কালাম কাশতে কাশতে দোকানীকে বলল, ভাই এক প্যাকেট গোল্ডলিফ সিগারেট দাও।
-এই নেন। আগুন লাগবো স্যার?
-উহুম, লাইটার আছে।
সিগারেট ধরিয়ে কালাম; রিপনকে নিয়ে ওভারব্রীজের উপরে চলে গেল। বাংলা বাজার, সদরঘাট, পাটুয়াটুলির চার রাস্তার মোড়ের এই ওভারব্রীজ সাধারনত কেউ ব্যবহার করে না। শুধু কিছু টোকাই আর ভিটামাটি-হীন দুএকটি লোক থাকে। নিচে প্রচন্ড কোলাহল আর জনগণের ভিড় থাকলেও উপরে বেশ নিরিবিলি। নিচের দিকে তাকিয়ে কালাম দেখল, হরেক রকম গাড়িতে হরেক রকম বাতি জ্বলছে আর রাস্তায় জ্বলছে সোডিয়াম লাইটের আলো। কালাম স্বগতোক্তি করে বলল, মানুষ কত চঞ্চল! সবাই সারি ধরে ধরে নিজ প্রয়োজন মিটাতে চলেছে, যেমন পিপড়াগুলো বেরিয়ে পড়ে নিজ প্রয়োজনে। আমরা মানুষের ভিড়ে বাস করলে, মানুষকে তেমন বুঝতে পারি না। কিন্তু যখন আমরা উপর থেকে দেখি তখন ভিন্ন রকম মনে হয় মানুষকে। আমরা কেউ কাউকে বুঝতে পারি না, যেমন পিপড়াকে বুঝতে পারি না! শুধু জানি সবাই নিজের প্রয়োজনে ছুটছে।
-বন্ধু তুই এত দার্শনিক টাইপসের কথা কই পাস? বলল রিপন।
-কালাম বলল, প্রতিটা মানুষই একেকটা দার্শনিক। কিস্তু যারা জীবনের গভীরে ডুব দিয়ে জীবনকে দেখেছে, তারা ছোট-খাট হলেও শক্তিশালী দার্শনিক। আর নিঃসন্দেহে আমি জীবনকে অনেকখানি গভীর হতে দেখেছি।
জানো বন্ধু, জীবন খুব সুন্দর কিন্তু কিছু কিছু মানুষ একে নরক বানিয়ে রেখেছে। তুমি জানো যে, আমার বাবা মা কেউ নেই। আর মা বাবা কে তাও জানিও না। সোজা কথায় তোমরা যাকে "টোকাই" বলে থাকো আমি তাই।
আমি যখন এই অঞ্চলে থাকতাম, এক মহৎ প্রাণ আমাদের লেখা পড়া শেখানোর জন্য আসত। স্থানীয় এক নেতা আমাদের এ লেখা পড়া করতে দেয়নি। বিভিন্ন সময়ে ঐ নেতা আমাদের দিয়ে নানা আজে-বাজে কাজ করিয়ে নিত। সে এক দিন বলল, তোদের লেখা-পড়া শিখিয়ে উল্টাপাল্টা কাজ করাবে, তোরা ওর কাছে আর পড়বি না। তোরা এ ফালতু লেখাপড়া করিস না, আমার কাজকাম করবি আর খাওয়া দাওয়া করবি; মজ-মাস্তিতে দিন কাটাবি, এর থেকে ভাল জীবন আর কি! একদিন জানতে পারলাম, মেয়েলি কেইসে ফেলে ঐ টিচারকে তাড়িয়ে দিয়েছে। এখন বুঝি, লেখাপড়া শিখলে আমাদের দিয়ে কি উল্টাপাল্টা কাজ করাতো! আর নেতার কি ক্ষতিই বা হত! সে এখন এলাকার হাজী সাহেব! সম্মানিত ব্যক্তি তিনি। তার অসুন্দর মনের জন্য কত সুন্দর ফুলের ঘ্রাণ অকালে কাঁদায় মিশেছে কে জানে(!) কথাগুলো বলে কালাম যেন হাঁফিয়ে উঠল। আবার সিগারেটে একটা টান দিয়ে কাশতে লাগল। কাশতে কাশতে একগাল কফ পাশেই ফেললো কালাম। রিপন বলল, ধুর করলি কি দুরে-টুরে ফেল। রিপন দেখল কফের মধ্যে রক্তের মত কি যেন। সে বলল,
-বন্ধু কফে রক্ত কেন?
