শেফালির প্রত্যাশা

প্রত্যাশা (আগষ্ট ২০২০)

শাহনাজ বেগম
  • ২৮
এক
শেফালি অনেক দিন থেকে আশা করে আছে বোনের ছেলে আসরাফের সাথে মেয়ের বিয়ে দিবে । একথা সবাই জানে । এ জন্য চলাফেরা দেওয়া নেওয়াও বেশ চলে । কিন্তু সমস্যাটা হলো একজায়গায়, আসরাফের চাকুরি বাকরি এখনও হয়নি ।
ওর মা বাবা নেই জমিজমা নেই এমনকি শোয়ার মত ঘরটাও নেই । বাবার রেখে যাওয়া যে মাটির ঘরখানা ছিল তাও অযত্নে বৃষ্টির পানি পড়ে বছর খানেক হলো ভেঙ্গে পড়েছে । বাড়ির ভিটাটায় যা দু এক শতক ভাগ পাবে তাই । জমিজমা যা ছিল বাবা বিক্রি করে বোনদের বিয়ে দিয়েছে । ভাইয়েরা আছে তো কে কার । নিজ নিজ সংসার নিয়ে ব্যাস্ত । মেজ ভাইভাবি তো আরো দুশমন বাপের যে টুকু অবশিষ্ট ছিল তাও লিখে নিয়েছে ।
চোখ অপারেশন করতে গিয়ে মেজভাইভাবি বাবাকে বলেছিল -বাবা এখানে স্বাক্ষরদাও , চোখ অপারেশন করতে স্বাক্ষর লাগবে । বৃদ্ধ স্বাক্ষর দিয়েছিল। পরে যখন তা জানাজানি হলো তখন আর তা ফিরিয়ে নেওয়ার সময় হলো না বাবা মারা গেল।
আসরাফ আগে মনে করত - যে ভাবে লেখাপড়া করছি এম এ পাশটা করলেই চাকুরি ।
কিন্তু বাস্তবে তা নয় । এ যে সোনার হরিণ অক্ষরে অক্ষরে সে টের পেল ।
সরকারি চাকুরি পাওয়ার বয়স তার প্রায় শেষের পথে । এর মধ্যে করোনা ভাইরাস এসেছে । লক ডাউন চলছে । পৃথিবীটা যেন স্থবির হয়ে পড়েছে । আসরাফ ভেবে পায় না সে কি করেবে ।
পরের ছেলেকে প্রাইভেট পড়িয়ে যে টাকা হত তাও তো আর হয় না ,কারণ স্কুল কলেজ বন্ধ ।
এই দুর্দিনে অনেক চিন্তা ভাবনা আগাছার মত হয়ে মনে গজিয়েছে তার । যা এক সময় গভির অরণ্যের মত রুপ ধারন করল ।জীবিকার পথগুলো ক্রমশ শরু হতে হতে নিশ্চিহ্ন হওয়ার উপক্রম হলো । পথ হারা পথিকের মত সে বুদ্ধির খেই হারিয়ে ফেলল ।
এখনও মেসভাড়া কয়েক মাসের বাকি ।কতদিন যে স্কুল কলেজ বন্ধ থাকবে তা আল্লাহই জানেন ।
এমন দূর্দিনে খালা আর খালাত বোনের কথা বার বার মনে পড়ছে তার । খালা কত আশা করে আছে চাকুরি হলেই বিয়ে।
আসরাফ এক সময় খালাত বোন রিক্তাকে ফোন দিল ।
বলল- খালাকে বলিও যদি দশলাখ টাকা দেয় তাহলে তোমাকে বিয়ে করব । আমার যদি কিছু থাকত তা হলে টাকা চাইতাম না ।এই টাকা দিয়ে কোন ব্যাবসা করব না হয় কোন লোক পেলে চাকুরির জন্য ধরা ধরি করব, একটু বুঝিয়ে বলিও ।
রিক্তা – আপনি বলবেন ।
আসরাফ - আমি সরা সরি বলতে পারছি না ।তুমি বলিও ।
রিক্তা বলল- আচ্ছা ঠিক আছে বলব , কিন্তু যদি না দেয় ?
