বুঝল না—
মনের দরদ কেউই বুঝল না
এ সংসারে কেউ কারে বুঝে না,
বুঝতে চায় না
ছোটবেলায় মার সাথে কত গিয়েছি নানার বাড়ি
এখানে-ওখানে কত শোনেছি আদেশবাণী—
তুমি ছোটমানুষ বড়দের কাছে বসতে নেই,
বড়দের কথা শোনতে নেই।
এ কথাটাই শোনেছি বেশি
আজও বুঝি নি কথাটার প্রকৃত অর্থ কী
কত শালিসবিচার
গ্রামের কত ঝগড়াঝাটি
কত দেখেছি...শোনেছি...
বুঝার অনেক চেষ্টা করেছি
শুধু ‘আপনবাঁচা’ বুঝেছি—
সাপ মরুক না আঘাতে কেউ পার হচ্ছে
কেউ সত্য বললে কেউ টুঁটি ধরছে তার
তামাশা দেখাতে কেউ আগুনে দিচ্ছে তেলের ছিটা
কেউ দুমুখে ফুঁকছে দুদলে কানপড়া
তুমুল তর্কে কেউ কেউ পক্ষাবলম্বনে কথা বলছে পাক্কা বেইমান
মারমুখো কেউ কেউ গালাগালি আর হাতাহাতিতে উপক্রম
বিবাদের লেঠা বিবাদেই রইল—হল না এতটা মীমাংসা
চলল আরো বেড়ে
কেউ কারে পুছলে মিলছে সান্ত্বনা—
তোমরা অইসব বুঝবে না।
সত্য বলতে পারে না এমন দুর্বল ইমানের প্রতি ‘আফসোস’
সত্য বলতে পারে না এমন বাকশক্তিহীন মানুষের প্রতি ‘আফসোস’
আফসোস! আফসোস!!
তখন আমার বয়স কি—আট কিবা নয়
আজ আটান্ন বছরের বয়সী আমি
এখনো বুঝতে পারি না এবং পারছি নে
মানুষ কেন তুচ্ছ বিষয়ে লড়াই করে
একটুকিছুতে লাঠালাঠি ও রক্তক্ষয়ী দাঙ্গাফ্যাসাদে নেমে আসে
জায়গাটা অবিকল খিল আজও পড়ে আছে
আলটা এখনো বাঁকা রয়ে গেছে
যার জন্যে সেই আটচল্লিশ বছর আগে
মারা গিয়েছিল আফিদের বাবা গোবিধন
আর সামন্তাদের দাদা সুমনশেঠ
আজও অমন অনর্থের লড়াই দেখি!
‘হৃদ্যিতা’ অর্থাৎ ছোটখালার বিয়ে
সবাই যার যার কাজে, খোশমেজাজে ও গল্পগুজবে মশগুল
এককোণে চুপটি করে বসা ছোট্ট বাবুটিরে কেউ দেখে না
পুছে না ‘বাবু কিছু খেয়েছ কি? খাবে নাকি?’
বড়রা বড়দের খাতিরদারিতে ব্যস্ত—
দাদা এসেছেন? আসুন আসুন—এখানে বসুন
বিনয়, দাদার জন্যে...
দাদা খুব নামি মানুষ
ভিতরঘরে আরো জলুস—
মেঝবু, আর কিছু খাবে? চা আরেক কাপ দি?
‘নারে সানু বরং আমায় আরেক খিলি পান দে
আমাদের মহেষখালির পানগুলোনা—তুলনা হয় না’
মেঝ আপার স্বামী অনেক বড় পয়সাওয়ালা
ওদিকে খাওয়াদাওয়া প্রায় শেষের দিকে
কেউ কেউ চলেও যাচ্ছে
বিদায়ের মুহূর্ত—
একটা সিগারেট নিন্ বেয়াই সাহেব
মাথাধরাটা একটু হালকা হয়ে আসবে
কী দেখছেন?
বিলেতি ব্র্যান্ড—সেন্ট একেবারে আলাদা
ওসব তখন বুঝি নি
সামর্থ্যবানদের কাতিরদারি
সেই আদিকাল থেকেই চলে আসছে
আজও চলছে
চলবেই...
তবে¬—
চোখের সামনে কতটা বছর চলে গেল
বয়স বাড়ল মনে হয়
ছোটমানুষ বড় হলাম নাকি
বউ এল ঘরে
তারপর এক-দুই-তিন-চার ছেলেমেয়ে
ঘর ভরে গেল হইহুল্লোড়ে
ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে
হল—
কেউ বিএ ত কেউ এমএ
পরামর্শ এখন তারাই তারাই চলে—
যা ভুল করেছি নাকি এ জীবনে
মাশুল গনতে গেলে দশ জনম যথেষ্ট নয়
আমার মতো ভুল বোকাও করবে না নিশ্চয়
‘তুমি বুঝবে না বাবা’
কথায় কথায় আজকাল আমি কিচ্ছু বুঝি না
যাক গে...
