"ভালবাসা"-র জন্য ভালবাসা খুঁজতে বারইচিলাম ; কিন্তু দেখি সব ভালবাসা আকাশের দিকে -'তোমার জন্য আলো হবো, বাতাস হবো শিহরণে/ভেজা বর্ষার বান হবো ছায়ার আবরণে।' এমন ভালবাসার বচন ঊধর্বপানে সুরৰিতভাবে আটকানো। হায় ভালবাসা ! তুমি কি আমাদের ধূলির ধরাধামে নেমে আসবে না ? এক সময় আমি একজনকে ভালবাসতাম - তার নাম দিয়েছিলাম আকাশ, আর আমার নাম ছিল মাটি। কারণ ওকে দেখতে পেতাম দোতলার ব্যালকনিতে নয়তো ছাদে, আর আমি হাটতাম রাসত্দায় - থাকার আবাস একটা ছিল ; কিন্তু সে ছিল একচালা টিনের, যার কোনো ছাদ ছিল না। সে কখনো মাটির দিকে ফিরে তাকাত না বরং তার চোখ (আমার দেখা সকল মানবীর চোখের চেয়ে সুন্দর-ঐ চোখ জোড়াই তার প্রতি আমার আকর্ষণ বাড়িয়েছিল) জোড়া দেখতাম আরো উঁচু আকাশের দিকে, নয়তো অন্য বিল্ডিংয়ের ব্যালকনিতে। সুতরাং আমাদের কখনো দেখা সাৎ হয়নি।
আকাশের দিকে ভালবাসা লটকানো দেখে তাই আমার ভয় হয় আহা ! তাহলে কি ভালবাসার দেখা পাব না ? "ভালবাসা"র জন্য ভালবাসা তাহলে আমি কেমন করে দেব ?
আমি নিজেই তবে আকাশের দিকে উঠি না কেন, দেখি ভালবাসার খোঁজ পাওয়া যায় কি না। নগরীর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বিখ্যাত নদী, নাকি নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে নগরী ? এক সময় আমাদের কবিরা নদী-নারী নিয়ে অনেক কাব্য চর্চা কেরছেন কিন্তু এ যুগের কবিরা বুঝি আরেকটা আদ্যানুপ্রাস ব্যবহার করে লিখবেন- নদী-নারী-নগরী। নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে নগরী,আর নগরীতে উঠে এসেছে সব সুন্দরী রমণী _ যাদেরকে আমরা আমাদের হৃদয় মন সব দিয়ে বসি।(শুধূ কি নরেরা দেয় ? নারীরাও দেয় ঐ নগরী নর দেখে।) সুতরাং ভালবাসা-বাসি সেখানে কিছু হতে পারে মনে করে আমি সে নগরীর পাশে যে নদী বয়ে গেছে, তার ঊধর্ব দিকে উঠবার চেষ্টা করি। নদীটার ওপর ব্রীজ করা ছিল নগরীর মানুষের কাছে স্বপ্নের মতো। যার জন্যে হয়েছে অনেক আলোড়ন আন্দোলন - হয়তোবা রক্তপাতও। স্বপ্নের সেতু হয়ে যাওয়ার পর তাকে দেখতে এসেছ অনেকে - আমার বৃদ্ধ বাবাও বাদ যান নি; জীবনে বেঁচে থাকতে তিনিও দেখে গেছেন সেতুটি। সেতুটি কখনো ঘটা করে আমাকে দেখতে যেতে হয়নি কারণ ওর ওপর দিয়ে বাসে চড়ে প্রতি সপ্তাহে গতায়ত করতে হয়। কখনো এ ব্রীজের সর্বোচ্চ শিখরে বাসের মধ্যে বসে আমাকে ভালবাসা খুঁজতে হবে তা আমি ভাবিনি। যাই হোক তখন বিকাল ছিল, নগরীর সব ভবনগুলো প্রায় দেখা যায় নদীর ঐ শিখরদেশ থেকে। দেখলাম আমি সেই সে বিকেল বেলা -নগরীর কত কত কৰে ভালবাসার বৃষ্টি ঝরছে - পুরম্নষদের নাভির নিচের থলি থেকে নারীদের গর্ভে গর্ভে ছড়িয়ে যাচ্ছে ভালবাসা - এই মুহূর্তে যখন আমি ভাবছি - তখনই গড়িয়ে যাচ্ছে কত কত ভালবাসা !