আসরাফ – না দিলে বিয়ে করব না , যেখানে পাব সেখানে বিয়ে করব ।
রিক্তা মাকে সব বলল ।শেফালি বলল- কোথায় পাব দশ লাখ টাকা?
ভিটা মাটি সব বেচে ওকে দিব তাহলে আমিইবা কি খাব , আর বড়টাকেই কি দিব ?
রিক্তা বলল - এই কি তোর ভালোবাসা ?তুই নাকি তোর খালাকে মায়ের মত ভালোবাসছিলি , তো কই ?
শেফালি বোনের ছেলের পক্ষ নিয়ে বলল- শোন , শোন , এমনি টাকা চায় নি - দুঃখে টাকা চাইছে । মাও নাই বাপ নাই ভিটা মাটি জমি জায়গা কিচ্ছু নাই ,ডিমান চাইবে না তো কি করবে ?

রিক্তা ভাবতে থাকে এখন কি করবে সে ? সবাই জানে আসরাফের সাথে তার বিয়ে হবে । বান্ধবিরা কত বলেছে আসরাফের বৌ । এখন কি বলবে ওরা । ওর আশাতে সে রেসেলকে ভুলেছে ।
এসব ভাবতে ভাবতে এক সময় সে জ্ঞান হারালো । এরকম সে আরো কয়েকদিন হয়েছিল । এখলাস মুন্সি এসে ঝাড় ফুঁক করে ভালো হয়েছে । এখন গভির রাত কেমন করে সেফালি যাবে তাকে ডাকতে । পুরুষ মানুষকে কি এত রাতে ঘরে ডাকা যায় ? মানুষ কি ভাববে । তা ছাড়া এই করোনা পরিস্থিতিতে আসবে কি ?
সে অসুস্থ মেয়ের পাশে জেগে বসে রয়েছে । কতবার ডাকছে না রিক্তা শোনে না , মনে হচ্ছে কখনবা জীবণটা বেরিয়ে যায় । এক সময় সে আর নিজেকে সামলিয়ে রাখতে পারল না । জোর গলায় কাঁদতে সুর করল । বড় মেয়েটাকে কল দিবে তো ফোনেও টাকা নেই । কল দিলেই বলছে দুঃখিত টাকা নেই ।দয়া করে রিচার্জ করুন । শেফালির ইচ্ছাকরছে মোবাইল টা পাক মেরে ফেলে দেয় ।
এমন সময় কি যেন কি ভেবে শেফালির বড় মেয়ে রেহেনা ফোন দিল । শেফালি বলল – হ্যালো !
রেহেনা – ভালো আছিস মা ।
শেফালি – ভালো নাই রে বাছা , ঐ তো রিক্তা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে । ওকে নিয়ে বসে আছি ।
রেহেনা – ডাক্তার কি কবিরাজ কে ডাকিস নি ।
শেফালি- না রে বাছা । কোথায় পাব এত রাতে ।
রেহেনা – থাম , কাকো না পেলেও তো হোসনেয়ারা আপাকে পাব ।
সে হোসনেয়ারাকে ফোন দিয়ে তাদের বাড়িতে যেতে বলল। হোসনেয়ারা বলল- ঠিক আছে রাখ আমি দেখছি ।
হোসনেয়ারা ও তার স্বামি রিক্তাদের বাড়িতে এল । তারা নানা ভাবে রিক্তার জ্ঞান ফিরানোরর চেষ্টা করতে লাগল ।
একটু পরেই রিক্তা উঠে বসল ।বলল- মা পানি দাও পানি খাব ।
