তরুণ, অবিবাহিত টুটুল যখন তার বিগত জীবনের দিকে চোখ বন্ধ করে তাকায় সে দেখে যে বরাবরের মতোই রয়ে গিয়েছে একগুঁয়ে, হতাশাগ্রস্ত আর গরীব। আজন্মের গরীব সে; আজন্মের অন্ধকার ছায়া ফেলেছে তার ভবিষ্যতমুখী চিন্তাধারার উপর। না আছে যৌক্তিক আকাঙ্ক্ষা, না আছে সেই আকাঙ্ক্ষার প্রতি যৌক্তিক ভরসা। স্বপ্ন ও সাধকে বিশ্বাস করার মতো পর্যাপ্ত বাস্তবতা, বিশেষত অর্থনৈতিক কাঠামোর কোন অস্তিত্ব তার নেই।
ভোগবাদী সমাজব্যবস্থায় কোনরকমে জীবনকে যাপন করার মতো প্রয়োজনীয় আর্থিক সংস্থান না থাকা স্বপ্নবাজ যে কোন তরুণের জন্যই অত্যন্ত ট্র্যাজিক বিষয়। টুটুলের জীবনের আর্থ-বাস্তবতা এই কারণে গুরুত্ববহ যে, মানুষের চিন্তাই মূখ্যত মানুষের যাপনকে নিয়ন্ত্রণকারী একমাত্র অনুঘটক নয়। টুটুল দেখতে পায় তার জীবন স্মরণকাল হতেই ক্রমে টাকাপয়সা কেন্দ্রিক চেতনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। যত বয়স বেড়েছে সুখ দুঃখগুলো ক্রমেই হয়ে উঠেছে অর্থকড়ি সাপেক্ষ। রাত আর দিনগুলো হয়ে উঠেছে হাতে অর্থকড়ি থাকা না থাকার অনিশ্চয়তায় বিভ্রান্ত। নানা সময়ে তার আর্থিক অনিশ্চয়তা তার জীবনপ্রবাহের গতিমুখ নির্ধারণ করে দিচ্ছে ক্রমশ। গুরুত্বপূর্ণ সব পাওয়া না পাওয়াকে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে তা। অত্যন্ত সংগত কারণেই তাতে করে তার চিন্তা হয়ে পড়েছে সংকীর্ণ, মন দ্বিধাগ্রস্ত, প্রত্যাশাগুলো মারাত্মক অনিশ্চয়তায় পূর্ণ।
অত্যন্ত ছেলেবেলা হতেই বড়ো রকমের শিল্পী-সাহিত্যিক হওয়ার যে চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে, পৃথিবীর বিচিত্র রহস্য আর সৌন্দর্যের আস্বাদনের প্রতি ছাইচাপা আগুনের মতো প্রত্যাশা যেভাবে তাকে সময়ে সময়ে অনুরণিত করেছে আজ চোখ বুজে ভাবতে গিয়ে সে দেখে সেইসব ব্যাপারগুলো কেমন ধোঁয়াটে, নিষ্প্রভ আর অনিশ্চয়তায় কম্পমান। তখন তার সন্দেহ হতে থাকে বিগত জীবনের বিভিন্ন স্বপ্ন ও এমনকি বর্তমানের স্বপ্নগুলোর প্রতি তার যথেষ্ট সততা ও আন্তরিকতা নিয়ে। সেলিব্রেটি জীবনের গর্জিয়াস যাপনের প্রতি কৈশোর সুলভ আগ্রহ এক্ষণ আর তার নেই। কিন্তু এতো এতো সঙ্কট, এতো এতো অবদমনের যাপনের মধ্যেও মনের অতলে রয়ে গিয়েছে মর্যাদাপূর্ণ জীবনের প্রতি তীব্রতম বাসনা। যদিও মর্যাদাপূর্ণ জীবনের সংজ্ঞায়ন নিয়ে তার রয়ে গেছে পরিবর্তনশীল অনির্দিষ্টতা। সম্ভবত বাসনা যেকোন পরিস্থিতিতে মৃত্যুকে স্বীকার করে না বলে তা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে এবং আমাদের টুটুল বেঁচে আছে এখনো সমস্ত বর্তমানকে অগ্রাহ্য করেই অভিশাপগ্রস্তের মতো।
