ভালবাসি তোমায়’ কথাটা জীবনে শুধু একজনকেই বলার ইচ্ছে হয়েছিল। মানুষটার জন্য একটু একটু করে মায়া জন্মেছিল আর সেই মায়া থেকে জন্মেছিল ভালবাসা।
রজতের সাথে আমার দেখা হয় বর্ষাস্নাত এক দিনে। মন খুব খারাপ কারণ পাত্রপক্ষ গায়ের রঙ কালো বলে মানা করে দিয়েছিল। মা-বাবার ভালবাসায় সিক্ত আমি কখনো ভাবিনি যে জীবনে এমন দিন আসবে।অশ্রু লুকোতে ছুটে গিয়েছিলাম বারান্দায় এমন সময় শুরু হল মেঘের ডাক। নানা ভাবনা খেলছিল মাথায় হঠাৎ দেখি ধীরপায়ে এক যুবককে আমাদের বিল্ডিং থেকে বের হতে। বৃষ্টিতে সবাই দৌড়াচ্ছে কিন্তু সে ভাবলেশহীন, ঠায় দাঁড়িয়ে যেন বৃষ্টির সাথে এক হতে চায়। কেন জানি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না তাই খুব বিব্রতবোধ করলাম যখন সে আকস্মিকভাবে ফিরে তাকালো এবং আমাদের চোখাচোখি হল। বড্ড সুন্দর তবে মলিন এক মুখ, সুন্দর চোখজোড়া যেন প্রানহীন।প্রথম দেখাতেই কি ওর প্রতি মায়া জন্মেছিল আমার?
সে সময়ে নিজেকে পরিত্যাক্ত মনে হত। মা-বাবার ভালবাসা ছিল কেবল বাঁচার স্পৃহা। পড়াশুনা শেষে না হছিল চাকরি না বিয়ে, আত্মীয়স্বজনেরা করুণার চোখে তাকাত। ধীরে ধীরে নিজের মনকে শক্ত করছিলাম, জীবনে কেউ আসবে না তাই নিজেকে সেভাবে তৈরি করতে হবে, নিজেকে শক্ত হতে হবে বেশ। কিন্তু অচেনা রজতকে দেখে মনের কাঠিন্য নিমিষেই দূর হয়ে গিয়েছিল। তাই সেদিনের পর থেকে বারান্দাতে সময় কাটাতাম দিনের পর দিন। খুব দেখবার ইচ্ছে হত তাকে কিন্তু তার দেখা মিলত শুধু বর্ষার দিনগুলতে। তার প্রতি টান অনুভব করলেও কিভাবে তাকে কাছে টানব তা অজানা ছিল এবং মনে ছিল সাহসের অভাব। কিন্তু নিয়তির লেখা খণ্ডানো যায় না, ধরা পড়ে গেলাম।
চাকরির খোঁজ শেষে বাসায়ে ফিরছি, মেঘ ডেকে চলছে অনবরত। আচমকা কে যেন ডেকে উঠল, “একটু শুনবেন?” পিছ ফিরে তাকাতেই চমকে উঠলাম, যাকে খুঁজেফিরি সে আমার সামনে দাঁড়িয়ে। “আপনি আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন কেন? কিছু কি বলতে চান?” তার সরল প্রশ্ন। কখনো কখনো ভীরু মানুষেরাও অকস্মাৎ সাহসী হয়ে ওঠে। বলে ফেললাম, “আপনি সুন্দর বলে”। এবার তার হতভম্ব হবার পালা আর এই সুযোগে পালালাম তার কাছ থেকে। প্রচণ্ড লজ্জায় এরপর বারান্দায় যাওয়া বন্ধ করলাম কিন্তু বিধাতার ইচ্ছায় আবার দেখা হয়ে গেল। বাসায় খালু আসবেন বলে ছাদে লুকালাম। তিনি মানুষ ভালো হলেও বিয়ে নিয়ে এমন সব বলেন যে অসহনীয় লাগে। কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি হঠাৎ আবার শুনি সেই মোলায়েম তবে দৃঢ় কণ্ঠস্বর, ‘আমি রজত, দোতালার নতুন ভাড়াটে’। ‘আমি রোদেলা, চার তলার ভাড়াটে’ – সেই থেকে শুরু হল কথপোকথন। নিজের মাঝে এত কথা লুকিয়ে ছিল তা জানতাম না। পরদিন আবার ছুটে যাই ছাদে তাকে দেখার আশায়। সে আসল না, মুহূর্তে সব ভাললাগা বদলে বিষণ্ণতার রূপ নিল। খুব অল্পতেই মনে অনেক স্বপ্ন দেখে ফেলেছিলাম। আমার ভালবাসার গল্প এখানেই শেষ হলে ভালো হত কিন্তু হল না।