রিক্তা পানি খেয়ে শুয়ে পড়ল ।
হোসনেআরা বলল- ওকে ভাত খাওয়াও । অনেক রাত হয়েছে আমরা বাড়ি যাই ।
শেফালি বলল- যাও ।
রিক্তা মায়ের অনুরোধে কয়েক গ্রাস ভাত খেয়ে শুয়ে পড়ল ।
সে শুয়ে শুয়ে ভাবে এতদিনের আশা টাকার জন্য চুরমার হয়ে গেল !কোথায় পাবে টাকা সে ।
রিক্তার মনে পড়ে আসরাফের মা যখন অসুস্থ হয়ে পড়েছিল মার হাত ধরে বলেছিল আমার আসরাফ কে মায়ের মত করে দেখিস । রিক্তার সাথে বিয়ে দিস । আমি তো আর দেখে যেতে পেলাম না ।
সেই থেকে চলছে এই আশা তা তো দশ বছর হবেই । রিক্তা তখন ক্লাস ফোর কি ফাইভে পড়ত ।
রিক্তার মনে পড়ে আস্রাফের সাথে স্বপ্নপুরীর পার্কে বেড়াতে যাওয়ার কথা । আহা কত না আনন্দে কেটেছিল দিনটা । আসরাফ তাকে মালা কিনে দিয়েছিল ।একজোড়া দুল কিনে দিয়েছিল । কানের কাছে ধরে বলেছিল তোকে বেশ মানাবে তুই নে । রিক্তা দুলগুলো নিয়েছিল । এখনও সেগুলোয় আছে । কি সুন্দর পুতি দিয়ে গাঁথা ।
মনে পড়ে আসরাফের সাথে নাগর দোলায় আর দোলনাতে দোলার কথা । নাগরদোলা যখন উপরে উঠছিল রিক্তাকে ভয় লেগেছিল আসরাফ তাকে চেপে ধরেছিল ।
রিক্সায় উঠে কেমন জড়িয়ে ধরছিল যাতে সে না পড়ে।
আহা এত ভালোবাসা গেল কোথায় ?টাকার জন্য সব শেষ ।
আহা কি কান্ডটায় না করেছিল স্বপ্নপুরী থেকে ফিরে এসে সেই রাতে । মা ঘুমিয়ে পড়েছিল আর আসরাফ কেমন ওড়না ধরেবিছানায় টানছিল । রিক্তা জোর করে ছেড়ে নিয়ে মায়ের ঘরে খিল এটে দিয়েছিল । রিক্তা যদি চিতকার করত তাহলে লোকজন জমায়েত হয়ে সে দিনেই বিয়ে পড়েদিত ।সেটায় ভালো হত , এখন কেমন এত টাকা চায় ।
রিক্তা আবার ভাবে - না বিয়া করবি নাই, তোর চেয়ে রাসেল অনেক ভাল । তোর তো অনেক বয়স হয়েছে , ত্রিশ বত্রিশ বছর তো হবেই । মাথায় নদীর চরের মত টাক পড়েছে আর রাসেল কেমন লাউয়ের কচি ডগার মত লক লক করে বাড়ছে রঙ টাও কি সুন্দর উজ্জ্বল । রাসেল এখনও আমায় ক্ষমা করবে ।
রিক্তা সাবধানে মায়ের শিওর থেকে মোবাই্ল ফোনটা তুলে নেয় । ফোন টিপে রাসেল কে ফোন দেয় । কিন্তু কয়েকবার দেওয়ার পরেও যখন উত্তর পেল না মন খারাপ করে শুয়ে পড়ল ।
রিক্তা ভাবে – তা কি আর হয় ? রাসেল যে মারটায় না সে দিন খেয়েছিল আমার জন্য । সেকি আর ফোন ধরবে ?