কিছু বাদে বাসটা ঘুরে নগরীতে প্রবেশ করলে আমাকে নামতে হয়। ভালবাসার জন্য আমাকে এখন বাজারে ঢুকতে হবে - কিনতে হবে মাছ তরি-তরকারি। আমাদের নাভির নিচে যে ভালবাসার জম্ম হয় তা দেখি সব শ্রেণীবদ্ব হয়ে আছে এই বাজারের মধ্যে। একপাশে লাল কাটা মাংস ঝুলানো, অন্য পাশে কুক্কুটের কক কক। দাম শুনে আমার ভালবাসা সেই রক্ত- পাখনার মধ্যে চিৎপটাং ; আমি বরং ঢুকি মাছের ভেতর। বাঙালী যে এতো ভালবাসা প্রিয় তার পেছনে আছে নাকি এই মৎসকুল। ছোট বেলায় আমার এক বন্ধু ছিল_ ওরা খুব মাছ শিকার করতো। যখন মাছের মৌসুম ছিল না, তখনও ওর বাপ খেও জাল নিয়ে কোথা থেকে মাছ ধরে এনে হাজির। তার এক কথা - মাছ ছাড়া কি ছেলে-মেয়ের ভাত মুখে ওঠে ? আশ্বিন-কার্তিক মাসে যখন বিলের ধানৰেতগুলো মানুষের মাথার ওপর ছাড়িয়ে, তখন ছিল আমাদের এলাকার মাছের পুরো বতর(মৌসুম)। সে সময় ওদের বাড়িতে মাছের পাহাড় জমতো- কৈ, শোল, টাকি, মাগুরে ওদের কোলা(মাছ জিয়ানোর মাটির বড় পাত্র)গুলো গম গম করতো। সকালে গরম ভাতের সাথে মাছের ঝোল। আর পেস্নটে ভাতের চেয়ে কৈ মাছ বেশি সাজানো থাকতো। আমরা একসাথে হলে গল্পে রত হতাম যে, কে ক'টা কৈ মাছ আজ সকালে খেয়েছে তা নিয়ে কিন্তু ওর ওপরে আমরা কেউ সে গণনায় উঠতে পারতাম না। তখন মনে হয় আমরা দশম শ্রেণীর টেস্ট পরীৰা দিয়েছি। শুনি কি ওদের বাড়ির পাশে দুঃসম্পর্কের চাচাত বোনের পেটে বাচ্চা। অনেক ঘোর-প্যাচ পেরিয়ে এক সময় জানা গেল ও ই নাকি তার জনক। আমরা অন্য বন্ধুরা মিলে বৈঠকখানায় জড়ো হলাম এবং আমাদের সে বন্ধুর কোনো দোষ পেলাম না, দোষ যা হলো তা সব ঐ বেশি বেশি মাছ খাওয়ার। সেই মাছের বাজারে ঢুকবো তখন দেখি এক বিক্রেতা মাথায় চুপড়ি নিয়ে সহাস্য বদনে ডাক দিয়ে যাচ্ছে - 'আসেন স্যার আসেন, গোপালগঞ্জ থেকে দেশী কৈ আনছি!' 'দাম কত ?' 'একদম হসত্দা ... মাত্র ছয়শ।' 'দেখি, চুপড়ি খোল তো ? 