয়ে গিয়েছিল।
‘তুমি কি এখনো চায়ে চিনি বেশি খাও?’
আমার কথা শোনে মিলি একটু কেঁপে উঠল। কিছুই বলল না। আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি বুঝতে পেরে মোবাইল নিয়ে কি দেখতে লাগল। যেন কিছুই দেখছেনা বা শোনছেনা।
‘আপনি দেশে এলেন কবে?’
‘এইত আজকেই এলাম।‘
‘আবার চলে যাবেন। না এবার পাকাপাকি ভাবে দেশে থেকে যাবেন?’
‘যাযাবর জীবন। এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরি। এই বেদুইন জীবন থেকে সরে আসতে পারব বলে মনে হয় না। সত্যি করে বলতে কি তেমন ইচ্ছাও আর নেই।‘
‘বিয়ে করেননি কেন, এখনো?’
মিলি অনেকটাই ধাতস্থ হয়ে গিয়েছে। ও এখন আগে যেভাবে কথা বলত সেভাবেই বলছে। কত অধিকার নিয়ে। মেয়েদের এই গুণটি দেখে অবাক না হয়ে পারা যায় না। কত সহজেই কত মাস কত বছরের না দেখা সময় ভুলে গিয়েছে। আস্তে আস্তে ওর কিশোরী সুলভ উচ্ছলতাটাও ফিরে এসেছে।
‘তোমার মত কাউকে পাইনি বলে।‘
বলেই একটু উচ্চস্বরে হাসলাম। ভেবেছিলাম মিলি রাগ করে বসবে। নাহ ও রাগ করেনি। বরং মিটিমিটি করে হাসছে। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। যাক বাবা। তবে ভেবে একটু অবাক লাগল। চরম একটা সত্যি কথা কত সহজেই যেন বলা হয়ে গেল।গলাটা একটুও কাঁপল না। প্রথমবার মিলিকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়াটা আজকের মত এত সহজে বলা হয়নি। কতদিন সাইকেলে করে ওর রিকশার পিছনে পিছনে ঘুরেছি। ও হয়ত বুঝতে পারত। কিন্তু কিছুই বলত না। মাঝে মাঝে কপট রাগ করে রিকশার পিছন ফিরে আমার দিকে তাকাত। মাসের পর মাস এভাবে ওর পিছনে ঘুরতে দেখেই কিনা আমার প্রেমে পরেছিল অবশেষে। মনে পরলে এখনো হাসি পায়। আষাঢ় মাসের ভারী বৃষ্টিতে সব যেন ভেসে যাচ্ছিল। আমি কাকভেজা হয়ে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে সাইকেল নিয়ে ওর রিকশার পিছনে যাচ্ছি। পরেরদিন সকাল বেলা ওর গোটা গোটা হাতে লিখা চিঠি। সামনে আপনার পরীক্ষা। এভাবে ঘুরলে পরীক্ষা খারাপ হবে। আরো কত কি লিখা ছিল! ওটা চিঠি ছিল। হয়ত কথার কথা। আমি যা ধ্রুব সত্য বলে মেনে নিয়েছিলাম। চিঠিতে একটা শর্তের কথা লিখেছিল। তিনটি কদম্ফুল নিয়েই যেন ওর সামনে যাই। আপাত দৃষ্টিতে খুব সাধারন মনে হলেও আমার কদমফুল যোগার করতে প্রায় এক সপ্তাহ লেগে গিয়েছিল।
‘আপনার উপন্যাসের কি খবর, এখনো লিখেননি কেন? না ভুলেই গিয়েছেন?’
‘প্রথমে সময় পাইনি। আর যখন লিখব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম তখন দেখি গল্পের নায়িকা হারিয়ে গিয়েছে। এই সময়ে লিখতে বসলে নায়িকা না আবার ভিলেন হয়ে যায়। অবশ্য, আমি তো তোমার হুমায়ূন আহমেদ না। যার গল্পের নায়িকা হবে অতি অসাধারণ।‘
এই বলে আরেক দফা হাসলাম। তবে এই হাসি লোকদেখানো হাসি।
‘আপনি আগের মতই আছেন এখনো। সবকিছুতেই ফাজলামি করেন। সিরিয়াস হতে পারলেন না আর।‘
‘একমাত্র তোমার জন্যই কিন্তু সিরিয়াস ছিলাম।‘
মিলি তার সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে ছিল লেখক হুমায়ূন আহমেদের নায়িকা। প্রথম প্রথম খুব রাগ হত। তারপরও কিছু বলিনি। তবে আমি পাড় হুমায়ূন ভক্ত হয়েও মিলির সাথে যতদিন সম্পর্ক ছিল ততদিন কোন উপন্যাস পড়িনি। এটা কি প্রিয় লেখকের সাথে অভিমান না হিংসা। ঠিক বলতে পারবনা। ঠিক করেছিলাম একদিন আমিও উপন্যাস লিখা শুরু করে দিব। আমার কথা শোনে মিলির কি হাসি। অনেকটা কাটা গায়ে নুনের ছিটার মত।
মিটিমিটি হেসে জিজ্ঞাস করল-