একদিন রাসেল আর রিক্তা স্কুল থেকে আসার পথে এক ঝোপে বসে কথা বলছিল কয়েকজন ছেলে ধরে রাসেলকে কি মারটায় না মেরেছিল । বয়স আঠারো হলে সে দিনই দুইজনের বিয়া পড়ে দিত । বয়স আঠারোর কম বলে মোবাই ফোনটা কেড়ে নিয়ে বিদায় দিয়েছে । সে দিন থেকে রা্সেল আর রিক্তার ছায়াও মাড়ায় না ।
রিক্তা এক ক্লাস ফেল করায় আর রাসেল পাশ করায় রাসেলের সাথে আর দেখাও হয় না । দেখা হলেও কথা হয়না ।
এ সব ভাবতে ভাবতে রিক্তা এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল ।
দুই
সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠতে রিক্তার একটু দেরিহলো। উঠান ভরা রোদ- মনে হয় না যে পৃথিবীটা এক সময় আঁধারে ঢেকে গিয়েছিল বা আবার ঢাকবে । ইতি মধ্যে মায়ের রান্নাবান্না শেষ হয়েছে ।
রিক্তা যখন বিছানা গোছাচ্ছিল । মা বলল- মুখহাত ধুয়ে খেয়ে নে রে মা । তারপর গরুগুলো মাঠে নিয়ে চল তো ভালো করে খাইয়ে দেখি কি হয় ।দরকার হলে বাড়িঘর বেচে আসরাফের সাথে তোর বিয়া দেব , নিজের জীব্নে যা হয়েছে হয়েছে মেয়েদের জীবণে হতে দেব না আমি ।বড়টার বিয়া দিয়াছি দিয়াছি তোর আর মুর্খের সাথে বিয়া দিব না এতে আমার কি হয় হোক । আমার ভাগে আল্লাহ আছে ।
রিক্তা বলল – হয়েছে , হয়েছে , তোর বোনের বেটার কথা আর বলিস না তো , ওর কথা আর শুনতে ইচ্ছা করছে না ।
মা – রাগ করিস না করিস না শোন, এতবড় একটা লেখাপড়া ছেলের কি মূল্য নাই ?
রিক্তা আর কিছু বলে না ।খাওয়াদাওয়া সেরে গরুনিয়ে মায়ের সাথে মাঠে চলল ।
মা সব সময়েই গরুর সাথে কথা বলে কালোগরুটা একটু টানে বেশি । বলল – থাম থাম তোকে বেচব থাম , আল্লাহ করে খোদায় করে তুই এমন ঘরে যাস যেনে তোকে না খাইয়ে বেধে রাখে ।
লাল গরুটাকে বলল- খা খা ঘাসগুলো কি দেখতে পাস না ? তোর কি চোখ কানা হয়েছে ?
বাড়িফিরে শেফালি প্রতিবেশি হোসনেয়ারার কোন গরুছাগল নাই তাই তার বাড়িতে একটা বালতি নিয়ে গেল । বলল- তোমার মাড়পানি এটেঝুটেগুলো দিওতো গরুগুলোকে আমাও খাওয়াব ।
হোসনেয়ারা বলল – ঠিক আছে নিও ।
শেফালি গরুগূলোকে খাওয়ায় আর নিজের জীবন নিয়ে চিন্তা গবেষণা করে । মাঝে মাঝে মেয়ের জীবণের সুখের স্বপ্ন দেখে । নিজের জীবণে কি কাহিনীটায় না ঘটেছে ।বাবা ছিল বাহাতারা সব সময় হাটেবাজারে থাকত আর তাকে সৎ মায়ের কাছে থাকতে হয়েছে । সৎ মা টাকার ভয়ে এক বুড়োর সাথে বিয়ে দিয়েছিল । কয়েক বছর পর বুড়ো তো গেল মরে এখন সারাটি জীবণ একা একা কাটাতে হচ্ছে । আল্লাহ তো তার কোলে একটা ছেলেও দিল না ।না হোক মেয়ে তো হয়েছে । বড় মেয়েটা অতটা সুন্দর নয় এ মেয়ে তো সুন্দর । টাকা পয়সা লাগে লাগুক মেয়ে তো সুখি হবে । তার মত তো আর গরু ছাগল পুষতে হবে না ।
কিন্তু রিক্তার মন মোড় নিয়েছে আবার রাসেলের দিকে । সে বিলের ধারে গরুকে ঘাস খাওয়ায় আর রাসেলের পথের দিকে চেয়ে থাকে কিন্তু কই একদিনও তো দেখা হলো না ? স্কুল খোলা থাকলে না হয় দেখা হত ।সে মনে মনে বিরিক্ত হয়ে বলল- কিশের যে লক ডাউন শুরু হয়েছে কবে যে শেষ হবে ? কেমন করে যে করোনা ভাইরাস দুনিয়ায় এলো ।
আবার ভাবে গ্রামের ছেলেরা মোবাইল কেড়ে নিয়েছিল হয়তবা আর কিনতে পারেনি সে জন্য আর ফোনও দেয় না ।
সত্যি সত্যিই একদিন দেখাহলো রাসেলের সাথে সেও গরু চরাতে এসেছিল কিন্তু ভয়ে কথা বলল না যদি ফের সেদিনের মত কেউ দেখে ফেলে ।তবে রাসেল একটা গরুকে মারতে মারতে বলল – আর কত দূরে দূরে থাকবি ?