-না-না, পান খেয়েছিলাম ওর রঙ হয়ত।
-ওহ, আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম।
-রিপন আবার বলল, বন্ধু পান নিয়ে ঐ গানটা মনে আছে?
-বন্ধু আমার পানের দোকানদার... এই গান (?)
-হুম। সেদিনটা অনেক মজার ছিল তাই নারে?
-হুম।
রিপন বলল, বন্ধু দীর্ঘদিন হতে বন্ধুত্বের সুত্র ধরে তোকে আমি চিনি। তোকে যত দেখি ততই বুঝতে অসুবিধায় পড়ি আমি! কখনও মনে হয় তুই খুব সুখি আবার কখনও মনে হয় তোর মত দুঃখি বুঝি দুনিয়াই নাই! বুঝলামই না তোকে বন্ধু। কালাম বলল, আরে একটু আগে বললাম না যে, কেউ কাউকে চিনতে পারে না; বুঝতে পারে না। কেউ কারোর দুঃখের সংবাদ শোনার পর যখন বলে, তোমার দুঃখে আমি দুঃখিত! আসলে এটাই সর্বোচ্চ পর্যায়। এর বাইরে কোন অস্ত্র নাই যা দিয়ে মানুষ দুঃখ ভাগ করে নিতে পারে! কিন্তু যার দুঃখ তার থেকেই যায়। বেচারা শ্রোতা কতটুকু দুঃখিত হয়, সে সেটা নিজেই জানে।
রিপন বলল, হুম বুঝলাম সব কিছু। এবার তোমার কথাগুলো বল শুনি, আমার যে অস্ত্র আছে তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করব। কালাম কথাটা শুনে মুচকি হাসল। সে সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে কাশতে কাশতে বলল, অন্যদিন শুনিস। কালাম সিগারেটটার বাকি অংশ নিচে ফেলে পায়ে পিষ্ট করে বলল, আমরাও এমন; নিজের ব্যবহার শেষে একে অন্যকে পিষ্ট করি!
হঠাৎ একদিন কালাম একটা হুডি পরে রিপন কে বলল চল গল্প করি। রিপনের কাজ থাকা স্বত্বেও বন্ধুকে বেশ হাসিখুশী দেখে কাজ ফেলে রেখে চলে এল। দুজনে আজকেও ঐ নিরিবিলি ওভারব্রীজে গিয়ে বসল। সিগারেটটা হাতে জ্বলছে; শূন্যে চেয়ে থেকে কালাম শুষ্ক একটা হাসি দিয়ে বলল, এবার বেশ শীত পড়েছে না-রে? উত্তরের অপেক্ষা না করেই কালাম সিগারেটে বড় একটা টান দিয়ে বলল, ভাবলাম তোকে আমার কিছু কথা বলি। জীবনে আর কত দিন বাঁচব জানি না, একটু হলেও আমার গল্প দুনিয়া জানুক। আর তুই তো ইচ্ছাকৃত আমার গল্প শুনবি বলে বলেছিলি। তাহলে শোন, তুই তো আমার জন্মের ব্যাপারে জানিস। আমার বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে দেখছি আমার চারধারে আপন বলে কেউ নেই। কিন্তু প্রতিটা বছরের শীত আমার জন্য একেকটা বেঁচে থাকার সুত্র বয়ে আনে। এমন কোন শীত কাল যায়নি যাতে আমি ঐ সুত্র পায়নি।
ঘটনাগুলি প্রথম থেকেই বলি শোন, ছোট বেলায় আমাকে সবাই কালু বলে ডাকত। আমি যেমন নিকষ কালো তাতে কালু ছাড়া (তারপরও বাস্তুহীন) এই মানুষকে আর কি বলেই বা ডাকা যায়? ভাগ্যের ফেরে টাকা পয়সাওয়ালা হলে না কালাম সাহেব হলাম! মানুষ কি আজব। যার টাকা আছে তার সম্মান আছে, যার নাই তো তার কিছুই নাই! একদিন দেখি, স্থানীয় নেতার মেয়ে কলেজে ভর্তি হল বিনে পয়সায়, আর গার্মেন্টস শ্রমিকের মেয়েকে এক পয়সা ছাড়েও ভর্তি করা গেল না। এই দেখে হাসব না কাঁদব তখন বুঝে উঠতে পারিনি আমি।
-তোর গল্প শোনার জন্য আসছি বন্ধু।
-বলছি তো!