‘বৃষ্টি তো আপনার খুব প্রিয় ছিল। এখনো ভিজতে ইচ্ছে হয়?’
‘নাহ, আমাদের দেশের মত এসব রোমান্টিক বৃষ্টি কোরিয়াতে হয় না।’
‘ওখানে কি কদমফুল ফোটে বৃষ্টিতে?’
‘ঠিক বলতে পারবনা। তবে আমার যান্ত্রিক নগর জীবনে বৃষ্টি, কদম ফুল এসব দেখিনি কখনো।‘
মিলি আমার কথাকে পাত্তা দিলনা। সে নিজের মত করে বলেই চলল-
‘তানিয়ার কথা মনে আছে?’
‘হ্যাঁ মনে আছে। ফেসবুকে ওর সাথে কথা হয়।‘
‘ওর কাছ থেকেই আপনার খোজ খবর নেই মাঝে মধ্য।‘
বেশ অবাক হবার মত। আমি ভেবেছিলাম এই আমিই শুধু খোঁজ খবর রাখি। ভেবেছিলাম ও ভুলে গিয়েছে সবকিছু। সংসার, শিক্ষকতা এইসব জাগতিক ব্যস্ততায়। এতদিন পরে এসে একটা প্রশ্নের উত্তর জানতে খুব ইচ্ছে হল। কেন সে সেদিন আমার হাতটা ধরতে পারেনি। ওদিকে মিলি বলেই চলল ওর কথা। আমার মাথায় ওসব কিছুই ঢুকছে না। আমি ভাবছি ওর সাথে শেষ দেখা হওয়া দিনটির কথা। আমার স্পষ্ট মনে আছে সবকিছু। ওর ফ্যামিলিতে কিছু ঝামেলা চলছিল তখন। ওর বাবার সাথে ওর মায়ের। তারপর হঠাৎ করেই বিয়ে। তানিয়ার কাছে সব শোনে আমি সিলেট থেকে ছুটে গিয়েছিলাম। ইউনিভাসিটির বন্ধুদের সাথে কথা বলে রেখেছিলাম। আমি মিলিকে নিয়ে পালিয়ে সিলেট চলে আসব।
‘আচ্ছা সেদিন তুমি আমার সাথে পালিয়ে যেতে রাজি হওনি কেন?’
‘খুব ভয় পেয়েছিলাম। পরেরদিন যখন ভেবেছিলাম আপনার সাথে পালিয়ে যাব। আর আপনাকে খুঁজে পাইনি। আপনি একটা দিন আমার জন্য অপেক্ষা করেননি।‘
বলেই মিলি মাথা নিচু করে ফেলল। ও কাঁদছে। সেদিন রাতেও মিলি কেঁদেছিল।
একদিন কত ভাবে জানতে চেয়েছি। কারো কাছে কোন সঠিক জবাব পাইনি। জানতাম পারিবারিক চাপে বিয়ে করতে চলছে। একসময় আমিও মেনে নিয়েছিলাম। আমার এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। কোন বুদ্ধিমান মেয়েই এই অন্ধকারে ঝাপ দিতে রাজি হবেনা। ভাবতে অবাক লাগে যে প্রশ্নের জবাব এতদিন পাইনি। আজ যখন পেলাম তখন মনে হচ্ছে, না জানলেই ভাল হত। এতদিন পর এসে নিজেই সব কিছুর জন্য দায়ী হয়ে গেলাম। নিজের কাছে, মিলির কাছে। তবু কেমন যেন নিস্তব্ধ মনে হচ্ছে নিজেকে। হঠাৎ ঝড় সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে চলে যাবার ঠিক পর মুহূর্তে যেমন হয়। আজ এতগুলো বছর পর এসে আমি কি শান্ত। অথচ সেদিন যদি আর একটা দিন অপেক্ষা করতে পারতাম। তাহলে জীবনের গতিপথ অন্যরকম কিছু হয়ে যেতে পারত। মিলিকে বাসে উঠিয়ে দিতে গেলাম। ও একবারের জন্যও পিছন ফিরে তাকাল না। এমনকি একবার ধন্যবাদ দেবার জন্যও না। অনেক বছর আগে একবার পিছন ফিরে প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। সে আবার একই ভুল করতে চায় না। ওর চলে যাবার সময়টায় বৃষ্টিতে দাঁড়িয়েছিলাম। হয়ত এটাই শেষ দেখা। ময়মনসিংহগামী সৌখিন পরিবহনের বাসটি যখন মহাখালি বাস টার্মিনাল থেকে ডানে মোড় নেয়, তখন মিলি একবার ফিরে তাকিয়েছিল। যেন সেই মিনতি ভরা কিশোরীর দুচোখে।
এনা পরিবহনের বাসটিও ছুটে চলেছে সিলেটের উদ্দেশ্য। বৃষ্টিমাখা সন্ধ্যার রাজপথে নিয়ন আলো জ্বলে উঠেছে। গাড়ীর সারি লাল-নীল আলো জ্বেলে থেমে থেমে ছুটে যাচ্ছে তাদের গন্তব্যে। মিলি চলে যাবার পর আমার মনে হচ্ছে সব ফাঁকা। কেমন যে হিম শীতল। যেন কতদিন পর আবার মনের ভিতর একটা ঝড় বয়ে গেল। জীবনের যান্ত্রিকতায় কত লাল-নীল প্রেম আসে প্রতি নিয়ত। সব অসার মনে হচ্ছে আজ। সেই কিশোর বয়সের প্রথম প্রেম এখনো মনের খুব গভীরে। গলা ছেড়ে কথাগুলো মিলিকে বলতে ইচ্ছে করছে খুব।