এ কথা যে কাকে বলল রিক্তা বুঝতে পারল কিন্তু তার মুখ ফুটল না ।
সন্ধ্যায় রিক্তা আবার মুর্ছা গেল । প্রতিবেশিরা এল চাচা চাচি এল এনামুল মুন্সি অনেক ঝাড়ফুক করল না কিছুতেই কিছু হলো না । শেষমেষ তাকে মিন্টু কবিরাজের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো । কবিরাজ বলল তাকে করনী করা আছে আর কিছু ভুতবাতালীও আছে যা কিনা এমন করছে ।
শেফালী বলল – কথা ঠিক , একদিন ওই রাসেইলা লাল কাগজে কি লিখে পানিতে তা ধুইয়ে ওর বান্ধবীদের দিয়ে খাইয়েছিল ।আর এই কিছুদিন হলো যখন ছেলেধরা বেরিয়েছিল মাঠে গরু আনতে গিয়ে একটা মানুষের হাতে বড় হাইসা দেখে পালিয়ে এসেছিল । এখন সেটা মানুষ কি ভুত আল্লাহপাকই জানে ।
কবিরাজ বলল- দেখ আমি কি মিথ্যা বলেছি ?
তারা তেল পড়া পানি পড়া নিয়ে বাড়ি ফিরল ।
পথে আসতে আসতে ভ্যানে ওর জ্ঞান ফিরল । বলল- মা কোথায় গেছিলি ? ভ্যানে কেন?
মা বলল- তুই যে জ্ঞান হারাইছিলিরে বাছা , তাই তোকে মিন্টু কবিরাজের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম । এখন বাড়ি যাছি ।

তিন
আসরাফ যেদিন রিক্তার ওড়না ধরে টেনেছিল সে দিন থেকে কি যে হয়েছে মন সব সময় রিক্তার দিকে টানে । সমুদ্র যেমন টানে নদীকে লোহা টানে চুম্বুককে ।রাতে ঘুমাতে গেলেই রিক্তাকে স্বপ্ন দেখে । এই স্বপ্ন থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য বিয়ে করা আবশ্যক বলে সে মনে করল । সে মেস থেকে গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেল । ভাবিদের বলল - বউ দেখ বিয়ে করব ।
ভাবিরা বলল – কেন রে তোর আবার কি হলো , বউ তো দেখায় আছে ।
আসরাফ – ওখানে বিয়ে করব না আমার টাকার দরকার । চাকরি হলোনা ব্যাবসা করব নাহয় চাকরির জন্য কোন লোক ধরব ।
ভাবি – বউ ফের পাওয়া যাবে না ! কত বৌ আছে ।
কয়েকদিন পরে সে ভাবিকে নিয়ে বৌ দেখতে গেল। কথা বার্তা এক রকম ঠিক ঠাক । দশ লক্ষ টাকা দিবে তো দিবে গয়না পত্রও দিবে ।
বৌ সেজগুজে সমনে এসে বসল বিরাট মোটাসোটা সে বউ ।বয়স তো আসরাফের চেয়ে বেশি হবেই । গায়ের রঙ হাঁড়ির তলার কাছাকাছি ।
ওরা সময় চেয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরল । ঘটককে বলল আরেকটি দেখ যেন একটু পাতলা পুতলা হয় ।
এবার যে বউটা দেখল একটু সুন্দর বটে তবে খোজ নিয়ে দেখা গেল বৌয়ের আরেকবার বিয়ে হয়েছিল ।
আসরাফ যখন ঘটকের উপর রেগে গেল ঘটক বলল – তোমাকে মানুষ ভালো মেয়েও দিবে আবার টাকাও দিবে নাকি ?