-কলেজে কে ভর্তি হল না হল এটাও তোর গল্প?
-আমার খারাপ অভ্যাস এটা তুই জানিস। এক কথা বলতে বলতে অন্য কথায় চলে যায়। এবার থেকে না করতে চেষ্টা করব দেখি।
নে, এবারকার শীতের বিভৎস সুত্রই আগে দ্যাখ। এই কথা বলে কালাম পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে রিপনকে দিল। রিপন কাগজে চোখ বুলিয়ে নিয়ে মাথায় হাত রেখেই বলল, আগে কেন বললি না বন্ধু?
কালাম কোন উত্তর না দিয়ে বলল, আমার জীবন হল, হেমন্তের ঐ সবুজ পাতার মত যে গাছ থেকে পড়ে, পথে পথে হাওয়ায় উড়ে চলে। আর শেষটা কোন চুলায় বা নর্দমায় পড়ে জ্বলে বা পঁচে শেষ হয়।
শোন আমার শীতের আরেকটি বিভৎস রূপ, ছোট বেলায় সদরঘাট এলাকায় থাকাকালীন কেরানীগঞ্জের মীরের বাগ হতে একটা মেয়ে আসত, মায়ের সাথে ভিক্ষা করত সে। সারা মুখে ময়লা কাদা কাপড়চোপড় ময়লা কিন্তু চোখ দুটো বেশ উজ্জ্বল! আমার দেখে বেশ মায়া লাগত। বেশ খানিকটা বড় হলে আমার আর রূপার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। ও হ্যাঁ, ঐ মেয়েটিন নাম রূপা ছিল। আমরা একে অপরকে দেখার জন্য বেশ পাগল ছিলাম। অনেক মধুর ঘটনাও আছে আমাদের। থাক সে সব কথা। আমাদের প্রেম কি আর সমাজের কাছে প্রেম-রে! বড়লোকদের জন্য প্রেম আর আমাদের জন্য নষ্টামি, ওঁদের জন্য ভালবাসা আমাদের জন্য পরিহাস আর ওঁদের জন্য মজ-মাস্তি আমাদের জন্য খারাপ পাড়ায় খারাপ কাজ করা।
রিপন শোন, মাঝে মাঝে ভাবি শীত কালটি আমার জন্য একটা অভিশাপ! আমার জীবনের সব দুর্ঘটনা যাকে আমার বেচে থাকার সুত্র বলছি তা এই শীতেই ঘটে। আবার আধুনিক মানুষ হিসেবে ভাবতেই পারি না এমনটি। কিন্তু আমার জীবনে কাকতালীয়ভাবে এই শীতেই এমন সব দুর্ঘটনা ঘটে যে, সেই জন্য শীত কালকে আমার জন্য অভিশপ্ত না বলেও পারি না। জীবনের সব সমস্যার সমাধান হয়ত করা যায় না-রে!