অতএব টুটুল বেঁচে থাকার দার্শনিকতাকে স্বীকার করে নিয়ে বিড়ি ধরায়। বিড়ি ধরানোর মতো পর্যাপ্ত মানসিক ও শারীরিক উদ্দীপনা তার দেহে ও চিন্তায় বিজলির মতো খেলে যায়। আমরা অনুমান করি যে মৃত নয়, জড় নয় সে। প্রাণের সাড়ার মতো সে চঞ্চলতা অনুভব করে এবং মানুষের ভীড়ে মিশে যাওয়ার ব্যাকুলতায় বাজারের দিকে পা বাড়ায়। মানুষ আগে তাকে যেরকম করে টানতো এখন সেরকমের টানে না। অভ্যাসই মানুষের স্বভাবকে তৈরি করে থাকে এবং তা স্বভাবের থেকে বেশি শক্তিশালী। সে মানুষকে পর্যবেক্ষণ করে পণ্যের ভীড়ে, পণ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট করে এবং মোদ্দা কথা পণ্য হিসেবেই। আমাদের আর্থ মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতাই এককালের ভাবাবেগে উচ্ছল টুটুলকে অভ্যাসের দাসে পরিণত করে। ক্রমে এই গতানুগতিকতা তার স্বভাবে জড়িয়ে যায় এবং মানুষকে আর কয়েকটা পার্থিব উপকরণের বেশি না ভাবার অসুস্থতা তাকে ক্লান্ত করে তোলে।
সে বাজারে গিয়ে মুগ্ধ চোখে আগের মতোই উৎসাহী, ব্যস্ত, সাংসারিক লোকজনকে দেখে। পলাশ, অরুণ, নিয়ামতকে দেখতে পায় অপার্থিব কোন এক আগ্রহে শহীদের চায়ের দোকানে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। ঘেয়ো কুকুরটাকে সে রাস্তার তেমাথায় দেখতে পায় গবেষকের চঞ্চলতা নিয়ে ডাস্টবিন ঘাটাঘাটি করতে। নিষ্প্রাণ একটি কাক মরে পড়ে আছে পুরনো, বাতিল, লক্কড়ঝক্কড় কয়েকটি রিকশার ভাগাড়ে। পুরনো অভ্যাসের জেরে সে মানিকের চায়ের দোকানে যায়, কিন্তু বসে না। একবার বসেই আবার উঠে পড়ে এবং দ্রুত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এক কাপ চা পান করে এমনভাবে মনে হয় তার জরুরি কোন কাজের কথা মনে পড়ে গিয়েছে। সাংসারিক বুদ্ধিসম্পন্ন মানিক দ্বিধায় পড়ে যায় আমাদের টুটুলের হাতে নিজে থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে দেবে কি না। অর্থাৎ টুটুলের দ্বিধাগ্রস্ততা তার পরিবেশের আর সব উপাদানকেও দ্বিধান্বিত করে তোলে। তবে মানিক একান্ত ভদ্রতার এবং স্বভাবগ্রস্ততার পরিচয় দেয় টুটুলের হাতে একটা সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে। চালচলনের স্বাতন্ত্র্যের কারণে দোকানদার আর সবার মতো করে টুটুলকে পড়তে পারে না। আশেপাশের মানুষকে কনফিউজড করে রাখা আমাদের টুটুলের ইচ্ছাকৃত নয়। তবে তার এই চারিত্র্য তাকে প্রায়শই সুবিধা দিয়ে থাকে, যাকে সামাজিক নিরাপত্তা বলা যায়। বাকীতে সিগারেট বিক্রির ব্যাপারে প্রায় সকল সিগারেট বিক্রেতারই অল্পবিস্তর আপত্তি আছে। কিন্তু টুটুলের কাছে এই মুহূর্তে অর্থকড়ি কিছু আছে কি নেই বা কখন সে দিয়ে দিচ্ছে এর কোন গ্যারান্টি মানিককে তার এতোদিনের দোকানদারির অভজ্ঞতা প্রদান করে না।