আসরাফ বলল - যা শালা বিয়াই করব না । কিন্তু এভাবে আর কত দিন চলে । পৃথিবীর সব কিছুকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা যায় কিন্তু মনকে তো আর ধামাচাপা দিয়ে রাখা যায় না ।ঘুরে ফিরে রিক্তার কথা মনে পড়ে । মনটা যেন দিন দিন হাঁড়িজেদি হয়ে উঠছে ।
ইচ্ছা করে রিক্তা ও খালার সাথে কথা বলতে । টাকা চাওয়াটা বিষধর সাপের বিষাক্ত ছোবলের মত তাকে দংশন করতে ধাকে । একবার ভাবে ক্ষমা চেয়ে নিবে কিন্তু আরেকবার ভাবে টাকার তো দরকার ?
আসরাফের টাকা চাওয়ার ব্যাপারটা তার নিজ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ল । এ নিয়ে দকান পাটে বেশ ইয়ার্কি ফাজলামিও চলে । চায়ে চুমুক দিতে দিতে মালেক আসরাফকে বলল- দশ লক্ষ টাকা দামের লোক কি এসব দোকানে চা খায় নাকি?
লজ্জায় আসরাফ লাল হয়ে গেল । তার কন্ঠদিয়ে কথা বেরুলনা । নিরবে চা খেয়ে বাড়ি এল ।
শেফালীও এবার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে আসরাফকে সে পাঁচ লক্ষ টাকা দিবে । গরুগুলো বিক্রি করবে আর একটা জমি বিক্রি করবে । এই নিয়ে হোসনেয়ারার সাথে কথাও হয়েছে । হোসনেয়ারা জমিটা নিবে ।
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আসরাফের এক মাস কেটে গেল । গ্রাম্য জীবন যেন তার বিষময় হয়ে উঠল ওর মনে হচ্ছে টাকা চাওয়ার ব্যাপারটা এখানে সবাই জেনে ফেলেছে । কেননা যে কোন কথায় তো গ্রামে মহামারি রুপে ছড়িয়ে পড়ে । এটা যে পড়ে নি এমন কোনো কথা হলো ?
সে আবার মেসে ফিরে আসতে চাইল । ভাইকে বলল – ভাই কিছু টাকা দাও আমি মেসে যাব । ভাই বলল – টাকা কোথায় পাবি এ লক ডাউনে ব্যাবসা বানিজ্য কিছুই চলে না তো , তুই রিক্তা কে বিয়ে কর , খালাকে বল তোর মেস খরচটা চালাক ।
আসরাফ বলল - আমি বলতে পারব না তুমি বলিও ।
ভাই বলল- ফোনটা দে আমি বলছি।
ভাই ফোনটা নিয়ে খালাকে ফোন দিল । খালা এক কথায় রাজি হলো ।
এক সময় দিন তারিখ ধার্য্য করে বিয়ের কাজ সমাপ্ত শেষ হলো ।বাসর ঘরে আসরাফ রিক্তার হাত হাতে নিয়ে বলল-এ লক ডাউনের কারণে আমি তোমার জন্য কিছু আনতে পারিনি । লক ডাউন খুললে প্রাইভেট পড়িয়ে তোমাকে আমি শাড়ি কিনে দিব আর চাকুড়ি হলে তো দিবই।রিক্তা চোখে চোখ রেখে মুচকি হেসে বলল ঠিক আছে ।

চার
বিকেলের পড়ন্ত বেলায় হোসনেআরা একা একা ঘরে বসে ভাবছিল। সে ভাবছে কখন এই করোনা ভাইরাসের প্রতিকার প্রতিরোধ আবিস্কার হবে । আর ভালোলাগেনা এমন বন্দিজীবণ ।ছেলেমেয়েরা কেমন নিরাশ হয়ে পড়েছে ?পৃথিবীটা কেমন স্থবির হয়ে পড়েছে ।
এমন সময় সেখানে এল শেফালি ।সে সামনের খালি চেয়েরখানায় বসে পড়ল। সে হোসনেআরাকে বলল- জমির টাকাটা নিতাম , জামাই এসেছে দিব ।
হোসনেআরা বাক্সখুলে টাকা বের করে গুনে গুনে শেফালির হাতে দিল। টাকা দিতে দিতে বলল- সব টাকা জামাইদের হাতে দিওনা , হাজার হলেও পরের বেটা ।দুনিয়াতে কে কার ?পরে আবার চোখের পানি সঙ্গি হবে ।
শেফালি বলল –নাহ! আমার ছোট মেয়ের জামাই খুব ভালো ?ও আমাকে দেখবে ?লক ডাউনের সময় তাই, না হলে আমার বোনবেটার এত দিন চাকরি হয়ে যেত ।
হোসনেআরা কিছু বলল না ।মনেমনে বলল চাকুরি কি এত সহজ কথা ! এত সহজ হলে তো আমার ছেলেমেয়ের এত দিন চাকুরি হয়ে যেত । আমার ছেলেমেয়েরা তো আরো ভালোছাত্র ।
হোসনেআরা শেফালিকে বলল-তোমার জামাই কি পাশ ?