আবার অন্য লাইনে চলে যাচ্ছি, সরি। পুরান অভ্যাস বলে কথা। যাইহোক, এই কালো শীতে এক সন্ধ্যায় আমাদের দেখা করার কথা ছিল। রূপাকে ভিক্টোরিয়া পার্কে আসার জন্য বলেছিলাম সন্ধ্যার পর। অপেক্ষা করতে করতে রাত ৮ টা বেজে গেল কিন্তু এল না। তাই আমি উঠলাম আর ভাবলাম দেখে আসি কি হল। অনেক খোঁজাখুঁজি করলাম পেলাম না। সেই রাত কিভাবে যে কেঁটেছিল জানি না। কিছু দিন পর জানতে পেরেছিলাম যে, ও একটা বাড়িতে কাজ করত। সেখানে গেছিলো বেতন আনতে (সম্ভবত আমার জন্য কিছু গিফ্ট কিনবে সেই জন্য) কিন্তু সেদিন ওর জন্য দুর্ভাগ্য ছিল। মালিকের ফ্রেইন্ডরা মদ্যপানরত ছিল, বাসার অনান্যরা সেদিন গেছিল আত্মীয়ের বাসায়। আগে পরের ঘটনাগুলো অনেকটা সিনেমাটিক আরকি! ওর মা মারা গেছিল আগেই। আমি জানতে পারলেও কিছু করতে পারিনি। আমি নিজেই নিরীহ টোকাই, কি করতাম আমি (?) সমাজে কাগজের সম্মান বেশি বলে; পার পেয়ে গেল কিছু কুকুরের পাল। আর ওপারে চলে গেল এক নিষ্পাপ মাংশখন্ড! যেখানে কাগজের মূল্য বেশি সেখানে মাংশের মূল্য কম হওয়াই স্বাভাবিক। রিপন দেখল, কালাম একেবারেই শান্ত! রিপন মনে মনে বলল, একেই হয়ত বলে, অধিক শোকে পাথর।
কালাম বলল, এই ধাক্কা সামলাতে বেশ কষ্ট হয় আমার। তাই সহযোগী হিসেবে সিগারেট আর গাঁজা ধরেছিলাম। আর তখন থেকে একটা সংকল্প করেছিলাম টাকা পয়সার মালিক হব আর দেখব এর মধ্যে কি আছে। ইনকাম করলাম, দেখলাম কিছু পেলাম না এর মধ্যে। কিন্তু ঐ সিগারেট আর গাঁজা আমাকে দিয়েছে এই শীতের সুখবর! এই শীতের সুখবরের নিমন্ত্রণ পত্র তোর হাতের ঐ কার্ড!
-রিপন আস্তে আস্তে বলল, লাঞ্জ ক্যানসার (ফুসফুসের ক্যান্সার)।
- এই শীত বলল, নে তোকে এবারকার উপহার দিলাম। সামলে দেখা নিজেকে এবার।
-তাহলে সেদিনের ওটা পানের রঙ ছিল না?
-না রক্তই ছিল।
-বলিসনি ক্যান আগে কোনদিন?
-কোনটা বলব? আমার জীবন পুরোটাই শীত ট্রাজেডিতে ভরা।
-ডাঃ কি বলল?
-প্রথমে ধরা পড়লে বাঁচার সম্ভাবনা থাকে কিন্তু আমার নাকি বেশ দেরি হয়ে গেছে।
-আগে চেক করাসনি কেন?
-বন্ধু, প্রতি বছর এই রোগে ১৩ লক্ষ মানুষ মারা যায়। আমি গেলে কারো কিচ্ছু হবে না। সব ঠিকঠাকই থাকবে; থাকবে সব সাজানো গোছানো!
কালাম রিপনের দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে বলল, অামি আজ আর পাচ্ছি না। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে বেশ, অন্যদিন বাকি ট্রাজেডিগুলো শুনিস।
রিপন চুপ করে বসে রইল। কালাম চলে গেল তার সামনে দিয়ে। একবারও রিপন বলতে পারল না আরেকটু বোস, অনেক সময় আছে। বলতে পারল না, চল সিগারেট টানতে টানতে আরেকটা গল্প করি...
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
বিশেষ কারনে একই সময়ে বার বার, কাউকে কেন্দ্র করে দুর্ঘটনা ঘটলে তাকে দোষনীয় ভাবা হয়। এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রের জীবনে শীত কাল এক অভিশাপের মত, শীতেই তার জীবনের দুর্ঘটনাসমুহ প্রকাশিত হয়
০৪ নভেম্বর - ২০১৯
গল্প/কবিতা:
৭ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