'এ কি ! এতো আমাদের সে ছোট বেলার আশ্বিন-কার্তিকে ধরতামও না, বলতাম, এটা সামনের বছর খাবো। আর এ তার দাম হাঁকছে ছয়শ তাও বলে কি না হসত্দা ! হায়রে কৈ ! ভালবাসা বুঝি সব তোর শরীরের ভেতর ? অন্য মাছের তালাসে গিয়ে দেখি, কত বড় বড় সব মাছে সাজিয়ে দোকানীরা। বিজলী বাতির আলোয় তাদের চেহারায় ঝরছে লাবণ্যতা। যে লাবণ্যতা শহরের তরম্নণীদের শরীরে ঝিলিক মারে তা দেখি এই মাছের রম্নপালী আঁশের ওপর। সাদা বরফের ওপর শুয়ে চকচকা রম্নপালী ইলিশ ছুঁয়ে দেখারও সাহস হয় না -যেমন হতো না প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্বেও দুধে আলতাবরণ নগরী নারী ত্বককে। যেন দোকানী তেড়ে উঠবে -নাকি নিতে বলবে, আর এমনভাবে বলবে হয়তো সপ্তাহের পুরো মাছের টাকা শেষ এক ইলিশের শরীর ছুঁতে গিয়ে। আমি বরং সেখান থেকে দ্রম্নত পালাই। চিনত্দা করলাম, বাজারের এই সব বড় বড় মাছ - যা কিনা আমরা ছুঁয়েও দেখার সাহস পাই না তা সব তো প্রতিদিন বিক্রিই হয়ে যায় ? না হলে দোকানীদের এমন নাদুস-নুদুস চেহারা কেন ? হ্যা, বিক্রিই হয়ে যায় প্রতিদিন। এবং যারা কিনতে পারে তারাই হয়ত শ্রেষ্ট প্রেমিক এ জামানার। যাই হোক সবুজ সাক-সবজি - লেবু-গাজর-শশার গল্প না করে আমি বরং রাতের খাবারের জন্য কিছু কিনে বাজার থেকে দ্রম্নত বেরিয়ে পড়ি।
রাসত্দায় এসে রিকসায় চড়বো, দেখি, ভালবাসা মটর সাইকেলের পাছে দৌড়ে চলছে। এক তরম্নণ সিটে বসে ভোঁ ভোঁ আর তার পেছনে দুই তরম্নণী। এই শীতের দিন সন্ধ্যা নেমে এসেছে প্রায় - তরম্নণী দুজন খালি গায় প্রায়। টি শার্ট জিনস জোড়া বাহু তাদের বেরোনো_ শীতের দিনে মটর সাইকেলে অমন দৃষ্টি নন্দন বাহু যুগল জড়ানো দেখে সেদিকে দৃষ্টি পড়ে যায়। হ্যা, তাদের শীতের পোশাকও আছে বটে কিন্তু সেগুলো তারা গায়ে না চড়িয়ে রেখেছিল হাতে। মোড়টা অতিক্রম করার সময় সে সাইকেল আরোহী ত্রয় আমাকে অতিক্রম করার সময় পাশে দাড়ানো যুবক তাদেরকে উদ্দেশ্য করে কি যেন বলল। ততৰণে তারা আমার সামনে চলে গেছে। আর দেখি সর্ব পেছনে বসা দ্রম্নত চলমান তরম্নণী সহাস্য বদনে পিছনে পড়ে যাওয়া যুবককে উদ্দেশ্য করে হাত উঁচিয়ে সাইন দেখাচ্ছে। যাতে মনে হলো, তরম্নণী তরম্নণের শিশ্ন ধরে চাপ দিচ্ছে। আমার তখন মনে হলো, কিছুৰণ আগে আমি যে নগরীর নদীর শীর্ষ থেকে ভালবাসার বৃষ্টি ঝরতে দেখেছিলাম তার বাসত্দব উদাহরণ বুঝি এরা। তা না হলে এরা এতো গরম কেন যে শীতের দিন সন্ধ্যায় চলমান মটর সাইকেলে অমন উদোম ?