ক্লান্তিকর, একঘেয়ে, যাপনের সমান্তরাল চেতনা টুটুলকে বিপর্যস্ত করে তোলে। আর দশটা দিনের মতোই মনে হতে থাকে প্রত্যেকটা দিনকে। সে পরিচিত কারো সাথে দেখা হতে পারে এই অকারণ আশা নিয়ে রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে। প্রত্যাশিত কারো সাথে দেখা হওয়ার বদলে বাড়িওয়ালার সাথে দেখা হয়ে যায়। বকেয়া পড়েছে দুই মাসের সেই কথা বলার বিভিন্ন অবসরে বিভিন্ন উপদেশ টুটুলের উপর বর্ষিত হতে থাকে। কথামালার প্রায় সবটাই টুটুলের এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যায়। সে মাঝখানে বারকয়েক হ্যাঁ হ্যাঁ জবাব দিয়ে যায়। ভিন্ন এক চিন্তার জগতে ডুবে যায় সে। এইসব তুচ্ছ বাড়িভাড়ার বকেয়া, প্রতিদিনকার বাকীতে বিড়ি সিগারেট খাওয়া, শ্রমজীবী মা বাবার দোয়া ও দায়- সমস্ত অতিক্রম করে তার চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে প্রবল ফ্যান্টাসিতে। আলাদিনের চেরাগের মতো কয়েক লাখ বা কয়েক কোটি টাকা অনির্দেশ্য কোথাও না কোথাও থেকে হঠাত পেয়ে যাওয়ার অমূলক, অযৌক্তিক, চিন্তার মাঝখানে বাবার ফোন আসে। ফোনের ওপাশ থেকে দুর্দশাগ্রস্ত পরিচিত কন্ঠের গালিগালাজ নিয়তির মতো করে আছড়ে পড়ে তার ভাবনায়। বাবা চাকরি ছেড়ে দিয়েছে সুপারভাইজারের সাথে তর্কাতর্কি করে। অর্থাৎ বাড়ি নেই, ঘর নেই, খাবারের সংস্থান নেই পরিবারের সন্তানের চূড়ান্ত স্বাধীনতার অপ্রকৃত বোধ তাকে পেয়ে বসে এবং সেটা ভেবেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সে। মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপনের আজন্ম প্রত্যাশা শূন্য থেকে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে আবারো। সে একটা আকিজ বিড়ি ধরায়। কোন পিছুটান নেই, হারানোর কোন ভয় নেই। জয় করার জন্য রয়ে গিয়েছে অনাগত জীবন। জয় করা যায় এমন জিনিষের মধ্যে রয়ে গিয়েছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্তটাই।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
প্রত্যাশা অনেক সময়েই বিভিন্ন প্রতিকূল বাস্তবতার কারণে চাপা পড়ে থাকে। টুটুলের ক্ষেত্রেও অনুরূপই ঘটেছে। স্বপ্ন আর বাস্তবতার গোলমেলে হিসেবের মধ্যে পড়ে তার চরিত্রটাই হয়ে পড়েছিলো নিজের ইচ্ছার বিরোধী সত্তা। প্রত্যাশার নিরিখে নেতিবাচক জীবনযাপনে সে হয়ে পড়েছিলো বিধ্বস্ত, গা ছাড়া, অনেকটা আত্মমর্যাদাহীন। তার প্রতিদিনকার ক্লান্তিকর যাপনকে এক নিঃশ্বাসে উড়িয়ে নিয়ে যায় তার চূড়ান্ত অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার ধাক্কা, যা সে বুঝতে পারে পিতার চাকরি চলে যাওয়ার সাথে সাথে। সে দেখে 'ন্যাংটার নেই বাটপারের ভয়'। অর্থাৎ, সে দুর্দমনীয় হয়ে উঠে চরম বিপদের অভিঘাতে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন যে, "বাঁধা পেলেই শক্তি নিজেকে চিনতে পারে। আর চিনতে পারলেই তাকে আর ঠেকিয়ে রাখা যায় না।"
০৫ জুলাই - ২০২০
গল্প/কবিতা:
২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