হঠাৎ বিকট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল রফিকের।তরিঘরি করে উঠে কালুকে ডাকতে লাগল।
“ ডিসটাব করিস্ না রফিক।“ কালু ঘুম ঘুম অবস্থায় বলল।
না! আবার দরাম দরাম কিসের যেন আওয়াজ।দিনভর মিছিল করেছে। তাই সবাই খুব ক্লান্ত।
আর দেরী না করে রফিক থ্রি নট থ্রি কাটা রাইফেলটা হাতে নিয়ে সবাইকে ফিস ফিস করে ডাকতে লাগল। তাড়াতাড়ি উঠ,নইলে আজ আর বাঁচা যাবে না।
সবারই ঘুম ভেঙ্গে গেল।পর পর বিকট শব্দে সবাই আতংকিত। এইবার কারো বুঝতে আর বাকী রইল না যে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নিরীহ বাঙ্গালীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
দিনটি ছিল ২৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। বাংলাদেশ স্বাধীন করার অভিপ্রায়ে সবাই যখন সোচ্চার,তখন ইয়াহিয়া খান বেপরোয়া হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানকে আটক করে পাকিস্তানের একটি জেলে বন্দি করে রাখে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র/ছাত্রীরা এর প্রতিবাদে ফেটে পড়ে।দিনভর মিছিল মিটিং করে সবাই যার যার ঘরে ফিরে আসে।
ইয়াহিয়া খান ক্রেধের বশীভূত হয়ে বাঙ্গালী জাতির উপর গভীর রাত্রিতে নিশংস হামলা চালায়।
আগে থেকেই কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিল রফিকের মত অনেকেই।।
রাত তখন প্রায় তিনটা। সবাই একসাথে যার যার মত দেশীয় আস্ত্র নিয়ে বের হয়ে পড়ল রাস্তায়।
পাক মিলিটারীরা অস্ত্রে সাজোয় গাড়ী নিয়ে রাস্তায় টহল দিচ্ছে। মাঝে মাঝে ফায়ার করে জনগণের মধ্যে আতংক সৃষ্টি করছে।বাসাবাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। বাসা থেকে লোকজনদের ধরে এনে সরাসরি গুলি করছে।
এগুলো রফিকদের সামনেই ঘটছে।পাকবাহিনীদের এহেন কর্মকান্ডে সবাই অবাক।
“এদেরকি দেশের প্রতি একটুকুও মায়া নেই।এই পাশন্ড র্ববচিত পশুরা তো দেশকে শেষ করে দিবে?“ফিস ফিস করে বলল রফিক।
খুব সংদর্পনে তারা একটু আড়ালেই অবস্থান নিয়েছিল।তবে মিলিটারীদের আনাগোনায় তারা কেওই ওখান থেকে বের হতে পারছিল না।মিলিটারীদের ভারী অস্ত্রের কাছে তাদের প্রস্তুতি ছিল অপ্রতুল।
তারা দেখতে পেল,মিলিটারীরা এক বাসায় ঢুকে পড়ল।একটু পরে মেয়েলী কন্ঠের আওয়াজ তাদের কানে ভেসে আসল। মেয়েটি বলছে আমার বাবা মাকে মেরো না। আমাকে ছারো । একটু পরেই গুলির শব্দ। সব যেন নিস্তব্দ হয়ে গেল নিমিষেই।
রফিক,কালুসহ ওরা ১১ জন ওখান থেকে পাক সেনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে শহর থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করল।ততোক্ষণে পাকবাহিনীরাও শহরের বাইরে অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত গাড়ী বহর নিয়ে সারিবদ্ধভাবে যাত্রা শুরু করেছে।
রাস্তায় যাওয়ার সময় মাঝে মাঝে ফাঁকা গুলি বর্শন করছে। রাস্তায় কোন কোন জায়গায় গাড়ী থামিয়ে বাড়ীঘর,দোকান পাঠে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে।
দেশের সাধারন জনগণ এমন অনাকাঙ্খিত পাকসেনাদের র্বরবচিত হামলার জন্য আগে থেকে কোন মানসিক প্রস্তুতি ছিল না।তাই রাত্রিতে এমন গুলির শব্দ এবং আগুনের লেলিহান শিখা দেখে জনগণের মধ্যে এক গভীর আতংক এবং ক্ষেভের সৃষ্টি হয়েছিল।সবাই ভয়ে বাড়ীঘর ছেড়ে পালাতে শুরু করেছিল।
রফিক সবাইকে ডেকে বলল, আমাদের এগুলো দেখে আর চুপচাপ থাকা চলবে না। পাকবাহিনীর সাথে সম্মূখ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হবে।নইলে আমাদের দেশ তো ধংস হবেই,মা-বোনদেরও ইজ্জত রক্ষা হবে না।দেশের জনগণকে সংঙ্গে নিয়ে ওদের বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে হবে।