শেফালি –লেখাপড়া শেষ , এম এ পাশ।
সন্ধ্যায় হোসনেয়ারা আসরাফকে ডেকে এনে খাওয়াল গল্পগুজব করল । শেষে বলল ভাই! তোমার প্রতি আমার একটায় প্রত্যাশা রইল যে তুমি যখন যেটা চাকুরির দরখাস্ত করবে আমার ছেলেমেয়েদের একটু জানাইও ।গ্রামে থাকি তো জানতেওপারিনা কখন কিসের সার্কুলার ছাড়ে ।
আসরাফ বলল - আচ্ছা ঠিক আছে জানাব ।
আসরাফ সালাম জানিয়ে বিদায় নিল।

পাঁচ
কয়েকদিন পরে শেফালি এসে হোসনেআরাকে আবার বলল –তুমি আরো একটা জমি নাও ।আমার আরো টাকার দরকার ।
হোসনেআরা বলল – তোমার আবার কি হলো , এখন থেকেই সব জমিজমা বিক্রি করবা , পরে খাইবা কি ?
শেফালি বলল - কি করব , আমার ভাগে আল্লাহ আছেন ।সে কেঁদে ফেলল। চোখের পানি মুছে বলল-ছোট জামাইকে টাকা দেওয়া দেখে বড় জামাই আর আমার বেটিকে বাড়িতে রাখেনা ।মারছে ধরছে বলছে তোর মা ওকে টাকা দিল তুইও আন ।
আমার আশায় দেনা করে রেখেছিল , দেনা শোধ করবে । শুদের ওপর টাকা নিয়েছে এখন অনেক টাকা ঋণ হয়েছে ।
হোসনেআরা –সুদে টাকা তুলে কি করেছে ?
শেফালি –কিযে করেছে তা ওই জানে আর ওর আল্লাহ জানে ।
শেফালির হাতের ফোনটা বেজে উঠল । ফোন করেছে বড় জামাই । বড় জামাই বলল- হ্যালো আম্মা টাকা পাইলেন ?
শেফালি – না , কেবল তো আইনু , দেখি কি বলে ?