রাতে ছাদে উঠলাম আবার দেখি সে দাঁড়িয়ে। চলে আসতে চাইলাম কিন্তু সে হাত ধরে ফেলল। তার কণ্ঠে আকুতি, ‘দাঁড়ান! প্লিজ যাবেন না। খুব যন্ত্রণায় ছিলাম আজ, কাল অবশ্যই আসব’। সে কথা রেখেছিল তাই আমার এই গল্প শেষ হয়েও হল না শেষ। হাজারো গল্প বলতাম আমরা, ক্ষুদ্র থেকে বিশাল। সময়টা কেটে যেত মুহূর্তেই। কখনো কখনো নিঃশব্দে সময় কাটাতাম আমরা, দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে। আমার হাতটা খুব যত্নে তার হাতে রাখা। পরে নিজেই অবাক হতাম, আমি তখন একজন প্রাপ্তবয়স্ক যুবতী কোন ষোড়শী না। নিজ মনের উপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ রেখে চলতাম কিন্তু এই এক মানুষের কাছে গেলেই যেন আমার মন যেন এক রঙিন পৃথিবীতে পা রাখে, বিদ্রোহী হয়ে উঠে। এখন বুঝি কেন, রজতের মত কেউ কোনদিন আমায় এতটা সম্মান দেয়নি, এতটা নম্রতা দেখায়নি এবং তার মত কেউ বলেনি ‘ভালবাসি’। আমার পিপাসার্ত মনে প্রাণসঞ্চার হয়েছিল তার কারণে। কিন্ত রুপকথার এই দিনগুলো বেশিদিন আমার কপালে সইলো না।
আমার ভালবাসার মানুষটা ছিল সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। বেশিরভাগ সময় তার দিন কাটত যন্ত্রণার মাঝে।অনেক দিন এমন যেত যে তাকে আমি চিনতে পারতাম না আর সে পারত না আমায় চিনতে।হিংস্র হয়ে পড়ত। আমি ছিলাম দিশেহারা, কেবল ভাবতাম কিভাবে পারব আমার ভালবাসাকে একটু শান্তি দিতে। আমাদের সমাজ কোনদিনই মানসিকভাবে আক্রান্তদের মেনে নেয়নি। তাই বনেদি ও বিত্তশালী ঘরের ছেলে হয়েও রজতের পরিবার তাকে পাঠিয়ে দেয় দূরে, বিনে দোষে আমার ভালবাসার মানুষটা হয়ে দাঁড়ায় তাদের লজ্জা। রজত সব মেনে নেয়, সাথে কেবল একজন পুরনো ভৃত্য নিয়ে চলে আসে আমাদের এখানে। নিজেকে খুব কুৎসিত মনে হত তার কিন্ত আমার মুগ্ধভরা চাহনিতে সে নিজের সৌন্দর্য খুঁজে পেত। কোনকিছুই লুকোয়নি ও আমার কাছ থেকে, আগে থেকেই সব জানতাম।
বর্ষাস্নাত এক দিনে তাকে প্রথম দেখেছিলাম এবং শেষ দেখাটাও বর্ষণমুখর এক দিনে। তার বাহুডোরে আব্ধহ করে বারবার জিজ্ঞেস করছিল, ‘রোদেলা, তুমি আমায় ভালবাসো?তাই না? বল আমায় ভালবাসো!’ তাকে আঁকড়ে ধরে আমিও বলে উঠি, ‘হ্যাঁ, খুব ভালবাসি তোমায়। প্রচণ্ড ভালবাসি’। সেদিনের ওর মুখের হাসি আমি আজও স্বপ্নে দেখতে পাই। পরদিন ছাদে গিয়ে দেখি সে নেই্, ছুটে যাই দোতালায়- সেই দরজায় বড় তালা ঝুলানো। পাগলের মত ছুটে বেড়াই, খুঁজে পাই না তাকে আর। বুঝতে বাকি রইল না । সুস্থতার দিনগুলোতে মানুষটা সপ্ন দেখত আমাদের নিয়ে কিন্তু সেটা ছিল মনভুলানো, ওর অসুস্থতা ভাল হবার কোন সুযোগ ছিল না তখন। বাবা-মার ঘর থেকে সে ছিল বিতাড়িত আর আমার পরিবার ছিল অর্থহীন, ক্ষমতাহীন। মনে অঢেল ভালবাসা থাকলেও চোখে আঁধার দেখছিলাম আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। হাজারো কাঁটা ছিল আমাদের পথে কিন্তু শেষপর্যন্ত সেই পথে সে একা পাড়ি দিল। আমার আজও দৃঢ় বিশ্বাস যে ওর ভালবাসায় কোন খাঁদ ছিল না।
প্রচণ্ড আঘত পেয়েছিলাম। কতদিন উন্মাদের মত ছিলাম জানিনা, ছাদে আর বারান্দায় কেবল ঘুরে বেড়াতাম একজনের দেখা পাবার আশায়। পাইনি তার দেখা। ভেবেছিলাম আমর জীবন থমকে যাবে কিন্তু বাস্তবতা ঠিকই দেখিয়ে দিল যে নদীর মত জীবনটাও বহমান। জীবনে ভালবাসা আর পাইনি কিন্তু সংসার হল। একজনের স্ত্রী হলাম, তার সন্তানদের মা হলাম। স্বামী মানুষটি কোনদিন ভালবাসি বলেননি এবং আমিও বলার প্রয়োজনবোধ করিনি। সম্মান আর সমঝোতা থাকলেই সংসারধর্ম ভালভাবে পালন করা যায়। এ দুটো আমাকে তিনি দিয়েছেন তাই আর কিছু চাইবার ছিল না। হ্যাঁ, আমি ভাল আছি যতটা ভাল থাকা যায়। রজতের খব্রর আমি আজও জানিনা, জানতে খুব ভয় লাগে। আড়ালে থেকে কেবল মনকে শুধাই যে সে ভাল আছে, খুব ভাল।
২৫ জুন - ২০২০
গল্প/কবিতা:
২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