দুই।
বেশ কয়েক মাস পরের কথা। এত বেশি বৃষ্টি হয়েছে যে ময়মনসিংহ শহরের বিভিন্ন স্থানে পানি জমে গিয়েছে। রাস্তায় জমে থাকা পানির জন্য মিলি আজকে কলেজে যেতে পারেনি। অনেকদিন পর চা হাতে নিয়ে আয়েশ করে বেলকনিতে বসল। এই উত্তরমুখি বেলকনিটা ওর খুব প্রিয়। সামনে খোলা মাঠ। আর মাঠ শেষ হলেই ব্রহ্মপুত্র নদী। এখনো খবরের কাগজ আসেনি। তবে একটু আগে বাসার দারোয়ান একটা চিঠি দিয়ে গেছে। সরকারি হলুদ খামের চিঠি। প্রেরক এর ঠিকানায় কিছু লিখা নেই। চিঠিটা দেখে ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বরাবরের মতই সজাগ হয়ে উঠল। এই রকম প্রেরকের ঠিকানা বিহীন চিঠি অনেক দিন পর!
খুব বেশি কিছু লিখা ছিলনা। শুধুই কয়েকটি শব্দ।
‘প্রিয়তমাসু,
এখনো আমার শহরে অঝোরে বৃষ্টি হয়। সে বৃষ্টির ছোঁয়ায় নরম কদমফুল ফোটে। তবে এখন আর ভিজতে ইচ্ছে হয়না। বরং বৃষ্টি দেখলেই ভিজে জবুথবু হয়ে যাওয়া পাখির মত একা মনে হয় নিজেকে।‘
মিলি সামনের খোলা আকাশপানে তাকাল। ওদের বাসার সামনে ফাঁকা জায়গায় একটি উচু সুপারি গাছ। এর উপর একটি পাখি ভিজে শরীর ফুলিয়ে বসে আছে। খুব অদ্ভুদ রকমের একটা মায়া লাগছে দেখে। বাতাসের তোড়ে গাছের সাথে পাখিটি একবার এপাশ থেকে ওপাশে দুলছে। তবু কোথাও চলে যাচ্ছেনা। মনে হচ্ছে খুব একা। কেন জানি মিলির বুক ফেটে একটা তীব্র কান্না আসছে ভিজে চুপসে যাওয়া পাখিটির জন্য।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী অসাধারণ  দারুণ প্রকাশ
ধন্যবাদ। আপনার সুন্দর মন্তব্যে ভবিষ্যতে আরো লিখতে অনুপ্রেরণা যোগাবে।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

গল্পের বাঁধন একজন প্রবাসী বাংলাদেশী। অনেকদিন পর দেশে এসে অপ্রত্যাশিত ভাবে দেখা হয়ে যায় তার তরুন বয়সের প্রেমিকা মিলির সাথে। দুজনের মনে পড়ে যায় ফেলে আসা প্রথম প্রেমের কিছু মিষ্টি-বেদনার স্মৃতি। ব্যস্ত সময়ের কাছে হার মেনে আবার তারা চলে যায় তাদের নিজ নিজ গন্তব্যতে। দুজন মানুষ, আপাতত দৃষ্টিতে সফল মনে হলেও, মনের ভিতরে দুজন ভীষণ একা। মনের গভীরে লোকানো এই শূন্যতা আবার নতুন করে উপলব্দি করতে পারে অনেকদিন পর

১৮ জুলাই - ২০২০ গল্প/কবিতা: ৪ টি

সমন্বিত স্কোর

৫.২২

বিচারক স্কোরঃ ২.২২ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ৩ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী