বেশ কয়েকমাস ধরে শাহীন ঘরে আছে।মেডিকেল লাইফে প্রবেশের পর থেকে সম্ভবত এটাই সবচেয়ে বেশিসময় ধরে বাসায় অবস্থান করা।একরকম দোটানা অবস্থা।সে সব সময়ই চাইত মেডিকেলের একঘুয়ে জীবন থেকে কিছুটা দুরে গিয়ে নিজের মত করে নির্ভাবনায় কিছু সময় কাটাতে। ভাগ্যের কি পরিহাস!! তার চাওয়া পূরণ হলেও মনে সেই তৃপ্তি পাওয়া যাচ্ছে না।এভাবে ঘরে বসে থাকতে কারই বা ভালো লাগে,তারউপর চারপাশে মানুষের আহাজারি বাড়ছেই
নিজের জন্য,নিজের পরিবারের জন্য চারপাশের মানুষজনের জন্য হলেও ঘরে থাকাটাই এখন একমাত্র উপায় সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য।যেখানে আমরা নিরাপত্তার জন্য ঘরে বসে আছে সেই সময়ই কিছু পেশার মানুষ নিজেদের নিরাপত্তা বিসর্জন দিয়ে সামনের সারি থেকে মহামারীর বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে।স্বাস্থ্যসেবায়,আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত সকলে সবার জায়গা থেকে তাদের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে
শাহীনের ও ইচ্ছে হয় অন্তত কিছু করার জন্য কিন্তু হাত পা যে বাধা।শাহীনের পাশের বাসার জিনিয়া আপা ডাক্তার,করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন সেই প্রথম থেকেই।জিনিয়া আপার স্বামী জাপানের একটা হাসপাতালে কর্মরত আছেন,জিনিয়া আপার ও গতবছর সেখানেই সেটেল হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু দেশের মায়ার টানে এখনো মন কে সেভাবে মানাতে পারেন নি বিদেশে সেটেল হওয়ার জন্য,তাই এখনো দেশেই আছেন মা বাবার সাথে।একমাত্র মেয়ে বলেই জিনিয়া আপার মা রাহেলা বেগমের চিন্তার শেষ নেই।মাঝেমধ্যেই শাহীনের মা এর সাথে এসে কিছুক্ষণ গল্প করে যায়।শাহীনের মা কে নিজের মেয়ের মতই দেখে রাহেলা বেগম।
বেশ কিছুদিন যাবত ঘরে ফিরছে না জিনিয়া,হাসপাতালেই কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকার ব্যবস্থা করেছে কর্তৃপক্ষ।থাকার ব্যবস্থা হলেও খানাপিনার একেবারে নাজেহাল অবস্থা।একের পর এক ওয়ার্ড পুরে যাচ্ছে করোনা রোগী দিয়ে,রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত দের,প্রচুর সীমাবদ্ধতা সত্ত্বে ও চিকিৎসা সেবা চলছে।জিনিয়ার জন্য ও একেবারে নতুন অবস্থা এটা,বাসায় বৃদ্ধ মা বাবা,তাদের একা রেখে রাত দিন এক করে রাউন্ড দিচ্ছে,ক্রিটিকাল পেশেন্টদের ম্যানেজ করছে
এদিকে প্রতিদিনই মেয়ের সাথে অল্প সময় হলেও কথা বলা লাগবেই রাহেলা বেগমের।মেয়ের কন্ঠ শুনেই বুঝে ফেলেন মেয়ে ভালো নেই,কিন্তু জিনিয়া মা কে বুঝতে দিতে চায় না।রাহেলা বেগম সিদ্ধান্ত নিলেন তিনিও তার মেয়ের মত মানুষের সেবায় কাজ করবেন।
নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী ৫-১০ জনের জন্য রান্না করে নিজে গিয়ে দিয়ে আসবেন হাসপাতালে যাতে নিজের মেয়ে সহ কয়েকজন অন্তত খাবার নিয়ে কষ্ট না করে।এই শুনে শাহীনের মা রাহেলা বেগমকে বললে আপনি বৃদ্ধ মানুষ আপনি কেনো যাবেন,আমার শাহীন ত আছেই ওই নিয়ে যাবে আর আমিও রান্না করে দিবো এখন থেকে।
কি শাহীন,পারবি না তোর জিনিয়া আপুর হাসপাতালে প্রতিদিন খাবার পৌছে দিতে?মায়ের এ কথা শুনে শাহীন বলল অবশ্যই পারব,আর হাসপাতাল ত কাছেই,১০ মিনিটের রাস্তা।ছেলের উত্তরে শাহীনের মা এর চোখ ছলছল করে উঠে