জামাই – একটু তাড়াতাড়ি দেখেন টাকার খুব দরকার ।
সেফালি কলটা কেটে দিয়ে হোসনেয়ারাকে বলল- দেখ তো, মনটা কি কয় ? একটু তো দেরি সয় না ।এখন যদি আমি টাকা না দেই ! মনটা কইছে বেটিকে ঘুরিয়ে নিই ।যার স্বামি মরে সেই কি করে খায় না ? আমার বেটিও করে খাবে ।
এবারে রেহানা ফোন দিল , বলল – মা জানিস ! তোর জামাইয়ের পাঁচটা হালখাতার চিঠি পেয়েছি । আজই আছে তিনটা হালখাতা । তিনটাতে বিশ হাজার টাকা । পানের দোকান থেকেই এসেছে দু হাজার টাকার ।
শেফালি – কি করব রে বাছা, কত মিছাকথা , ও তো বলল টাকা নিয়ে ব্যাংকের লোন রিকভারি করবে । কদিন পরে আবার টাকা তুলে আমাকে দিবে । আমি তো তোর হোসনেআরা ভাবির কাছে এসেছি টাকা নিতে । কি করব , টাকা নিব , না নিব না ।
রেহানা – না হলে আমাকে মারবে যে , আর কত মার খাব ।
শেফালি বলল –আচ্ছা রাখ ।
রেহানা – তোকে যে এ কথা বললাম ওকে বলিস না যেনে । না হলে আমাকে মারবে ।
শেফালি – আচ্ছা ঠিক আছে রাখ ।
শেফালি হোসনেয়ারাকে বলল- মেয়ের সিজার করাতে হাসপাতালে গেনু তো , কেমন যে ওই জামাই দশটা টাকার একটা বিস্কুট খাওয়ায় ? আসার সময় বলছে পকেটে টাকা ছিল হারিয়ে গেছে । না পারে ভাইকে ফোন দিয়ে ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা ধার করে নিয়ে তারপর হাসপাতাল থেকে ছুটি হয়ে আসি।
হোসনেয়ার –ভাইকে টাকা দিয়েছ?
শেফালি – দিয়েছি । পরে ধান বিক্রি করে টাকা দিয়েছি । আমার ভাতিজা, আমি জীবণে বলিনি যে আমার মোবাইলে টাকা দিয়ে দিস তো আর ওই বলবে । মন্টুরে , বিশটা টাকা এই নম্বারে দিস তো , কাজলরে দিস তো । ওদের কি হাত্তি বান্ধা আছে? গরীব মানুষ খেটেখুটে খায় ।
হোসনেয়ারা বলল- জমির দরদাম না হতে কেমন করে তোমাকে হঠাতকরে টাকা দিব ?
শেফালি – দরদাম পরে করিও তো আজ আমাকে বিশ হাজারটা টাকা দাও , জামাইয়ের দেনা টা আগে মিটাই ।
হোসনেয়ারা টাকা দিল । শেফালি তা গুনে নিতে নিতে বলল- এবারকার টা দিয়ে দেখি । এবার যদি ভালোনা হয় তো কোটে কেস করে দিব ।
একটু পরে আবারও ফোন – আম্মা টাকা পাইয়াছেন ?
শেফালি – পাইয়াছি ,আইসা নিয়ে যাও ।
জামাই – আসছি । বিকালে এসে সে বিশ হাজার টাকা নিয়ে গেল । সাইকেলে উঠতে উঠতে বলল-চিন্তা করেন না আম্মা , টাকা আপনাকে দিয়ে দিব ।
সন্ধ্যায় ছোট জামাই আসরাফ ফোন দিল । বলল –খালা ভালো আছেন ?
শেফালি – আছি, তুমি ভালো আছ ?
আসরাফ- জি ভালো , রিক্তা যে মন খারাপ করেছে । দশ হাজারটা টাকা দেন ওকে একটা স্কিনটাস মোবাইল কিনে দিই । তাহলে ওর মনটা ভালো থাকবে ।
শেফালি বলল – আচ্ছা কাল দিয়ে পাঠাব ।
পরের দিনে হোসনেয়ারার কাছে আরো দশ হাজার টাকা নিয়ে বিকাশ করে পাঠাল ।
আসরাফ টাকা পেয়ে স্কিনটাস মোবাইল আর রিক্তা ও ওর মায়ের জামাজুতা , মিষ্টি নিয়ে এল ।
শেফালি খুব খুশি । অনেকের কাছে বলল – এমনি কি বিয়া দিয়াছি , খাইবা পিনবার লাগিই তো ?
আসরাফ বলল- খালা , কখন কত টাকা দিচ্ছ হিসাব করে রাখিও চাকুরি পেলে সব তোমাকে দিয়ে দিব ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী শ্বেত নির্মল ও স্বচ্ছ কলমের ছোঁয়া পারে সমাজ বদলে দিতে ।

১২ ডিসেম্বর - ২০১৯ গল্প/কবিতা: ১০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