রফিকরা রাস্তার পাশেই এক গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়ল, তখনও রাত্রি শেষ হয় নাই। গ্রামের লোকজন তাদের দেখে ডাকাত মনে করে সবাইকে ধরে ফেলল। কিন্তু ওরা ১১ জন তাতে ভয় পেল না ।ওরা বলতে লাগল, “আমরা ডাকাত নই।আমাদের কথা শুনেন।“
কে কার কথা শুনে। গ্রামের লোকজন তাদেরকে বেদম প্রহার করতে লাগল।প্রহারে তাদের পোষাক রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল। যতই বলে তারা ডাকাত নয়। ততই আরো মারতে লাগল।এক পর্যায়ে তাদের ভবলীলা সাঙ্গ হওয়ার উপক্রম হল ।এমন সময় গ্রামের এক বয়োজ্যেষ্ঠ লোক এসে জনগণের রোষানল থেকে এদেরকে বাঁচাল।
ওরা ১১ জনই মারের কারণে অবচেতন হয়ে পড়ে আছে।এমন সময় রফিক আস্তে আস্তে বলল, একটু পানি,একটু পানি।পাশের বাড়ীর এক মহিলার দয়া হল এবং তিনি এক গ্লাস পানি এনে দিলেন।
রফিক তখন একটু সুস্থ বোধ করল।তারপর আব্দুর রহমান নামের ঐ বয়োজ্যেষ্ঠ লোককে পূর্বদিনের ঢাকা শহরের ১৪৪ ধারা ভঙ্গের কাহিনী ও রাত্রিতে হঠাৎ পাকবাহিনীদের বর্রবরচিত হামলার কাহিনী বলল।পাকবাহিনীদের অপতৎপরতা রুখতেই তাদের এই বাহিনী জনগণকে সংঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সংঘবদ্ধ করতেই এই গ্রামে আগমন।
অবশেষে গ্রামের লোকজনদের ভুল ভাঙ্গল।দেশে এমন কিছু ঘটার জন্য অনেকেরই পূর্ব থেকেই প্রস্তুতি ছিল।দেশীয় কিছু অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে ওরা ১১ জনসহ গ্রামের সাহসী জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে পাকবাহিনীদের প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নিল।
পাকবাহিনীরা রাস্তার পাশের বাড়ীঘর এবং বাজারের দোকানপাঠ আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে, দোকানের মালামাল রাজাকাররা লুটপাট করে নিয়ে যাচ্ছে । এদের বিভিন্ন অন্যায় কর্মকান্ড দেখে গ্রামের সবাই অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল।
অতপর রফিকের নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন সাহসী যুবক দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত অবস্থায় সামনের একটা রাস্তার বেলিী ব্রীজের নাট বল্টু খুলে ফেলল।ঐ রাস্তা দিয়ে পাকবাহিনীরা শহর খেবে বেরুয়ে আসছে।
“তোমরা সব এদিকে জংগলের ভিতর এসো। নইলে দেখে ফেললে বিপদ হবে। ওরা আমাদের শত্রু,দেশের শত্রু, ওদের সাথে মুক্তির জন্য যুদ্ধ করতে হবে। ওদেরকে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যেতে বাধ্য করতে হবে।“বলল রফিক।
পাকবাহিনীর গাড়ী ব্রীজের দিকে আসতে দেখে সবাই যখন দৌড়ে পালাচ্ছিল,তখনই পাকসেনাদের নজরে পড়ল ওদের গতিবিধি।
তখন পাকবাহিনী ওদের দিকে গুলি বর্ষণ করল। মূহুত্বেই গুলি লেগে কালু মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। আর সবাই পাশের জংগলে লুকিয়ে পড়ল। পাকসেনারা গাড়ী থামিয়ে কালুর নিকটে আসল। কালু তখনও ছটফট করছে আর বলছে “পানি“ “পানি“। আমাকে একটু পানি দাও।
পাকসেনারা গাড়ী থেকে নেমে এসে কালুর বুকে লাথি মারতে লাগল। যখন কালু আর নড়াচড়া করছে না অর্থাৎ মৃত্যু নিশ্চিত জেনে সবাই গিয়ে গাড়ী উঠল।
রফিক একটা গ্রেনেট হাতে ব্রীজের খুব কাছাকাছি অবস্থান করছিল আর পাকসেনাদের কর্মকান্ড লক্ষ্য করেছিল।
পাকসেনাদের গাড়ী ব্রীজে উঠতেই হুড়মুড় করে ব্রীজ ভেংগে নীচের পড়ে গেল। অমনি রফিকও ওদের উপরে গ্রেনেট ছুঁড়ল।