মাস্ক আর হ্যান্ড গ্লাভস পরে প্রতিদিন হাসপাতলে দুই বেলা করে খাবার পৌছে দেয় শাহীন,এটা তার নিত্যদিনের কাজ হয়ে দাড়িয়েছে।জিনিয়া আপার সাথেও মাঝেমধ্যে কথা হয় শাহীনের তবে দূরে থেকে।জিনিয়া আপা বলে তোরা আছস বলেই দেশটা এখনো এত সুন্দর।শাহীন বলে,"কি যে বলেন আপা,আপনারা আমাদের অনুপ্রেরণা,আমার এই আর কি এমন কাজ,সমগ্র বিশ্ব যেখানে স্থবির সেখানে আপনারা ছুটছেন অবিরত।"
এই শুনে কিছুটা ফ্যাকাসে হাসি দেয় জিনিয়া আপা,আরো কিছু বলতে যাবে কিন্তু গলাটা বার বার ধরে আসছে।শাহীন জিজ্ঞেস করল আপা সব ঠিক আছে ত,জিনিয়া আপা যথেষ্ট দূরে থেকেই বলল এখনো জানি না রে,টেস্ট এর রেসাল্ট আসলেই বলতে পারব।তুই খবরদার আমার মা কে এসব কিছু বলবি না আর সবাইকে দেখে রাখবি,তোর দায়িত্ব সবাইকে দেখে রাখা।
এভাবে বেশ কিছুদিন চলে গেলো,রোজই হাস্পাতালের গেটে এসে খাবার দিয়ে যায় শাহীন,দারোয়ান আংকেল এর সাথেও বেশ ভাব হয়েছে এই কয়দিনে,তবে এখন আর জিনিয়া আপার সাথে দেখা হয় না
দারোয়ান আংকেল কে জিনিয়া আপার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করায় দারোয়ান আংকেল কেমন জানি বিমর্ষ হয়ে গেলেন।যা বুঝার বুঝে ফেলে শাহীন।জিনিয়া আপার অইদিনের কথা মনে বাজতে থাকে তার।"দায়িত্ব,দায়িত্ব,দায়িত্ব"আমাদের সকলের দায়িত্ব পরিবারের খেয়াল রাখা,এমন কিছু মানুষ আছে যারা নিজেদের দায়িত্ব কে শুধুমাত্র পরিবারে সীমাবদ্ধ না রেখে সমাজ,রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিয়েছে
শাহীনের এখন আর হাসপাতালে খাবার নিয়ে যাওয়া হয় না,বেশ কিছুদিন যাবত গায়ে জ্বর দিচ্ছে,সাথে গলা ব্যাথা।রাহেলা বেগম দিন রাত জায়নামাজ র পরে থাকেন,শাহীনের মা ও,সেই সাথে অনবরত কান্না করে যাচ্ছেন ছেলের অসুখে কাছে থাকতে না পেরে।একদল লোক এসে শাহীন থেকে স্যাম্পল কালেকশন করে নিয়ে গেলো.....
(চলমান)
পর্বঃ০২
বেশ কয়েকদিন পরে রিপোর্ট এলো করোনা নেগেটিভ।পরিবারের সবাই হাফঁ ছেড়ে বাচল।শাহীনের কোনো ভাবান্তর নেই।একসপ্তাহের মধ্যে সেরে উঠল সে।কথায় আছে ভাইরাল জ্বর হলে সেরে উঠতে ওষুধ সেবনে ১ সপ্তাহ আর ওষুধ ছাড়া ১ উইক লাগে।সে যাই হোক শাহীনের অসুস্থতা পরিবারকে ভালোই নাড়া দিয়েছে,এই অবস্থায় তার যে আর হাসপাতালে খাবার নিয়ে যাওয়া হবে না ভালোই অনুভব করল সে।
এই অবস্থায় ঘরে বসেও তেমন কিছু করা যাচ্ছে না,ভিডিও কলে বন্ধুদের সাথে টুকটাক কিছু কথা হয়।ইদানিং সাহরীর পরে কিছুটা সময় ছাদে কাটায় শাহীন।ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস,চারপাশের নিস্তব্ধতা ভালোই লাগে তার।সুবহে সাদিকের সময়টাতে এক অন্যরকম অনুভূতি খেলা করে,মনে হয় যেন সমস্ত শরীর হাল্কা হয়ে আছে ঠিক যেমনটা দেখা যায় মহাশূন্যে নভোচারীরা হাওয়ায় ভেসে থাকে।মাঝেমধ্যে রাহেলা বেগমের কাছ থেকে জিনিয়া আপার খবর নেওয়া হয়।আপার অবস্থা নাকি খুব বেশি ভালো না।
রাতুল অনেকদিন পর শাহীনকে কল দিয়েছে।বেশ অনেকদিন পর বন্ধুর কল পেয়ে শাহীনের বেশ খানিকটা হাল্কা লাগল,এর মধ্যে অনেকদিন ধরে রাতুলের সাথে যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায় না।কল দিয়ে রীতিমতো বোমা ফাটাল রাতুল,এত দিন সে কুর্মিটোলা হাসপাতালে ছিলো।করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে অনেকটা গা ঢাকা অবস্থায় ছিলো পাছে কেউ অযথা তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করে না করে,তবে আজকে তৃতীয়বারের রিপোর্ট এ তার করোনা নেগেটিভ এসেছে,এটা জানানোর জন্যই বন্ধুকে ফোন দেয়া