রাতে ১৭ ইঞ্চি পর্দার সামনে বসলে- দেখি, সুন্দরী তরম্নণী বধূ গলা পানিতে শরীর ডুবিয়ে ব্যথার অনুরননে গুণ গুণ করছে.... ওঃ...উঃ...... আমারে ছাড়িয়া বন্ধু কই রইলা .... এরপর সেই তরম্নণী বধূর ভিজে কাপড়ে খালি পা। গলা পানিতে শরীর ডুবিয়ে থাকার মর্মার্থ আছে যে, ভালবাসার গরম সহ্য করতে না পেরে অমন হয়েছে কিন্তু শেষ দৃশ্যে দেখি ভালবাসার অনুভূতি নিয়ে কি অপূর্ব বাণিজ্য। মনে হলো - আকাশের দিকে শক্ত করে লটকানো আর কত ভালবাসা আছে তা আমাকে খুঁজে দেখতে হবে।
একদিন পর ভোর সকালে ছেড়ে যাওয়া বাসে দৌড়ে গিয়ে উঠি- পাশাপাশি তিন সিট খালি তার একটাতে বসে পড়ি।তখনও ভালভাবে কুয়াশা কাটেনি - আকাশের দিকটা ভালভাবে দেখা যায় না ; তবু সেই কুয়াশার মধ্যে ঊধর্্বপানে নজর দিয়ে বসে থাকি আর খুঁজতে থাকি কোথাও ভালবাসা লটকানো আছে কি না। সোজা পূব দিক পানে রাসত্দা শেষ হলে দেখি সেই বচন-' তোমার জন্য আলো হবো,বাতাস হবো শিহরণে/ ভেজা বৃষ্টির বান হবো, ছায়ার আবরণে।' সূর্যের আলো ছড়ালে সে চরাচরে, দূরে শ্যামল গাঁয়ের শীর্ষে চারিদিকে ফিট করা মাইকের মতো - ভালো করে তাকিয়ে দেখি, না সেতো মোবাইল ফোনের(যারা নাকি সব ভালবাসার ফায়দা লুটে নিয়ে যাচ্ছে) বিটিএস - টাওয়ার। গত রাতভর বিশাল গামলার মতো যন্ত্রগুলো থেকে কত ভালবাসা চৌদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে এবং ক্রমাগত দিয়ে চলেছে। ধন্য হে, ঊধর্্বপানে খাড়া ভালবাসা ছড়ানো যন্ত্র - তুমি এসেছ বলে না আমাদের চরাচরে ভালবাসা আছে !
বাসের ভেতরে যাত্রীদের এতৰণে ভাল করে লৰ্য করা হয়নি। বাসটা রাসত্দার পাশে দাড়িয়ে চেরাই কাঠ ছাঁদে তুলছে। আমার দু'পাশের সিট দুটো তখনও খালি। ও পাশের টু সিটের পর পর দুটোতে দেখি- জ্বলজ্বলা ভালবাসা -কল্পনা করতে হয় না। একজোড়া পরিত্যক্ত, অন্য জোড়া টসটসে রসে ভরা। অর্থাৎ কিনা তারা চারজন নারী - জানালা ঘেষে বসা দুজন যুবতী সুন্দরী আর মধ্যের প্যাসেজ পাশ্বর্ে বসা দুজন বার্ধক্যে উপনীত। তারা হয়ত মা, আর ওরা দুজন মেয়ে- কান মাথা আগলা-আর সুন্দরী কানের লতিকা জুড়ে মোবাইল ফোনের এয়ারফোন লাগানো। আহা ! ওদের পাশাপাশি সিটে যদি বসতে পারতাম, তাহলে এই ঠান্ডা সকালে ভালবাসার কিছু উত্তাপ পেতাম ! এমন ভাবতে ভাবতে দেখি -ঐ দুই সুন্দরী রমনীয় কমনীয়তার বিপরীত চেহারা আমার দু'পাশে। পুরম্নষ দু'জন শ্রমজীবী ; কালো ত্বক রোদে পুড়তে পুড়তে কয়লা। মাথা জোড়া মাফলার পেচানো, ময়লা লুঙ্গি, সুইটার। কব্জি থেকে হাতের আঙুলগুলো দেখা যায় কিন্তু সেতো কাঠের চেয়ে শক্ত আর এই ঠান্ডা সকালে বাসের ছাদে কাঠ তোলার জন্য হাতের এক জায়গায় থেতলে গিয়ে বেরম্নচ্ছে রক্ত। অন্যজন কিছুটা রোগাক্রানত্দ, বাসের ছাদে যে কাঠগুলো ওঠানো হয়েছে, সে যেন এখনো আছে তারই কাঁধের ওপর। দু'জন শ্রমজীবী আমার দু'পাশ থেকে ওম দিচ্ছে আর আমার মনে হতে লাগল- এত দিন ৰণ পর বুঝি আমি "ভালবাসা"র জন্য প্রকৃত ভালবাসা খুঁজে পেলাম।
২০ জানুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৬ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