দেখেতে দেখতে গাড়ীতে আগুন ধরে গেল । রফিক দৌড়ে ওখান থেকে নিরাপদ দূরে এসে সংঙ্গীদের খুঁজতে লাগল।অবশেষে সংঙ্গীদের খুঁজে পেল।
“তাড়াতাড়ি চল সবাই।“কালুর অবস্থা ভাল নয়।“বলল রফিক।
সবাই হতসংকিত চিত্তে রফিকের মুখের দিকে চেয়ে রইল।এভাবে যে পাকসেনাদের ধংস করা যাবে তা কেওই কখনই ভাবে নাই। এসব বুব্ধি সব রফিকের । পাকসেনাদের সাথে আমাদের দেশীয় অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করে হটানো যাবে না।বাঙ্গালীদের বুদ্ধিবলে দু:সাহসের মাধ্যমে মুক্তির জন্য যুদ্ধ করতে হবে।
রফিকের মত বুদ্ধি খাটিয়ে দু:সাহসের মাধ্যমে যদি বাঙ্গালী জাতি মুক্তির জন্য যুদ্ধ করতে পারে তবেই দেশ স্বাধীন করা সম্ভব।
রফিক সবাইকে সংগে নিয়ে কালুকে খুঁজে বের করল। কালু তখনও বেঁচে আছে। তাকে নিয়ে অনতিদূরে একটি ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়া হল। ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বললেন,কালুকে রক্ত দিতে হবে। তাকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াও তো কঠিন। চারিদিকে মিলিটারীর গাড়ী এদিক ওদিক আসা যাওয়া করছে।
রফিক একটা ভ্যানে করে কালুকে নিয়ে অদূরে একটি হাসপাতালে রওনা দিল।এমন সময় একটি মিলিটারীর গাড়ী এসে ভ্যানের পাশে দাঁড়াল।
“এধার মে আও“একজন মিলিটারী গাড়ী থেকে বলল।
রফিক ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল মিলিটারীর গাড়ীর দিকে।
কাছে গেলে আবার বলল, “তুমি কি মুসলিম হায়?“
মাথা নিচু করে রফিক বলল, “হুম।“
“ভ্যানে কে হায়?“ মিলিটারী বলল।
“অসুস্থ রুগী হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি হায়।“রফিক বলল।
তারপর গাড়ী ছেড়ে মিলিটারী চলে গেল।
রফিক কালুকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করল।কালু একটু সুস্থ হল।
কালুকে হাসপাতালে রেখে রফিক সাথীদের কাছে রওনা দিল। পথে আবারও মিলিটারীদের গাড়ী আসতে দেখে রাস্তার পাশে রফিক গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল।একটি গ্রেনেট তখনও রফিকের কাছে ছিল।
রফিক মনে মনে সংকল্প করল,এইবার গাড়ী আসলে কাছে রাখা গ্রেনেটটি ছুঁড়ে মারবে। যেমন কথা তেমন কাজ। ইতিমধ্যেই একটি মিলিটারীর গাড়ী আসার সাথে সাথে রফিক প্রাণের ভয় না করে গ্রেনেট ছুঁড়ে মারল।অমনি গাড়ীটি উল্টে গেল এবং আগুন ধরে গেল।মিলিটারীরা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ছটফট করতে লাগলো।
রফিক প্রাণপণে ওখান থেকে ছুঁটে পালালো।রফিকের এই দু:সাহস দেশের মুক্তির জন্য এক অন্যন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।
দেশের মুক্তির জন্য চেতনার কারনেই এই দু:সাহস। শুধু রফিক নয় দেশে রফিকের মত অনেকেই পাকবাহিনীদের ঐ রাত্রিতে আকস্মিক হামলার কারণে দেশ স্বাধীন করার অভিপ্রায়ে মরিয়া হয়ে উঠেছিল।ঐ রাত্রি ছিল বাঙ্গালী জাতির জন্য একটি কালো রাত।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
রফিকের মত দেশের অনেকেরই দু:সাহস থাকার জন্যই দেশ আজ মুক্ত।পাকবাহিনীদের অকস্মাৎ ২৫ মার্চ ১৯৭১ রাত্রিতে বাঙ্গালী জাতির উপর হামলা করার কারনেই বাঙ্গালীজাতি ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করে দেশকে পরাধীনতার গ্লানি হতে মুক্ত করেছে।সেই কালরাত্রিতে ন্যাক্কারজনক হামলার কাহিনী এই গল্পে ফুটে উঠেছে।
২০ মে - ২০২০
গল্প/কবিতা:
৪৪ টি
সমন্বিত স্কোর
৪.৯৭
বিচারক স্কোরঃ ২.৫৭ / ৭.০পাঠক স্কোরঃ ২.৪ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।