সব শুনে রাগ করবে নাকি আনন্দিত হবে বুঝে উঠতে পারল না শাহীন।পাগল নাকি তুই দোস্ত?রাতুল কে বেশ অনুযোগের সুরেই বলল শাহীন।তবে বিপদ কেটে গেছে এই স্বস্থির খবর।বন্ধুকে একগাদা উপদেশ দিয়ে আর অনেক্ষণ আড্ডা দিয়ে তবেই ফোন রাখল শাহীন
এদিকে দিন দিন জিনিয়ার অবস্থার অবনতি হচ্ছে।যদিও জিনিয়ার কোনো কো মরবিডিটি নেই তাও স্বস্থির সুযোগ নেই।করোনা ভাইরাস যেভাবে গিরগিটির মত এক দেশ থেকে আরেক দেশে রং পাল্টাচ্ছে তাতে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা কারো রেহায় নাই।
দ্বিতীয় বারের রিপোর্ট এ ও করোনা পজিটিভ এসেছে জিনিয়ার,ডাক্তাররা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে।এরমধ্যে আইসিইউ তে স্থানান্তর করা হয়েছে জিনিয়াকে।কোনো কিছুতেই কিছু হয়ে উঠছে না।রাহেলা বেগমের চোখের নীচে কালি পরেছে,দেখেই বুঝা যায় মেয়ের চিন্তায় খাওয়া ঘুম সব ছেড়ে দিয়েছেন।
শাহীন বিছানার এক কোণায় বসে মনোযোগ দিয়ে নখ কাটতেছিলো এমন সময় হঠাৎ করে রাহেলা বেগম শাহীন এর কাছে ছুটে এলো,তার আতংকিত চেহারা দেখে শাহীন ভড়কে গেলো।আপনি শান্ত হয়ে বসুন খালা এই বলে রাহেলা বেগম কে চেয়ার টেনে বসিয়ে দিলো শাহীন।তোর জিনিয়া আপার অবস্থা ত ভালো না হাসপাতাল থেকে ফোন করে বলল প্লাজমা না কি যেনো একটার থেরাপি দিয়ে শেষ চেষ্টা করে দেখবে।কিন্তু এখন পর্যন্ত এমন কাউকে নাকি পাওয়া যায় নাই
প্লাজমা থেরাপি কথাটার সাথে পরিচিত শাহীন।করোনায় আক্রান্ত কেউ যদি সুস্থ হয়ে উঠে তখন তার শরীরে এন্টিবডি তৈরী হয় মানে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য শক্তির সঞ্চার হয় একেই বলে কনভালসেন্ট প্লাজমা।এই প্লাজমা সংগ্রহ করে যদি আক্রান্তের শরীরে দেয়া হয় তাহলে করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক গুণে বেড়ে যায়,যদিও বা এটা এখনো ট্রায়াল অবস্থাতে আছে
শাহীন দ্রুত তার বন্ধুকে ফোন করে সব বুঝিয়ে বলল।রাতুল ও একবাক্যে রাজি হয়ে গেলো আর বলল ডাক্তার রা নিজেদের জীবন বাজি রেখে আমাদের সুস্থ করে তুলতে পারে আর আমি রক্তের সামান্য জলীয় অংশ দিতে পারব না?রাতুল কে ধন্যবাদ জানিয়ে হাসপাতালে ফোন করে রাতুলের ব্যাপারটা জানায় শাহীন।হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শাহীনের মাধ্যমে রাতুলের সাথে যোগাযোগ করে যাবতীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তবেই প্লাজমা সংগ্রহ করে এবং জিনিয়াকে তা দিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়।
বেশকয়েকদিন পর হাসপাতাল থেকে রাহেলা বেগমের কাছে কল আসে,ওপারে কথা বলছে তার মেয়ে জিনিয়া,মেয়ের কন্ঠ শুনেই ঢুকরে কেদেঁ উঠেন তিনি,দীর্ঘ দুইমাসের লড়াই শেষে তার মেয়ে আরোগ্য পেলো।এই কান্না আনন্দের কান্না,এই কান্না এক সংগ্রামি,সাহসী মেয়ের জন্য তার সাহসী মায়ের কান্না,এ যেনো একাত্তরের জাহানারা ইমামের সেই প্রতিচ্ছবি।জাহানারা ইমাম আজো বেচে আছেন সব সংগ্রামী,আত্তপ্রত্তয়ী,দৃঢচেতা মায়ের বুকে।