মেয়ের বিয়ে হল সম্ভ্রান্ত ঘরে—বিরাট পরিবারে
বছর দুয়েক কেটেছে
আসা-যাওয়ায় জেনেছি খুব সুখে আছে
মনটা ভরে যায় শান্তিতে
একদিন বড্ড ইচ্ছে হল মেয়েটিকে দেখতে
দেখলাম—
শ্বশুরশাশুড়ি যেমন তারচেয়ে জামাই আর ভাইয়েরা
হরদম টুকিটাকি চলছে ত চলছেই
বললাম, এ কেমন কুলীনতা?
এখানেই ত বড় যুদ্ধের বার্তা...
মেয়ে বলল ‘তোমার বুঝার দরকার নেই বাবা’
দুঃখটা রয়ে গেল এখানে—
আমি ত চাই নি কারো কাছে কিছু পেতে
অর্থকড়ি—এতখানি ধনসম্পদ
চাই নি কারো কাছে গিয়ে হাঁটুগেড়ে খেতে
হাঁ, চেয়েছি একটু আদর-মহব্বত
পাই নি বলে দুঃখ আছে—দুঃখিত নই
জীবন আসলেই বিচিত্রময়—
আমার জীবনটা কেটেছে ভাগ্যের বড় নির্মম পরিহাসে
যাকেই আপন মনে করেছি তাকেই রূপ পাল্টাতে দেখেছি
যাকেই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছি সে-ই মেরেছে পিঠে ছুরি
আত্মীয়স্বজন থাক গে—ভাইবন্ধু কেউই আপন নয়
এটাও জানি—
কেউ আমাকে নিয়ে বিব্রত থাকতে আসে নি ধরায়
আমিও মানি—
আমিও কাকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকতে আসি নি জগতে
এ পৃথিবীটা নিজের নিজের চিন্তক
নিজের নিজেরই মঙ্গলের সাধক
মানুষ কেবলই নিজের ভাল বুঝে
নিজের ভালর ভিত্তিতে চলে
স্বার্থ যেখানে বড় নয় সেখানে কেউই পা রাখে না
আমার বুঝতে দেরি হল বটে
সব বেদনা ভুলে
বাকি জীবনটা কাটাতে চেয়েছিলাম...
হঠাৎ ‘সান্ত্বনা’ চলে গেল পৃথিবী ছেড়ে
আমি বিমর্ষ—রয়ে গেলাম নিরানন্দের কৃষ্ণকুটিরে
নির্জনতা আমায় গ্রাস করেছিল বলে...
তারপর ছেলের বউ এল ধুমধামে
মনে করলাম, আবার ভরে উঠবে সেই ভরপুর কোলাহলে
আস্তে আস্তে সংসারের সৌন্দর্য ফুটে উঠছে বিষণ্নতার রঙে
আমার স্থান হয় ভবঘুরে
ঘুরতে ঘুরতে কোথায় এলাম কে জানে
আর পারছি নে সামনে যেতে
ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত ও রোগাক্রান্ত দেহের প্রতিটি অঙ্গ মনে হচ্ছে বিকল
এ অশ্বত্থের ছায়াতলে অনুভব করছি কিছুটা শান্তি—একটু সোয়াস্তি
সামনে যত দেখছি ধু-ধু মাঠ
পিছনদিকে বহতা নদী
মাথার উপর নিঝুমদুপুর
চার দিকে খাঁখাঁ শূন্যতা
শুধু শোনছি পাখিদের চেঁচামেচি
মনে পড়ছে...
চোখের সামনে ভেসে উঠছে আবছায়াটা
সেই কৈশরের দিনগুলি—
খেলাধুলা
দুরন্তপনা
মান-অভিমান...
‘অই গাধাটারে পুছ কী, সে কী বুঝে বেঙের ছাতা কী’
অর্ধছুটিতে কিবা শেষছুটির পরে
স্কুলের পশ্চিমের বটতলে সেকি জমত আড্ডাআড্ডি
মনে পড়ছে বালকবেলার স্মৃতি
মনে পড়ছে বন্ধুবান্ধবের কথা
দেখতে বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে কারে কারে
জানতে বড় ইচ্ছে হচ্ছে সকলের কথা
সবার কথা মনে পড়ছে
সবার জন্যে প্রাণ কাঁদছে
কে কেমন সুখে আছে জানি না
প্রার্থনা করি সুখী হোক সকলে
তবে—
আমার মতো জিন্দেগি না-হোক কার কবে
এবার চোখের পাতা জানি বন্ধ হয়ে আসছে
কে যেন আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে...
চারি দিকে অন্ধকার আর অন্ধকার।
“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।
প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী